আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব by চৌধুরী আফতাবুল ইসলাম
খুব ভোরে রূপবতী বাংলার পথে আমি পরিব্রাজক। হাঁটছি। কালো-আলোর মিশেলে ম্লান উজ্জ্বলতার আশ্চর্য শান্ত জগৎ। বৃষ্টিধারায় স্নান সেরে রুক্ষ মাটি ফিরিয়ে দিয়েছে স্নিগ্ধ সবুজ। শ্যামলিমা সমর্পিত জমি তাই খুব খুশি খুশি। পুরো বাংলা যেন ধান-বাগান। মৃদু বাতাসে কচি পাতার হুল্লোড়।
ওদের ফাঁক গলে উঁকি মারে চকচকে জল। সেখানে চলছে ফিঙে আর শালিকের অসময়ের গোসল। বৃষ্টির নবধারায় পুষ্ট ঝিলের বুকে নুয়ে পড়ে মুখ দেখছে আগাছারা। বাতাসের আঁচলে ধানের পাতা, কুন্দ, রাখালশসা, ধুতরা আর বৃষ্টিভেজা মাটির ঘ্রাণ। যেমন, প্রিয় আমার মায়ের শাড়ির গন্ধ। নেশা ধরিয়ে দেয়। তালগাছগুলো স্থির। ঝিঙেফুলে মৌমাছির রাজ্যের ব্যস্ততা। এভাবেই চলে নরম আলোয় বাংলা নামের কনে দর্শন। হাজার বছর ধরে আমরা পথ হাঁটছি পৃথিবীর পথে...। প্রিয় বাংলার অনেক রূপের একাংশ এটি। এমন অজস্র অপার্থিব সৌন্দর্যে আমরা আত্মস্থ, নিবেদিত।
আদিম সময়ের পৃথিবীর প্রাকৃতিক পাঠশালায় ছিল অনেক ক্লাস। স্থানভেদে কালের ভিন্নতায় সেসব শিক্ষালয়ে গড়ে উঠেছিল বহুমাত্রিক সভ্যতা। একসময় গড়ে ওঠে প্রকৃতিতে সমর্পিত মন-মনন। এরপর আসে মনোভাব প্রকাশের তাগিদ। খোঁজ চলে প্রকাশের উপায়। এগোয় বিশ্বের নানা প্রান্তে আপন আপন ভাষার ইতিহাস। প্রথমে শরীরী ভাষা, তারপর সচেতন ইঙ্গিত, পরের ধাপে অর্থহীন ধ্বনি, অর্থবহ ধ্বনি, শব্দ, ভাষা। অবশেষে তার লিখিত প্রকাশলিপি। এই ভাষার ভেলাতেই এগোয় সভ্যতা, ঋদ্ধ হয় সংস্কৃতি। যেমন, হায়ারোগি্লফিককে সঙ্গী করে মিসর, রুনিকলিপির হাত ধরে জার্মানি, লাতিন আলফা-বিটা-গামা-ডেলটার আশ্রয়ে গ্রিক সভ্যতা, পিক্টোরিয়াললিপিতে চীন আর ব্রাহ্মী, খরোষ্টি নিয়ে আমাদের যাত্রা। এভাবেই ক্রমবিবর্তন। প্রকৃতি পরিবেশই এখানে শিক্ষক। এই ধারাতেই পলিমাটির গন্ধ, দুরন্ত বাতাস, ফল-ফুল-ফসলের রূপ-মাধুর্য, নদীর প্রবহমানতার ছন্দে গড়ে উঠেছে আরেক মানস জগৎ, যার প্রকাশ বাঙালিয়ানায়। প্রকৃতি-পরিবেশই বানিয়ে দিয়েছে ভিন্ন এক সংস্কৃতি, জীবনাচরণের মঞ্চ। একে বিসর্জন দিয়ে নয়, এগোতে হবে এই নিজস্বতাকে ধারণ করেই। পহেলা বৈশাখ সেই শপথের দিন। বাঙালিয়ানার যাবতীয় নিজস্বতা আর আপন ভাষা-ঐতিহ্যের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশের প্রতীকী উৎসব।
আজ পহেলা বৈশাখ। চিত্রার্পিত বাংলার ষড়ঋতুর সবচেয়ে বদমেজাজি সময় গ্রীষ্মের সূচনা দিন। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের নিদাঘ দুপুর, তপ্ত রোদ, বাতাসের সন্ত্রাস, কালবৈশাখী- এসব এখন গা-সওয়া। এসব আচরণ প্রকৃতির যৌবনি ট্রেড মার্ক। তবে এমন মেজাজি চরিত্রের হলেও গ্রীষ্ম তথা বাংলা নববর্ষের সূচনা পর্বটি কিন্তু দারুণ প্রসন্ন। রাতদুপুরে হর্ন বাজিয়ে, হল্লা করে, পটকা ফাটিয়ে, ঘুমতাড়ানি হামলায় বাংলা নববর্ষ আসেন না। ইনি খুব ভোরবেলা রাগ ভৈরবির ভেলায় চড়ে, স্নিগ্ধ আলোর ধারায় প্রশান্ত হাসিমুখে হাজির হন। সুতরাং বাংলা নববর্ষ ইংরেজির তুলনায় ঢের বেশি ভদ্রলোক।
