বিশ্বায়ন ও হালখাতা by মুহম্মদ সবুর
ভাপসা গরম, চৈত্রের কাঠফাটা রোদ, ধুলোর ওড়াওড়ি, ঘাম দরদর-ঝরঝর হাল- সব কিছু ছাপিয়ে যেত হালখাতার টানে। সেই যে দোকান ঘুরে ঘুরে মিষ্টিমুখ, কোলাকুলি, সবচেয়ে বড় কথা, হালখাতায় নাম লেখানো- সে বড় সুখের সময়, সে বড় আনন্দের সময়।
বৈশাখী মেলার চেয়েও নববর্ষের প্রথম দিনে হালখাতা টেনে নিত গঞ্জের দোকানে কিংবা শহরের বিপণি বিতানগুলোতে। মেলার রেশ অনেক দিনই থাকত। জুটত নানা বিনোদনের রকমারি জগৎ। হালখাতার খবর আগেভাগেই মিলে যেত। তা নিয়ে প্রস্তুতি চলত বেশ আগেই। চৈত্রসংক্রান্তির পঞ্চব্যঞ্জন শেষে হালখাতার জন্য প্রস্তুতিটা মন্দ ছিল না। ফিনফিনে পাঞ্জাবি-পাজামা, চপ্পল, হাতে রুমালও থাকত। বণিক সভ্যতার বিকাশে প্রযুক্তির ব্যবহার হালখাতার নাম লেখার গৌরব বঞ্চিত করেছে বৈকি। নববর্ষের শুভেচ্ছাসমেত হালখাতার চিঠিপত্র বাড়িতে আসা শুরু হয়ে যেত চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে। চৌষট্টি সালে কলকাতার ওয়াসেক মোল্লার দোকান থেকে আসা নববর্ষের শুভেচ্ছাসহ হালখাতার আমন্ত্রণসংবলিত চিঠি বাড়িতে দেখেছি। চট্টগ্রাম শহরের জুয়েলারি দোকানগুলোর প্রায় সব নেমন্তন্নপত্র চৈত্রেই এসে যেত।
সব চিঠি জমিয়ে কিশোর-তরুণরা ভাগ করে নিত কে কোন দোকানে যাবে। শখানেক আমন্ত্রণপত্র থেকে বাছাই করা হতো দোকানের মান ও আপ্যায়নের পূর্ববর্তী গুণাগুণ থেকে। তবে পরিবারের পরিচিত বা ঘনিষ্ঠজনদের দোকানগুলো এড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। বাড়তি লাভও ছিল। হালখাতায় নাম তোলার জন্য এক পয়সা বা পাঁচ পয়সা জমা দিতে আর হতো না। উল্টো পাঁচ-দশ টাকা পকেটে গুঁজে দেওয়া হতো। বুঝতাম নববর্ষের উপহার; মেলা থেকে কেনাকাটার সুযোগ করে দেওয়া যেন। দৈবাৎ নববর্ষের প্রথম দিনে কালবৈশাখী ঝড় হানা দিত। তবে তা বিকেলের দিকে কিংবা রাত ১০টার পর। সে কারণে হালখাতা শুরু হতো সকাল থেকেই। চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ মানেই ভিন্নতর আবাহন। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খিস্ট্রান, হরিজন, আদিবাসী সম্প্রদায়ের সহাবস্থান। তাই নববর্ষ এখানে আসে নানা বৈচিত্র্য নিয়ে। সবার বাড়িতে সবার আমন্ত্রণ স্বতঃসিদ্ধ। খাবার আদান-প্রদানও চলে। পহেলা বৈশাখ মানেই হালখাতা। এমনটাই ছিল ব্যবসায়ী সম্প্রদায়সহ শিক্ষিত সমাজে। বৈশাখী মেলার আবেদনও ছিল ভিন্নতর। চলত সপ্তাহব্যাপী। কিন্তু হালখাতা শুরু হতো পহেলা বৈশাখের সকাল থেকে। রাত গড়িয়ে যেত। হালখাতায় সপরিবারেও আসা হতো। মহিলাদের জন্য পৃথক আয়োজনও থাকত।
