স্বাগত ১৪১৯ বঙ্গাব্দ-মুক্তি মিলনেই by করুণাময় গোস্বামী

স্বাগত ১৪১৯ বঙ্গাব্দ। নববর্ষ সবার জন্য শুভ হোক এবং কোটি কোটি বাঙালি প্রাণ নববর্ষের আহ্বানে মিলিত হোক। মিলনেই মুক্তি। মিলন বন্ধনকে দৃঢ় করে। অনৈক্য নির্মূল করে। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষ অতিক্রান্ত হলো। পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যে কটি বই ও কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে কয়েকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে


দেখা যাচ্ছে। একটি বিষয় হচ্ছে সুখ, হ্যাপিনেস। সুখ ব্যাপারটা কী, কিভাবে সুখ বস্তুটিকে পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কী ভাবছেন, প্রাচীন ভারতের ঋষিরা কী ভেবেছিলেন, সেসব ভাবনাকে অতি ভোগপরায়ণ মানুষের কাছে কিভাবে উপস্থাপন করা যায় এবং রবীন্দ্রনাথ যে ঋষিবাক্যকে শিরোধার্য করেছিলেন, ত্যাগ দ্বারাই ভোগ করতে শেখো- এই বার্তাকে কিভাবে ত্যাগবিমুখ মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়, সে ব্যাপারে রবীন্দ্রভাবনাকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। উৎপাদন ও বিপণনপ্রক্রিয়ানির্ভর অর্থনীতির মনের কথাটি হচ্ছে মানুষকে ভোগমুখী করে তোলা। সে কারণে প্রচার-প্রচারণার জন্য যা করা দরকার, উদ্যোক্তারা তা-ই করবেন। মানুষ যদি ত্যাগী হয়ে যায়, তাহলে ভোগবাদী অর্থনীতির কী হবে? কিন্তু চিন্তাশীল মানুষরা দেখতে পাচ্ছেন, ভোগের উন্মাদনা একটা গন্তব্যহীন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেটাকে সামাল দেওয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে মিলন-ভাবনা প্রচারের জন্য। যোগাযোগের উপায় যতই বিস্তৃত হচ্ছে, মানুষ যতই স্থান থেকে স্থানান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে, ততই দেখা যাচ্ছে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। মানুষে-মানুষে সংঘর্ষের প্রবণতা বাড়ছে। বিশ্ব মানবসমাজ মিলেমিশে বসবাস করতে পারবে কি পারবে না, এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কারণ দেখা দিচ্ছে। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রচিন্তাকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের নানা সাধনার মধ্যে প্রধান একটি বিষয় ছিল মানুষে-মানুষে মিলন সাধন। বলতে গেলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির বহু উদ্যোগের মধ্যে সে ছিল একটি। ১৮৬৮ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রাজনারায়ণ বসুর প্রেরণায় একটি দেশাত্মবোধক গান লেখেন, তখন তাঁর মূল আহ্বানটি ছিল মিলনের, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান যেন মিলিতভাবে দেশব্রতে কাজ করে, সে ছিল তাঁর একান্ত আহ্বান। রবীন্দ্রনাথ তখন সাত বছরের বালক। এই গান থেকেই শুরু হয় মিলনগানের দীর্ঘ ধারা, সে মিলন হিন্দু-মুসলমানের মিলন। রবীন্দ্রনাথ নিজ কর্মে ও সাধনায় মেজদার এই আহ্বানকে আরো গভীর এবং আরো প্রসারিত করে তোলেন। তিনি স্বদেশি মিলনচিন্তাকে বিশ্ব পটভূমিতে সংস্থাপন করেন এবং মিলিত মানব অস্তিত্বের গৌরব সম্পর্কে যেকোনো সুযোগে গভীর আবেগ দিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রচিন্তার এই মিলনবাদী দিকটির দিকে পশ্চিমের চিন্তাবিদদের বিশেষ উৎসাহ নিতে দেখা যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের বৃহৎ মিলন-ভাবনার একটি দিক হচ্ছে তাঁর উৎসব-ভাবনা। মানুষকে উৎসবের ভেতর দিয়ে একত্র করা, এই বোধ জাগানো যে আমরা একত্রে আছি, একত্রে থাকাই আমাদের জন্য মঙ্গল। রবীন্দ্রনাথের উৎসব-দর্শন সম্পর্কে কিছু লেখা ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। তারই সূত্রে বর্তমান লেখার অবতারণা।
