বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের আর্তনাদ বিড়ম্বনা by এস এম আব্রাহাম লিংকন

মেয়ের পাত্র ঠিক করেছেন বাবা, বংশ ভালো শুনে বেশ খুশি মেয়ের মা। তিনি খুশি হয়ে অন্য দিনের চেয়ে একটু বাড়তি সোহাগে এক খিলি পান এগিয়ে দিয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, তা তোমার হবু জামাই কী করে? স্বামী বেশ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে উত্তর দেন, কেন, আমার মতো বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক,


শুনেই স্ত্রী বেচারীর মন ভারী, তিনি বিলম্ব না করেই উত্তর দেন, তার মানে তোমার হবু জামাইয়ের এখনো চাকরি হয়নি! অর্থাৎ বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কর্মটি তাঁদের বেতন-ভাতার বিবেচনায় কোনো চাকরির পর্যায়ে পড়ে না। এ গল্পটি প্রায় তিন দশক আগে কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের ইংরেজি শিক্ষক শ্রদ্ধেয় মাহফুজার রহমান স্যারের কাছ থেকে শুনেছিলাম। তিন দশক পর গত ২১ মার্চ কুড়িগ্রামে ডিসি অফিসের সামনে বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের মানববন্ধন কর্মসূচির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জেলা বিএনপি নেতা কলেজ শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বেবুর বক্তৃতায় সেই গল্পটি শুনে স্যারের কথা বেশ মনে পড়ছিল। গল্পটিতে পার্থক্য, সেদিন স্যার স্কুলের শিক্ষকদের জন্য বলেছিলেন, আজ ৩০ বছর পর তা কলেজ শিক্ষকদের জন্য শুনছি। তাঁদের একটি কথাও উপেক্ষা করার সামর্থ্য ছিল না। সরকারি স্কুল-কলেজের একজন শিক্ষক যখন শ্রেণীভেদে অন্যান্য সুবিধা বাবদ তাঁর মূল বেতনের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া পান, ৭০০ টাকা চিকিৎসা বাবদ মাসিক ভাতা প্রাপ্ত হন, তখন বেসরকারি স্কুল-কলেজের একজন শিক্ষককে, দেশের শিক্ষামন্ত্রীর ভাষায়, ঢাকা শহরে ফুটপাতে এক রাত ঘুমাতে মাস্তানকে দিতে হয় ১০০ টাকার বেশি; সেখানে একজন উচ্চশিক্ষিত যুবক, যিনি শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় অবতীর্ণ, তাঁর জন্য রাষ্ট্র যখন বাড়ি ভাড়া বাবদ মাসে ১০০ এবং চিকিৎসা বাবদ ১৫০ টাকার বরাদ্দ করে, তা কষ্টকর ও পীড়াদায়ক এবং নাগরিক ভাবনায় লজ্জাকর।
বেসরকারি শিক্ষকদের বেতনাদি প্রদানের বিদ্যমান পদ্ধতিটি অনেকটাই অসৌজন্যমূলক। পদ্ধতির বিচারে মনে হবে, যেন শিক্ষকরা আত্মসাৎকারী, কারো পাওনা অস্বীকার করেছেন। পাওনাদাররা যেন তাদের টাকা সুদাসলে বুঝে নিতে পারে তার জন্যই বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন বিলিব্যবস্থা। নতুবা শিক্ষকরা কবে বেতন পাবেন তা পত্রিকায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানোর আবশ্যকতা কী? মন্ত্রণালয় কি পত্রিকায় প্রচার করে জানান দিচ্ছে যে শিক্ষকদের বেতন হয়েছে? যেসব দোকান থেকে শিক্ষকরা বাকি খেয়েছেন বা যে ব্যক্তির কাছ থেকে কর্জ নিয়েছেন, তিনি যেন সতর্ক হয়ে ধার্য তারিখের মধ্যে তার পাওনা আদায়ের মোক্ষম সুযোগটি গ্রহণ করেন। পত্রিকায় প্রচার না করে যদি রাষ্ট্রের অন্য সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন হয়, তাহলে শুধু বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য এ বিজ্ঞাপনী ব্যবস্থা কেন? বেতন তো প্রত্যেক শিক্ষকের ব্যাংকের হিসাবেই জমা হয়, তাহলে প্রতিমাসে নির্দিষ্ট সময়ে অন্য কর্মচারীরা যেভাবে পান তাঁরাও একই সময়ে পেলে অসুবিধা কী?
রাষ্ট্রের বিবেচনা করা উচিত একজন নাগরিকের সম্মানের প্রতি। যদি অর্থ দিতে না-ও পারে, তবু যেন প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়। বেসরকারি শিক্ষকরা কলেজ পর্যায়ে যদি প্রভাষক পদে যোগ দেন তবে সে পদে থেকেই তাঁকে অবসর নিতে হচ্ছে, যেন তাঁদের কোনো যোগ্যতা নেই। বেসরকারি কলেজে পদোন্নতির সুযোগ অন্যায়ভাবে রুদ্ধ আছে। কারো কারো মতে, তাঁদের প্রমোশন হলে বাড়তি অর্থ গুনতে হবে, তার চেয়ে রুদ্ধ থাকাই শ্রেয়। সরকারি শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে জনবলের আনুপাতিক প্রথা নেই, একজন সরকারি প্রভাষক চাকরিতে প্রবেশের পর বিভাগীয় পরীক্ষা সাপেক্ষে পাঁচ বছরের মাথায় সহকারী অধ্যাপক, সেখান থেকে তিন বছরের মধ্যে সহযোগী, তারপর দুই বছরের মাথায় অধ্যাপক পদে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু বেসরকারি কলেজের একজন প্রভাষক ৩০ বছর অতিক্রম করার পরও প্রভাষকের ওপরে যেতে পারেন না। মনে রাখতে হবে, দেশের উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষাদান কর্মসূচি বেসরকারি শিক্ষকদের দ্বারা ৮০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়। এই বিপুল শক্তিকে প্রাপ্য মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা না দিলে তাঁদের আর্থিক কারণেই পেশাভিত্তিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
কিছুদিন ধরে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বেশ বাদানুবাদ চলছে। দীর্ঘ ১০ বছর পর প্রদত্ত টাইম স্কেল সরকার ও শিক্ষামন্ত্রীর সফলতা। শিক্ষকদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। মাত্র দুই মাস টাইম স্কেলের টাকা দেওয়ার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক রূঢ় ফরমান বলে তা বেআইনি অজুহাতে প্রত্যাহার বা বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত সরকারের সাফল্যে ফাটল ধরানোর জন্য যথেষ্ট। দেশের যে বিপুলসংখ্যক নাগরিক উচ্চশিক্ষা নিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, তাঁরা কিন্তু রাষ্ট্রের সফলতার চাবিকাঠি হতে পারেন। রাজনৈতিক শক্তি যখন বিপুল জনসমর্থিত মহাজোটের বিরুদ্ধে রাজপথে নামার সুযোগ পাচ্ছে না, তখন বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের মাঠে সরকারবিরোধী অবস্থান নিতে অনেক পতিত রাজনৈতিক শক্তির চেষ্টা আছে, সেটি ভাবনায় নিতে হবে। পেশাগত আন্দোলন সরকারবিরোধী না হলেও এর প্রবল প্রতাপ কিন্তু সরকারের সব সাফল্যকে ম্লান করে দেয়। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতাবিরোধীরা নানা রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তারা অপেক্ষায় আছে ক্ষমতাসীনদের ভুল সিদ্ধান্তের।
লেখক : আইনজীবী
Lincoln_bd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.