দোকানগুলো সাজানো হতো হরেক সাজে। কয় দিন ধরেই করা হতো সাফসুতরো। দোকানের সামনে কলাগাছ দিয়ে তোরণ। সুতায় বাঁধা লাল, নীল, হলুদ, সবুজ ও বেগুনি কাগজে সাজানো। দোকানের সামনে লেখা থাকত- শুভ নববর্ষ, শুভ হালখাতা। কলাগাছের তোরণের পাশে কলস-পানি, তুলসীপাতা, ঘটি ফুল, গাঁদা ফুল। রঙিন বাতি দিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। দোকানঘরের ভেতর গদিতে লাল সালু, সাদা কাপড় দিয়ে তাক-তাকিয়া সাজিয়ে মহাজন-মালিক বেশ ধবধবে পোশাক পরে সুগন্ধি মাখিয়ে আসন পেতে বসতেন। দুই পাশে দাঁড়ানো পাখাওয়ালা এবং হিসাবরক্ষক বসা। লাল কাপড়ের মোড়কে নতুন মোটা হালখাতা, পাশে সুতায় বাঁধা কালির দোয়াত-কলম। সকাল ৭টায় আগরবাতি, ধূপধুনো জ্বালিয়ে শুরু হতো হালখাতার উদ্বোধন। ছিটানো হতো গোলাপজল। মহাজন খাতায় কলমের আঁচড় কেটে নতুন দিনটির শুভ সূচনা করতেন। ক্যাশ বাক্সের পাশে থাকত পঞ্জিকা। কোথাও দোয়া-দরুদ, কোথাও মন্ত্র পাঠ দিয়ে শুরু হতো। হালখাতার আমন্ত্রণপত্র ক্রেতা, বন্ধু, প্রতিবেশী, বিদগ্ধজন, শুভার্থীদের আগেই পাঠানো হতো। বকেয়া হালনাগাদ করার জন্য সকালের দিকে ক্রেতারা টাকা নিয়ে আসতেন। বস্তা ভর্তি করে টাকা নিয়ে আসার দৃশ্যও দেখেছি বঙ্রি হাটে। বিকেল বা সন্ধ্যায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসতেন আমন্ত্রিতরা। পরনে সবার ধোপদুরস্ত জামাকাপড়। আলিঙ্গন, করমর্দন (হ্যান্ডশেক), কুশলাদি জানা- সবই চলত। সবার জন্যই অবারিত ছিল। দোকানের সামনে খোলা জায়গায় শামিয়ানা টানিয়ে অথবা দোকানের ভেতর সাজানো হতো পরিপাটি করে খাবারের ব্যবস্থা। নিমকি, রাবড়ি, দই, পানতোয়া, রসগোল্লা, সন্দেশ, কদমা, জিলাপি, রেশমি মিঠাই ইত্যাদি কোথাও একসঙ্গে মিলত। কোথাও তিনটির বেশি আইটেম থাকত না। বিভিন্ন দোকানি হাঁড়িভর্তি মিষ্টি পাঠাতেন তাঁদের ক্রেতাদের। অমন হাঁড়ি আসত কুমিল্লা থেকে। বাড়িতে দেখেছি রসে ভেজা ওই মিষ্টির স্বাদ ভোলার নয়।
হালখাতা নিয়ে সে যুগে ব্যঙ্গ মন্তব্যও করা হয়েছে। প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী তো নববর্ষের দিন বাঙালি ব্যবসায়ীদের হালখাতা খোলার প্রসঙ্গে এই প্রথার অসারতা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, 'নতুন বছরের প্রথম দিনে হিসাবের নতুন খাতা খোলার পর তা শুরু হয় ধার বা পাওনা দিয়ে, সারা বছরই এই নতুন খাতায় হিসাব নতুন করে লেখা হলেও তা একরকমের পুরনো অনুবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। এর মধ্য দিয়ে নতুনের আদর্শ প্রকাশিত হয় না।' আসলে হিসাবের খাতা নতুন খোলা হলেও তাতে আবার পুরনো প্রথাই অনুসৃত হতো। তার পরও হালখাতা নতুন বর্ষে ব্যবসায়ীদের কাছে নতুনভাবে ব্যবসা করার আদর্শ। চট্টগ্রাম শহরে ষাটের দশকে ব্যবসাকেন্দ্রিক অঞ্চল শুধু নয়, মহল্লার দোকানগুলোতেও জাঁকজমকের সঙ্গে