আমি বাঙালি থাকব, না বিশ্ব নাগরিক হব- এ এক জটিল প্রশ্ন এখন। যুক্তি-তর্কের চেনা শৃঙ্খলায় এর কোনো উত্তর হয় না। সাইবার স্পেস, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, স্যাটেলাইট, জিপিএস, সেলফোন, নিয়ন লাঞ্ছিত হোর্ডিং, সর্বত্র বিশ্বায়নের উদ্যাপন, উসকানি। অথচ এই হুল্লোড় সময়েও বাঙালিয়ানার পক্ষে বাঙালির নিরঙ্কুশ রায়। কারণ যত ব্যস্ত সময় আর আন্তর্জাতিকতার সুনামি চলুক না কেন- সময়, প্রকৃতি, ঐতিহ্য কী এক নিবিড়তায় যেন ছুঁয়ে থাকে জীবনকে; যার আহ্বান মানুষ এড়াতে পারে না। টেমস, ভল্গা, আমাজন টানে ঠিকই কিন্তু মনের গভীরে নিরন্তর বয়ে চলে ধানসিঁড়ির চোরা স্রোত। সে কারণেই আজ ১৪১৯ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন সারা বাংলায় থাকবে নিজস্ব উৎসবের নিপাট আয়োজন, যাতে শামিল সব-সব মানুষ। প্রান্তিক সংস্কৃতির জয়জয়কার আজ নাগরিক উঠোনে। বাংলা নববর্ষ মানে নিজস্বতা, আপন ঐতিহ্যের প্রতি সমর্পণ, বিশ্বায়নের শেকড় উপড়ানো ঘূর্ণিবার্তাকে ঠেলে দূরে সরানো, বাঙালি জাতি দর্শনের একমাত্র সর্বজনীন ঠিকানা। সে জন্যই পুরো জাতি আজ উৎসবের মেজাজে। বাড়ির অন্দরমহল থেকে পথ-প্রান্তর আজ নানা আয়োজনের রঙিন মঞ্চ। মণ্ডা-মিঠাই, মুড়ি-মুড়কি, ইলিশ-পান্তা, বারোয়ারি মেলা, হালখাতা আর বাউল গানের লোকজ সুরে মাতবে পুরো জাতি বরণ উৎসবে। সব বাঙালিই আজ খোদ শিল্পী তাঁদের নিজ নিজ উৎসব মঞ্চে। আর গর্বের কথা, আমাদের নতুন প্রজন্ম যাবতীয় জাতীয় আর লোকজ উৎসব আয়োজনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। বাংলা-বাংলাদেশ তাদের রক্তস্রোতে, অস্থিমজ্জায়। সর্বগ্রাসী আন্তর্জাতিকতার প্রবল উৎপাতের মধ্যেও বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রতি এমন নিমগ্নতা আমাদের আশাবাদী করে।
'তোমার যেখানে সাধ চলে যাও- আমি এই বাংলার পারে
রয়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে...।'
আদিম সময়ের পৃথিবীর প্রাকৃতিক পাঠশালায় ছিল অনেক ক্লাস। স্থানভেদে কালের ভিন্নতায় সেসব শিক্ষালয়ে গড়ে উঠেছিল বহুমাত্রিক সভ্যতা। একসময় গড়ে ওঠে প্রকৃতিতে সমর্পিত মন-মনন। এরপর আসে মনোভাব প্রকাশের তাগিদ। খোঁজ চলে প্রকাশের উপায়। এগোয় বিশ্বের নানা প্রান্তে আপন আপন ভাষার ইতিহাস। প্রথমে শরীরী ভাষা, তারপর সচেতন ইঙ্গিত, পরের ধাপে অর্থহীন ধ্বনি, অর্থবহ ধ্বনি, শব্দ, ভাষা। অবশেষে তার লিখিত প্রকাশলিপি। এই ভাষার ভেলাতেই এগোয় সভ্যতা, ঋদ্ধ হয় সংস্কৃতি। যেমন, হায়ারোগি্লফিককে সঙ্গী করে মিসর, রুনিকলিপির হাত ধরে জার্মানি, লাতিন আলফা-বিটা-গামা-ডেলটার আশ্রয়ে গ্রিক সভ্যতা, পিক্টোরিয়াললিপিতে চীন আর ব্রাহ্মী, খরোষ্টি নিয়ে আমাদের যাত্রা। এভাবেই ক্রমবিবর্তন। প্রকৃতি পরিবেশই এখানে শিক্ষক। এই ধারাতেই পলিমাটির গন্ধ, দুরন্ত বাতাস, ফল-ফুল-ফসলের রূপ-মাধুর্য, নদীর প্রবহমানতার ছন্দে গড়ে উঠেছে আরেক মানস জগৎ, যার প্রকাশ বাঙালিয়ানায়। প্রকৃতি-পরিবেশই বানিয়ে দিয়েছে ভিন্ন এক সংস্কৃতি, জীবনাচরণের মঞ্চ। একে বিসর্জন দিয়ে নয়, এগোতে হবে এই নিজস্বতাকে ধারণ করেই। পহেলা বৈশাখ সেই শপথের দিন। বাঙালিয়ানার যাবতীয় নিজস্বতা আর আপন ভাষা-ঐতিহ্যের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশের প্রতীকী উৎসব।
