ইতিহাস-এই মার্চে একজন একাত্তরের যাত্রীর প্রত্যাশা by আবদুল মান্নান

গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী একটি দেশে যে দল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়, সে দলই সরকার গঠন করে। এর ব্যত্যয় হলে সংঘাত অনিবার্য, ঠিক যেমনটি হয়েছিল একাত্তরের অখণ্ড পাকিস্তানে। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি (মহিলা আসনসহ) আসনের মধ্যে এককভাবে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে


বিজয়ী হয়। সুতরাং পাকিস্তানের পরবর্তী সরকার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠন করা হবে, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বিরোধী দলের আসনে বসতে অস্বীকার করলে পুরো পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। অবশ্য ভুট্টো যে একক ক্ষমতাবলে সেই পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছিলেন তা নয়, তাঁর পেছনে মদদ জুগিয়েছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। তাদের কাছে এটি একটি অচিন্তনীয় বিষয় ছিল, বাঙালিরা ভবিষ্যতে পাকিস্তানকে শাসন করবে, তা-ও আবার আওয়ামী লীগ প্রণীত ছয় দফার ভিত্তিতে রচিত একটি সংবিধানের আওতায়। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারই রচিত হয়েছিল বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফার ভিত্তিতে। ছয় দফার অন্যতম দফা ছিল, পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। এতে কেন্দ্রে পাঞ্জাব প্রদেশের আধিপত্য বেশ বড় আকারে খর্ব হতো। ভুট্টো নিজে যদিও সিন্ধি ছিলেন, তথাপি তিনি সব সময় পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক আমলাদের কাছে প্রিয়পাত্র ছিলেন। কারণ তারা জানত, ভুট্টো নিজ প্রদেশ সিন্ধুর চেয়ে পাঞ্জাবের স্বার্থকে কখনো ছোট করে দেখবেন না। শুরু থেকেই ভুট্টো ছয় দফাভিত্তিক পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের বিরোধিতা করে আসছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা নিয়ে তাঁর অবস্থানে অনড় থাকলেও তিনি বারবার বলে আসছিলেন, জাতীয় পরিষদে এসে কেউ যদি ন্যায্য কথা বলেন, তিনি যদি একজনও হন, তাহলেও তাঁর প্রস্তাব মেনে নেওয়া হবে। কিন্তু ভুট্টো তো ঘোষণাই দিয়েছেন, তিনি বিরোধী দলে বসবেন না। এর সহজ অর্থ দাঁড়াল, ইচ্ছা করেই তিনি পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক অক্ষশক্তির সহায়তায় পাকিস্তানের কফিনে একটির পর একটি পেরেক ঠুকছিলেন।
নিয়ম অনুযায়ী, একটি নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব নেওয়া অথবা শপথ গ্রহণের পূর্বক্ষণে পুরোনো মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয় অথবা আপনাআপনি তা ভেঙে যায়। কিন্তু এক দুরভিসন্ধিমূলক সিদ্ধান্ত মাথায় রেখে ২২ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে প্রাদেশিক গভর্নর ও উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠক করেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। বৈঠক শেষে কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে ইয়াহিয়া খান তাঁর মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেন। পরে জানা যায়, এই কাজটি তিনি করেছিলেন পিপলস পার্টির পরামর্শে। এর অর্থ দাঁড়াল, যদিও আওয়ামী লীগ হচ্ছে পাকিস্তানের নবনির্বাচিত গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, কিন্তু শুরু থেকেই ইয়াহিয়া খান গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করেছিলেন সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের নেতা ভুট্টো ও তাঁর দলের পরামর্শে। এটি ছিল এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। তার পরও বঙ্গবন্ধু আশা করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত যুক্তি, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রত্যাশার বিজয় হবে। কিন্তু সব প্রত্যাশায় পানি ঢেলে দিলেন ইয়াহিয়া খান, যখন ১ মার্চ দুপুরে এক বেতার ঘোষণার মাধ্যমে তিনি ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় নতুন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে মুলতবি ঘোষণা করেন। এই অপকর্মটিও করা হয়েছিল ভুট্টোর জেদের কারণে। তিনি শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, তিনি বিরোধী দলে বসবেন না এবং সংবিধান বিষয়ে মৌলিক বিষয়গুলো (ছয় দফাকেন্দ্রিক) সংসদের বাইরেই নিষ্পত্তি হতে হবে। তিনি এও হুমকি দিয়েছিলেন, ৩ তারিখে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেউ অংশ নিতে ঢাকায় গেলে তাঁদের পা ভেঙে দেওয়া হবে। আবারও ইয়াহিয়া খান জাতীয় পর্যায়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিলেন ভুট্টোর স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। তাঁর এই সিদ্ধান্ত ছিল চরম আত্মঘাতী এবং অখণ্ড পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক।
মজার বিষয় হচ্ছে, ভুট্টো, ইয়াহিয়া খান এবং পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক আমলারা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাভিত্তিক পাকিস্তানের নতুন সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগকে পাকিস্তানের অন্য রাজনীতিবিদেরা স্বাগত জানান, এমনকি পাকিস্তানের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ডন ২৮ ফেব্রুয়ারি এক মন্তব্য প্রতিবেদনে এই মত প্রকাশ করা হয়, যেহেতু পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে এক হাজার ২০০ মাইলের একটি বিশাল দূরত্ব আছে এবং যেহেতু দেশটি মোট জনসংখ্যার ৫৪ ভাগ মানুষ তার পূর্ব অংশে বাস করে, সেহেতু ছয় দফাভিত্তিক একটি সংবিধান পাকিস্তানের জন্য কল্যাণকর হবে। প্রতিবেদনটি শেষ হয়েছে এই মন্তব্য দিয়ে, ‘The position, therefore, that emerges is that Bangla Desh, which was in the vanguard of the Pakistan movement, has given its verdict that Pakistan should exist as a federation based on the Six-point programme.’ কিন্তু এসব হচ্ছে যুক্তির কথা, আর ষড়যন্ত্রই যাঁদের রাজনীতির পুঁজি, তাঁরা যুক্তি শুনবেন কেন?
১ মার্চ যখন বেতারের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চে অনুষ্ঠেয় গণপরিষদের সভা স্থগিত করেন, ঠিক একই সময় সমগ্র পাকিস্তানের প্রশাসনিক ব্যবস্থারও তিনি পুনর্বিন্যাস করেন। তিনি নিজের একান্ত আস্থাভাজন সামরিক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর ও সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। আসলে ইয়াহিয়া খান এসবের আড়ালে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ইয়াহিয়া-ভুট্টো গংয়ের ধারণা ছিল, একবার বাঙালির সঙ্গে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে পারলে তারা চিরদিনের জন্য শায়েস্তা হয়ে যাবে, আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এটি ছিল ইয়াহিয়া খানের একটি গুরুতর ঐতিহাসিক ভুল।
২ মার্চ থেকে শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন। তিনি ঘোষণা করলেন, ২ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে সকাল থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত হরতাল পালন করা হবে এবং ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে তিনি এক জনসভায় পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। ২ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যা হয়েছে, তা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা, যিনি সরকারের কেউ নন, ৩১৩ জন গণপরিষদ সদস্যের মধ্যে একজন; তাঁর হুকুম আর নির্দেশে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চলছে। তিনি বলছেন, ব্যাংক খুলবে, তো ব্যাংক খুলছে। তিনি বলছেন, রাস্তায় গাড়ি চলবে, তো রাস্তায় গাড়ি চলছে। তিনি বলছেন, আদালত বসবে, তো আদালত বসছে। এককথায় তাঁর নির্দেশেই পূর্ববঙ্গে সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। পাকিস্তানের প্রশাসন শুধু সেনানিবাসগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, সাতই মার্চ। লাখ লাখ মানুষের উদ্দেশে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সাতই মার্চের ঘোষণা ছিল বাংলা আর বাঙালির ইতিহাসে এক টার্নিং পয়েন্ট। আজকের প্রজন্মকে এটি বোঝানো সত্যিই কঠিন, সাতই মার্চ-পরবর্তী সময়টা কেমন ছিল। বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মতো এমন দূরদর্শী নেতার আবির্ভাব সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল। ইংরেজিতে যাকে বলে, he was larger than a life size leader। তিনি অনেকটা দিব্যদৃষ্টি দিয়ে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, আগামী দিনগুলোতে এ দেশে কী ঘটতে যাচ্ছে। সম্ভবত সে কারণেই তাঁর সাতই মার্চের ভাষণটিও ছিল অনেকটা দিকনির্দেশনামূলক। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য যখন চূড়ান্ত লড়াই শুরু হবে, তখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সামনে তাঁর বিষয়ে দুটি পথ খোলা থাকবে। প্রথমটি হচ্ছে, তাঁকে হত্যা করা আর দ্বিতীয়টি তাঁকে গ্রেপ্তার করা। তারা ধারণা করেছিল, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলার জনগণ তাদের স্বাধিকার আন্দোলন বেশি দূর নিয়ে যেতে পারবে না। আবারও একটি মারাত্মক ভুল; কারণ তত দিনে মনে হচ্ছিল, বাংলার প্রত্যেকটি মানুষই যেন একেকজন শেখ মুজিব। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গ্রেপ্তার করেছিল ঠিকই, কিন্তু লাখো-কোটি বাঙালির হূদয় থেকে তাঁকে তারা ছিনিয়ে নিতে পারেনি। তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ, তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের নানা বীরত্বগাথা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, তাঁর সম্মোহনী শক্তি—সবকিছু মিলিয়ে প্রত্যেক বাঙালিকে নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
পৃথিবীর অনেক দেশ যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু অন্য কোনো দেশের মানুষ এত কম সময়ে নিজের দেশকে স্বাধীন করার জন্য এত রক্ত দিয়েছে, এর দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। আমরা যাঁরা একাত্তরের যাত্রী, তাঁদের মনে এই প্রশ্নটা জাগা স্বাভাবিক যে দেশটির জন্মের পেছনে এত মানুষ নিজের জীবন উৎসর্গ করল, সে দেশটি কি তার চলার পথ ঠিক রাখতে পেরেছে? এককথায় এর উত্তর হচ্ছে—না, পারেনি। এই না পারার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে যাঁদের অবদান ছিল বা যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, দেশটি খুব বেশি দিন তাঁদের হাতে থাকেনি। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর খুব দ্রুততম সময়ে দেশটি বেহাত হয়ে গিয়েছিল। চলে গিয়েছিল এমন সব মানুষের হাতে, যারা শুরু থেকেই একটি স্বাধীন বাংলাদেশের ধারণাই শুধু অবিশ্বাস করেনি, বরং সে দেশটির যাতে জন্মই না হয়, এর জন্য পাকিস্তানের হয়ে লড়াই করেছে। এই পরিস্থিতি থেকে শুধু বর্তমান প্রজন্মই উত্তরণ ঘটাতে পারে, যাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য একাত্তরের যাত্রীরা তাঁদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছিলেন।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.