বহে কাল নিরবধি-জাপানের পারমাণবিক বিপর্যয় ও আইনস্টাইনের সতর্কবাণী by এম আবদুল হাফিজ
আমাদের প্রচারমাধ্যম সচরাচর সরব হলেও জাপানের সাম্প্রতিক 'চেরনোবিল মুহূর্ত নিয়ে' অপ্রত্যাশিতভাবে নিরুদ্বেগ। এ দেশেও পারমাণবিক চুলি্লর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা অন্ততপক্ষে আলোচনায় আছে। জাপানের চলমান পারমাণবিক বিপর্যয় সংবাদের উপাদান হিসেবে সংবাদপত্রে এলেও বিশেষ জ্ঞ পর্যায়ে তা কোনো টকশো অথবা বিদ্যুৎ
ঘাটতিকবলিত বাংলাদেশে তার জন্য পারমাণবিক চুলি্ল নির্ভরতার সমস্যাসংক্রান্ত বিতর্কে উঠে আসেনি। এমনকি প্রাকৃতিক বা যেকোনো দুর্যোগে ভাগ্যবাদীরা বা ষড়যন্ত্রের সূত্রে বিশ্বাসীরাও নীরব। যদিও তারা কয়েক বছর আগে প্যাসিফিকে ভূমিকম্প বা শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও সুমাত্রায় বিধ্বংসী সুনামির জন্য ওয়াশিংটনকে দায়ী করে অভিযোগ উত্থাপন করতে কালক্ষেপণ করেনি।
জাপানের এঙ্পার্টরা এখনো জনগণকে নিশ্চিত করে যাচ্ছেন যে ফুকুসিমার তেজস্ক্রিয়া বিকিরণ আরেকটি চেরনোবিলে পরিণত হবে না। কেননা জাপানের চুলি্লগুলো ধারণপাত্রের অভ্যন্তরে রয়েছে। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত রিপাবলিক ইউক্রেনে ১৯৮৬ সালে যে চুলি্লটি দুর্ঘটনায় নিপতিত হয়েছিল, তার এমন কোনো বহিরাবরণ ছিল না। কিন্তু একটি হতাশার সময়ে একজনের আশাবাদ পোষণ করা ছাড়া উপায়ান্তর থাকে না। সুতরাং এখন পর্যন্ত জাপানি বিশেষজ্ঞদের অভিমতই গ্রহণীয়। কিন্তু যদি কোনো একটি চুলি্ল বিস্ফোরিত হয়, তার দূষণ বা সংক্রমণ হবে মারাত্মক। তার তেজস্ক্রিয়া শুধু জাপানের ভৌগোলিক সীমায়ই আবদ্ধ থাকবে না, জাপানের বাইরে তা রাশিয়া, চীন, কোরিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার অনেক অংশেই ছড়িয়ে পড়বে।
আমরা যেন ভুলে না যাই যে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত বোমার যে তেজস্ক্রিয়া বিকিরিত হয়েছিল, তারও এক শ গুণের অধিক বিকিরণ ঘটেছিল চেরনোবিলের নির্গমনে। বলা হয়ে থাকে যে একটি মাত্র পারমাণবিক চুলি্লর তেজস্ক্রিয়ায় অর্ধেক পৃথিবী দূষিত করার নিধন ক্ষমতা রাখে। ফ্রান্সের পারমাণবিক সেফটি অথরিটি এএসএন (অঝঘ) তাদের ক্ষতি পরিমাপের মাত্রা এক থেকে সাতের মধ্যে, ফুকুসিমার তেজস্ক্রিয়তাকে ছয়ের কোটায় রেখেছে। এই পরিমাপক কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় চেরনোবিল বিপর্যয় সর্বোচ্চ মাত্রায়ই উঠেছিল।
ফুকুসিমা ডাইল্চি ফ্যাসিলিটিতে ১০টি চুলি্ল আছে। ভাগ্যক্রমে সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ও সুনামির সময় এর মধ্যে মাত্র তিনটি সক্রিয় ছিল। তবে বিস্ফোরণের আভাস পাওয়া গেছে শুধু এক এবং তিন নম্বর চুলি্ল থেকে। বিলম্বিত সংবাদ অনুযায়ী দুই নম্বর চুলি্লটিও বিস্ফোরিত হয়েছে। আরো দুর্ভাবনার বিষয় এই যে ফুকুসিমা কমপ্লেঙ্রে অদূরে আরো পারমাণবিক চুলি্লর উপস্থিতি ভয়াবহতার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। জাপানের