হালখাতার উৎসব হতো, মাইকে বাজত গ্রামোফোন রেকর্ডের গান। কানন দেবী, কমলা ঝরিয়া, কে এল সায়গল, কে মলি্লক, বেচু দত্ত, শৈল দেবী, কেদারনাথ ভট্টাচার্য, সুধীরলাল চক্রবর্তী, আব্বাসউদ্দীন আহমদের গ্রামোফোন রেকর্ডের গানের পাশাপাশি শামসাদ বেগম, সুরাইয়া, মোহাম্মদ রফি, লতার গানও বাজত। কীর্তনও বাজত। ব্যবসায়ীদের পছন্দের চেয়েও গান বাছাইয়ের ব্যাপারটা নির্ভর করত মাইকওয়ালার ওপর। তখনকার দিনে যাঁরা মাইক ব্যবসা করতেন, তাঁরা বক্তৃতা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন রেকর্ড বাজাতেন। চট্টগ্রামে এ রকম গ্রামোফোন রেকর্ডের দোকান ছিল দুটি। সারা বছর রেকর্ড বিক্রি হলেও বৈশাখের পুজোতে বিক্রির হিড়িক পড়ত। বহদ্দারহাট, চকবাজার, বঙ্রি হাট, চাকতাই, আন্দরকিল্লা, দেওয়ানবাজার, ফিরিঙ্গীবাজারের প্রায় দোকানে বৈশাখে ফুলের মালা দেখা যেত। এত ফুল সে সময় কোথা থেকে জোগান হতো জানা নেই। বাকি না থাকলেও হালখাতায় যোগ দিলে কিছু টাকা দেওয়া হতো। এটা কি জমা হিসাবে থাকত, নাকি উপহার- জানা ছিল না। আমরাও দিয়েছি, দিতে হয় প্রথা জেনেই।
কোনো দোকানে কোনো বাকি না থাকলেও অতিথি হিসেবে সম্মানের কমতি ছিল না। বেশ আপ্যায়ন করে হাঁড়ি বা বালতি থেকে রসে ভেজা রসগোল্লা, জিলাপি ও আমিত্তি প্লেটে এসে যেত। একজন বেতের টুকরিতে করে নিমকি, লাড্ডু দিয়ে যেত। কাচের গ্লাসে পানি ঢালার জন্য লোক সব সময় থাকত। খাবার শেষে বেরিয়ে আসার সময় পরিবেশনকারীদের দুই-চার পয়সা বকশিশ দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। জুয়েলারি দোকানগুলোতে সমাদর বেশি মিলত। খাবারদাবারও উন্নত মানের। অনেক ক্রেতাকে উপহার হিসেবে তাঁরা কলম, কলমদানি, নোটবুক দিতেন। মুসলিম দোকানগুলোতে দুপুরে মুরগি-পোলাও খাওয়ানো হতো। সম্ভবত সেদিন গো-মাংস ব্যবহার হতো না। সঙ্গে বোরহানি, জরদাও থাকত। অলংকার কেনার রেওয়াজও ছিল নববর্ষের দিনে। দামে রেয়াত মিলত, তদুপরি ভেজাল না থাকার এক ধরনের নিশ্চয়তা। শহরের বইয়ের দোকানগুলোতেও হালখাতা হতো। সেদিন নতুন গল্পের বইও কেনা হতো। সব সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে হালখাতার অনুষ্ঠানে সম্মিলিত হওয়ার দিন; একাত্তরের যুদ্ধকালে আর মেলেনি। সেদিন যুদ্ধজয়ের হালখাতা খুলতে হয়েছিল লঞ্চে বসে, শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে। হালখাতা অনুষ্ঠানে হিন্দুদের দোকানে গণেশ বন্দনা হতো। মুসলমানদের দোকানে মিলাদ। ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের অভিব্যক্তি ছিল তা অবশ্য।
