ভিন্নমত-মানুষ যখন বৃদ্ধ হয় by আবু আহমেদ
সময়কে যদি বদল করা যেত, তাহলে অনেক বৃদ্ধ মানুষ তাঁদের বৃদ্ধকালের ১০ বছর সময়কে যৌবনকালের সঙ্গে পরিবর্তন করে নিতেন। কিন্তু নিরেট সত্য হলো, কেউ পেছনের সময় দিয়ে ভবিষ্যতের সময়কে পরিবর্তন করতে পারেন না, আর কেউই বর্তমান দ্বারাও ভবিষ্যতের সময়কে স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন না।
মানুষ জন্মগ্রহণের সময় থেকে দিন-মাস-বছর গণনা করতে পারে, একদিন সেই গণনা শেষ হয়ে যায় এবং তখন আমরা বলি, মানুষটা মৃত্যুবরণ করেছে। মৃত্যুকে কেউ পরাজিত করতে পারেনি, কখনো পারবেও না। প্রাণমাত্রই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মানুষ বিখ্যাত হয় শিক্ষাজীবনে, তারপর যৌবনকালে। যৌবনকালের বিখ্যাত কাজগুলোর স্বীকৃতি মেলে অনেক সময় তাঁর বৃদ্ধকালে। কিন্তু বৃদ্ধকালে সে যতই বিখ্যাত হোক না কেন, সততই মনে হবে, এই বিখ্যাত হওয়াটা তাঁর কোনো কাজে আসছে না। যৌবনকালে সামান্য বিখ্যাত হওয়ার যে স্বাদ পাওয়া যায়, বৃদ্ধকালে অনেক বিখ্যাত হয়েও সেই স্বাদ পাওয়া যায় বলে মনে হয় না।
মানুষের বয়স যতই বাড়তে থাকে, ততই সে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তাঁকে আক্রমণ করে অনেক রোগব্যাধি এবং সেই সঙ্গে দুশ্চিন্তাও। মানুষ ভাবতে থাকে সে কী ছিল, কী হয়েছে এবং কী হবে। অনেক মানুষই পরিতৃপ্তি বোধ করে এই ভেবে যে অতীতের জীবনটা কাজে ভরপুরের জীবন ছিল, সফলতার জীবন ছিল। অনেক মানুষই বৃদ্ধদের শিশুদের সঙ্গে তুলনা করেন। এই সময়ে তাঁরা অবুঝ এবং ক্ষেত্রবিশেষে অসহায়ও হন। বেশির ভাগ বৃদ্ধ মানুষ এই কামনাই করেন, যাতে তাঁদের মৃত্যুটা আরামের হয়। এ বয়সের বেশির ভাগ মানুষ মসজিদ-গির্জা-উপাসনালয়ে যাতায়াত করেন এবং প্রার্থনা করে সময় কাটান। পেছনের দিনের জমায়িত গুনাহের জন্য মাফ চান তাঁর প্রভুর কাছে। আবার কেউ কেউ দৃশ্যমান ধর্মীয় জীবনযাপন করতে না পারলে নীরবে তাঁর প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অন্য কেউ আবার নিজের কিছু মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে জীবনের শেষদিনগুলো কাটিয়ে দিতে চান।
ধর্মীয় আচার-আচরণে তাঁদের অবস্থান যেখানেই থাকুক না কেন, একটা বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মিল আছে। সেটা হলো, তাঁরা শারীরিক ও মনের দিক দিয়ে অতি দুর্বল। তাঁরা অন্যের সহায়তা চান, সেই অন্যরা যদি নিজ স্ত্রী-সন্তান হয়, তাহলে বেশি ভালো। বৃদ্ধ বয়সে যে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর কী প্রয়োজন, সেটা যাঁরা বৃদ্ধ হয়েছেন তাঁদের জিজ্ঞেস করলেই বোঝা যাবে। আমাদের যৌবনকালে আমরা যখন দেখতাম, একজন বুড়ো মানুষের সঙ্গে একজন বুড়িও আছেন, তখন ভাবতাম বুড়ি মানুষটাকে আনতে গেল কেন। এখন ভাবি, সেটাই বৃদ্ধ মানুষটির জন্য স্বাভাবিক ছিল। যে বৃদ্ধ মানুষকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য একজন