এই পারমাণবিক ট্র্যাজেডি জাপানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিস্তৃত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। যদি তা হয়, তবে ধরে নিতে হবে যে পারমাণবিক অপশন শান্তিপূর্ণ বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত হলেও যেকোনো পর্যায়ে বা সময়ে তা বিধ্বংসী রূপ ধারণ করতে পারে। চেরনোবিল দুর্ঘটনার দায়িত্ব অনেকটাই চাপানো হয়েছিল অনগ্রসর সোভিয়েত পারমাণবিক প্রযুক্তির ওপর, যদিও তা সর্বৈব সত্য ছিল না। কিন্তু জাপান তো প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত অগ্রসর এবং নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের। পশ্চাৎপদ দেশের মোল্লাদের মতো জাপানিরা তো আর 'বিধাতার অভিশাপ' তাদের ওপর নিপতিত হওয়ার অপেক্ষায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেনি, বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য তাদের ষোলো আনা প্রস্তুতিই ছিল। উল্লেখ্য, জাপানের ঘরবাড়ির স্থাপত্যেও প্রকৃতির প্রচণ্ডতম ঝাঁকুনি সয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বিবেচনায় রাখা হয়।
আন্তর্জাতিক পরিমাপকের মাত্রা-৯ ভূমিকম্প, যা গত ১১ মার্চে জাপানের উডবাংসকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তা সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকের পর সবচেয়ে শক্তিশালী ভূকম্পন। কিন্তু শুধু এই ভূকম্পনই জাপানকে বিপর্যস্ত করেনি বা নিউক্লিয়ার সংকটের উদ্ভাব ঘটায়নি। জাপানের ধ্বংসলীলার সিংহভাগই ঘটেছে সুনামির কারণে। সাত মিটার জলোচ্ছ্বাস (সুনামি), যা জেট ইঞ্জিনের বেগে ছুটে এসেছে এবং ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে_সেটাও ছিল একইভাবে বিধ্বংসী। তবে সুনামি জাপানের জন্যই নির্দিষ্ট কোনো দুর্যোগ নয়। বিশ্বের যেকোনো স্থানে প্রকৃতি বন্য রূপ ধারণ করলে এই বিপর্যয় সর্বত্রই ঘটতে পারে। জাপানেও সেই নিয়মেই সুনামিও ঘটেছে। তবে সুনামির প্রভাব ভয়ংকর হতে পারে যদি তার সঙ্গে পারমাণবিক বিস্ফোরণের সংকট যুক্ত হয়, যেমনটি জাপানে হয়েছে। সত্তরের দশকে তাবৎ পৃথিবীতে মাত্র ৩৫টি পারমাণবিক চুলি্ল ছিল। এখন তার সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৩৩৮টিতে। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই আছে ১০৪টি পারমাণবিক চুলি্ল। তার কারণও রয়েছে। এই পরাশক্তিকে চাহিদার ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে হয় পারমাণবিক উৎস থেকে।
জাপানকেও তার বিদ্যুৎ চাহিদার ৩০ শতাংশ মেটাতে হয় পারমাণবিক উৎস থেকে, যার জোগান দেয় দেশের ১৩টি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টস। সর্বত্রই এই পারমাণবিক চুলি্লগুলো কোনো না কোনোভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। আজ ভূমিকম্প ও সুনামির পর পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা বিস্তারকে ঘিরে জাপানে যা ঘটছে, পারমাণবিক উৎস থেকে বিদ্যুৎ সংগ্রহকারী যেকোনো দেশে তা ঘটতে পারে। এমন দুর্ঘটনা ঘটার জন্য কারণেরও অভাব নেই। হঠাৎ বন্যা, কোনো বিশাল বাঁধে ফাটল, ভূমিকম্প, সুনামি, প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা বা মানবিক ভ্রমে এমনটা ঘটতে পারে।