শারদোৎসব ঋতুনাট্য বলে কথা নয়, রবীন্দ্রনাথ অজস্রভাবে চেষ্টা করেছেন মানুষে-মানুষে মিলন সাধনের চেষ্টাকে কিভাবে সফল করে তোলা যায়। শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালায়, ধর্ম প্রবন্ধমালায়, বিপুলসংখ্যক গানে-কবিতায়-প্রবন্ধে, পত্রে-অভিভাষণে তিনি ভারতবর্ষে মানুষে-মানুষে মিলন ও বিশ্বমানুষের মিলন নিয়ে কথা বলেছেন। মিলনের উপায় হিসেবে তিনি শিক্ষার কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল পুরস্কার গ্রহণ উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে অন্য কোনো বিষয়ে কথা না বলে শুধু শিক্ষা এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলন নিয়ে কথা বলেছেন। উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে তিনি ভাবতেন, সে যেন মানুষকে মিলিত করে। মিলনের প্রথম পর্যায়টি হচ্ছে জানা, একে অন্যকে জানা চাই, শিক্ষা যেন সেই জানার উপায় হয়। একে অন্যের জন্য শ্রদ্ধা। শিক্ষা যেন পারস্পরিক শ্রদ্ধা সৃজনের উপায় হয়। শিক্ষার ভেতর দিয়ে প্রাচ্য যেন পাশ্চাত্যকে জানে, পাশ্চাত্য যেন প্রাচ্যকে জানে। উভয়ই যে মহত্তম মূল্যবোধকে আদর্শ হিসেবে মানছে, সে জায়গায় তারা যে এক, এই বোধ যেন উচ্চশিক্ষা গড়ে দিতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয় যেন বিশ্বশিক্ষার কেন্দ্র হয়, বিশ্বশিক্ষা যেন মানুষকে বিশ্বমনস্ক করে। বিশ্বমানুষের মিলন যেন সম্ভব হয়।
বিবাদ-বিচ্ছেদ যখন একটা হানাহানির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে গেছে, পাশ্চাত্য যখন অসহনশীল হয়ে উঠছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ক্রমে ক্রমে পাশ্চাত্যে মানুষের সহাবস্থানের যেটুকু সম্ভাবনা গড়ে উঠছিল, তাও যখন ছিন্নভিন্ন হতে চলেছে, তখন অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছেন। রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করার অর্থ এই নয় যে তিনি মানব মিলন সম্পর্কে যা ভেবেছেন বা যেমন কার্যসূচি গ্রহণ করেছেন, অবিকল তেমন ভাবা যাবে বা করা যাবে, কিন্তু তিনি একটি মডেল হিসেবে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁকে অনুসরণ করা দরকার সৃজনশীলভাবে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই সৃজনের ক্ষেত্রটিকে অসামান্য গুরুত্ব দিয়েছেন। সৃজনের ক্ষেত্রটি সত্যি সত্যি অসামান্য মূল্যবান। বাংলাদেশে নববর্ষ পালনের চালক প্রেরণা রবীন্দ্রনাথ। একটি ধর্মনিরপেক্ষ মানব মিলনমঞ্চ রচনার জন্যই ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে ছায়ানট এই অনুষ্ঠানের সূচনা করে। ঠিক রবীন্দ্রনাথ নববর্ষ পালনের যে উদ্দেশ্য স্থির করেছিলেন তাকে শিরোধার্য করেই। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে তাতে নানা সৃজনশীল মাত্রা যুক্ত হয়েছে, সময় যত এগোবে তাতে আরো নানা সৃজনশীল মাত্রা যোজিত হবে, মানুষের মিলন এই সৃজনের ভেতর দিয়েই সার্থক হতে থাকবে।
বাংলাদেশ বলে কথা নয়, বিশ্বজুড়েই মানব মিলনমঞ্চ রচনার কাজ জোরদার থেকে জোরদার করে তোলা প্রয়োজন। নরওয়েতে ব্রেইভিক যে হত্যাকাণ্ড ঘটাল এবং এর ভেতর দিয়ে যে বার্তা প্রচার করল, সেই বার্তা কিন্তু অগ্রাহ্য হয়নি। ফ্রান্সের নির্বাচনে সেই বার্তা কাজ করছে বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ ব্রেইভিক ভাবানুসারীদের মন পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারেন, পাশ্চাত্য আজ এই বিশ্বভাবুক রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করতে চাইছে। আমাদের উচিত হবে এই মিলনব্রতী কবিকে সামনে নিয়ে আসার যথাসাধ্য চেষ্টা করা।