বৃদ্ধা পাওয়া যায় সে বৃদ্ধ তো অতি ভাগ্যবান। আসলে বৃদ্ধ মানুষের অভাব-অসহায়ত্বকে আর একজন বৃদ্ধ কেবল ভালোভাবে বুঝতে পারার কথা। আমাদের ধর্মে বৃদ্ধ মা-বাবার খেদমত করার জন্য অনেক আহ্বান জানানো হয়েছে। আহ্বান এ জন্যই করা হয়, আমাদের সৃষ্টিকর্তা জানেন বৃদ্ধ বয়সে মানুষ কতটা অসহায়ত্ব অনুভব করে। অনেকে বিচ্ছিন্ন এবং ভেঙে পড়ে। পারিবারিক জীবনে আমরা সন্তানরা বা আমাদের সন্তানরা আমাদের ধর্মের সেই অনুশাসনকে কতটা মানছি সে প্রশ্ন তো থেকেই যাচ্ছে। তবে আমি এমন অনেক সন্তান দেখেছি, যারা মা-বাবার জন্য যথেষ্ট করেছে এবং তাদের করা অব্যাহত ছিল তাদের মা-বাবাকে কবরে শুইয়ে দেওয়া পর্যন্ত। এসব সন্তান আমার নজরে অত্যন্ত সফলকাম। আমাদের অনেকের অনেক অর্থ আছে সত্য, কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সে অর্থ কী কাজে লাগে বুঝে আসে না। অর্থ লাগে সন্তানদের জন্য। সে সন্তানরা আবার বিদেশে অথবা মা-বাবা থেকে অনেক দূরে। মা-বাবা একা পড়ে আছেন এই সমাজে, কিন্তু সন্তানরা আছে যুক্তরাষ্ট্রে কিংবা অন্য কোথাও। তবে মানুষের জীবনাচরণের এই ধারা বদল হওয়ার নয়। জীবন যতই কঠিন হচ্ছে, আমরা একে অন্যকে ছেড়ে শুধু দূরে চলে যাচ্ছি।
আমি বহু মানুষকে দেখেছি, কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পর পারতপক্ষে আর ঘর থেকে বের হননি, একদিন তাঁরা সমাজের অন্যদের জানান না দিয়ে পৃথিবী থেকেই চলে যান। আমাদের এই সমাজে অনেক মানুষ ছিলেন, যাঁরা আমাদের তুলনায় অনেক মেধাবী এবং অনেক বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তাঁরা যখন লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন, তখন তাঁদের সমাজের অন্যরা ভুলতেই বসে। একে অন্যকে জিন্দাবাদ দেয় যখন তারা পারস্পরিকভাবে একে অন্যের কাজে আসবে বলে মনে করে। প্রয়োজন ছাড়া আজকাল কেউ জিন্দাবাদ দেয় বলে মনে হয় না।
আমরা কি কখনো চিন্তা করেছি, আমাদের বৃদ্ধদের মধ্যে অনেকেই বর্তমানের বিখ্যাতদের থেকে বিখ্যাত ছিলেন? কিন্তু বৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছে এবং তাঁরা সমাজে থেকেও নেই-এর মতো হয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন বা দিচ্ছেন। সমাজে অনেকের জন্য আমরা অনেক অধিকারের কথা বলি। কিন্তু কয়জন বৃদ্ধের অধিকারের কথা বলেন। কর্মজীবীদের জন্য অনেক আশ্রম-হোস্টেল তৈরি হয়, কিন্তু বৃদ্ধদের জন্য আমরা কি কোনো আশ্রয়স্থলের কথা চিন্তা করছি? যাঁদের পরিবার আছে, কেয়ারিং সন্তান আছে তাঁদের জন্য কিছু করার দরকার নেই। কিন্তু যাঁদের পরিবার নেই, সন্তান নেই_তাঁদের জন্য তো অন্তত একটা আশ্রয়স্থল দরকার। যেখানে ডাক্তার থাকবে, সামান্য ওষুধ থাকবে, মানুষটার কী হচ্ছে সকাল-বিকেল খোঁজ নেওয়া হবে। যে সমাজ বৃদ্ধদের অবহেলা করে, সেই সমাজ ভালো থেকেও ভালো থাকবে না। বৃদ্ধরা একসময় সমাজকে অনেক কিছু দিয়েছে, সমাজ কি পরবর্তী সময় একটু ঋণ শোধ করতে পারে না?