জানা যায় যে ফুকুসিমার প্লান্টগুলো অত্যন্ত পুরনো। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই নাকি সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। চেরনোবিলে ছিল পুরনো যন্ত্রাংশ, নিম্নমানের সংরক্ষণ। তবে এঙ্পার্টদের মতে, সর্বোত্তম সংরক্ষণের পরও পারমাণবিক চুলি্ল থেকে বিদ্যুৎ আহরণ কখনো এক শ ভাগ নিরাপদ নয়। যেকোনো যন্ত্র বা যান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধার সততা ভেঙে পড়ার বা অকার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা পূর্ণ।
প্রযুক্তিবান্ধব ও প্রযুক্তিতে অগ্রসর সুইডেনের মতো দেশেও গত বছর একটি পারমাণবিককেন্দ্রে দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর বাজেটে নতুন চুলি্ল নির্মাণ বাবদ ৩৬ বিলিয়ন ডলার প্রস্তাব করেছেন। বস্তুত সুইডেন থেকে ইংল্যান্ড, ব্রাজিল থেকে ইরাক, ভারত ও ইসরায়েল সর্বত্রই এই পারমাণবিক শক্তি নির্ভরতা। এদের সবাই শুধু পরমাণু অপশনে যাচ্ছে না, এই বাবদ তারা তাদের ব্যয়ের পরিমাণও বাড়িয়ে চলেছে। আমরা বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশগুলো পরমাণুর ব্যবহার থেকে তাৎক্ষণিক ফায়দাই নিতে চাই। কিন্তু এর কুফলগুলো, যেমন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বা নিদেনপক্ষে পারমাণবিক বর্জ্যের কথা বিবেচনায়ই আনতে চাই না। পারমাণবিক খণ্ডাংশ বা সমগ্র যন্ত্রটি যতই সুরক্ষিত রাখা যাক সেগুলো থেকে তেজস্ক্রিয়তা বিকিরিত হতেই থাকবে এবং এই সতত বিকিরণের প্রক্রিয়াতেই নিহিত এগুলোর বর্জ্য, যা শুধু এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবিশেষের জন্য ক্ষতিকরই নয়, পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
এঙ্পার্টদের মতে, মাত্র ১০০০ মেগাওয়াটের চুলি্ল বছরে ৫০০ পাউন্ড প্লুটোনিয়াম তৈরিতে সক্ষম। এভাবে তৈরি মাত্র ১০ পাউন্ড প্লুটোনিয়াম বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট, যা একটি বৃহৎ নগরীকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে। বিশ্বের কোনো দেশই পরমাণুকে হাত দ্বারা স্পর্শ এবং স্থানান্তর, সংরক্ষণ ইত্যাদির সমস্যার সমাধান দিতে পারেনি। এই সমাধান কোনো দিন বেরিয়ে আসারও সম্ভাবনা নেই। আংকল স্যাম সেই ১৯৪৫ সালের আগাম হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানোর আগেই আলবার্ট আইনস্টাইন আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
