রঞ্জিতের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই?-মানুষরতন

কারও কাছে তিনি দিনমজুর, কারও তিনি শিক্ষক। দিনমজুরি করেন বলেই কি করতে পারেন শিক্ষকতা? নাকি শিক্ষকতা করার জন্যই খেটে মরেন ইটভাটায়? সব প্রশ্নের একটিই উত্তর—তিনি উচ্চশিক্ষিত কিন্তু গরিব এবং অসম্ভব সৎ। দারিদ্র্য বাস্তবে কাউকে মহান করে কি না, সন্দেহ। কিন্তু এই মানুষটি একজন দরিদ্র ও মহান শিক্ষক।


তিনি শুধু বিনা বেতনে মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, তা-ই নয়, শেষ সম্বল পৈতৃক ১৫ শতাংশ জমিও দান করে দিয়েছেন সেই মাদ্রাসায়। তাঁকে কেবল মানুষ বললে কম বলা হয়, তিনি মানুষরতন।
কোন পরিচয়ে ডাকা যায় ৩৬ বছর বয়সী রঞ্জিত কুমার রায়কে? শিক্ষক না মজুর? মাটি পুড়ে ইট হয়, আর অভাবে পুড়তে পুড়তে তিনি হয়েছেন ইটভাটার শ্রমিক। দিনমজুরির শেষে তিনি করেন শিক্ষকতা, আর বেতনহীন শিক্ষকতার শেষে দিনমজুরিই তাঁর ও তাঁর পরিবারের বাঁচার উপায়। স্নাতক পাসের পর চাকরি নেন স্থানীয় এক মাদ্রাসায়। কিন্তু সেই মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত নয় বলে শিক্ষকদের বেতন দিতে পারে না। তবু এক নয়, দুই নয়, ১১টি বছর তিনি বিনা বেতনে পড়িয়ে যাচ্ছেন সেই মাদ্রাসায়। সরকার শিশুদের জন্য বিনা বেতনে শিক্ষার ব্যবস্থা করলেও সব শিক্ষকের বেতনের নিশ্চয়তা আজও অর্জিত হয়নি। অথচ তাঁদেরও খেতে হয়, খাওয়াতে হয় স্ত্রী-সন্তানকে। শিক্ষকতা মহান পেশা বলে সবাই মহিমা দেন, কিন্তু বেতন দেওয়ার যখন কাউকে পাওয়া যায় না, তখন কী করবেন সেই শিক্ষক? কেউ পেশা ছেড়ে দেন, কেউ প্রাইভেট টিউশনি করেন, কেউ পাশাপাশি করেন ব্যবসা। কিন্তু ইটভাটার দিনমজুরির কাজই রঞ্জিতের সম্বল। দিনের অর্ধেকটা ইট বহন করেন, বাকি অর্ধেকটায় করেন শিক্ষকতা।
রঞ্জিতের এই দুঃখভরা জীবন আমাদের লজ্জিত করে, ছোট করে দেয়। তাঁর উপজেলায় কি কোনো হূদয়বান মানুষ নেই? সরকারি শিক্ষা কর্মকর্তারা কি একেবারেই অক্ষম? সর্বোপরি স্থানীয় সাংসদ মহাশয়েরও কি দায়িত্ব ছিল না এ রকম একজন শিক্ষকের ত্যাগের প্রতিদান দেওয়ার, একটু সম্মান দেওয়ার? যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ রকম এক মানুষরতন আছেন, সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে পুরস্কৃতই করা উচিত। উচিত কাজটা অনেক সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা করেন না, করেন সাধারণ কেউ। রঞ্জিত রায় সে রকমই এক সাধারণ জন, কিন্তু তাঁর অবদান অসাধারণ। যিনি শিক্ষার সম্মান রেখেছেন, শ্রমের মর্যাদা হাড়ে হাড়ে শোধ করেছেন, তাঁর পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই? সরকার ও সমাজের কি কেউ এই মহৎ মানুষটির প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়াবে না?

No comments

Powered by Blogger.