আওয়ামী লীগের শত্রু-মিত্র by সুভাষ সিংহ রায়
এ দেশে আওয়ামী লীগবিরোধীরা খুব সহজেই বিখ্যাত হয়ে যান। বিখ্যাত রাজনীতি বিশ্লেষক অমলেশ ত্রিপাঠীর একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম 'স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের কংগ্রেস'। এই গ্রন্থের মুখবন্ধে লেখা হয়েছে_'যখনই বিপ্লবী দল বা কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের সহযোগিতা করেছে বা বিরোধিতা করেছে, তখনই পাদপ্রদীপের
আলো তাদের ওপর পড়েছে।' অনুরূপভাবে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও এ কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্য। এ দেশে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সহযোগিতা করে বিখ্যাত হয়েছেন। হয়তো যাঁরা বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের ওপর পাদপ্রদীপের আলো বেশি করে পড়েছে। আজ যাঁরা আওয়ামী লীগবিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিত, তাঁদের অনেকেই এই অবস্থানগত কারণে সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। তা ছাড়া চিরস্থায়ী আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থানে তাঁদের সবাইকে দেখা যায় না। কেননা, সুবিধামতো সময়ে তাঁদের অনেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ফেলেন। এ কথা বিলক্ষণ বলা যায়, এর জন্য ওই সময় এসব নেতাই বেশি সুবিধা পান। তাঁদের কাছ থেকে আওয়ামী লীগ খুব বেশি সুবিধা না পেলেও তাঁরা কিন্তু বেশ ভালোভাবেই আলোকিত হন। আবার তাঁরাই আওয়ামী লীগের বিপদ দেখলে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন।
বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির অনেকেই এই সমীকরণে বিখ্যাত হয়ে আছেন। ১৪ দলীয় জোটের একজন শ্রদ্ধেয় বড় নেতা জোটের ভেতর এ রকম কথা বলতেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণ-আন্দোলনের। আবার তিনিই 'সাপ্তাহিক ২০০০' পত্রিকায় ছদ্মনামে অন্য ধরনের লেখা লিখতেন। এটা আওয়ামী লীগকে জেনেও না জানার ভান করতে হয়। ওই নেতা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান। আওয়ামী লীগের এই সীমাবদ্ধতা নানা কারণে। হয়তো কোনো কোনো সীমাবদ্ধতা নিয়তির বিধানে লিপিবদ্ধ। এই মাটিতে এত নেতা বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করলেন, অথচ তাঁরাও কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে চলতে পারলেন না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির স্বভাবজাত বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে চিহ্নিত করে গেছেন। চমৎকারভাবে বলেছেন, 'আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি; অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করি।' এ দেশের সুশীল সমাজ সব সময় আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সম্ভব-অসম্ভব সবই প্রত্যাশা করে; কিন্তু আওয়ামী লীগের সামান্য ত্রুটি নিয়ে আকাশ বিদীর্ণ করে।
দীর্ঘকাল যাবৎ বলা হয়েছে, শেখ মুজিব একজন আধা শিক্ষিত নেতা। পণ্ডিত হিসেবে খ্যাত কিছু কিছু ব্যক্তি সব সময় বলতেন, শেখ মুজিব অনেক কিছু না বুঝে করেছেন। অবশ্য এসব গুণীজন না বুঝে শেখ মুজিবের বিরোধিতা করেননি। সেই সময় সরাসরি পাকিস্তানিদের পক্ষ নেওয়াটা ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এবং দৃষ্টিকটু। তাই সেসব পণ্ডিত নানা রকম সাম্যবাদের রাজনীতির কথা বলে শেখ মুজিবের বিরোধিতা করতেন। এই কৌশল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও খুব কার্যকরভাবে অনুসরণ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু খুব গভীরভাবে পাকিস্তানের সাংবিধানিক সমস্যা নিয়ে ভাবতেন এবং সমাধান জানার জন্য পড়াশোনা করতেন। ডেভিড ফ্রস্ট যখন বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, তখন গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ঘুরে দেখেন। তাঁর গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, টেবিলের ওপর রাখা তাঁর স্যার আইভর জেনিংসের 'কনস্টিটিউশনাল প্রবলেমস