রবীন্দ্রনাথের শারদোৎসব ঋতুনাট্য ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হয়। শান্তিনিকেতন আশ্রমে শারদোৎসব অভিনয় উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ এই নাটকের 'ভিতরের কথাটি' সম্পর্কে জানান : 'আগামী ছুটির পূর্বরাত্রে আশ্রমে শারদোৎসব অভিনয়ের প্রস্তাব হইয়াছে। তাহার বাহিরের ধারণাটি ছেলেদের বুঝিবার পক্ষে কঠিন নহে, কেবল তাহার ভিতরের কথাটি হয়তো ছেলেরা ঠিক বোঝে না। বিশেষ বিশেষ ফুলে-ফলে হাওয়ায়-আলোকে আকাশে-পৃথিবীতে বিশেষ বিশেষ ঋতুর উৎসব চলিতেছে। সেই উৎসব মানুষ যদি অন্যমনস্ক হইয়া অন্তরের মধ্যে গ্রহণ না করে তবে সে পার্থিব জীবনের একটি বিশুদ্ধ এবং মহৎ আনন্দ হইতে বঞ্চিত হয়। মিলন ঠিকমত ঘটিলেই, অর্থাৎ তাহা কেবলমাত্র হাটের মেলা বাটের মেলা না হইলে সেই মিলন নিজেকে কোনো-না-কোনো উৎসব আকারে প্রকাশ করে। মিলন যেখানেই ঘটে, অর্থাৎ বহুর ভিতরকার মূল ঐক্যটি যেখানেই ধরা পড়ে, যাহারা বাহিরে পৃথক বলিয়া প্রতীয়মান হয় তাহাদের অন্তরের নিত্য সম্বন্ধ যেখানেই উপলব্ধ হয়, সেখানেই সৃষ্টির অহেতুক অনির্বচনীয় লীলা প্রকাশ পায়। বহুর বিচিত্র ঐক্যসম্বন্ধই সৃষ্টি। মানুষ যেখানে বিচ্ছিন্ন সেখানে তাহার সৃজনকার্য দুর্বল। সভ্যতা শব্দের অর্থই এই, মানুষের মিলনজাত একটি বৃহৎ জগৎ- এই জগতের ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট বিধিব্যবস্থা ধর্মকর্ম শিল্প সাহিত্য আমোদ-আহ্লাদ সমস্তই একটি বিরাট সৃষ্টি। এই সৃজনের মূল শক্তি মানুষের সত্য সম্বন্ধ। মানুষ যেখানে বিচ্ছিন্ন, যেখানে বিরুদ্ধ, সেখানে তাহার সৃজনকার্য নিস্তেজ। সেখানে সে কেবল কলে চালানো পুতুলের মতো চিরাভ্যাসের পুনরাবৃত্তি করিয়া চলে, আপন জ্ঞান প্রাণ প্রেমকে নব নব আকারে প্রকাশ করে না। মিলনের শক্তিই সৃজনের শক্তি।'
'মানুষ যদি কেবলমাত্র মানুষের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করিত তবে লোকালয়ই মানুষের একমাত্র মিলনের ক্ষেত্র হইত। কিন্তু মানুষের জন্ম তো কেবল লোকালয়ে নহে, এই বিশাল বিশ্বে তাহার জন্ম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে তাহার প্রাণের গভীর সম্বন্ধ আছে। তাহার ইন্দ্রিয়বোধের তারে তারে প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের স্পন্দন নানা রূপে রসে জাগিয়া উঠিতেছে। বিশ্বপ্রকৃতির কাজ আমাদের প্রাণের মহলে আপনিই চলিতেছে। কিন্তু মানুষের প্রধান সৃজনের ক্ষেত্র তাহার চিত্তমহলে। এই মহলে যদি দ্বার খুলিয়া আমরা বিশ্বকে আহ্বান করিয়া না লই, তবে বিরাটের সঙ্গে আমাদের পূর্ণ মিলন ঘটে না। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে আমাদের চিত্তের মিলনের অভাব আমাদের মানব প্রকৃতির পক্ষে একটা প্রকাণ্ড অভাব। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের উৎসব ঘরে ঘরে বারে বারে ঘটিতেছে। কিন্তু প্রকৃতির সভায় ঋতু উৎসবের নিমন্ত্রণ যখন গ্রহণ করি তখন আমাদের মিলন আরো অনেক বড়ো হইয়া উঠে। প্রকৃতির মধ্যে যখন কেবল আছি মাত্র তখন তাহা না থাকারই শামিল, কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের প্রাণমনের সম্বন্ধ অনুভবেই আমরা সৃজনক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য লাভ করি, চিত্তের দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখিলে আপনার মধ্যে এই সৃজনশক্তিকে কাজ করিবার বাধা দেওয়া হয়।'

লেখক : গবেষক ও শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.