এবারের নববর্ষে by আনিসুজ্জামান
মানুষমাত্রই উৎসবপ্রিয়। কেননা উৎসব সব প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে। উৎসবে আমরা পরস্পর মিলিত হই—তাতে ব্যক্তির খণ্ডতা ও বিচ্ছিন্নতা দূর হয়ে সমষ্টির সম্পূর্ণতা ও অবিচ্ছিন্নতার প্রকাশ ঘটে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘মিলনের দ্বারা, প্রাচুর্যের দ্বারা, সৌন্দর্যের দ্বারা আমরা উৎসবের দিনকে বৎসরের সাধারণ দিনগুলির মুকুটমণিস্বরূপ করিয়া তুলি।’
বলা হয়, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তেরো কেন, তার বেশি। তবে বেশির ভাগ পার্বণই আমাদের ধর্মপালনের সঙ্গে যুক্ত—ঈদ, পুজো, ক্রিসমাস, বৌদ্ধপূর্ণিমা। দেশের সব ধর্মের মানুষ যেখানে সহজে মিলতে পারে, তেমন উৎসব বাঙালির নববর্ষ।
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস খোঁজার দরকার এই মুহূর্তে নেই। পাঁচ-ছ শ বছর ধরে বাংলা পঞ্জিকা চলছে, কোনো এক কালের অগ্রহায়ণকে বাদ দিয়ে বৈশাখ মাস চলে এসেছে তার গোড়ায়। সেই বৈশাখের পয়লা তারিখে নববর্ষের উৎসব। ঐতিহ্যগতভাবে নববর্ষ উদ্যাপিত হতো হালখাতার অনুষ্ঠান করে আর মেলার আয়োজন করে। হালখাতার সঙ্গে সম্পর্ক ব্যবসার, মেলার সঙ্গে কারুকলার। হালখাতায় পুরোনো বছরের হিসাবের জের উঠত নতুন খাতার পাতায়, সংশ্লিষ্ট সবাই মিষ্টিমুখ করতেন। মেলায় জমা পড়ত রকমারি কারুপণ্য। অনেকেই তা সংগ্রহ করতে উদগ্রীব হতেন। হালখাতায় আমন্ত্রণ হতো অল্প লোকের, মেলায় সমাগম হতো বহুজনের।
প্রথাগত এই নববর্ষ-উৎসব একটু নতুন রূপ পেল উনিশ শতকে। শাসক প্রভুরা পয়লা জানুয়ারিতে নববর্ষ উদ্যাপন করেন, শাসিত বঙ্গসন্তানেরাও তার অনুকরণ করে। বঙ্কিমচন্দ্রের রামবাবু যখন স্ত্রীকে বললেন যে, তাঁরা নববর্ষ গণনা করেন পয়লা জানুয়ারি থেকে এবং তাই শ্যামবাবু নববর্ষের প্রথম দিনে সংবৎসরের আশীর্বাদ করতে এসেছিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘শ্বশুর ধরিতেন ১লা বৈশাখ থেকে, তুমি ধর ১লা জানুয়ারি থেকে, আমার ছেলে বোধ করি ধরিবে ১লা শ্রাবণ থেকে?’ এ-রচনা সম্ভবত ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের।
তার আগে রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপন করেন জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা (Society for the Promotion of National feeling among the educated Natives of Bengal)। রাজনারায়ণ লিখেছেন, ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভার সভ্যেরা ‘good night’ না বলিয়া ‘সুরজনী’ বলিতেন। ১লা জানুয়ারি দিবসে পরস্পর অভিনন্দন না করিয়া ১লা বৈশাখে করিতেন; আর ইংরাজী বাঙ্গলা না মিশাইয়া কেবল বিশুদ্ধ বাঙ্গলাতে কথা কহিতে চেষ্টা করিতেন। যে একটি ইংরাজী শব্দ ব্যবহার করিত তাহার এক পয়সা করিয়া জরিমানা হইত।’
এই বিবরণের সত্যতায় সন্দেহ করার কারণ নেই। অতএব, মনে করতে হবে যে, হালখাতার অনুষ্ঠানের বাইরে, সামাজিকভাবে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের শুরু ১৮৬১-৬২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে।
