খোলা চোখে-দুই বুড়োর কাণ্ড: একনায়কত্ব থেকে গণতন্ত্র by হাসান ফেরদৌস
পৃথিবীজুড়ে হঠাৎ যেন বিপ্লবের মৌসুম শুরু হয়েছে। শুধু আরব বিশ্বেই নয়, তথাকথিত অগ্রসর গণতন্ত্রের দেশসমূহেও সে জোয়ার এসে লাগছে। আমেরিকার উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্যোগ নিয়েছেন রক্ষণশীল রিপাবলিকান গভর্নর।
তার প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ উইসকনসিনের রাজধানী ম্যাডিসনে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রায় পুরোটাই দিনের পর দিন বিক্ষোভ চালিয়ে গেছেন। প্রায় এক লাখ বিক্ষোভকারীর হাতে রাজ্য আইনসভাটি দিন কয়েকের জন্য বেহাত হয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা একটানা দুই সপ্তাহ রাজধানীর ক্যাপিটল ভবন ঘেরাও করে রাখেন। কেউ কেউ লেপ-কাঁথা নিয়েও সেখানে রাত্রি যাপন করেন। সে ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে এক পত্রিকা লিখেছে, মিসর এখন উইসকনসিনে। এত কিছুর পরও রিপাবলিকান গভর্নর অবশ্য তাঁর সিদ্ধান্ত বদলাননি। আগামী বছর মধ্যবর্তী নির্বাচনে এর শোধ তুলব, সে কথা ঘোষণা করেছেন বিক্ষোভকারীরা।
বিলেতে যা হচ্ছে, তা আরও বিপ্লবী। গত বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর সে দেশে এখন ক্ষমতায় এসেছেন রক্ষণশীল দলের ডেভিভ ক্যামেরন। লিবারেল পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠনের পর তিনি চেষ্টায় আছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিলেতে যে উদারনৈতিক জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাকে ভেঙে ফেলার। তাঁর যুক্তি, সামাজিক খাতে ভর্তুকি দিতে দিতে সরকার এখন দেউলিয়া হওয়ার জোগাড়। টাঁকশালে অর্থ নেই। অতএব, সামাজিক খাতে সরকারি ব্যয় কমাতে হবে। তিনি যে প্রস্তাব করেছেন, তার ফলে সরকারি স্কুল-কলেজে বেতন কয়েক গুণ বেড়ে যাবে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দ হ্রাস পাবে, জনসেবামূলক কাজকর্ম কাটছাঁট হবে, বেকার ভাতা পর্যায়ক্রমে তুলে দেওয়া হবে। এমনকি অনেক হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাবে। কম করে হলে দুই লাখ মানুষ, যাঁরা সাহায্য-ভাতা পেতেন, তাঁদের ভাড়াবাড়ি ছাড়তে হবে। কলেজে পড়ার স্বপ্ন ত্যাগ করতে হবে হাজার হাজার নিম্নবিত্তের ছেলেমেয়েদের। সরকারের প্রস্তাবিত এ ব্যবস্থার প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সবচেয়ে কার্যকর যে বিক্ষোভ চলছে, তার নাম ‘ইউকে আনকাট’ (UK Uncut)। টাকা নেই বলে সামাজিক নিরাপত্তা-জাল ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। অথচ বিশাল সব করপোরেশন নামমাত্র ট্যাক্স দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। কর ফাঁকি দেওয়ার নানা ফাঁকফোকর রেখে দেওয়া হচ্ছে, যাতে করে ‘আইনসম্মত’ভাবেই কর দেওয়া থেকে রেহাই পায় তারা। ইউকে আনকাট আন্দোলনের লক্ষ্য এসব করপোরেশনকে তার ন্যায্য কর প্রদানে বাধ্য করা। তারা যদি সেই কর দেয়, তাহলে হয়তো অনেক সামাজিক কর্মসূচি বাঁচানো সম্ভব হবে।
এ রকম করপোরেশনের একটি হলো ভোডাফোন নামের সেলফোন কোম্পানি। কোটি কোটি টাকা ব্যবসা করছে তারা, অথচ কর দেওয়ার সময় তাকে দিতে হচ্ছে নামমাত্র অর্থ। এর পরও এক সরকারি মন্ত্রী ভোডাফোনের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, তাদের যে এত বেশি কর দিতে হয়, সে জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। গত বছর সরকারি পয়সায় এই ফোন কোম্পানির এক মস্ত চাঁইকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ভারত ঘুরে আসেন। উদ্দেশ্য: ভারতে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ। ‘ইউকে আনকাট’ আওয়াজ তুলেছে, এ দেশে ব্যবসা করতে হলে ভোডাফোনকে নিয়মমাফিক কর দিতে হবে। বিভিন্ন শহরে যেখানে ভোডাফোনের ব্যবসাকেন্দ্র রয়েছে, ইউকে আনকাটের সমর্থকেরা তা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করা শুরু করেন। প্রথম প্রথম ব্যাপারটায় কেউ গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু যখন দেখা গেল, প্রতিবাদী লোকের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে, তখন পত্রপত্রিকা, টিভি নজর দেওয়া শুরু করল। সরকারের ওপরও চাপ এসে পড়ল। বইপত্র খুলে দেখাতে হলো ভোডাফোন কত কর দেয়, কত কর তাদের দেওয়ার কথা।