সারা বছরের হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে আবার নতুন করে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাই শুধু জোগাত না হালখাতা, মানুষে মানুষে, সম্প্র্রদায়ে সম্প্র্রদায়ে, নারী-পুরুষে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, বন্ধন, সামাজিকতা, আন্তরিকতা, সর্বোপরি মহামিলনের পথ তৈরি করে দিত। হালখাতা টিকে আছে এখনো এ দেশে স্বল্প পরিসরে। প্রীতি-সম্ভাষণ আজও বিনিময় হয়। বিশ্বায়ন আর মুক্তবাজারের যুগে হালখাতা সব সময়ই হাল করে রাখা হয় এখন। বর্ষ শেষের হিসাব-নিকাশ চুকাতে আর ধৈর্য ধরে না। তবু হালখাতার হালচাল থেকে যাবে বণিক সভ্যতায়।
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক
সব চিঠি জমিয়ে কিশোর-তরুণরা ভাগ করে নিত কে কোন দোকানে যাবে। শখানেক আমন্ত্রণপত্র থেকে বাছাই করা হতো দোকানের মান ও আপ্যায়নের পূর্ববর্তী গুণাগুণ থেকে। তবে পরিবারের পরিচিত বা ঘনিষ্ঠজনদের দোকানগুলো এড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। বাড়তি লাভও ছিল। হালখাতায় নাম তোলার জন্য এক পয়সা বা পাঁচ পয়সা জমা দিতে আর হতো না। উল্টো পাঁচ-দশ টাকা পকেটে গুঁজে দেওয়া হতো। বুঝতাম নববর্ষের উপহার; মেলা থেকে কেনাকাটার সুযোগ করে দেওয়া যেন। দৈবাৎ নববর্ষের প্রথম দিনে কালবৈশাখী ঝড় হানা দিত। তবে তা বিকেলের দিকে কিংবা রাত ১০টার পর। সে কারণে হালখাতা শুরু হতো সকাল থেকেই। চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ মানেই ভিন্নতর আবাহন। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খিস্ট্রান, হরিজন, আদিবাসী সম্প্রদায়ের সহাবস্থান। তাই নববর্ষ এখানে আসে নানা বৈচিত্র্য নিয়ে। সবার বাড়িতে সবার আমন্ত্রণ স্বতঃসিদ্ধ। খাবার আদান-প্রদানও চলে। পহেলা বৈশাখ মানেই হালখাতা। এমনটাই ছিল ব্যবসায়ী সম্প্রদায়সহ শিক্ষিত সমাজে। বৈশাখী মেলার আবেদনও ছিল ভিন্নতর। চলত সপ্তাহব্যাপী। কিন্তু হালখাতা শুরু হতো পহেলা বৈশাখের সকাল থেকে। রাত গড়িয়ে যেত। হালখাতায় সপরিবারেও আসা হতো। মহিলাদের জন্য পৃথক আয়োজনও থাকত।
দোকানগুলো সাজানো হতো হরেক সাজে। কয় দিন ধরেই করা হতো সাফসুতরো। দোকানের সামনে কলাগাছ দিয়ে তোরণ। সুতায় বাঁধা লাল, নীল, হলুদ, সবুজ ও বেগুনি কাগজে সাজানো। দোকানের সামনে লেখা থাকত- শুভ নববর্ষ, শুভ হালখাতা। কলাগাছের তোরণের পাশে কলস-পানি, তুলসীপাতা, ঘটি ফুল, গাঁদা ফুল। রঙিন বাতি দিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। দোকানঘরের ভেতর গদিতে লাল সালু, সাদা কাপড় দিয়ে তাক-তাকিয়া সাজিয়ে মহাজন-মালিক বেশ ধবধবে পোশাক পরে সুগন্ধি মাখিয়ে আসন পেতে বসতেন। দুই পাশে দাঁড়ানো পাখাওয়ালা এবং হিসাবরক্ষক বসা। লাল কাপড়ের মোড়কে নতুন মোটা হালখাতা, পাশে সুতায় বাঁধা কালির দোয়াত-কলম। সকাল ৭টায় আগরবাতি, ধূপধুনো