আমার ছেলেবেলায়, চল্লিশের দশকের শুরুতে, ইংরেজশাসিত কলকাতায় আমরা হালখাতা-অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচলন দেখেছি, নৃত্যগীতবাদ্য-সহযোগে এর উদ্যাপন দেখিনি। সেটা দেখলাম ১৯৪৯-৫০ সালে, ঢাকায়। লেখক-শিল্পী মজলিসের উদ্যোগে নববর্ষ পালিত হয়েছিল মেহবুব আলী ইনস্টিটিউটে। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদে ১৯৫২-৫৩ সালে আমরা নববর্ষ উৎসব করেছি কবিতা পড়ে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়ের পর এ কে ফজলুল হক নাকি সাড়ম্বরে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন সবাইকে—ঘটনাটা আমার মনে নেই, কিন্তু কারও কারও রচনায় এমনই দেখেছি।
ততদিনে কিন্তু পাকিস্তান সরকার নববর্ষ পালনকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী একটি প্রবন্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন যে, পারস্যে যদি ইসলামপূর্ব নওরোজ উৎসব অব্যাহতভাবে চলে আসতে পারে, তার অনুকরণে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে যদি নওরোজ উৎসব অনুষ্ঠিত হতে পারে, তাহলে আমরা কেন বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করতে পারব না—বিশেষ করে, বাংলা বর্ষ যেখানে মোগলদের প্রবর্তন বলে সর্ববাদিসম্মত? পাকিস্তানের শাসকেরা কিন্তু একে বিজাতীয় অনুষ্ঠান বলে গণ্য করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। ফলে, শাসকদের বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবে উদ্বুদ্ধ আমরা বাংলা নববর্ষ পালনে তৎপর হয়ে পড়লাম। এ ক্ষেত্রে ছায়ানটের ভূমিকা ছিল সর্বপ্রধান।
ছায়ানটের নববর্ষ উদ্যাপন অচিরেই জাতীয় উৎসবের রূপ পরিগ্রহ করে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা আয়োজিত মেলা দর্শককে আকর্ষণ করে। ঢাকার অনুসরণে অন্যান্য শহরেও মহাসমারোহে নববর্ষ পালিত হতে থাকে। বস্তুত বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে যেমন সাড়ম্বরে নববর্ষ পালিত হয়, ভারতের বাংলাভাষী অঞ্চলে তা হয় না। আমাদের ভারতীয় বন্ধুরা খুবই অবাক হন এখানে নববর্ষ উৎসবের এই আকারপ্রকার দেখে।
বেশ কিছুকাল আগে নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমাদের এক সহকর্মী-বন্ধু আমাদের নববর্ষ উদ্যাপন নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এ দিনে নাগরিক মধ্যবিত্ত যখন সানকিতে করে পান্তা-ইলিশ খায়, তাঁর মনে হয়, তাঁরা চাষাভুষোদের বিদ্রূপ করছেন। তাঁর সঙ্গে আমি একমত হতে পারিনি। নিজে পান্তা-ইলিশ খাই না বটে, তবু আমি বলেছিলাম, উৎসবের দিনে বিশেষ আয়োজনই স্বাভাবিক। বছরের অন্য দিনে আমরা যা খাই না, উৎসবের দিনে তারই ব্যবস্থা করি। এই সেদিন এক তরুণ সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করলেন, এখন নববর্ষের দিনে নতুন কাপড় ও ইলিশ মাছ কেনার যে হুড়োহুড়ি লেগে গেছে, তাতে নববর্ষের অনভিপ্রেত বাণিজ্যিকীকরণ ঘটছে কি না। আমি বললাম, উৎসব উপলক্ষে সামর্থ্য থাকলে সাজসজ্জার এবং খাবারের বিশেষ আয়োজন আবশ্যিক না হলেও প্রথাসম্মত। ঈদে বা পুজোয় এমনটি হয়। নববর্ষ উপলক্ষে তেমন হলে ক্ষতি কী!
নববর্ষের দিনটি আলোয়-ফুলে-গানে-সাজে ভরে উঠুক। আমাদের চিত্ত পরিপূর্ণ হোক। দুহাত বাড়িয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে হূদয় থেকে নিঃসৃত হোক: তুমি এসো, তুমি এসো, তুমিও এসো এবং তুমি।
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস খোঁজার দরকার এই মুহূর্তে নেই। পাঁচ-ছ শ বছর ধরে বাংলা পঞ্জিকা চলছে, কোনো এক কালের অগ্রহায়ণকে বাদ দিয়ে বৈশাখ মাস চলে এসেছে তার গোড়ায়। সেই বৈশাখের পয়লা তারিখে নববর্ষের উৎসব। ঐতিহ্যগতভাবে নববর্ষ উদ্যাপিত হতো হালখাতার অনুষ্ঠান করে আর মেলার আয়োজন করে। হালখাতার সঙ্গে সম্পর্ক ব্যবসার, মেলার সঙ্গে কারুকলার। হালখাতায় পুরোনো বছরের হিসাবের জের উঠত নতুন খাতার পাতায়, সংশ্লিষ্ট সবাই মিষ্টিমুখ করতেন। মেলায় জমা পড়ত রকমারি কারুপণ্য। অনেকেই তা সংগ্রহ করতে উদগ্রীব হতেন। হালখাতায় আমন্ত্রণ হতো অল্প লোকের, মেলায় সমাগম হতো বহুজনের।
প্রথাগত এই নববর্ষ-উৎসব একটু নতুন রূপ পেল উনিশ শতকে। শাসক প্রভুরা পয়লা জানুয়ারিতে নববর্ষ উদ্যাপন করেন, শাসিত বঙ্গসন্তানেরাও তার অনুকরণ করে। বঙ্কিমচন্দ্রের রামবাবু যখন স্ত্রীকে বললেন যে, তাঁরা নববর্ষ গণনা করেন পয়লা জানুয়ারি থেকে এবং তাই শ্যামবাবু নববর্ষের প্রথম দিনে সংবৎসরের আশীর্বাদ করতে এসেছিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘শ্বশুর ধরিতেন ১লা বৈশাখ থেকে, তুমি ধর ১লা জানুয়ারি থেকে, আমার ছেলে বোধ করি ধরিবে ১লা শ্রাবণ থেকে?’ এ-রচনা সম্ভবত ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের।
তার আগে রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপন করেন জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা (Society for the Promotion of National feeling among the educated Natives of Bengal)। রাজনারায়ণ লিখেছেন, ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভার সভ্যেরা ‘good night’ না বলিয়া ‘সুরজনী’ বলিতেন। ১লা জানুয়ারি দিবসে পরস্পর অভিনন্দন না করিয়া ১লা বৈশাখে করিতেন; আর ইংরাজী বাঙ্গলা না মিশাইয়া কেবল বিশুদ্ধ বাঙ্গলাতে কথা কহিতে চেষ্টা করিতেন। যে একটি ইংরাজী শব্দ ব্যবহার করিত তাহার এক পয়সা করিয়া জরিমানা হইত।’
এই বিবরণের সত্যতায় সন্দেহ করার কারণ নেই। অতএব, মনে করতে হবে যে, হালখাতার অনুষ্ঠানের বাইরে, সামাজিকভাবে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের শুরু ১৮৬১-৬২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে।
আমার ছেলেবেলায়, চল্লিশের দশকের শুরুতে, ইংরেজশাসিত কলকাতায় আমরা হালখাতা-অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচলন দেখেছি, নৃত্যগীতবাদ্য-সহযোগে এর উদ্যাপন দেখিনি। সেটা দেখলাম ১৯৪৯-৫০ সালে, ঢাকায়। লেখক-শিল্পী মজলিসের উদ্যোগে নববর্ষ পালিত হয়েছিল মেহবুব আলী ইনস্টিটিউটে। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদে ১৯৫২-৫৩ সালে আমরা নববর্ষ উৎসব করেছি কবিতা পড়ে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়ের পর এ কে ফজলুল হক নাকি সাড়ম্বরে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন সবাইকে—ঘটনাটা আমার মনে নেই, কিন্তু কারও কারও রচনায় এমনই দেখেছি।
ততদিনে কিন্তু পাকিস্তান সরকার নববর্ষ পালনকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী একটি প্রবন্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন যে, পারস্যে যদি ইসলামপূর্ব নওরোজ উৎসব অব্যাহতভাবে চলে আসতে পারে, তার অনুকরণে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে যদি নওরোজ উৎসব অনুষ্ঠিত হতে পারে, তাহলে আমরা কেন বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করতে পারব না—বিশেষ করে, বাংলা বর্ষ যেখানে মোগলদের প্রবর্তন বলে সর্ববাদিসম্মত? পাকিস্তানের শাসকেরা কিন্তু একে বিজাতীয় অনুষ্ঠান বলে গণ্য করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। ফলে, শাসকদের বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবে উদ্বুদ্ধ আমরা বাংলা নববর্ষ পালনে তৎপর হয়ে পড়লাম। এ ক্ষেত্রে ছায়ানটের ভূমিকা ছিল সর্বপ্রধান।
ছায়ানটের নববর্ষ উদ্যাপন অচিরেই জাতীয় উৎসবের রূপ পরিগ্রহ করে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা আয়োজিত মেলা দর্শককে আকর্ষণ করে। ঢাকার অনুসরণে অন্যান্য শহরেও মহাসমারোহে নববর্ষ পালিত হতে থাকে। বস্তুত বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে যেমন সাড়ম্বরে নববর্ষ পালিত হয়, ভারতের বাংলাভাষী অঞ্চলে তা হয় না। আমাদের ভারতীয় বন্ধুরা খুবই অবাক হন এখানে নববর্ষ উৎসবের এই আকারপ্রকার দেখে।
বেশ কিছুকাল আগে নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমাদের এক সহকর্মী-বন্ধু আমাদের নববর্ষ উদ্যাপন নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এ দিনে নাগরিক মধ্যবিত্ত যখন সানকিতে করে পান্তা-ইলিশ খায়, তাঁর মনে হয়, তাঁরা চাষাভুষোদের বিদ্রূপ করছেন। তাঁর সঙ্গে আমি একমত হতে পারিনি। নিজে পান্তা-ইলিশ খাই না বটে, তবু আমি বলেছিলাম, উৎসবের দিনে বিশেষ আয়োজনই স্বাভাবিক। বছরের অন্য দিনে আমরা যা খাই না, উৎসবের দিনে তারই ব্যবস্থা করি। এই সেদিন এক তরুণ সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করলেন, এখন নববর্ষের দিনে নতুন কাপড় ও ইলিশ মাছ কেনার যে হুড়োহুড়ি লেগে গেছে, তাতে নববর্ষের অনভিপ্রেত বাণিজ্যিকীকরণ ঘটছে কি না। আমি বললাম, উৎসব উপলক্ষে সামর্থ্য থাকলে সাজসজ্জার এবং খাবারের বিশেষ আয়োজন আবশ্যিক না হলেও প্রথাসম্মত। ঈদে বা পুজোয় এমনটি হয়। নববর্ষ উপলক্ষে তেমন হলে ক্ষতি কী!
নববর্ষের দিনটি আলোয়-ফুলে-গানে-সাজে ভরে উঠুক। আমাদের চিত্ত পরিপূর্ণ হোক। দুহাত বাড়িয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে হূদয় থেকে নিঃসৃত হোক: তুমি এসো, তুমি এসো, তুমিও এসো এবং তুমি।
No comments