শুধু ভোডাফোন নয়, বিভিন্ন বহুজাতিক করপোরেশন, যারা কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য বিখ্যাত, তাদের দপ্তরে বেছে বেছে ধরনা দেওয়াও শুরু হলো। খুব বেশি লোক নয়, শ খানেক বা শ দেড়েক মানুষ—তাঁদের মধ্যে বুড়োবুড়ি রয়েছেন, রয়েছেন ছাত্র-কর্মজীবী-বেকার, প্রতিদিন সকাল থেকেই পিকেটিং করা শুরু করেন। যদি কারও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে এভাবে দিনের পর দিন পিকেটিং হয়, তা লোকজনের নজরে না এসে উপায় নেই। দেখা গেল, যে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে, তার কোনোটার মালিক যে পরিমাণ আয়কর দেন, তার চেয়ে বেশি আয়কর দিতে হয় তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের। এ নিয়ে জানাজানি হলে বিক্ষোভকারীর সংখ্যা বেড়ে গেল। টিভিতে টক শোগুলোও হইচই বাধিয়ে দিল এ নিয়ে। জনমতের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এরপর অনেকটা তড়িঘড়ি করেই ব্রিটিশ সরকার আয়কর ফাঁকির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ফলে প্রথম সপ্তাহেই তারা দুই বিলিয়ন পাউন্ড নতুন অনাদায়ী কর ফেরত পায়।
মজার কথা হলো, এই পুরো বিক্ষোভটাই চলছে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে। পরিকল্পনাটি শুরু হয়েছিল মোট ১৩ জন লোকের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা থেকে। একটা কিছু করা দরকার, এভাবে আর চলতে পারে না, সে ব্যাপারে তারা সবাই একমত। বিক্ষোভকারীদের একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া হয় টুইটার ও ফেসবুক। ইন্টারনেটে এই দুই প্ল্যাটফরম থেকে প্রথমে অল্প কজন স্বেচ্ছাসেবী একে অপরের সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রাথমিক পরিকল্পনা সারেন। সেই অল্প কজন থেকে আরও অনেক মানুষের মধ্যে এই আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় বিক্ষোভ। রেডিও-টিভি যুক্ত হওয়ার পর সে বিক্ষোভ জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়। তিউনিসিয়া ও মিসরে যেভাবে গণ-উত্থান হলো, তা-ও কিন্তু এভাবেই শুরু হয়েছিল।
আমরা ভেবেছিলাম, এই যে ফেসবুক-টুইটার-বিপ্লব শুরু হলো, তা বুঝি পুরোপুরি তরুণদের নেতৃত্বে চলছে। কিন্তু জেনে অবাক হয়েছি, এই নতুন বিপ্লবী জোয়ারের পেছনে সবচেয়ে বড় প্রেরণা এসেছে দুই বুড়োর কাছ থেকে। তাঁর একজন হলেন ৮৮ বছর বয়স্ক গান্ধীবাদী মার্কিন শিক্ষাবিদ জিন শার্প, অন্যজন ফ্রান্সের ৯৩ বছর বয়সের ফরাসি শান্তিবাদী স্তেফান হেসেল। আসুন, এই দুজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।
জিন শার্পের নাম আমরা প্রথম শুনি ২০০৭ সালে। সে সময় ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ এই অজ্ঞাতপরিচয় মার্কিন বৃদ্ধের নাম ধরে বলেছিলেন, তাঁর দেশের সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পেছনে তাঁর মদদ রয়েছে। কেউ সে কথায় খুব একটা পাত্তা দেননি। জিন শার্পের পরিচয় উদ্ধারের কোনো চেষ্টাও হয়নি। কিন্তু গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রবিক্ষোভের সময় ইরান সরকার এক ভিডিও বানিয়ে দাবি করে, জিন শার্প সরকারবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত, তিনি সিআইএর চর। সে কথা শুনে তখন অনেকেই নড়েচড়ে বসেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, জিন শার্প বোস্টনের কাছে তাঁর নিজের বাসায় আলবার্ট আইনস্টাইন ইনস্টিটিউট নামে একটি ছোট গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক। নামেই গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, আসলে তিনি ও তাঁর এক আফগান নারী সহকর্মী নিয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানটি চলছে। জিনের সারা জীবনের সাধনা—অহিংস উপায়ে কীভাবে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনা সম্ভব, তাঁর গবেষণা ও সবার সঙ্গে নিজের অর্জিত শিক্ষা ভাগাভাগি করে নেওয়া। এই নিয়ে তিনি একটি চটি বই লিখেছেন—নাম ফ্রম ডিক্টেটরশিপ টু ডেমোক্রেসি।
