বিদ্যুৎ-পরমাণুশক্তি: বিকল্প ভাবনা by জিয়া উদ্দিন আহমেদ

আমাদের দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎশক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে, কিন্তু যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অনালোচিত সেটি হলো, আমাদের জীবতাত্ত্বিক বাস্তবতা, অর্থাৎ দেশের জনঘনত্ব। আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি অনুসারে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে আগ্রহী দেশকে বিশদ ও পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হয়।


পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশে জনবসতির ঘনত্ব, বিস্তৃতি, মানুষের কর্মকাণ্ড ইত্যাদি স্থান পায় সে নীতিমালায়। এসব বিবেচনায় রেখে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ এলাকা অর্থাৎ ৩.১৪(৩০)২= দুই হাজার ৮২৬ বর্গকিলোমিটার বৃত্তাকার একটি এলাকাকে তিনটি বৃত্তাকার অংশে ভাগ করা হয়। জোন-১ চুল্লি এলাকা, জোন-২ নিরাপত্তা এলাকা, জোন-৩ বিপর্যয় পরিকল্পনা এলাকা। জোন-১ চুল্লি এলাকা এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বা ৩.১৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি বৃত্ত। এই এলাকা কেবল চুল্লি পরিচালনা-সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহূত হয়। এখানে চুল্লি-কর্মচারী ছাড়া অন্য কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে না; এখানে অন্যদের প্রবেশাধিকার কঠোরভাগে নিয়ন্ত্রিত। জোন-২ নিরাপত্তা এলাকা স্থাপনা কেন্দ্র থেকে পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের, অর্থাৎ মোট আয়তন ৩.১৪(৫)২=৭৮.৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা। এই এলাকায় ঘন জনবসতি থাকবে না, এমন কোনো স্থাপনা থাকবে না যেখানে অনেক মানুষের যাতায়াত আছে। এবং এই এলাকায় ব্যাপক উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ড থাকবে না (নিবিড় চাষাবাদ, শিল্প-স্থাপনা ইত্যাদি)। এই জোনে স্থায়ী বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা হবে মাত্র ২০০ জন (প্রতি বর্গকিলোমিটারে তিনজন)। জোন-৩ বিপর্যয় পরিকল্পনা এলাকা স্থাপনাকেন্দ্র থেকে ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ-বিস্তৃত; এখানে বিশদ উদ্ধার পরিকল্পনা থাকবে জননিরাপত্তার জন্য। এমন জনবসতি থাকবে না, যা উদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। চেরনোবিল রিঅ্যাক্টরের ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ এলাকা প্রায় জনবসতিশূন্য। আমাদের দেশে একটি চেরনোবিল ধরনের বিস্ফোরণ হলে আশপাশে ৫০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ এলাকা অর্থাৎ ৩.১৪(৫০)২=৭৮৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা থেকে লোকজন সরিয়ে নিতেই হবে। প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজার ২০০ মানুষের বসবাস হলে এই এলাকার প্রায় এক কোটি মানুষ সরিয়ে নিতে হবে।
বিভিন্ন দেশ নিজস্ব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এবং দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে এসব নিয়মাবলির সামান্য কিছু পরিবর্তন করতে পারে। ভারতে রয়েছে চারটি জোন—স্থাপনা এলাকা ব্যাসার্ধ ০.৫ কিলোমিটার, তারপর ১.৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ নিষিদ্ধ জোন। সেখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ এলাকা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে অনপত্য জোন, যেখানে স্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি অনুমোদিত কিন্তু পরিকল্পিত। তারপর ১৬ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ বিস্তৃত বিপর্যয় পরিকল্পনা এলাকা। উল্লিখিত তিনটি জোনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অবস্থান যে বিশেষ সমস্যাসংকুল তাতে সন্দেহ নেই। রিঅ্যাক্টর স্থাপনের জন্য স্থান পাওয়া যাবে, কিন্তু জোন-২ যে পরিমাণ স্থানের নির্দেশনা দেয়, অর্থাৎ ৭৮.৫ বর্গকিলোমিটার এবং যেখানে জনসংখ্যা সর্বমোট ২০০ হবে, এমন স্থান বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সমতল অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। জোন-৩ বা জরুরি পরিকল্পনা জোনের মোট আয়তন হবে দুই হাজার ৮২৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা। বর্তমানে জনবসতি প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজার ২০০ হলে এই পরিমাণ স্থানে জনসংখ্যা আমাদের দেশে হবে প্রায় ৩৪ লাখ। ভারতের বর্তমানে চালু মোট নয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রায় সবগুলোই জনবিরল এলাকায় স্থাপিত।
আমাদের দেশে পাবনা জেলার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা হয় ১৯৬১ সালে। ১২০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে সেখানে কেবল চুল্লি বসানোর জন্য প্রয়োজন ৩১৪ হেক্টর জমি। এ ছাড়া রয়েছে জোন-২ ও জোন-৩ এলাকা। পাঁচ দশকেও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কোথায় মূল সমস্যা? রূপপুর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সীমান্ত থেকে খুব দূরে নয়, আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জোন-৩ ভারত সীমান্তের কিছু এলাকায় বিস্তৃত হতে পারে। সীমান্ত এলাকায় জনবসতি কম, এ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই এলাকায় কৃষিকর্ম নিবিড়।
আমাদের জন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎশক্তির যৌক্তিকতার নিরাবেগ মূল্যায়ন আজও করা হয়নি। সন্দেহ নেই, বিশাল জনসম্পদের পূর্ণ ব্যবহার কেবল শিল্পায়নের মাধ্যমেই সম্ভব, সে জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তির। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ পরমাণুশক্তির মাধ্যমেই হতে হবে, এমন নয়।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান জীবতাত্ত্বিক বাস্তবতা আমাদের বিপক্ষে। বিদ্যুতের ব্যবস্থা আমাদের বিকল্প পথেই সুবিধা হবে। এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন: বিদ্যুতের প্রয়োজন আমাদের কোথায়, আজ এবং ৫০ বছর পর? আমাদের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজন শিল্পায়নে। কিন্তু কোন ধরনের শিল্পায়নে? প্রাকৃতিক সম্পদ শিল্পায়নের একটি মৌলভিত্তি, সেটি না থাকলেও শিল্পায়ন সম্ভব, কিন্তু সেটি ভিন্ন পথ। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে গেলে তেমন কিছুই নেই। অজৈব সম্পদের মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস, যা আমরা অপচয় করছি নানাভাবে আর আছে কিছু চীনামাটি ও চুনাপাথর। শিল্পায়নের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আর কোনো অজৈব কাঁচামাল আমাদের নেই—সামান্য পরিমাণ কঠিনশিলা, সৈকতবালি, কাচবালি রয়েছে, কিন্তু পরিমাণ এতই কম যে তা দিয়ে লাভজনক শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব নয়। রসায়নশিল্প মূলত কয়েকটি দ্রব্যে সীমাবদ্ধ—ইউরিয়া, অ্যালুমিনিয়াম সালফেট, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, সালফিউরিক এসিড ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে একমাত্র ইউরিয়া ছাড়া পরিমাণে আর সবই নগণ্য। একইভাবে জৈব সম্পদভিত্তিক কাঁচামালও আমাদের কম। এ ক্ষেত্রে শিল্প গড়ে উঠেছে প্রধানত দুটি ক্ষেত্রে, আবাদি জমি থেকে চিনিশিল্প আর প্রাকৃতিক বন থেকে কাগজশিল্প। প্রয়োজনের তুলনায় কাঁচামালের অভাব এ ক্ষেত্রেও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাটশিল্পের বেলাতেও চিত্রটি মোটামুটি অভিন্ন। আমরা পাট থেকে উচ্চ মূল্যের সামগ্রী তৈরি করতে পারিনি, চটের উৎপাদনেই সেটি সীমিত ছিল, সংযোজিত মূল্যের সামগ্রী তৈরির গবেষণা করতে করতেই পাটের বাজার ও পাট চাষের জমি উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হলো। আজ আমাদের ভাবতে হবে, খাদ্যনিরাপত্তার প্রয়োজনে আমরা কীভাবে আবাদি জমি ধান চাষের জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণে পেতে পারি।
বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পায়নই হচ্ছে আমাদের বিপুল কর্মশক্তি ব্যবহারের প্রধান ও একমাত্র পথ। আমাদের হাত ব্যবহারে আমরা যত বেশি মূল্য সংযোজন করব, ততই সৃষ্টি হবে দেশের সম্পদ। হিসাব করে দেখতে হবে, এভাবে অর্জিত অর্থ দিয়ে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ কেনা সম্ভব কি না।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নীতিমালা নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনা শোনা যায় না। অধিকন্তু জীবতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটটি এ ক্ষেত্রে নিতান্তই অবহেলিত। আমাদের পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জোনের বিন্যাস ও প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা এবং ব্যাপক আলোচনা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ উভয়কেই একযোগে বস্তুনিষ্ঠভাবে কাজটিতে অংশ নিতে হবে। বিষয়টি আমাদের জন্য জটিল বলেই এখানে সঠিক তথ্যের বাস্তব বিশ্লেষণ অপরিহার্য। এই কাজে কোনো স্তরেই মনোরঞ্জন বা লোকরঞ্জনের ছোঁয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
জিয়া উদ্দিন আহমেদ: ভিজিটিং প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.