শনিবারের সুসংবাদ-দেশি ধানে নিদান দূর by শামস শামীম

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার অংশবিশেষের হাওর অঞ্চল ধান উৎপাদনের বড় ক্ষেত্র। হাওর এলাকার একফসলি এই বিশাল জমি প্রতিবছরই সবুজ ধানগাছে সুশোভিত হয়। ফলে বিপুল পরিমাণ ধান। কিন্তু বিরূপ প্রকৃতি এ ক্ষেত্রে কৃষকের বড় শত্রু।


আগাম প্রবল বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল প্রায় বছরই কেড়ে নেয় এ ফসল। এ অবস্থায় এক বছর ঘরে তুলতে পারা ফসলে চলতে হয় কয়েক বছর। সে জন্য এখানকার প্রান্তিক কৃষকদের অভাব পুরোপুরি দূর হয় না।
প্রতিবছরই বোরো ধান কাটার আগ মুহূর্তে হাওরের প্রান্তিক, আধিভাগা ও অসচ্ছল কৃষকরা বিপাকে পড়ে যান। ক্ষেতে ধান পাকতে যত দেরি, ততই প্রলম্বিত হতে থাকে অভাবের দিন। এ অবস্থায় অভাব কিছুটা প্রশমিত করতে কৃষকদের নজর থাকে আগাম দেশি ধানের দিকে। উদ্দেশ্য, বৃষ্টি আর ঢলের পানির আগ্রাসনের আগেই ধান ঘরে তোলা যায়।
চলতি বছরে হাওর অঞ্চলে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। আর এই সোনার ফসল হারানোর আশঙ্কায় হাওরবাসীর চোখে ঘুম নেই। তাদের অপেক্ষার সময় কাটছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। এই সময়টাতে আকাশের মেঘ ভর করে হাওর অঞ্চলের কৃষকের মুখেও।
সুখের কথা হলো, হাওর অঞ্চলে এবার আগাম দেশি বোরো ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। অভাবী কৃষকরা এই ধানের সংসারের নিদান দূর করছেন। ভাঁড়ারের গেলবারের ধান ফুরিয়ে গেছে। শেষ হয়ে গেছে ঘরের খাবার। এ অবস্থায় এই দেশি ধান আসা মানে বাড়তি আনন্দ ভর করে কৃষক পরিবারে। দেশি ধান দিয়েই তারা বোরোর স্বাদ নেয়।
বহুজাতিক কম্পানির হাইব্রিড ও উফশী ধানের পাশাপাশি প্রতিবছর নিদান সময়ের জন্যই কৃষকরা দেশি ধানের চাষ করেন।
তাঁদের যুক্তি, হাইব্রিড ও উফশী ধানের চেয়ে ফলন তুলনামূলক কম হলেও ঝড়-জল-বানে ফসলহানির আশঙ্কা দেখা দেওয়ার আগেই এ ধান পেকে যায়। তাই অন্য ধান কাটার এক সপ্তাহ বা দশ দিন আগেই তাঁরা দেশি ধানে খাবার চাহিদা মেটান। দেড় দশক আগে কৃষকরা বোরো ক্ষেতে দেশি ধান লাগালেও এখন চৈত্র মাসের শেষ ও বৈশাখের শুরুতে খাবারের নিদান (সংকট) দূর করতে কিছু জমিতে দেশি ধান চাষ করেন।
সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সবুজের খোলস ভেঙে বোরো ধান ধীরে ধীরে সোনারং নিচ্ছে। উত্তুরে হাওয়ায় ধানের শীষের সঙ্গে শীষকাটা শনশন সুর হাওরের বিশাল বুকে এক অন্য রকম আবহ তৈরি করেছে। দেশি বোরো ধান বাদে হাইব্রিড ও উফশী ধান কাটা এখনো শুরু হয়নি। তাই বলে কৃষকরা বসে নেই। হাওরের জাঙ্গালে কান্দায় ফসল তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন কিষান-কিষানিরা। ফসল তুলতে তৈরি হচ্ছে ধানখোলা ও খুপরিঘর। তবে বরাবরের মতোই উফশী ও হাইব্রিড ধান পেছনে ফেলে দেশি বোরো ধান আগাম পেকে যাওয়ায় মনের আনন্দে সেই ধান কাটছেন কৃষকরা। এ ধানেই তাঁরা চৈত্রের নিদান (খাবার সংকট) কাটিয়ে বোরোর প্রথম স্বাদ নেবেন।
সুনামগঞ্জ সদরের দেখার হাওরপাড়ের গ্রাম হালুয়ারগাঁওসংলগ্ন বিছরাতলা (দেখার হাওরের একটি অংশ) হাওরে গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, কয়েকটি স্থানে দেশি ধান কাটছেন কৃষকরা। তাঁরা জানান, ঘরের খাবার শেষ হয়ে গেছে। চৈত্র মাসের শেষের দিক থেকে বৈশাখের শুরু বা মাঝামাঝি পর্যন্ত যে খাদ্য সংকট দেখা দেয় তা দূর করতে দেশি ধান চাষ করেন তাঁরা। তুলনামূলক ফলন কম হলেও দেশি ধান চাষে পরিশ্রম ও খরচ কম লাগে। সবচেয়ে বড় কথা, এই ধান আগাম পাকে।
হালুয়ারগাঁও গ্রামের কৃষক আবদুল করিমকে দেখা গেল দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া সন্তান হোসেন আহমদসহ আরো পাঁচজন ধানকাটা শ্রমিক নিয়ে দেশি বোরো ধান কাটছেন। তিনি জানান, ঘরের খাবার শেষ হয়ে গেছে। এই দেশি ধানে খাবার সংকট দূর করবেন। তাঁর ২৫০ শতক জমির মধ্যে মাত্র ৩০ শতক জমিতে যে দেশি ধান লাগিয়েছিলেন তা এখন কাটা হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'দেশি ধান দিয়েই সপরিবারে বৈশাখের প্রথম আহার সারব।' তবে বাকি জমিতে যে হাইব্রিড ও উফশী ধান লাগিয়েছিলেন তা পাকতে আরো সাত থেকে ১০ দিন সময় লাগবে বলে তিনি জানান। তবে এই সময়টাতে বড় ধরনের বৃষ্টি বা পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কা তাঁকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
একই গ্রামের একটু দূরে দেখা যায়, কৃষক নজির হোসেন দেশি ধান কাটছেন। তিনিও দেশি ধান দিয়ে খাবারের নিদান দূর করতে ধান চাষ করেছিলেন এবং এখন কেটে সেই সংকট দূর করবেন। নজরুল জানান, কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের লোকের পরামর্শ, পত্রিকা ও টিভিতে বিজ্ঞাপনের কারণে তিনি তাঁর জমিতে হাইব্রিড ও উফশী ধান চাষ করছেন। তবে প্রান্তিক অভাব দূর করতে নিজের প্রায় ৩০০ শতক বোরো জমির মধ্যে মাত্র ২০ শতক জমিতে দেশি ধান লাগিয়েছিলেন।
একই এলাকার কৃষক কমর উদ্দিন জানান, ঝড় আর জল-বানের আগে দেশি ধান পেকে যায়। ফসলহানির আশঙ্কা না থাকায় এই ধান আগাম পেকে গিয়ে কৃষকের খাবার সংকটও দূর করে। তবে ফলন কমের কারণে এবং এই ধানের বীজ সরকারিভাবে সরবরাহ না করায় দেশি ধান চাষের প্রতি অনেকেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন।
সুনামগঞ্জ কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এস এম আফসারুজ্জামান বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে এক লাখ ৯২ হাজার হেক্টরের মধ্যে ১২ হাজার ১৬৫ হেক্টর জমিতে দেশি ধান চাষ হয়েছে। বাকি জমিতে হাইব্রিড ও উফশী ধান চাষ হয়েছে। দেশি ধান আগাম পাকে এবং বন্যামুক্ত থাকার পরও কম ফলনের কারণে কৃষকরা তা চাষ করতে নিরুৎসাহী। যেটুকু আবাদ হয় তা কেবলই চৈত্রের শেষাংশ থেকে বৈশাখের প্রথম ভাগ পর্যন্ত দেখা দেওয়া অভাব দূর করতে।

No comments

Powered by Blogger.