তাঁর কথায়, "আমাদের এই গ্রহ চিন্তার অতীত এক মহাসংকটের দিকে ধাবমান। তা থেকে আমরা পরিত্রাণ পাব কি না নির্ভর করছে, যারা এই মহাসংকট তৈরিতে সক্ষম তারা কী সিদ্ধান্ত নেবে_সেই সিদ্ধান্ত কী ভালো বা মন্দের জন্য হবে। 'এটম'-এর অন্তর্নিহিত শক্তি একবার মুক্ত হতে পারলে তা আমাদের চিন্তার পরিবর্তন ছাড়া আর সব কিছু বদলে দিতে সক্ষম। ফলে আমরা সম্প্রবাহে অবর্ণনীয় এক সর্বনাশের দিকে ধাবিত হব।" ১৯৪৬ সালেই এ সন্ন্যাসীসদৃশ বৃদ্ধ সারা বিশ্বের কাছে যেকোনো আকার, আয়তন বা পরিমাণের পারমাণবিক শক্তি বর্জনের মিনতি জানিয়ে আসছিলেন। এও বলেছিলেন যে নতুবা আমাদের অস্তিত্বের অবসান অবধারিত।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
ও কলামিস্ট
জাপানের এঙ্পার্টরা এখনো জনগণকে নিশ্চিত করে যাচ্ছেন যে ফুকুসিমার তেজস্ক্রিয়া বিকিরণ আরেকটি চেরনোবিলে পরিণত হবে না। কেননা জাপানের চুলি্লগুলো ধারণপাত্রের অভ্যন্তরে রয়েছে। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত রিপাবলিক ইউক্রেনে ১৯৮৬ সালে যে চুলি্লটি দুর্ঘটনায় নিপতিত হয়েছিল, তার এমন কোনো বহিরাবরণ ছিল না। কিন্তু একটি হতাশার সময়ে একজনের আশাবাদ পোষণ করা ছাড়া উপায়ান্তর থাকে না। সুতরাং এখন পর্যন্ত জাপানি বিশেষজ্ঞদের অভিমতই গ্রহণীয়। কিন্তু যদি কোনো একটি চুলি্ল বিস্ফোরিত হয়, তার দূষণ বা সংক্রমণ হবে মারাত্মক। তার তেজস্ক্রিয়া শুধু জাপানের ভৌগোলিক সীমায়ই আবদ্ধ থাকবে না, জাপানের বাইরে তা রাশিয়া, চীন, কোরিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার অনেক অংশেই ছড়িয়ে পড়বে।
আমরা যেন ভুলে না যাই যে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত বোমার যে তেজস্ক্রিয়া বিকিরিত হয়েছিল, তারও এক শ গুণের অধিক বিকিরণ ঘটেছিল চেরনোবিলের নির্গমনে। বলা হয়ে থাকে যে একটি মাত্র পারমাণবিক চুলি্লর তেজস্ক্রিয়ায় অর্ধেক পৃথিবী দূষিত করার নিধন ক্ষমতা রাখে। ফ্রান্সের পারমাণবিক সেফটি অথরিটি এএসএন (অঝঘ) তাদের ক্ষতি পরিমাপের মাত্রা এক থেকে সাতের মধ্যে, ফুকুসিমার তেজস্ক্রিয়তাকে ছয়ের কোটায় রেখেছে। এই পরিমাপক কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় চেরনোবিল বিপর্যয় সর্বোচ্চ মাত্রায়ই উঠেছিল।
ফুকুসিমা ডাইল্চি ফ্যাসিলিটিতে ১০টি চুলি্ল আছে। ভাগ্যক্রমে সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ও সুনামির সময় এর মধ্যে মাত্র তিনটি সক্রিয় ছিল। তবে বিস্ফোরণের আভাস পাওয়া গেছে শুধু এক এবং তিন নম্বর চুলি্ল থেকে। বিলম্বিত সংবাদ অনুযায়ী দুই নম্বর চুলি্লটিও বিস্ফোরিত হয়েছে। আরো দুর্ভাবনার বিষয় এই যে ফুকুসিমা কমপ্লেঙ্রে অদূরে আরো পারমাণবিক চুলি্লর উপস্থিতি ভয়াবহতার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। জাপানের এই পারমাণবিক ট্র্যাজেডি জাপানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিস্তৃত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। যদি তা হয়, তবে ধরে নিতে হবে যে পারমাণবিক অপশন শান্তিপূর্ণ বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত হলেও যেকোনো পর্যায়ে বা সময়ে তা বিধ্বংসী রূপ ধারণ করতে পারে। চেরনোবিল দুর্ঘটনার দায়িত্ব অনেকটাই চাপানো হয়েছিল অনগ্রসর সোভিয়েত পারমাণবিক