আজ পহেলা বৈশাখ। চিত্রার্পিত বাংলার ষড়ঋতুর সবচেয়ে বদমেজাজি সময় গ্রীষ্মের সূচনা দিন। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের নিদাঘ দুপুর, তপ্ত রোদ, বাতাসের সন্ত্রাস, কালবৈশাখী- এসব এখন গা-সওয়া। এসব আচরণ প্রকৃতির যৌবনি ট্রেড মার্ক। তবে এমন মেজাজি চরিত্রের হলেও গ্রীষ্ম তথা বাংলা নববর্ষের সূচনা পর্বটি কিন্তু দারুণ প্রসন্ন। রাতদুপুরে হর্ন বাজিয়ে, হল্লা করে, পটকা ফাটিয়ে, ঘুমতাড়ানি হামলায় বাংলা নববর্ষ আসেন না। ইনি খুব ভোরবেলা রাগ ভৈরবির ভেলায় চড়ে, স্নিগ্ধ আলোর ধারায় প্রশান্ত হাসিমুখে হাজির হন। সুতরাং বাংলা নববর্ষ ইংরেজির তুলনায় ঢের বেশি ভদ্রলোক।
আমি বাঙালি থাকব, না বিশ্ব নাগরিক হব- এ এক জটিল প্রশ্ন এখন। যুক্তি-তর্কের চেনা শৃঙ্খলায় এর কোনো উত্তর হয় না। সাইবার স্পেস, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, স্যাটেলাইট, জিপিএস, সেলফোন, নিয়ন লাঞ্ছিত হোর্ডিং, সর্বত্র বিশ্বায়নের উদ্যাপন, উসকানি। অথচ এই হুল্লোড় সময়েও বাঙালিয়ানার পক্ষে বাঙালির নিরঙ্কুশ রায়। কারণ যত ব্যস্ত সময় আর আন্তর্জাতিকতার সুনামি চলুক না কেন- সময়, প্রকৃতি, ঐতিহ্য কী এক নিবিড়তায় যেন ছুঁয়ে থাকে জীবনকে; যার আহ্বান মানুষ এড়াতে পারে না। টেমস, ভল্গা, আমাজন টানে ঠিকই কিন্তু মনের গভীরে নিরন্তর বয়ে চলে ধানসিঁড়ির চোরা স্রোত। সে কারণেই আজ ১৪১৯ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন সারা বাংলায় থাকবে নিজস্ব উৎসবের নিপাট আয়োজন, যাতে শামিল সব-সব মানুষ। প্রান্তিক সংস্কৃতির জয়জয়কার আজ নাগরিক উঠোনে। বাংলা নববর্ষ মানে নিজস্বতা, আপন ঐতিহ্যের প্রতি সমর্পণ, বিশ্বায়নের শেকড় উপড়ানো ঘূর্ণিবার্তাকে ঠেলে দূরে সরানো, বাঙালি জাতি দর্শনের একমাত্র সর্বজনীন ঠিকানা। সে জন্যই পুরো জাতি আজ উৎসবের মেজাজে। বাড়ির অন্দরমহল থেকে পথ-প্রান্তর আজ নানা আয়োজনের রঙিন মঞ্চ। মণ্ডা-মিঠাই, মুড়ি-মুড়কি, ইলিশ-পান্তা, বারোয়ারি মেলা, হালখাতা আর বাউল গানের লোকজ সুরে মাতবে পুরো জাতি বরণ উৎসবে। সব বাঙালিই আজ খোদ শিল্পী তাঁদের নিজ নিজ উৎসব মঞ্চে। আর গর্বের কথা, আমাদের নতুন প্রজন্ম যাবতীয় জাতীয় আর লোকজ উৎসব আয়োজনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। বাংলা-বাংলাদেশ তাদের রক্তস্রোতে, অস্থিমজ্জায়। সর্বগ্রাসী আন্তর্জাতিকতার প্রবল উৎপাতের মধ্যেও বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রতি এমন নিমগ্নতা আমাদের আশাবাদী করে।
'তোমার যেখানে সাধ চলে যাও- আমি এই বাংলার পারে
রয়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে...।'
No comments