জিনের মোদ্দা বক্তব্য: একনায়কের একমাত্র অস্ত্র হিংস্র ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার ভয়েই মানুষ একনায়ককে মেনে চলে। কিন্তু একবার যদি সে ভয় দূর করা যায়, কোনো একনায়কের সাধ্য নেই জনতাকে কাবু করে। তবে একনায়কের বিরুদ্ধে হিংসার পথে এগোলে চলবে না। তুমি যদি সেই হিংসার পথেই যাও, সেই একনায়কের ফাঁদে ধরা পড়বে। সে যুক্তি দেখাবে, শক্তি প্রয়োগ ছাড়া সহিংস বিদ্রোহ দমনের অন্য আর কোনো পথ নেই, কিন্তু অহিংস পথে এগোলে সে একনায়ক ঠাহরই করে উঠতে পারবে না, তার জবাবে কোন পথে সে এগোবে। গান্ধীর লবণ আন্দোলন জিনের কাছে অহিংস আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। আমেরিকায় কৃষ্ণ অধিকার আন্দোলনকারীরা একসময় বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদে লাঞ্চ-কাউন্টারে ঠায় বসে থাকতেন। পুলিশ এসে গুঁতিয়ে না সরানো পর্যন্ত সরতেন না। জিন শার্প সে উদাহরণও প্রায় দিয়ে থাকেন। সাধারণ মানুষের কাছে গণতন্ত্র বা রাজনৈতিক সমানাধিকারের দাবির কোনো তাৎপর্যপূর্ণ মূল্য নেই। কিন্তু তার রুটিরুজির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, এমন দাবির কথা বলো, দেখবে সে ঠিকই তোমার সঙ্গে আসবে। জিন শার্পের বইতে মোট ৯৮ রকম অহিংস পদ্ধতির উদাহরণ রয়েছে। সে উদাহরণের অনেকগুলো ব্যবহূত হয়েছে মিসর ও তিউনিসিয়ার সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময়। যেমন—এই দুই দেশেই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত তরুণ সংগঠকেরা একদম গোড়া থেকেই দেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো রকম সংঘর্ষে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ বা সেনাসদস্যদের দিকে তাঁরা ফুল এগিয়ে দেন, তাদের দেখলে আনন্দে হাততালি দেন। উদ্দেশ্য: পুলিশ বা সামরিক বাহিনী তাঁদের শত্রু নয়, এ কথা বোঝানো। শত্রু মোবারক—সাধারণ জনতার যেমন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও।
জিন শার্পের আরেক বুদ্ধি কৌতুকের প্রয়োগ। তাঁর বুদ্ধি ধার করেই নব্বইয়ের দশকে সার্বিয়ার একনায়ক মিলোসেভিচের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা একবার এক কাঠের পিপার চারধারে মিলোসেভিচের কার্টুন এঁকে তা রাস্তার ওপর ছেড়ে দেন। চার আনা পয়সা দিয়ে যে কেউ সেই পিপায় লাথি মারতে পারত। লোকজন সব লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল পিপায় লাথি দিতে। মজা দেখতে পত্রপত্রিকা ও টিভির লোকজনও এসে হাজির। খানিক পর পুলিশ এসে সেই পিপা সরিয়ে নিল। পরদিন পত্রপত্রিকায় খবর হলো, মিলোসেভিচের পুলিশ এক কাঠের পিপা গ্রেপ্তার করেছে।
বার্মাতেও জিন শার্পের বুদ্ধি ধার করে ছাত্র ও ভিক্ষুরা সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অহিংস বিক্ষোভ করেছেন। খালি পায়ে হাঁটার বুদ্ধি তাঁর কাছ থেকেই শেখা। ইউক্রেন, জর্জিয়া, এমনকি ইরানেও জিনের অহিংস আন্দোলনের ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে। কোনো একটা বিশেষ রঙের ব্যবহার—ইরানে সবুজ, বার্মায় গেরুয়া, জর্জিয়ায় কমলা—তাও এসেছে জিনের কাছ থেকে। এসব দেশের প্রতিটিতেই জিনের ওই চটি বই স্থানীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে হাতে হাতে বই বিলি হয়েছে। যদ্দুর জানি, নেপালি ও হিন্দি ভাষাতেও এই বই পাওয়া যায়, কিন্তু বাংলায় নয়। কেউ যদি আগ্রহ নিয়ে এ কাজটি করে, তাহলে আমাদের আগামী আন্দোলনে তা কাজে লাগবে। বইটি ইন্টারনেটে বিনা মূল্যে পাওয়া যায় এই ঠিকানায়: http://www.aeinstein.org/organizations/org/FDTD.pdf