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মানুষের বয়স যতই বাড়তে থাকে, ততই সে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তাঁকে আক্রমণ করে অনেক রোগব্যাধি এবং সেই সঙ্গে দুশ্চিন্তাও। মানুষ ভাবতে থাকে সে কী ছিল, কী হয়েছে এবং কী হবে। অনেক মানুষই পরিতৃপ্তি বোধ করে এই ভেবে যে অতীতের জীবনটা কাজে ভরপুরের জীবন ছিল, সফলতার জীবন ছিল। অনেক মানুষই বৃদ্ধদের শিশুদের সঙ্গে তুলনা করেন। এই সময়ে তাঁরা অবুঝ এবং ক্ষেত্রবিশেষে অসহায়ও হন। বেশির ভাগ বৃদ্ধ মানুষ এই কামনাই করেন, যাতে তাঁদের মৃত্যুটা আরামের হয়। এ বয়সের বেশির ভাগ মানুষ মসজিদ-গির্জা-উপাসনালয়ে যাতায়াত করেন এবং প্রার্থনা করে সময় কাটান। পেছনের দিনের জমায়িত গুনাহের জন্য মাফ চান তাঁর প্রভুর কাছে। আবার কেউ কেউ দৃশ্যমান ধর্মীয় জীবনযাপন করতে না পারলে নীরবে তাঁর প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অন্য কেউ আবার নিজের কিছু মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে জীবনের শেষদিনগুলো কাটিয়ে দিতে চান।
ধর্মীয় আচার-আচরণে তাঁদের অবস্থান যেখানেই থাকুক না কেন, একটা বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মিল আছে। সেটা হলো, তাঁরা শারীরিক ও মনের দিক দিয়ে অতি দুর্বল। তাঁরা অন্যের সহায়তা চান, সেই অন্যরা যদি নিজ স্ত্রী-সন্তান হয়, তাহলে বেশি ভালো। বৃদ্ধ বয়সে যে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর কী প্রয়োজন, সেটা যাঁরা বৃদ্ধ হয়েছেন তাঁদের জিজ্ঞেস করলেই বোঝা যাবে। আমাদের যৌবনকালে আমরা যখন দেখতাম, একজন বুড়ো মানুষের সঙ্গে একজন বুড়িও আছেন, তখন ভাবতাম বুড়ি মানুষটাকে আনতে গেল কেন। এখন ভাবি, সেটাই বৃদ্ধ মানুষটির জন্য স্বাভাবিক ছিল। যে বৃদ্ধ মানুষকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য একজন বৃদ্ধা পাওয়া যায় সে বৃদ্ধ তো অতি ভাগ্যবান। আসলে বৃদ্ধ মানুষের অভাব-অসহায়ত্বকে আর একজন বৃদ্ধ কেবল ভালোভাবে বুঝতে পারার কথা। আমাদের ধর্মে বৃদ্ধ মা-বাবার খেদমত করার জন্য অনেক আহ্বান জানানো হয়েছে। আহ্বান এ জন্যই করা হয়, আমাদের সৃষ্টিকর্তা জানেন বৃদ্ধ বয়সে মানুষ কতটা অসহায়ত্ব অনুভব করে। অনেকে বিচ্ছিন্ন এবং ভেঙে পড়ে। পারিবারিক জীবনে আমরা সন্তানরা বা আমাদের সন্তানরা আমাদের ধর্মের সেই অনুশাসনকে কতটা মানছি সে প্রশ্ন তো থেকেই যাচ্ছে। তবে আমি এমন অনেক সন্তান