প্রযুক্তির ওপর, যদিও তা সর্বৈব সত্য ছিল না। কিন্তু জাপান তো প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত অগ্রসর এবং নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের। পশ্চাৎপদ দেশের মোল্লাদের মতো জাপানিরা তো আর 'বিধাতার অভিশাপ' তাদের ওপর নিপতিত হওয়ার অপেক্ষায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেনি, বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য তাদের ষোলো আনা প্রস্তুতিই ছিল। উল্লেখ্য, জাপানের ঘরবাড়ির স্থাপত্যেও প্রকৃতির প্রচণ্ডতম ঝাঁকুনি সয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বিবেচনায় রাখা হয়।
আন্তর্জাতিক পরিমাপকের মাত্রা-৯ ভূমিকম্প, যা গত ১১ মার্চে জাপানের উডবাংসকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তা সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকের পর সবচেয়ে শক্তিশালী ভূকম্পন। কিন্তু শুধু এই ভূকম্পনই জাপানকে বিপর্যস্ত করেনি বা নিউক্লিয়ার সংকটের উদ্ভাব ঘটায়নি। জাপানের ধ্বংসলীলার সিংহভাগই ঘটেছে সুনামির কারণে। সাত মিটার জলোচ্ছ্বাস (সুনামি), যা জেট ইঞ্জিনের বেগে ছুটে এসেছে এবং ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে_সেটাও ছিল একইভাবে বিধ্বংসী। তবে সুনামি জাপানের জন্যই নির্দিষ্ট কোনো দুর্যোগ নয়। বিশ্বের যেকোনো স্থানে প্রকৃতি বন্য রূপ ধারণ করলে এই বিপর্যয় সর্বত্রই ঘটতে পারে। জাপানেও সেই নিয়মেই সুনামিও ঘটেছে। তবে সুনামির প্রভাব ভয়ংকর হতে পারে যদি তার সঙ্গে পারমাণবিক বিস্ফোরণের সংকট যুক্ত হয়, যেমনটি জাপানে হয়েছে। সত্তরের দশকে তাবৎ পৃথিবীতে মাত্র ৩৫টি পারমাণবিক চুলি্ল ছিল। এখন তার সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৩৩৮টিতে। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই আছে ১০৪টি পারমাণবিক চুলি্ল। তার কারণও রয়েছে। এই পরাশক্তিকে চাহিদার ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে হয় পারমাণবিক উৎস থেকে।
জাপানকেও তার বিদ্যুৎ চাহিদার ৩০ শতাংশ মেটাতে হয় পারমাণবিক উৎস থেকে, যার জোগান দেয় দেশের ১৩টি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টস। সর্বত্রই এই পারমাণবিক চুলি্লগুলো কোনো না কোনোভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। আজ ভূমিকম্প ও সুনামির পর পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা বিস্তারকে ঘিরে জাপানে যা ঘটছে, পারমাণবিক উৎস থেকে বিদ্যুৎ সংগ্রহকারী যেকোনো দেশে তা ঘটতে পারে। এমন দুর্ঘটনা ঘটার জন্য কারণেরও অভাব নেই। হঠাৎ বন্যা, কোনো বিশাল বাঁধে ফাটল, ভূমিকম্প, সুনামি, প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা বা মানবিক ভ্রমে এমনটা ঘটতে পারে।