অব পাকিস্তান' নামক গ্রন্থটি পড়ে থাকতে দেখেন। বইটি তাঁর শিক্ষক জুবেরি তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। বইয়ের ভেতর জুবেরি লিখেছিলেন, 'রাজনীতিকে অবলম্বন করে এগিয়ে যাওয়া যায় ক্ষমতার দিকে; তবে জ্ঞানও হচ্ছে ক্ষমতা।' বঙ্গবন্ধু পরে ফ্রস্টকে বলেছিলেন, যতবার তিনি কারাগারে গেছেন, প্রতিবার এই বই পড়েছেন। তবে এবার আর এই বইটি সঙ্গে নেওয়ার ফুরসত তাঁর হয়নি। প্রকৃত অর্থে দেশকে ভালোবাসতে পারলে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। বিশেষ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একটি অংশ মনে করেছিল, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আর জেলখানার বাইরে আসতে পারবেন না। এই সময়কালে হয়তো আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারাও বিশ্বাস করেছিলেন, আওয়ামী লীগের নিকট-ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। বোধকরি, আওয়ামী লীগ সৃষ্টির পর থেকে এ রকম ঘটনা বহুবার ঘটেছে। তাই এ কথা স্পষ্ট করে বলা যায়, আওয়ামী লীগের চিরশত্রু বলে অনেক মানুষ আছেন এবং থাকবেন; কিন্তু চিরবন্ধু বলে খুব বেশি মানুষ থাকেন না। জন্মগতভাবে আওয়ামী লীগের এটি দুর্ভাগ্য_বলতেই হবে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বলেছিলেন, 'বাঙালি চিরদিন দলাদলি করতেই পারে, কিন্তু দল গড়ে তুলতে পারে না।' বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের জন্য এটা একটা অনিবার্য সত্যে পরিণত হয়ে গেছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে স্বীকার করবেন, আওয়ামী লীগ সব সময় পরাজিত হয় নিজেদের ভেতরকার দলাদলির কারণে। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো শীর্ষ নেতা এই দলাদলি চিরকাল চাষাবাদ করে এসেছেন। দিন দিন তা সব ধরনের নীতিবিবর্জিত পরিস্থিতির দিকে পেঁৗছুছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের ভেতর যখন দলাদলি ভয়ংকর অবস্থায় ছিল, তখন শেখ হাসিনাকে সভানেত্রীর দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। এরপর থেকে তাঁর অবিরাম কঠিন পথচলা। জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘাতকরা বারবার তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছে। ইমেজ ধ্বংস করার যত কলাকৌশল আছে, সবই তাঁর বিরুদ্ধে নানাভাবে প্রয়োগ করেছে এবং এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের ভোট ডাকাতির নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা করা হয়। কিন্তু যেখানেই তিনি গিয়েছেন, মানুষের ঢল নেমেছে। আপামর মানুষের ঢল দেখে সরকার শেখ হাসিনার ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা যখন গফরগাঁও গিয়েছিলেন, সেখানে একজন তাঁকে সালাম দিয়েছিল। শুধু এই অপরাধে ওই নিরীহ লোকটির ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তাঁর বাড়িঘর ভেঙেচুরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে সেখানে পুকুর কেটে দেওয়া হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা যখন প্রতিবাদ করেছেন, তখন অনেকেই প্রতিবাদের ভাষা পছন্দ করেননি। মহিমা-পূর্ণিমারা যখন ধর্ষিত হয়, তখন বিবেকবান হিসেবে খ্যাতরা কোনো প্রতিবাদ করেননি। কেউ কেউ এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদেরকে শেখ হাসিনা ছেড়ে কথা বলেন না। তাই বিবেকবান হিসেবে খ্যাতরা অনেক সময় শেখ হাসিনাকে পছন্দ করেন না। বোধ হয় আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে যিনি থাকবেন, তাঁর বিরুদ্ধে কারণে-অকারণে সমালোচনা হবেই। এটা মেনে নিয়েই আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে পথ চলতে হবে।
এবার আসা যাক আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে। প্রতিষ্ঠার পর ৬০ বছরে মাত্র ১০ বছর আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে। যুক্তফ্রন্টের সময় দেড় বছর, স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছর এবং শেখ হাসিনার বিগত সরকারের সময় পাঁচ বছর_এই মোট ১০ বছর আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল। মূলত এই দলটি মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং বিত্তহীনদের আবেগ-ভালোবাসার দল। এই দলের জনসভায় যে পরিমাণ লুঙ্গি পরা মানুষ আসে, সারা পৃথিবীর কোনো সাম্যবাদী দলের জনসভায় এত ভুখা-নাঙা আসে না। ভারতের কংগ্রেস যেমন বলে, তারা 'আদ আদমির দল', তেমনি আওয়ামী লীগও শোষিত-নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষের কথা রেখে সরকার পরিচালনা করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সুসম্পর্ক গড়ে তোলায় তৎকালীন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরাগভাজন হয়েছিল। আমেরিকার পক্ষ থেকে কিউবায় চট রপ্তানি করতে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু জাতির জনক তা মানতে পারেননি; এবং মূলত একটি জনগণতান্ত্রিক সরকার এই আচরণই করবে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর যারা নানাভাবে বেনিফিশিয়ারি হয়েছে, তারা কখনোই এ দলটিকে সমর্থন করতে পারে না। তাই আওয়ামী লীগ যখনই সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পায়, তখনই শুরু হয়ে যায় নানা রকম অন্তর্ঘাতমূলক ষড়যন্ত্র। আজকের আওয়ামী লীগের ছয় দশকের পথপরিক্রমায় এ বিষয়টি মাথায় রেখে দল গঠনে নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন, 'আমরা কেবলই দুঃখ এবং অসুবিধা বহন করি, কিন্তু দায়িত্ব বহন করিতে চাই না।' আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ব বহন করার ইচ্ছা জাগ্রত করা গেলে দেশের অধিকাংশ মানুষ সব সময়ই এই দলের সঙ্গে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রীর গত ভারত সফরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো পারস্পরিক আস্থা অর্জন করা। ভারতের বর্ষীয়ান নেতা অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বলেছেন, 'আমরা বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা শুনেছি; আমরাও আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি।' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্টভাবে বলেছেন, এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান শত্রু দারিদ্র্য। তিনি এই কমন শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছেন। বৈঠকের পর দুই দেশের যৌথ ইশতেহার ঘোষিত হয়। সেখানে ভারতের স্পষ্টত প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে তারা এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয় । বাংলাদেশের মানুষ জানে, এ ব্যাপারে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেননি। আমাদের দেশের মানুষ এখন রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট সচেতন। যেসব রাজনীতিবিদ মানুষকে বোকা ভাবেন, তাঁদের মতো বোকা বোধ হয় আর কেউ নেই।
লেখক : ফার্মাসিস্ট ও রাজনীতিক
svuassingho@gmail.com
বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির অনেকেই এই সমীকরণে বিখ্যাত হয়ে আছেন। ১৪ দলীয় জোটের একজন শ্রদ্ধেয় বড় নেতা জোটের ভেতর এ রকম কথা বলতেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণ-আন্দোলনের। আবার তিনিই 'সাপ্তাহিক ২০০০' পত্রিকায় ছদ্মনামে অন্য ধরনের লেখা লিখতেন। এটা আওয়ামী লীগকে জেনেও না জানার ভান করতে হয়। ওই নেতা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান। আওয়ামী লীগের এই সীমাবদ্ধতা নানা কারণে। হয়তো কোনো কোনো সীমাবদ্ধতা নিয়তির বিধানে লিপিবদ্ধ। এই মাটিতে এত নেতা বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করলেন, অথচ তাঁরাও কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে চলতে পারলেন না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির স্বভাবজাত বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে চিহ্নিত করে গেছেন। চমৎকারভাবে বলেছেন, 'আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি; অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করি।' এ দেশের সুশীল সমাজ সব সময় আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সম্ভব-অসম্ভব সবই প্রত্যাশা করে; কিন্তু আওয়ামী লীগের সামান্য ত্রুটি নিয়ে আকাশ বিদীর্ণ করে।
দীর্ঘকাল যাবৎ বলা হয়েছে, শেখ মুজিব একজন আধা শিক্ষিত নেতা। পণ্ডিত হিসেবে খ্যাত কিছু কিছু ব্যক্তি সব সময় বলতেন, শেখ মুজিব অনেক কিছু না বুঝে করেছেন। অবশ্য এসব গুণীজন না বুঝে শেখ মুজিবের বিরোধিতা করেননি। সেই সময় সরাসরি পাকিস্তানিদের পক্ষ নেওয়াটা ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এবং দৃষ্টিকটু। তাই সেসব পণ্ডিত নানা রকম সাম্যবাদের রাজনীতির কথা বলে শেখ মুজিবের বিরোধিতা করতেন। এই কৌশল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও খুব কার্যকরভাবে অনুসরণ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু খুব গভীরভাবে পাকিস্তানের সাংবিধানিক সমস্যা নিয়ে ভাবতেন এবং সমাধান জানার জন্য পড়াশোনা করতেন। ডেভিড ফ্রস্ট যখন বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, তখন গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ঘুরে দেখেন। তাঁর গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, টেবিলের ওপর রাখা তাঁর স্যার আইভর জেনিংসের 'কনস্টিটিউশনাল প্রবলেমস অব পাকিস্তান' নামক গ্রন্থটি পড়ে থাকতে দেখেন। বইটি তাঁর শিক্ষক জুবেরি তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। বইয়ের ভেতর জুবেরি লিখেছিলেন, 'রাজনীতিকে অবলম্বন করে এগিয়ে যাওয়া যায় ক্ষমতার দিকে; তবে জ্ঞানও হচ্ছে ক্ষমতা।' বঙ্গবন্ধু পরে ফ্রস্টকে বলেছিলেন, যতবার তিনি কারাগারে গেছেন, প্রতিবার এই বই পড়েছেন। তবে এবার আর এই বইটি সঙ্গে নেওয়ার ফুরসত তাঁর হয়নি। প্রকৃত অর্থে দেশকে ভালোবাসতে পারলে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। বিশেষ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একটি অংশ মনে করেছিল, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আর জেলখানার বাইরে আসতে পারবেন না। এই সময়কালে হয়তো আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারাও বিশ্বাস করেছিলেন, আওয়ামী লীগের নিকট-ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। বোধকরি, আওয়ামী লীগ সৃষ্টির পর থেকে এ রকম ঘটনা বহুবার ঘটেছে। তাই এ কথা স্পষ্ট করে বলা যায়, আওয়ামী লীগের চিরশত্রু বলে অনেক মানুষ আছেন এবং থাকবেন; কিন্তু চিরবন্ধু বলে খুব বেশি মানুষ থাকেন না। জন্মগতভাবে আওয়ামী লীগের এটি দুর্ভাগ্য_বলতেই হবে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বলেছিলেন, 'বাঙালি চিরদিন দলাদলি করতেই পারে, কিন্তু দল গড়ে তুলতে পারে না।' বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের জন্য এটা একটা অনিবার্য সত্যে পরিণত হয়ে গেছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে স্বীকার করবেন, আওয়ামী লীগ সব সময় পরাজিত হয় নিজেদের ভেতরকার দলাদলির কারণে। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো শীর্ষ নেতা এই দলাদলি চিরকাল চাষাবাদ করে এসেছেন। দিন দিন তা সব ধরনের নীতিবিবর্জিত পরিস্থিতির দিকে পেঁৗছুছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের ভেতর যখন দলাদলি ভয়ংকর অবস্থায় ছিল, তখন শেখ হাসিনাকে সভানেত্রীর দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। এরপর থেকে তাঁর অবিরাম কঠিন পথচলা। জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘাতকরা বারবার তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছে। ইমেজ ধ্বংস করার যত কলাকৌশল আছে, সবই তাঁর বিরুদ্ধে নানাভাবে প্রয়োগ করেছে এবং এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের ভোট ডাকাতির নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা করা হয়। কিন্তু যেখানেই তিনি গিয়েছেন, মানুষের ঢল নেমেছে। আপামর মানুষের ঢল দেখে সরকার শেখ হাসিনার ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা যখন গফরগাঁও গিয়েছিলেন, সেখানে একজন তাঁকে সালাম দিয়েছিল। শুধু এই অপরাধে ওই নিরীহ লোকটির ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তাঁর বাড়িঘর ভেঙেচুরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে সেখানে পুকুর কেটে দেওয়া হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা যখন প্রতিবাদ করেছেন, তখন অনেকেই প্রতিবাদের ভাষা পছন্দ করেননি। মহিমা-পূর্ণিমারা যখন ধর্ষিত হয়, তখন বিবেকবান হিসেবে খ্যাতরা কোনো প্রতিবাদ করেননি। কেউ কেউ এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদেরকে শেখ হাসিনা ছেড়ে কথা বলেন না। তাই বিবেকবান হিসেবে খ্যাতরা অনেক সময় শেখ হাসিনাকে পছন্দ করেন না। বোধ হয় আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে যিনি থাকবেন, তাঁর বিরুদ্ধে কারণে-অকারণে সমালোচনা হবেই। এটা মেনে নিয়েই আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে পথ চলতে হবে।
এবার আসা যাক আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে। প্রতিষ্ঠার পর ৬০ বছরে মাত্র ১০ বছর আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে। যুক্তফ্রন্টের সময় দেড় বছর, স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছর এবং শেখ হাসিনার বিগত সরকারের সময় পাঁচ বছর_এই মোট ১০ বছর আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল। মূলত এই দলটি মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং বিত্তহীনদের আবেগ-ভালোবাসার দল। এই দলের জনসভায় যে পরিমাণ লুঙ্গি পরা মানুষ আসে, সারা পৃথিবীর কোনো সাম্যবাদী দলের জনসভায় এত ভুখা-নাঙা আসে না। ভারতের কংগ্রেস যেমন বলে, তারা 'আদ আদমির দল', তেমনি আওয়ামী লীগও শোষিত-নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষের কথা রেখে সরকার পরিচালনা করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সুসম্পর্ক গড়ে তোলায় তৎকালীন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরাগভাজন হয়েছিল। আমেরিকার পক্ষ থেকে কিউবায় চট রপ্তানি করতে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু জাতির জনক তা মানতে পারেননি; এবং মূলত একটি জনগণতান্ত্রিক সরকার এই আচরণই করবে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর যারা নানাভাবে বেনিফিশিয়ারি হয়েছে, তারা কখনোই এ দলটিকে সমর্থন করতে পারে না। তাই আওয়ামী লীগ যখনই সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পায়, তখনই শুরু হয়ে যায় নানা রকম অন্তর্ঘাতমূলক ষড়যন্ত্র। আজকের আওয়ামী লীগের ছয় দশকের পথপরিক্রমায় এ বিষয়টি মাথায় রেখে দল গঠনে নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন, 'আমরা কেবলই দুঃখ এবং অসুবিধা বহন করি, কিন্তু দায়িত্ব বহন করিতে চাই না।' আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ব বহন করার ইচ্ছা জাগ্রত করা গেলে দেশের অধিকাংশ মানুষ সব সময়ই এই দলের সঙ্গে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রীর গত ভারত সফরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো পারস্পরিক আস্থা অর্জন করা। ভারতের বর্ষীয়ান নেতা অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বলেছেন, 'আমরা বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা শুনেছি; আমরাও আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি।' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্টভাবে বলেছেন, এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান শত্রু দারিদ্র্য। তিনি এই কমন শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছেন। বৈঠকের পর দুই দেশের যৌথ ইশতেহার ঘোষিত হয়। সেখানে ভারতের স্পষ্টত প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে তারা এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয় । বাংলাদেশের মানুষ জানে, এ ব্যাপারে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেননি। আমাদের দেশের মানুষ এখন রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট সচেতন। যেসব রাজনীতিবিদ মানুষকে বোকা ভাবেন, তাঁদের মতো বোকা বোধ হয় আর কেউ নেই।
লেখক : ফার্মাসিস্ট ও রাজনীতিক
svuassingho@gmail.com
No comments