মধ্যযুগের দিকে নয়, সামনে যেতে চাই by মহসীন হাবিব
শিক্ষক, ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদ বলতেন, 'আমরা পেছন ফিরে হাঁটছি।' তিনি আজ বেঁচে নেই। যারা আমাদের পেছনের দিকে ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে, তাদেরই একটি অংশ হুমায়ুুন আজাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুরুতর আহত করে এবং তিনি মারা যান।
তিনি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন কিভাবে আমরা পেছনের দিকে হাঁটছি। সে হাঁটার গতি যে দিন দিন আরো কত দ্রুত হচ্ছে তা লক্ষ করলে গা শিউরে ওঠে।
একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড। অসংখ্য মেধাবী ছাত্র পাস করে বেরিয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, যাঁরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন। তুখোড় শিক্ষক হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের অন্যান্য খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দৌড়ে একেবারে পেছনের সারিতে ছিল না। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আজ কোথায়? কয়েক দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে টাইমস এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ২০১০-১১ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে এশিয়ার ৬০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে 'প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামগন্ধ নেই! বাকি বিশ্বের কথা বাদ দিলাম। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ের ক্রাইটেরিয়ায় শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর মান বা সংখ্যা দিয়ে বিচার করা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়, পেপার ওয়ার্কসের মান ও পরিমাণ, সায়েন্টিফিক পেপার্স, রিসার্চ সব কিছু মিলিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ণয় করা হয়ে থাকে। সুতরাং শুধু শিক্ষার্থীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কমে যাওয়ার জন্য দায়ী নয়। তবে শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগের নৈতিক স্খলন এবং লেখাপড়ায় মনোনিবেশে যে অনীহা সে জন্য দায়ী কে তা এক কথায় বলা মুশকিল। পারিবারিক সংস্কৃতি, শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষকের আদর্শ, রাজনৈতিক নেতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসহ অনেক কিছুর বিচার করতে হয়। সে আলোচনায় যাব না। অন্যান্য বিশ্বব্যিালয়ের অবস্থা আরো করুণ, সে আলোচনা আরো দীর্ঘ।
তবে মানুষ গড়ার প্রথম সিঁড়ি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, স্কুল। সে শিক্ষার চেহারা কেমন বাংলাদেশে? ৩৫ লাখ শিক্ষার্থী বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে 'লেখাপড়া' করে। সে মাদ্রাসাকে কোনোক্রমেই আধুনিক, যুগোপযোগী করতে দেওয়া হচ্ছে না। যেন বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কেউ নেই। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের প্রণীত শিক্ষানীতিকে দেশের সচেতন সমাজ যারপরনাই প্রশংসা করেছেন। এমন কথাও বলা হয়েছে, এযাবৎকালের সবচেয়ে প্রশংসনীয় ও গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি। কিন্তু এক শ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল নেমেছে এ শিক্ষানীতি বাতিল করার আন্দোলনে। তারা নারী অধিকার নিয়ে বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাতিলের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। দেশ পেছনের দিকে হাঁটছে না তো কী?
একটি সমাজে যখন অন্যায় সব কিছু গ্রাস করে নিতে থাকে, তখন সমাজকে দিকনির্দেশনা দেন লেখক-সাহিত্যিকরা তাঁদের লেখনীর মধ্য দিয়ে। যেমন দিয়েছেন আহমদ শরীফ তাঁর প্রবন্ধে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালুর মতো উপন্যাসে, আবুল মনসুর আহমদ আসমানি পর্দা বা আহলে সুন্নতের মতো গল্পের মধ্য দিয়ে। জুজুবুড়ির ভয়ে এ ধরনের সাহিত্যকর্ম বাংলাদেশে এখন একপ্রকার নিষিদ্ধ। শুধু ছোটকাগজে (লিটল ম্যাগজিন) কিছু লেখা হয়, যা সাধারণ মানুষের কাছে পেঁৗছে না। যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে উপলব্ধি প্রয়োজন, সে জনগোষ্ঠী ওসব ছুঁয়েও দেখে না। যাঁরা পাকিস্তানের পত্রপত্রিকা ইন্টারনেটের বদৌলতে প্রতিনিয়ত দেখেন, ডন পত্রিকার নিবন্ধ পড়েন তাঁরা জানেন সেখানে কত সাহসী আন্তর্জাতিক মানের লেখা ছাপা হয়। ডনের সম্পাদকীয় পাতায় কী ছাপা হচ্ছে তা মার্কিন রাজনীতিবিদ ও ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা মনোযোগ দিয়ে পড়েন বলে জানতে পেরেছি। রাজনীতির প্রতিহিংসা বা প্রতিহিংসার রাজনীতি প্রাচীনকালের রাজা-বাদশাদের নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। ৩০ মার্চ বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি দলীয় সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে খুশির সঙ্গে সুর করে টেনে বললেন, ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকার যে আচরণ করেছে তার ফল কী হয়েছে? ওই আচরণ করার জন্য জাপান এখন আর পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থ দেবে না। সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি-সমর্থক অডিয়েন্স থেকে হাততালি ও উল্লাস শোনা গেল! যেন পদ্মা সেতু হলে তা বাংলাদেশ নয়, আওয়ামী লীগ ব্যবহার করবে। প্রতিহিংসা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! এ প্রতিহিংসা এবং অগণতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে আজ এই সভ্য যুগে বাংলাদেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। অথচ অপ্রিয় সত্য হলো, পাকিস্তানের ক্ষমতালিপ্সু শাসকদের সময় এমন ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়নি। '৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে একচেটিয়া জয়লাভ করেছিল বিরোধীরা। শাসকরা সে নির্বাচনকে ডাকাতি করে কেড়ে নিতে পারেনি। বরং কী ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমরা দেখেছি? সে নির্বাচনে আবুল মনসুর আহমেদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুসলিম লীগ থেকে মনোনীত আবুল কালাম শামসুদ্দিন। সবাই বুঝতে পেরেছিলেন, মুসলিম লীগের পক্ষে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। তখন তাঁর সম্মান রক্ষার জন্য আবুল মনসুর আহমেদরা তাঁর পক্ষে কিছু ভোট দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যেন শামসুদ্দিনের সম্মান রক্ষা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে একচেটিয়া ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৬০ আসন। পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে ভোট বাঁচাতে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন পড়েনি। আজ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলেই মধ্যযুগীয় কায়দায় ক্ষমতা ধরে রাখতে লাঠিসোঁটা নিয়ে, পুলিশ ও সরকারি মেশিনারি ব্যবহার করে সব ভোট কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকারের প্রশাসনকে ব্যবহার করে কোটি কোটি মিথ্যা ভোট বানিয়ে জয় নিশ্চিত করা হয়। মনে পরে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির সেই কুখ্যাত নির্বাচনের কথা? তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান কে হবেন তা আগে থেকে ঠিক করে রাখতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর যে অপরাজনীতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তার চেয়ে গণতন্ত্রের পেছনের ইতিহাসকে আমরা বেশি নোংরা দেখিনি।
আজ সরকার চেষ্টা করছে দেশকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু সরকারি দলের সমর্থকরা, নেতা-কর্মীরা কী করছেন? এই আধুনিক যুগে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন এবং জনগণকে দেখাচ্ছেন, তখন মফস্বল শহর, গ্রামবাংলার চিত্র কী? বলিউডের কল্পনানির্ভর সিনেমাকেও হার মানায়। আওয়ামী লীগের থানা কমিটির সমাজকল্যাণ সম্পাদক পর্যন্ত থানা নিয়ন্ত্রণ করেন, ওসি সাহেবের সঙ্গে বসে চা খান এবং মামলা কোনটা নিতে হবে আর কোনটা নেওয়া যাবে না তার পরামর্শ দেন। এতে প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক, এ দেশের গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষদের সমর্থন পাওয়া, স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী দল আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি কোথায় যাচ্ছে, তা কি দলের নীতিনির্ধারক মহল একবার ভেবে দেখেছেন? একবার শীর্ষ পর্যায়ের পক্ষে এসব আচরণ থেকে বিরত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? সম্প্রতি একজন সচেতন নাগরিক আমাকে মুঠোফোনে বলেছেন, দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে! আওয়ামী লীগের কাছে প্রশ্ন, তারা কি দেশবাসীকে আবার বাগমারার মধ্যযুগীয় বর্বরতা, সিএনজি কেলেঙ্কারি, খাম্বা কেলেঙ্কারিসহ লুটপাটের মধ্যে দেশের মানুষকে ঠেলে দিতে চায়? তারা কী দেশবাসীকে বিমানবন্দরে গিয়ে কোনো অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু, অসাধু, লুটপাটকারীকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করার দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে? আমরা মধ্যযুগে ফিরে যেতে চাই না। আমরা সত্যিকার, আধুনিক আর ১০টি দেশের মতো স্বাভাবিক গণতন্ত্রের বিকাশ দেখতে চাই। সার্বিকভাবে আমাদের সেদিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড। অসংখ্য মেধাবী ছাত্র পাস করে বেরিয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, যাঁরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন। তুখোড় শিক্ষক হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের অন্যান্য খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দৌড়ে একেবারে পেছনের সারিতে ছিল না। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আজ কোথায়? কয়েক দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে টাইমস এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ২০১০-১১ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে এশিয়ার ৬০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে 'প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামগন্ধ নেই! বাকি বিশ্বের কথা বাদ দিলাম। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ের ক্রাইটেরিয়ায় শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর মান বা সংখ্যা দিয়ে বিচার করা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়, পেপার ওয়ার্কসের মান ও পরিমাণ, সায়েন্টিফিক পেপার্স, রিসার্চ সব কিছু মিলিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ণয় করা হয়ে থাকে। সুতরাং শুধু শিক্ষার্থীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কমে যাওয়ার জন্য দায়ী নয়। তবে শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগের নৈতিক স্খলন এবং লেখাপড়ায় মনোনিবেশে যে অনীহা সে জন্য দায়ী কে তা এক কথায় বলা মুশকিল। পারিবারিক সংস্কৃতি, শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষকের আদর্শ, রাজনৈতিক নেতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসহ অনেক কিছুর বিচার করতে হয়। সে আলোচনায় যাব না। অন্যান্য বিশ্বব্যিালয়ের অবস্থা আরো করুণ, সে আলোচনা আরো দীর্ঘ।
তবে মানুষ গড়ার প্রথম সিঁড়ি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, স্কুল। সে শিক্ষার চেহারা কেমন বাংলাদেশে? ৩৫ লাখ শিক্ষার্থী বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে 'লেখাপড়া' করে। সে মাদ্রাসাকে কোনোক্রমেই আধুনিক, যুগোপযোগী করতে দেওয়া হচ্ছে না। যেন বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কেউ নেই। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের প্রণীত শিক্ষানীতিকে দেশের সচেতন সমাজ যারপরনাই প্রশংসা করেছেন। এমন কথাও বলা হয়েছে, এযাবৎকালের সবচেয়ে প্রশংসনীয় ও গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি। কিন্তু এক শ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল নেমেছে এ শিক্ষানীতি বাতিল করার আন্দোলনে। তারা নারী অধিকার নিয়ে বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাতিলের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। দেশ পেছনের দিকে হাঁটছে না তো কী?
একটি সমাজে যখন অন্যায় সব কিছু গ্রাস করে নিতে থাকে, তখন সমাজকে দিকনির্দেশনা দেন লেখক-সাহিত্যিকরা তাঁদের লেখনীর মধ্য দিয়ে। যেমন দিয়েছেন আহমদ শরীফ তাঁর প্রবন্ধে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালুর মতো উপন্যাসে, আবুল মনসুর আহমদ আসমানি পর্দা বা আহলে সুন্নতের মতো গল্পের মধ্য দিয়ে। জুজুবুড়ির ভয়ে এ ধরনের সাহিত্যকর্ম বাংলাদেশে এখন একপ্রকার নিষিদ্ধ। শুধু ছোটকাগজে (লিটল ম্যাগজিন) কিছু লেখা হয়, যা সাধারণ মানুষের কাছে পেঁৗছে না। যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে উপলব্ধি প্রয়োজন, সে জনগোষ্ঠী ওসব ছুঁয়েও দেখে না। যাঁরা পাকিস্তানের পত্রপত্রিকা ইন্টারনেটের বদৌলতে প্রতিনিয়ত দেখেন, ডন পত্রিকার নিবন্ধ পড়েন তাঁরা জানেন সেখানে কত সাহসী আন্তর্জাতিক মানের লেখা ছাপা হয়। ডনের সম্পাদকীয় পাতায় কী ছাপা হচ্ছে তা মার্কিন রাজনীতিবিদ ও ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা মনোযোগ দিয়ে পড়েন বলে জানতে পেরেছি। রাজনীতির প্রতিহিংসা বা প্রতিহিংসার রাজনীতি প্রাচীনকালের রাজা-বাদশাদের নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। ৩০ মার্চ বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি দলীয় সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে খুশির সঙ্গে সুর করে টেনে বললেন, ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকার যে আচরণ করেছে তার ফল কী হয়েছে? ওই আচরণ করার জন্য জাপান এখন আর পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থ দেবে না। সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি-সমর্থক অডিয়েন্স থেকে হাততালি ও উল্লাস শোনা গেল! যেন পদ্মা সেতু হলে তা বাংলাদেশ নয়, আওয়ামী লীগ ব্যবহার করবে। প্রতিহিংসা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! এ প্রতিহিংসা এবং অগণতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে আজ এই সভ্য যুগে বাংলাদেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। অথচ অপ্রিয় সত্য হলো, পাকিস্তানের ক্ষমতালিপ্সু শাসকদের সময় এমন ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়নি। '৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে একচেটিয়া জয়লাভ করেছিল বিরোধীরা। শাসকরা সে নির্বাচনকে ডাকাতি করে কেড়ে নিতে পারেনি। বরং কী ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমরা দেখেছি? সে নির্বাচনে আবুল মনসুর আহমেদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুসলিম লীগ থেকে মনোনীত আবুল কালাম শামসুদ্দিন। সবাই বুঝতে পেরেছিলেন, মুসলিম লীগের পক্ষে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। তখন তাঁর সম্মান রক্ষার জন্য আবুল মনসুর আহমেদরা তাঁর পক্ষে কিছু ভোট দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যেন শামসুদ্দিনের সম্মান রক্ষা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে একচেটিয়া ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৬০ আসন। পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে ভোট বাঁচাতে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন পড়েনি। আজ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলেই মধ্যযুগীয় কায়দায় ক্ষমতা ধরে রাখতে লাঠিসোঁটা নিয়ে, পুলিশ ও সরকারি মেশিনারি ব্যবহার করে সব ভোট কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকারের প্রশাসনকে ব্যবহার করে কোটি কোটি মিথ্যা ভোট বানিয়ে জয় নিশ্চিত করা হয়। মনে পরে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির সেই কুখ্যাত নির্বাচনের কথা? তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান কে হবেন তা আগে থেকে ঠিক করে রাখতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর যে অপরাজনীতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তার চেয়ে গণতন্ত্রের পেছনের ইতিহাসকে আমরা বেশি নোংরা দেখিনি।
আজ সরকার চেষ্টা করছে দেশকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু সরকারি দলের সমর্থকরা, নেতা-কর্মীরা কী করছেন? এই আধুনিক যুগে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন এবং জনগণকে দেখাচ্ছেন, তখন মফস্বল শহর, গ্রামবাংলার চিত্র কী? বলিউডের কল্পনানির্ভর সিনেমাকেও হার মানায়। আওয়ামী লীগের থানা কমিটির সমাজকল্যাণ সম্পাদক পর্যন্ত থানা নিয়ন্ত্রণ করেন, ওসি সাহেবের সঙ্গে বসে চা খান এবং মামলা কোনটা নিতে হবে আর কোনটা নেওয়া যাবে না তার পরামর্শ দেন। এতে প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক, এ দেশের গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষদের সমর্থন পাওয়া, স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী দল আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি কোথায় যাচ্ছে, তা কি দলের নীতিনির্ধারক মহল একবার ভেবে দেখেছেন? একবার শীর্ষ পর্যায়ের পক্ষে এসব আচরণ থেকে বিরত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? সম্প্রতি একজন সচেতন নাগরিক আমাকে মুঠোফোনে বলেছেন, দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে! আওয়ামী লীগের কাছে প্রশ্ন, তারা কি দেশবাসীকে আবার বাগমারার মধ্যযুগীয় বর্বরতা, সিএনজি কেলেঙ্কারি, খাম্বা কেলেঙ্কারিসহ লুটপাটের মধ্যে দেশের মানুষকে ঠেলে দিতে চায়? তারা কী দেশবাসীকে বিমানবন্দরে গিয়ে কোনো অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু, অসাধু, লুটপাটকারীকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করার দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে? আমরা মধ্যযুগে ফিরে যেতে চাই না। আমরা সত্যিকার, আধুনিক আর ১০টি দেশের মতো স্বাভাবিক গণতন্ত্রের বিকাশ দেখতে চাই। সার্বিকভাবে আমাদের সেদিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
No comments