জানা যায় যে ফুকুসিমার প্লান্টগুলো অত্যন্ত পুরনো। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই নাকি সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। চেরনোবিলে ছিল পুরনো যন্ত্রাংশ, নিম্নমানের সংরক্ষণ। তবে এঙ্পার্টদের মতে, সর্বোত্তম সংরক্ষণের পরও পারমাণবিক চুলি্ল থেকে বিদ্যুৎ আহরণ কখনো এক শ ভাগ নিরাপদ নয়। যেকোনো যন্ত্র বা যান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধার সততা ভেঙে পড়ার বা অকার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা পূর্ণ।
প্রযুক্তিবান্ধব ও প্রযুক্তিতে অগ্রসর সুইডেনের মতো দেশেও গত বছর একটি পারমাণবিককেন্দ্রে দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর বাজেটে নতুন চুলি্ল নির্মাণ বাবদ ৩৬ বিলিয়ন ডলার প্রস্তাব করেছেন। বস্তুত সুইডেন থেকে ইংল্যান্ড, ব্রাজিল থেকে ইরাক, ভারত ও ইসরায়েল সর্বত্রই এই পারমাণবিক শক্তি নির্ভরতা। এদের সবাই শুধু পরমাণু অপশনে যাচ্ছে না, এই বাবদ তারা তাদের ব্যয়ের পরিমাণও বাড়িয়ে চলেছে। আমরা বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশগুলো পরমাণুর ব্যবহার থেকে তাৎক্ষণিক ফায়দাই নিতে চাই। কিন্তু এর কুফলগুলো, যেমন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বা নিদেনপক্ষে পারমাণবিক বর্জ্যের কথা বিবেচনায়ই আনতে চাই না। পারমাণবিক খণ্ডাংশ বা সমগ্র যন্ত্রটি যতই সুরক্ষিত রাখা যাক সেগুলো থেকে তেজস্ক্রিয়তা বিকিরিত হতেই থাকবে এবং এই সতত বিকিরণের প্রক্রিয়াতেই নিহিত এগুলোর বর্জ্য, যা শুধু এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবিশেষের জন্য ক্ষতিকরই নয়, পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
এঙ্পার্টদের মতে, মাত্র ১০০০ মেগাওয়াটের চুলি্ল বছরে ৫০০ পাউন্ড প্লুটোনিয়াম তৈরিতে সক্ষম। এভাবে তৈরি মাত্র ১০ পাউন্ড প্লুটোনিয়াম বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট, যা একটি বৃহৎ নগরীকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে। বিশ্বের কোনো দেশই পরমাণুকে হাত দ্বারা স্পর্শ এবং স্থানান্তর, সংরক্ষণ ইত্যাদির সমস্যার সমাধান দিতে পারেনি। এই সমাধান কোনো দিন বেরিয়ে আসারও সম্ভাবনা নেই। আংকল স্যাম সেই ১৯৪৫ সালের আগাম হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানোর আগেই আলবার্ট আইনস্টাইন আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
তাঁর কথায়, "আমাদের এই গ্রহ চিন্তার অতীত এক মহাসংকটের দিকে ধাবমান। তা থেকে আমরা পরিত্রাণ পাব কি না নির্ভর করছে, যারা এই মহাসংকট তৈরিতে সক্ষম তারা কী সিদ্ধান্ত নেবে_সেই সিদ্ধান্ত কী ভালো বা মন্দের জন্য হবে। 'এটম'-এর অন্তর্নিহিত শক্তি একবার মুক্ত হতে পারলে তা আমাদের চিন্তার পরিবর্তন ছাড়া আর সব কিছু বদলে দিতে সক্ষম। ফলে আমরা সম্প্রবাহে অবর্ণনীয় এক সর্বনাশের দিকে ধাবিত হব।" ১৯৪৬ সালেই এ সন্ন্যাসীসদৃশ বৃদ্ধ সারা বিশ্বের কাছে যেকোনো আকার, আয়তন বা পরিমাণের পারমাণবিক শক্তি বর্জনের মিনতি জানিয়ে আসছিলেন। এও বলেছিলেন যে নতুবা আমাদের অস্তিত্বের অবসান অবধারিত।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
ও কলামিস্ট
No comments