স্তেফান হেসেল নামের অন্য যে বুড়োর কথা বললাম, তাঁর কথাও অহিংস আন্দোলন। তিনি লিখেছেন আরও একটি চটি বই—নাম ইন্দিগনে-ভূ, অর্থাৎ ‘ক্রোধে ফেটে পড়ো’। মোট ৩০ পাতার বই, ইশতেহার-ধাঁচের ভাষায় লেখা। মোদ্দা বক্তব্য: পুঁজিবাদী দেশগুলোতে নাগরিক কল্যাণ-ব্যবস্থার ওপর আক্রমণ শুরু হয়েছে। অভাবী ও দুস্থদের সহায়ক সব সামাজিক কর্মসূচির কাটছাঁট হচ্ছে। এমনকি শিক্ষা খাতেও বরাদ্দ কমানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এসব হচ্ছে এমন এক সময়, যখন বড় বড় করপোরেশন রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা কামাচ্ছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পশ্চিমা বিশ্ব যখন প্রায় ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছিল, তখনো এসব দেশ দুর্বল ও অভাবীদের জন্য নিরাপত্তাবেড়ি নির্মাণে সফল হয়েছিল। অথচ এখন পুঁজিবাদ যখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে লাভজনক অবস্থায়, তখন আক্রমণ শুরু হচ্ছে নাগরিক কল্যাণের ওপর। হেসেলের প্রশ্ন: দেশের সব মানুষ বিনা প্রতিবাদে এই অনাচার মেনে নেবে? তাঁদের শরীরে ক্রোধের আগুন গেল কোথায়? কোথায় তাঁদের প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর?
স্তেফান হেসেলের জন্ম ১৯১৭ সালে, জার্মানিতে। শৈশবে তাঁর ইহুদি বাবা-মায়ের সঙ্গে তিনি ফ্রান্সে চলে আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি সেনাবাহিনীর হয়ে হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। সে সময় ধরা পড়ায় তাঁকে পাঠানো হয় বুখেনভালডের কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পে। গ্যাসচুল্লিতে তাঁর মারা যাওয়ার কথা, দৈবক্রমে বেঁচে যান। এরপর যোগ দেন ফরাসি প্রতিরোধ আন্দোলনে। যুদ্ধ শেষে হেসেল ফরাসি বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন এবং জাতিসংঘে মানবাধিকার ঘোষণার খসড়া রচনায় অংশ নেন। দীর্ঘ চাকরিজীবনের পর অবসর নিয়ে হেসেল মনোনিবেশ করেন সাহিত্যে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মী হিসেবেও সক্রিয় থাকেন।
ইন্দিগনে-ভূ গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়া মাত্রই ইউরোপের পাঠক তা লুফে নেন। যেন এমন একটি বইয়ের অপেক্ষায়ই তাঁরা ছিলেন। প্রকাশের প্রথম তিন মাসে কম করে হলেও ছয় লাখ কপি বিক্রি হয় সেই বই। ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় তা ইতিমধ্যে অনূদিত হয়েছে। (এই বইয়ের একটি ইংরেজি অনুবাদ পাওয়া যাবে এই ঠিকানায়: http://www.thenation.com/article/158683/indignez-vous)। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে এখন কট্টর দক্ষিণপন্থী সরকার ক্ষমতায়। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও দক্ষিণপন্থীদের অবস্থান শক্ত। এসব দেশের সর্বত্রই নাগরিক স্বার্থবিরোধী পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। তার ওপর রয়েছে অত্যন্ত বর্ণবাদী ও বহিরাগতবিরোধী রাজনীতি। এই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিরুদ্ধেই আওয়াজ তুলেছেন হেসেল তাঁর বইতে। হেসেল মনে করিয়ে দিয়েছেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রতিরোধ আন্দোলনের আসল শক্তি এসেছে প্রত্যাখ্যানের আগুন থেকে। তরুণদের লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন, ‘আমরা একসময় যেমন ক্রোধে জ্বলে উঠেছিলাম, এখন সময় তোমাদের সেই রকম জ্বলে ওঠার। জাগো, দখল করো, ক্রোধে ফুঁসে ওঠো। যারা এখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেতৃত্বে, তাদের ক্ষমতার শৌর্যে ভীত হোয়ো না। আমি চাই, তোমরা প্রত্যেকে কোনো একটা-না-একটা কারণে ক্রোধান্বিত হও। নাৎসিদের বিরুদ্ধে যেমন আমরা ক্রোধে ফেটে পড়েছিলাম, সেই রকম ক্রোধে তোমরাও জ্বলে ওঠো। ইতিহাসের গতিধারা অধিকতর ন্যায়সম্মত সমাজ সৃষ্টির দিকে। সেই ধারা যাতে বহমান থাকে, একমাত্র তোমরাই তা নিশ্চিত করতে পারো। অতএব, ক্রোধে জাগো, ফেটে পড়ো।’
বৃদ্ধ হেসেলের বক্তব্য ইউরোপীয় তরুণ ও যুবকদের উদ্দেশে। কিন্তু সেই একই কথা কি আমাদের দেশের তরুণদের বেলায়ও প্রযোজ্য নয়? কই, তোমাদের ক্রোধ কোথায়, কোথায় তোমাদের প্রত্যাখ্যান? নিজেদের চারপাশে তাকাও। ক্রোধে উত্তপ্ত হওয়ার মতো একটা কারণ কি তোমরা খুঁজে পাও না?
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
বিলেতে যা হচ্ছে, তা আরও বিপ্লবী। গত বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর সে দেশে এখন ক্ষমতায় এসেছেন রক্ষণশীল দলের ডেভিভ ক্যামেরন। লিবারেল পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠনের পর তিনি চেষ্টায় আছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিলেতে যে উদারনৈতিক জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাকে ভেঙে ফেলার। তাঁর যুক্তি, সামাজিক খাতে ভর্তুকি দিতে দিতে সরকার এখন দেউলিয়া হওয়ার জোগাড়। টাঁকশালে অর্থ নেই। অতএব, সামাজিক খাতে সরকারি ব্যয় কমাতে হবে। তিনি যে প্রস্তাব করেছেন, তার ফলে সরকারি স্কুল-কলেজে বেতন কয়েক গুণ বেড়ে যাবে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দ হ্রাস পাবে, জনসেবামূলক কাজকর্ম কাটছাঁট হবে, বেকার ভাতা পর্যায়ক্রমে তুলে দেওয়া হবে। এমনকি অনেক হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাবে। কম করে হলে দুই লাখ মানুষ, যাঁরা সাহায্য-ভাতা পেতেন, তাঁদের ভাড়াবাড়ি ছাড়তে হবে। কলেজে পড়ার স্বপ্ন ত্যাগ করতে হবে হাজার হাজার নিম্নবিত্তের ছেলেমেয়েদের। সরকারের প্রস্তাবিত এ ব্যবস্থার প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সবচেয়ে কার্যকর যে বিক্ষোভ চলছে, তার নাম ‘ইউকে আনকাট’ (UK Uncut)। টাকা নেই বলে সামাজিক নিরাপত্তা-জাল ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। অথচ বিশাল সব করপোরেশন নামমাত্র ট্যাক্স দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। কর ফাঁকি দেওয়ার নানা ফাঁকফোকর রেখে দেওয়া হচ্ছে, যাতে করে ‘আইনসম্মত’ভাবেই কর দেওয়া থেকে রেহাই পায় তারা। ইউকে আনকাট আন্দোলনের লক্ষ্য এসব করপোরেশনকে তার ন্যায্য কর প্রদানে বাধ্য করা। তারা যদি সেই কর দেয়, তাহলে হয়তো অনেক সামাজিক কর্মসূচি বাঁচানো সম্ভব হবে।
এ রকম করপোরেশনের একটি হলো ভোডাফোন নামের সেলফোন কোম্পানি। কোটি কোটি টাকা ব্যবসা করছে তারা, অথচ কর দেওয়ার সময় তাকে দিতে হচ্ছে নামমাত্র অর্থ। এর পরও এক সরকারি মন্ত্রী ভোডাফোনের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, তাদের যে এত বেশি কর দিতে হয়, সে জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। গত বছর সরকারি পয়সায় এই ফোন কোম্পানির এক মস্ত চাঁইকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ভারত ঘুরে আসেন। উদ্দেশ্য: ভারতে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ। ‘ইউকে আনকাট’ আওয়াজ তুলেছে, এ দেশে ব্যবসা করতে হলে ভোডাফোনকে নিয়মমাফিক কর দিতে হবে। বিভিন্ন শহরে যেখানে ভোডাফোনের ব্যবসাকেন্দ্র রয়েছে, ইউকে আনকাটের সমর্থকেরা তা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করা শুরু করেন। প্রথম প্রথম ব্যাপারটায় কেউ গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু যখন দেখা গেল, প্রতিবাদী লোকের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে, তখন পত্রপত্রিকা, টিভি নজর দেওয়া শুরু করল। সরকারের ওপরও চাপ এসে পড়ল। বইপত্র খুলে দেখাতে হলো ভোডাফোন কত কর দেয়, কত কর তাদের দেওয়ার কথা।
শুধু ভোডাফোন নয়, বিভিন্ন বহুজাতিক করপোরেশন, যারা কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য বিখ্যাত, তাদের দপ্তরে বেছে বেছে ধরনা দেওয়াও শুরু হলো। খুব বেশি লোক নয়, শ খানেক বা শ দেড়েক মানুষ—তাঁদের মধ্যে বুড়োবুড়ি রয়েছেন, রয়েছেন ছাত্র-কর্মজীবী-বেকার, প্রতিদিন সকাল থেকেই পিকেটিং করা শুরু করেন। যদি কারও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে এভাবে দিনের পর দিন পিকেটিং হয়, তা লোকজনের নজরে না এসে উপায় নেই। দেখা গেল, যে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে, তার কোনোটার মালিক যে পরিমাণ আয়কর দেন, তার চেয়ে বেশি আয়কর দিতে হয় তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের। এ নিয়ে জানাজানি হলে বিক্ষোভকারীর সংখ্যা বেড়ে গেল। টিভিতে টক শোগুলোও হইচই বাধিয়ে দিল এ নিয়ে। জনমতের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এরপর অনেকটা তড়িঘড়ি করেই ব্রিটিশ সরকার আয়কর ফাঁকির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ফলে প্রথম সপ্তাহেই তারা দুই বিলিয়ন পাউন্ড নতুন অনাদায়ী কর ফেরত পায়।
মজার কথা হলো, এই পুরো বিক্ষোভটাই চলছে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে। পরিকল্পনাটি শুরু হয়েছিল মোট ১৩ জন লোকের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা থেকে। একটা কিছু করা দরকার, এভাবে আর চলতে পারে না, সে ব্যাপারে তারা সবাই একমত। বিক্ষোভকারীদের একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া হয় টুইটার ও ফেসবুক। ইন্টারনেটে এই দুই প্ল্যাটফরম থেকে প্রথমে অল্প কজন স্বেচ্ছাসেবী একে অপরের সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রাথমিক পরিকল্পনা সারেন। সেই অল্প কজন থেকে আরও অনেক মানুষের মধ্যে এই আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় বিক্ষোভ। রেডিও-টিভি যুক্ত হওয়ার পর সে বিক্ষোভ জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়। তিউনিসিয়া ও মিসরে যেভাবে গণ-উত্থান হলো, তা-ও কিন্তু এভাবেই শুরু হয়েছিল।
আমরা ভেবেছিলাম, এই যে ফেসবুক-টুইটার-বিপ্লব শুরু হলো, তা বুঝি পুরোপুরি তরুণদের নেতৃত্বে চলছে। কিন্তু জেনে অবাক হয়েছি, এই নতুন বিপ্লবী জোয়ারের পেছনে সবচেয়ে বড় প্রেরণা এসেছে দুই বুড়োর কাছ থেকে। তাঁর একজন হলেন ৮৮ বছর বয়স্ক গান্ধীবাদী মার্কিন শিক্ষাবিদ জিন শার্প, অন্যজন ফ্রান্সের ৯৩ বছর বয়সের ফরাসি শান্তিবাদী স্তেফান হেসেল। আসুন, এই দুজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।
জিন শার্পের নাম আমরা প্রথম শুনি ২০০৭ সালে। সে সময় ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ এই অজ্ঞাতপরিচয় মার্কিন বৃদ্ধের নাম ধরে বলেছিলেন, তাঁর দেশের সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পেছনে তাঁর মদদ রয়েছে। কেউ সে কথায় খুব একটা পাত্তা দেননি। জিন শার্পের পরিচয় উদ্ধারের কোনো চেষ্টাও হয়নি। কিন্তু গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রবিক্ষোভের সময় ইরান সরকার এক ভিডিও বানিয়ে দাবি করে, জিন শার্প সরকারবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত, তিনি সিআইএর চর। সে কথা শুনে তখন অনেকেই নড়েচড়ে বসেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, জিন শার্প বোস্টনের কাছে তাঁর নিজের বাসায় আলবার্ট আইনস্টাইন ইনস্টিটিউট নামে একটি ছোট গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক। নামেই গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, আসলে তিনি ও তাঁর এক আফগান নারী সহকর্মী নিয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানটি চলছে। জিনের সারা জীবনের সাধনা—অহিংস উপায়ে কীভাবে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনা সম্ভব, তাঁর গবেষণা ও সবার সঙ্গে নিজের অর্জিত শিক্ষা ভাগাভাগি করে নেওয়া। এই নিয়ে তিনি একটি চটি বই লিখেছেন—নাম ফ্রম ডিক্টেটরশিপ টু ডেমোক্রেসি।
জিনের মোদ্দা বক্তব্য: একনায়কের একমাত্র অস্ত্র হিংস্র ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার ভয়েই মানুষ একনায়ককে মেনে চলে। কিন্তু একবার যদি সে ভয় দূর করা যায়, কোনো একনায়কের সাধ্য নেই জনতাকে কাবু করে। তবে একনায়কের বিরুদ্ধে হিংসার পথে এগোলে চলবে না। তুমি যদি সেই হিংসার পথেই যাও, সেই একনায়কের ফাঁদে ধরা পড়বে। সে যুক্তি দেখাবে, শক্তি প্রয়োগ ছাড়া সহিংস বিদ্রোহ দমনের অন্য আর কোনো পথ নেই, কিন্তু অহিংস পথে এগোলে সে একনায়ক ঠাহরই করে উঠতে পারবে না, তার জবাবে কোন পথে সে এগোবে। গান্ধীর লবণ আন্দোলন জিনের কাছে অহিংস আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। আমেরিকায় কৃষ্ণ অধিকার আন্দোলনকারীরা একসময় বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদে লাঞ্চ-কাউন্টারে ঠায় বসে থাকতেন। পুলিশ এসে গুঁতিয়ে না সরানো পর্যন্ত সরতেন না। জিন শার্প সে উদাহরণও প্রায় দিয়ে থাকেন। সাধারণ মানুষের কাছে গণতন্ত্র বা রাজনৈতিক সমানাধিকারের দাবির কোনো তাৎপর্যপূর্ণ মূল্য নেই। কিন্তু তার রুটিরুজির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, এমন দাবির কথা বলো, দেখবে সে ঠিকই তোমার সঙ্গে আসবে। জিন শার্পের বইতে মোট ৯৮ রকম অহিংস পদ্ধতির উদাহরণ রয়েছে। সে উদাহরণের অনেকগুলো ব্যবহূত হয়েছে মিসর ও তিউনিসিয়ার সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময়। যেমন—এই দুই দেশেই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত তরুণ সংগঠকেরা একদম গোড়া থেকেই দেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো রকম সংঘর্ষে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ বা সেনাসদস্যদের দিকে তাঁরা ফুল এগিয়ে দেন, তাদের দেখলে আনন্দে হাততালি দেন। উদ্দেশ্য: পুলিশ বা সামরিক বাহিনী তাঁদের শত্রু নয়, এ কথা বোঝানো। শত্রু মোবারক—সাধারণ জনতার যেমন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও।
জিন শার্পের আরেক বুদ্ধি কৌতুকের প্রয়োগ। তাঁর বুদ্ধি ধার করেই নব্বইয়ের দশকে সার্বিয়ার একনায়ক মিলোসেভিচের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা একবার এক কাঠের পিপার চারধারে মিলোসেভিচের কার্টুন এঁকে তা রাস্তার ওপর ছেড়ে দেন। চার আনা পয়সা দিয়ে যে কেউ সেই পিপায় লাথি মারতে পারত। লোকজন সব লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল পিপায় লাথি দিতে। মজা দেখতে পত্রপত্রিকা ও টিভির লোকজনও এসে হাজির। খানিক পর পুলিশ এসে সেই পিপা সরিয়ে নিল। পরদিন পত্রপত্রিকায় খবর হলো, মিলোসেভিচের পুলিশ এক কাঠের পিপা গ্রেপ্তার করেছে।
বার্মাতেও জিন শার্পের বুদ্ধি ধার করে ছাত্র ও ভিক্ষুরা সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অহিংস বিক্ষোভ করেছেন। খালি পায়ে হাঁটার বুদ্ধি তাঁর কাছ থেকেই শেখা। ইউক্রেন, জর্জিয়া, এমনকি ইরানেও জিনের অহিংস আন্দোলনের ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে। কোনো একটা বিশেষ রঙের ব্যবহার—ইরানে সবুজ, বার্মায় গেরুয়া, জর্জিয়ায় কমলা—তাও এসেছে জিনের কাছ থেকে। এসব দেশের প্রতিটিতেই জিনের ওই চটি বই স্থানীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে হাতে হাতে বই বিলি হয়েছে। যদ্দুর জানি, নেপালি ও হিন্দি ভাষাতেও এই বই পাওয়া যায়, কিন্তু বাংলায় নয়। কেউ যদি আগ্রহ নিয়ে এ কাজটি করে, তাহলে আমাদের আগামী আন্দোলনে তা কাজে লাগবে। বইটি ইন্টারনেটে বিনা মূল্যে পাওয়া যায় এই ঠিকানায়: http://www.aeinstein.org/organizations/org/FDTD.pdf
স্তেফান হেসেল নামের অন্য যে বুড়োর কথা বললাম, তাঁর কথাও অহিংস আন্দোলন। তিনি লিখেছেন আরও একটি চটি বই—নাম ইন্দিগনে-ভূ, অর্থাৎ ‘ক্রোধে ফেটে পড়ো’। মোট ৩০ পাতার বই, ইশতেহার-ধাঁচের ভাষায় লেখা। মোদ্দা বক্তব্য: পুঁজিবাদী দেশগুলোতে নাগরিক কল্যাণ-ব্যবস্থার ওপর আক্রমণ শুরু হয়েছে। অভাবী ও দুস্থদের সহায়ক সব সামাজিক কর্মসূচির কাটছাঁট হচ্ছে। এমনকি শিক্ষা খাতেও বরাদ্দ কমানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এসব হচ্ছে এমন এক সময়, যখন বড় বড় করপোরেশন রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা কামাচ্ছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পশ্চিমা বিশ্ব যখন প্রায় ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছিল, তখনো এসব দেশ দুর্বল ও অভাবীদের জন্য নিরাপত্তাবেড়ি নির্মাণে সফল হয়েছিল। অথচ এখন পুঁজিবাদ যখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে লাভজনক অবস্থায়, তখন আক্রমণ শুরু হচ্ছে নাগরিক কল্যাণের ওপর। হেসেলের প্রশ্ন: দেশের সব মানুষ বিনা প্রতিবাদে এই অনাচার মেনে নেবে? তাঁদের শরীরে ক্রোধের আগুন গেল কোথায়? কোথায় তাঁদের প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর?