জ্বালিয়ে শুরু হতো হালখাতার উদ্বোধন। ছিটানো হতো গোলাপজল। মহাজন খাতায় কলমের আঁচড় কেটে নতুন দিনটির শুভ সূচনা করতেন। ক্যাশ বাক্সের পাশে থাকত পঞ্জিকা। কোথাও দোয়া-দরুদ, কোথাও মন্ত্র পাঠ দিয়ে শুরু হতো। হালখাতার আমন্ত্রণপত্র ক্রেতা, বন্ধু, প্রতিবেশী, বিদগ্ধজন, শুভার্থীদের আগেই পাঠানো হতো। বকেয়া হালনাগাদ করার জন্য সকালের দিকে ক্রেতারা টাকা নিয়ে আসতেন। বস্তা ভর্তি করে টাকা নিয়ে আসার দৃশ্যও দেখেছি বঙ্রি হাটে। বিকেল বা সন্ধ্যায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসতেন আমন্ত্রিতরা। পরনে সবার ধোপদুরস্ত জামাকাপড়। আলিঙ্গন, করমর্দন (হ্যান্ডশেক), কুশলাদি জানা- সবই চলত। সবার জন্যই অবারিত ছিল। দোকানের সামনে খোলা জায়গায় শামিয়ানা টানিয়ে অথবা দোকানের ভেতর সাজানো হতো পরিপাটি করে খাবারের ব্যবস্থা। নিমকি, রাবড়ি, দই, পানতোয়া, রসগোল্লা, সন্দেশ, কদমা, জিলাপি, রেশমি মিঠাই ইত্যাদি কোথাও একসঙ্গে মিলত। কোথাও তিনটির বেশি আইটেম থাকত না। বিভিন্ন দোকানি হাঁড়িভর্তি মিষ্টি পাঠাতেন তাঁদের ক্রেতাদের। অমন হাঁড়ি আসত কুমিল্লা থেকে। বাড়িতে দেখেছি রসে ভেজা ওই মিষ্টির স্বাদ ভোলার নয়।
হালখাতা নিয়ে সে যুগে ব্যঙ্গ মন্তব্যও করা হয়েছে। প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী তো নববর্ষের দিন বাঙালি ব্যবসায়ীদের হালখাতা খোলার প্রসঙ্গে এই প্রথার অসারতা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, 'নতুন বছরের প্রথম দিনে হিসাবের নতুন খাতা খোলার পর তা শুরু হয় ধার বা পাওনা দিয়ে, সারা বছরই এই নতুন খাতায় হিসাব নতুন করে লেখা হলেও তা একরকমের পুরনো অনুবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। এর মধ্য দিয়ে নতুনের আদর্শ প্রকাশিত হয় না।' আসলে হিসাবের খাতা নতুন খোলা হলেও তাতে আবার পুরনো প্রথাই অনুসৃত হতো। তার পরও হালখাতা নতুন বর্ষে ব্যবসায়ীদের কাছে নতুনভাবে ব্যবসা করার আদর্শ। চট্টগ্রাম শহরে ষাটের দশকে ব্যবসাকেন্দ্রিক অঞ্চল শুধু নয়, মহল্লার দোকানগুলোতেও জাঁকজমকের সঙ্গে হালখাতার উৎসব হতো, মাইকে বাজত গ্রামোফোন রেকর্ডের গান। কানন দেবী, কমলা ঝরিয়া, কে এল সায়গল, কে মলি্লক, বেচু দত্ত, শৈল দেবী, কেদারনাথ ভট্টাচার্য, সুধীরলাল চক্রবর্তী, আব্বাসউদ্দীন আহমদের গ্রামোফোন রেকর্ডের গানের পাশাপাশি শামসাদ বেগম, সুরাইয়া, মোহাম্মদ রফি, লতার গানও বাজত। কীর্তনও বাজত। ব্যবসায়ীদের পছন্দের চেয়েও গান বাছাইয়ের ব্যাপারটা নির্ভর করত মাইকওয়ালার ওপর। তখনকার দিনে যাঁরা মাইক ব্যবসা করতেন, তাঁরা বক্তৃতা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন রেকর্ড বাজাতেন। চট্টগ্রামে এ রকম গ্রামোফোন রেকর্ডের দোকান ছিল দুটি। সারা বছর রেকর্ড বিক্রি হলেও বৈশাখের পুজোতে বিক্রির হিড়িক পড়ত। বহদ্দারহাট, চকবাজার, বঙ্রি হাট, চাকতাই, আন্দরকিল্লা, দেওয়ানবাজার, ফিরিঙ্গীবাজারের প্রায় দোকানে বৈশাখে ফুলের মালা দেখা যেত। এত ফুল সে সময় কোথা থেকে জোগান হতো জানা নেই। বাকি না থাকলেও হালখাতায় যোগ দিলে কিছু টাকা দেওয়া হতো। এটা কি জমা হিসাবে থাকত, নাকি উপহার- জানা ছিল না। আমরাও দিয়েছি, দিতে হয় প্রথা জেনেই।
কোনো দোকানে কোনো বাকি না থাকলেও অতিথি হিসেবে সম্মানের কমতি ছিল না। বেশ আপ্যায়ন করে হাঁড়ি বা বালতি থেকে রসে ভেজা রসগোল্লা, জিলাপি ও আমিত্তি প্লেটে এসে যেত। একজন বেতের টুকরিতে করে নিমকি, লাড্ডু দিয়ে যেত। কাচের গ্লাসে পানি ঢালার জন্য লোক সব সময় থাকত। খাবার শেষে বেরিয়ে আসার সময় পরিবেশনকারীদের দুই-চার পয়সা বকশিশ দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। জুয়েলারি দোকানগুলোতে সমাদর বেশি মিলত। খাবারদাবারও উন্নত মানের। অনেক ক্রেতাকে উপহার হিসেবে তাঁরা কলম, কলমদানি, নোটবুক দিতেন। মুসলিম দোকানগুলোতে দুপুরে মুরগি-পোলাও খাওয়ানো হতো। সম্ভবত সেদিন গো-মাংস ব্যবহার হতো না। সঙ্গে বোরহানি, জরদাও থাকত। অলংকার কেনার রেওয়াজও ছিল নববর্ষের দিনে। দামে রেয়াত মিলত, তদুপরি ভেজাল না থাকার এক ধরনের নিশ্চয়তা। শহরের বইয়ের দোকানগুলোতেও হালখাতা হতো। সেদিন নতুন গল্পের বইও কেনা হতো। সব সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে হালখাতার অনুষ্ঠানে সম্মিলিত হওয়ার দিন; একাত্তরের যুদ্ধকালে আর মেলেনি। সেদিন যুদ্ধজয়ের হালখাতা খুলতে হয়েছিল লঞ্চে বসে, শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে। হালখাতা অনুষ্ঠানে হিন্দুদের দোকানে গণেশ বন্দনা হতো। মুসলমানদের দোকানে মিলাদ। ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের অভিব্যক্তি ছিল তা অবশ্য।
সারা বছরের হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে আবার নতুন করে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাই শুধু জোগাত না হালখাতা, মানুষে মানুষে, সম্প্র্রদায়ে সম্প্র্রদায়ে, নারী-পুরুষে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, বন্ধন, সামাজিকতা, আন্তরিকতা, সর্বোপরি মহামিলনের পথ তৈরি করে দিত। হালখাতা টিকে আছে এখনো এ দেশে স্বল্প পরিসরে। প্রীতি-সম্ভাষণ আজও বিনিময় হয়। বিশ্বায়ন আর মুক্তবাজারের যুগে হালখাতা সব সময়ই হাল করে রাখা হয় এখন। বর্ষ শেষের হিসাব-নিকাশ চুকাতে আর ধৈর্য ধরে না। তবু হালখাতার হালচাল থেকে যাবে বণিক সভ্যতায়।
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক
No comments