দেখেছি, যারা মা-বাবার জন্য যথেষ্ট করেছে এবং তাদের করা অব্যাহত ছিল তাদের মা-বাবাকে কবরে শুইয়ে দেওয়া পর্যন্ত। এসব সন্তান আমার নজরে অত্যন্ত সফলকাম। আমাদের অনেকের অনেক অর্থ আছে সত্য, কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সে অর্থ কী কাজে লাগে বুঝে আসে না। অর্থ লাগে সন্তানদের জন্য। সে সন্তানরা আবার বিদেশে অথবা মা-বাবা থেকে অনেক দূরে। মা-বাবা একা পড়ে আছেন এই সমাজে, কিন্তু সন্তানরা আছে যুক্তরাষ্ট্রে কিংবা অন্য কোথাও। তবে মানুষের জীবনাচরণের এই ধারা বদল হওয়ার নয়। জীবন যতই কঠিন হচ্ছে, আমরা একে অন্যকে ছেড়ে শুধু দূরে চলে যাচ্ছি।
আমি বহু মানুষকে দেখেছি, কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পর পারতপক্ষে আর ঘর থেকে বের হননি, একদিন তাঁরা সমাজের অন্যদের জানান না দিয়ে পৃথিবী থেকেই চলে যান। আমাদের এই সমাজে অনেক মানুষ ছিলেন, যাঁরা আমাদের তুলনায় অনেক মেধাবী এবং অনেক বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তাঁরা যখন লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন, তখন তাঁদের সমাজের অন্যরা ভুলতেই বসে। একে অন্যকে জিন্দাবাদ দেয় যখন তারা পারস্পরিকভাবে একে অন্যের কাজে আসবে বলে মনে করে। প্রয়োজন ছাড়া আজকাল কেউ জিন্দাবাদ দেয় বলে মনে হয় না।
আমরা কি কখনো চিন্তা করেছি, আমাদের বৃদ্ধদের মধ্যে অনেকেই বর্তমানের বিখ্যাতদের থেকে বিখ্যাত ছিলেন? কিন্তু বৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছে এবং তাঁরা সমাজে থেকেও নেই-এর মতো হয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন বা দিচ্ছেন। সমাজে অনেকের জন্য আমরা অনেক অধিকারের কথা বলি। কিন্তু কয়জন বৃদ্ধের অধিকারের কথা বলেন। কর্মজীবীদের জন্য অনেক আশ্রম-হোস্টেল তৈরি হয়, কিন্তু বৃদ্ধদের জন্য আমরা কি কোনো আশ্রয়স্থলের কথা চিন্তা করছি? যাঁদের পরিবার আছে, কেয়ারিং সন্তান আছে তাঁদের জন্য কিছু করার দরকার নেই। কিন্তু যাঁদের পরিবার নেই, সন্তান নেই_তাঁদের জন্য তো অন্তত একটা আশ্রয়স্থল দরকার। যেখানে ডাক্তার থাকবে, সামান্য ওষুধ থাকবে, মানুষটার কী হচ্ছে সকাল-বিকেল খোঁজ নেওয়া হবে। যে সমাজ বৃদ্ধদের অবহেলা করে, সেই সমাজ ভালো থেকেও ভালো থাকবে না। বৃদ্ধরা একসময় সমাজকে অনেক কিছু দিয়েছে, সমাজ কি পরবর্তী সময় একটু ঋণ শোধ করতে পারে না?
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments