স্বাভাবিক মিত্র by সি. রাজা মোহন
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা সফরের ঘোষণাটা এত তাড়াতাড়ি আসার কথা ছিল না। বাংলাদেশ সম্পর্কে ড. সিংয়ের দুর্ভাগ্যজনক অফ দ্য রেকর্ড মন্তব্যের পর তার ঢাকা সফরের দিনক্ষণ আগাম ঘোষণা করা হলো। বাংলাদেশ সফর নিয়ে যাতে তার এই মন্তব্যে কোনো ধোঁয়াশা সৃষ্টি না হয়,
সে ক্ষেত্রে ঢাকার আচরণ ছিল যথেষ্ট পরিপকস্ফ। গত কয়েক দিনে ঢাকার ধীরস্থির আচরণ বাংলাদেশের আত্মপ্রত্যয়ী নতুন মানসিকতার প্রমাণ।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের সময় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ এজেন্ডা উন্মোচনের পর বাংলাদেশ ড. সিংয়ের ফিরতি সফরের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। এমনকি ঢাকায় যারা এতদিন পানি বণ্টন, বাজার সুবিধা প্রদান ও সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরাজমান দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিকে দিলি্লর কথার কথা মনে করত সেই সন্দেহবাদীরাও এখন তাদের পুরনো মনোভাব পাল্টাতে প্রস্তুত।
এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো, ড. সিং সে প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপ দেবেন কি-না। পাকিস্তানের বেলায় তিনি যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে একই অবস্থার সৃষ্টি হয় কি-না সে ব্যাপারে কারও কারও মধ্যে আশঙ্কা থাকতে পারে।
এ প্রসঙ্গে এখন সমাধানের দ্বারপ্রান্তে থাকা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সমস্যার কথা উল্লেখ করা যায়। বাস্তবতা হলো, ১৯৭৪ সালে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমান দু'দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি সম্পাদনের প্রায় চার দশক পর এখন আমাদের সে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার ১৫ বছর পর এখন তিস্তা ও ফেনীর পানি বণ্টন নিয়ে অন্তর্বর্তী চুক্তি সম্পাদনের জন্য প্রস্তুত বলে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর আরও বিলম্বিত হলে ঢাকার সঙ্গে নয়াদিলি্লর সম্পর্কোন্নয়নের যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল তা উবে যেতে পারে, এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। কারণ বেশি দেরি হলে শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পথে থাকবে। সুতরাং ড. সিংয়ের আসন্ন ঢাকা সফর মূলত সর্বশেষ সুবিধাজনক সময়েই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দুর্ঘটনাপ্রবণ কূটনীতির সম্ভাবনাকে সামনে রেখেও আমরা আশা করতে পারি যে, তার নির্ধারিত সফরের মাঝখানে এই দুই মাসে ঢাকা-দিলি্ল সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে তেমন অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটবে না।
এখন পর্যন্ত সবকিছু ভালোয় ভালোয় কাটছে। নয়াদিলি্ল ও ঢাকার আমলারা চুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে বাধা অপসারণে চমৎকার কর্মতৎপরতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন। উভয় এস্টাবি্লশমেন্টই তাদের চিরাচরিত পরিবর্তনবিরোধী মানসিকতাকে জয় করে পারস্পরিক লাভজনক ফলাফল অর্জনে ব্রতী হয়েছে। তবে এখনও কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলোর খুঁটিনাটির দিকে নজর দিতে হবে এবং কিছু বিষয় পার হয়ে যেতে হবে। আগামী সপ্তাহগুলোতে দিলি্ল থেকে ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের সফরের সময় মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকে অত্যন্ত অর্থবহ ও এমনকি এটিকে ঐতিহাসিক সফরে পরিণত করার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হবে বলে আশা করা যায়।
আশা করা যায়, ড. সিং তার ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আসামসহ ভারতের যেসব উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের উন্নতির প্রসঙ্গ জড়িত রয়েছে, সেসব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গী করতে পারেন। দেশভাগের তিক্ত উত্তরাধিকারের কারণে উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল যখন নিজেদের স্বার্থেও কোনো সহযোগিতা গড়ে তুলতে পারে না, তখন মনমোহন সিংয়ের আসন্ন বাংলাদেশ সফর সেই বাধাকে জয় করতে সক্ষম হবে।
মনমোহন সিং ও শেখ হাসিনা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন এক ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তুলবেন যার প্রভাব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বাইরেও অনুভূত হবে। দিলি্ল-ঢাকার মধ্যে যে ট্রানজিট চুক্তি হবে তাতে নেপাল ও ভুটানও জড়িত থাকবে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিনিময় চুক্তি দক্ষিণ এশিয়া উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সমন্বিত মডেল হতে পারে।
বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি করছে। সম্প্রতি প্রকাশিত সিটি ব্যাংকের এক রিপোর্টে দেখা যায়, বিশ্বের ইমার্জিং ১১টি অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এর প্রবৃদ্ধি বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলকে পুনরায় ইন্টিগ্রেট করা এবং দক্ষিণ এশিয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত সংযুক্তকরণে সহায়ক হতে পারে বাংলাদেশ। অতএব, আমাদের নিকট ও বিস্তৃত প্রতিবেশীদের নিয়ে কৌশলগত পুনর্ভাবনার ক্ষেত্রে দিলি্লর স্বাভাবিক মিত্র হচ্ছে ঢাকা।
সি. রাজা মোহন :দিলি্লর সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সিনিয়র ফেলো ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে
ভাষান্তর সুভাষ সাহা
২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের সময় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ এজেন্ডা উন্মোচনের পর বাংলাদেশ ড. সিংয়ের ফিরতি সফরের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। এমনকি ঢাকায় যারা এতদিন পানি বণ্টন, বাজার সুবিধা প্রদান ও সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরাজমান দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিকে দিলি্লর কথার কথা মনে করত সেই সন্দেহবাদীরাও এখন তাদের পুরনো মনোভাব পাল্টাতে প্রস্তুত।
এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো, ড. সিং সে প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপ দেবেন কি-না। পাকিস্তানের বেলায় তিনি যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে একই অবস্থার সৃষ্টি হয় কি-না সে ব্যাপারে কারও কারও মধ্যে আশঙ্কা থাকতে পারে।
এ প্রসঙ্গে এখন সমাধানের দ্বারপ্রান্তে থাকা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সমস্যার কথা উল্লেখ করা যায়। বাস্তবতা হলো, ১৯৭৪ সালে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমান দু'দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি সম্পাদনের প্রায় চার দশক পর এখন আমাদের সে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার ১৫ বছর পর এখন তিস্তা ও ফেনীর পানি বণ্টন নিয়ে অন্তর্বর্তী চুক্তি সম্পাদনের জন্য প্রস্তুত বলে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর আরও বিলম্বিত হলে ঢাকার সঙ্গে নয়াদিলি্লর সম্পর্কোন্নয়নের যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল তা উবে যেতে পারে, এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। কারণ বেশি দেরি হলে শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পথে থাকবে। সুতরাং ড. সিংয়ের আসন্ন ঢাকা সফর মূলত সর্বশেষ সুবিধাজনক সময়েই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দুর্ঘটনাপ্রবণ কূটনীতির সম্ভাবনাকে সামনে রেখেও আমরা আশা করতে পারি যে, তার নির্ধারিত সফরের মাঝখানে এই দুই মাসে ঢাকা-দিলি্ল সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে তেমন অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটবে না।
এখন পর্যন্ত সবকিছু ভালোয় ভালোয় কাটছে। নয়াদিলি্ল ও ঢাকার আমলারা চুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে বাধা অপসারণে চমৎকার কর্মতৎপরতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন। উভয় এস্টাবি্লশমেন্টই তাদের চিরাচরিত পরিবর্তনবিরোধী মানসিকতাকে জয় করে পারস্পরিক লাভজনক ফলাফল অর্জনে ব্রতী হয়েছে। তবে এখনও কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলোর খুঁটিনাটির দিকে নজর দিতে হবে এবং কিছু বিষয় পার হয়ে যেতে হবে। আগামী সপ্তাহগুলোতে দিলি্ল থেকে ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের সফরের সময় মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকে অত্যন্ত অর্থবহ ও এমনকি এটিকে ঐতিহাসিক সফরে পরিণত করার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হবে বলে আশা করা যায়।
আশা করা যায়, ড. সিং তার ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আসামসহ ভারতের যেসব উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের উন্নতির প্রসঙ্গ জড়িত রয়েছে, সেসব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গী করতে পারেন। দেশভাগের তিক্ত উত্তরাধিকারের কারণে উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল যখন নিজেদের স্বার্থেও কোনো সহযোগিতা গড়ে তুলতে পারে না, তখন মনমোহন সিংয়ের আসন্ন বাংলাদেশ সফর সেই বাধাকে জয় করতে সক্ষম হবে।
মনমোহন সিং ও শেখ হাসিনা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন এক ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তুলবেন যার প্রভাব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বাইরেও অনুভূত হবে। দিলি্ল-ঢাকার মধ্যে যে ট্রানজিট চুক্তি হবে তাতে নেপাল ও ভুটানও জড়িত থাকবে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিনিময় চুক্তি দক্ষিণ এশিয়া উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সমন্বিত মডেল হতে পারে।
বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি করছে। সম্প্রতি প্রকাশিত সিটি ব্যাংকের এক রিপোর্টে দেখা যায়, বিশ্বের ইমার্জিং ১১টি অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এর প্রবৃদ্ধি বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলকে পুনরায় ইন্টিগ্রেট করা এবং দক্ষিণ এশিয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত সংযুক্তকরণে সহায়ক হতে পারে বাংলাদেশ। অতএব, আমাদের নিকট ও বিস্তৃত প্রতিবেশীদের নিয়ে কৌশলগত পুনর্ভাবনার ক্ষেত্রে দিলি্লর স্বাভাবিক মিত্র হচ্ছে ঢাকা।
সি. রাজা মোহন :দিলি্লর সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সিনিয়র ফেলো ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে
ভাষান্তর সুভাষ সাহা
No comments