স্তেফান হেসেলের জন্ম ১৯১৭ সালে, জার্মানিতে। শৈশবে তাঁর ইহুদি বাবা-মায়ের সঙ্গে তিনি ফ্রান্সে চলে আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি সেনাবাহিনীর হয়ে হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। সে সময় ধরা পড়ায় তাঁকে পাঠানো হয় বুখেনভালডের কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পে। গ্যাসচুল্লিতে তাঁর মারা যাওয়ার কথা, দৈবক্রমে বেঁচে যান। এরপর যোগ দেন ফরাসি প্রতিরোধ আন্দোলনে। যুদ্ধ শেষে হেসেল ফরাসি বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন এবং জাতিসংঘে মানবাধিকার ঘোষণার খসড়া রচনায় অংশ নেন। দীর্ঘ চাকরিজীবনের পর অবসর নিয়ে হেসেল মনোনিবেশ করেন সাহিত্যে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মী হিসেবেও সক্রিয় থাকেন।
ইন্দিগনে-ভূ গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়া মাত্রই ইউরোপের পাঠক তা লুফে নেন। যেন এমন একটি বইয়ের অপেক্ষায়ই তাঁরা ছিলেন। প্রকাশের প্রথম তিন মাসে কম করে হলেও ছয় লাখ কপি বিক্রি হয় সেই বই। ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় তা ইতিমধ্যে অনূদিত হয়েছে। (এই বইয়ের একটি ইংরেজি অনুবাদ পাওয়া যাবে এই ঠিকানায়: http://www.thenation.com/article/158683/indignez-vous)। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে এখন কট্টর দক্ষিণপন্থী সরকার ক্ষমতায়। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও দক্ষিণপন্থীদের অবস্থান শক্ত। এসব দেশের সর্বত্রই নাগরিক স্বার্থবিরোধী পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। তার ওপর রয়েছে অত্যন্ত বর্ণবাদী ও বহিরাগতবিরোধী রাজনীতি। এই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিরুদ্ধেই আওয়াজ তুলেছেন হেসেল তাঁর বইতে। হেসেল মনে করিয়ে দিয়েছেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রতিরোধ আন্দোলনের আসল শক্তি এসেছে প্রত্যাখ্যানের আগুন থেকে। তরুণদের লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন, ‘আমরা একসময় যেমন ক্রোধে জ্বলে উঠেছিলাম, এখন সময় তোমাদের সেই রকম জ্বলে ওঠার। জাগো, দখল করো, ক্রোধে ফুঁসে ওঠো। যারা এখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেতৃত্বে, তাদের ক্ষমতার শৌর্যে ভীত হোয়ো না। আমি চাই, তোমরা প্রত্যেকে কোনো একটা-না-একটা কারণে ক্রোধান্বিত হও। নাৎসিদের বিরুদ্ধে যেমন আমরা ক্রোধে ফেটে পড়েছিলাম, সেই রকম ক্রোধে তোমরাও জ্বলে ওঠো। ইতিহাসের গতিধারা অধিকতর ন্যায়সম্মত সমাজ সৃষ্টির দিকে। সেই ধারা যাতে বহমান থাকে, একমাত্র তোমরাই তা নিশ্চিত করতে পারো। অতএব, ক্রোধে জাগো, ফেটে পড়ো।’
বৃদ্ধ হেসেলের বক্তব্য ইউরোপীয় তরুণ ও যুবকদের উদ্দেশে। কিন্তু সেই একই কথা কি আমাদের দেশের তরুণদের বেলায়ও প্রযোজ্য নয়? কই, তোমাদের ক্রোধ কোথায়, কোথায় তোমাদের প্রত্যাখ্যান? নিজেদের চারপাশে তাকাও। ক্রোধে উত্তপ্ত হওয়ার মতো একটা কারণ কি তোমরা খুঁজে পাও না?
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments