নারী উত্ত্যক্তকরণ-আসুন, ওদের ঘৃণা করি by ইয়াসমীন আরা

বেশ দেরিতে হলেও ইভ টিজিংকে যৌন হয়রানি হিসেবে চিহ্নিত করে একটি কঠোর আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে সংবাদপত্র সূত্রে জানা গেছে। এই আইন অনুযায়ী, ইভ টিজিংয়ের জন্য সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অপরাধটিকে অজামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবে ধরা হয়েছে। বর্তমানে আইনটি সংসদে পাস হওয়ার অপেক্ষাধীন।


তবে কবে নাগাদ আইনটি পাস হবে বা এর প্রয়োগ কবে হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ইভ টিজিংয়ের প্রকোপ থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য কঠোর আইন এবং এর প্রয়োগের বিষয়টি বহুদিন ধরে আলোচিত হয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত সরকার এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে গেছে, এটা খুবই আশার কথা। তবে জনগণের মঙ্গলের জন্য দ্রুত এই আইনটি পাস করে তা প্রয়োগ করা জরুরি।
বর্তমানে সমাজের একটি বড় ব্যাধি হলো নারী উত্ত্যক্তকরণ। গত কয়েক মাসে সামাজিক এই ব্যাধির প্রকোপ বেড়েছে। নাটোরে উত্ত্যক্তকারীদের হাতে শিক্ষক মিজানুর রহমান ও ফরিদপুরে এক মায়ের মৃত্যুর ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এরপর সারা দেশে আন্দোলন, প্রতিবাদ হলেও বখাটে ও পীড়নকারীদের দৌরাত্ম্য কমেনি। রাজশাহীতে আদিবাসী মেয়ে সিরাপিনা ও রংপুরে এসএসসি পরীক্ষার্থী রুমার আত্মহত্যার ঘটনা সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও সরকার ও প্রশাসন উত্ত্যক্তকারীদের ব্যাপারে তুলনামূলক কঠোর অবস্থান নিয়েছে। উত্ত্যক্তকারীদের তাৎক্ষণিক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় উত্ত্যক্তকারী ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের এক শিক্ষককে তাৎক্ষণিক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়। উত্ত্যক্তকারীদের কারাদণ্ড হচ্ছে, জরিমানা হচ্ছে, সেই সংবাদও ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বেশ ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে, কিন্তু উত্ত্যক্তকারীরা এসবের তোয়াক্কা করছে না। তারা একের পর এক অঘটন ঘটিয়ে চলছে। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে নিয়ে উত্ত্যক্তকারীদের হাতে জীবন দিতে হয়েছে সন্তানের বাবা-মা, ভাইবোন, শিক্ষিক-শিক্ষিকাসহ অনেক আত্মীয়স্বজনকে। অনেকে আহত, নিহত ও অপমানিত হয়েছেন, শুধু অপরাধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে।
যৌন নিপীড়কদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, সেটা এখনই ভাবতে হবে সমাজে বসবাসকারী সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে। এ ধরনের সমস্যা যদি সমাজে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে, তাহলে যে কেউ এ ধরনের অপকর্মের শিকার হতে পারেন। তাই সমাজের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই অপকর্ম প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যারা এর শিকার হচ্ছে তারা ছাড়া আশপাশের অনেকেই এর প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সন্ত্রাসী ও বখাটেদের সম্পর্ক, ছাত্র ও যুবসমাজের ওপর সন্ত্রাসীদের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার। সমাজে নারী উত্ত্যক্তকারীদের সামাজিকভাবে বয়কটের বিষয়টি জোর দিয়ে ভাবতে হবে। পরিবার বা আত্মীয়স্বজন এ ধরনের অপরাধীদের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে পারেন। এদের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগও বন্ধ করে দিতে পারেন তাঁরা। সমাজপতিরা প্রতি সপ্তাহে নিজেদের মধ্যে সভা করে তাঁদের নিজের সমাজের সব ছেলের খোঁজখবর রাখতে পারেন। সমাজের যে ছেলেটি এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হবে, তাকে একঘরে করতে পারেন। ওই অপরাধীর বিরুদ্ধে জোট বেঁধে তাকে আইনের হাতে তুলে দিতে পারেন এবং নিয়মিত এসব বিষয়ে মনিটর করতে পারেন। দেশের প্রতিটি স্কুল ও কলেজে এ বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি অপরাধীদের বোঝাতে হবে, তাদের সঙ্গে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজের লোকজন কেউ নেই। তাহলে হয়তো তারা নিজেদের বদলানোর বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবে। আইনজীবীরাও এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। ুএর পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের একজন অপরাধী যখন দেখবে যে তার জন্য আদালতে কথা বলার মতো কোনো লোক নেই, তখন সে বিষয়টি আমলে নিতেও পারে।
পরিবারই হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যাপীঠ, সেখান থেকে বাবা-মা সচেতনভাবে সন্তানকে শিক্ষা দেবেন। মনে রাখতে হবে, এই সমাজের একজন হিসেবে সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষেরই আমাদের প্রত্যেকের ওপর হক বা অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার পূরণে আজ আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
সরকারের আইন বা প্রশাসন কর্তৃক এর প্রয়োগের পাশাপাশি সমাজের অন্যায়-অবিচার রুখতে সমাজের মানুষদেরও দায়িত্ব রয়েছে। সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য আইনের পাশাপাশি সমাজের প্রত্যেক মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে নারী উত্ত্যক্তকরণের মতো জঘন্য অপরাধ রুখতে।
এর পাশাপাশি নারী উত্ত্যক্তকরণের কারণ এবং সমাজে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া নিয়েও গবেষণা অত্যন্ত জরুরি। ধর্মীয়, সামাজিক মূল্যবোধ এবং আইনশৃঙ্খলার পরিবেশ না থাকলে হয়তো পশু ও মানুষের ভেতরে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যেত না। তাই এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধের জন্য একদিকে মানুষকে মানবিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে; অন্যদিকে কঠোর আইন প্রয়োগ করার মাধ্যমে ইভ টিজারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ড. ইয়াসমীন আরা: ডিন, স্কুল অব এডুকেশন অ্যান্ড ফিজিক্যাল এডুকেশন, উত্তরা ইউনিভার্সিটি।

No comments

Powered by Blogger.