জিএমের বাংলোয় থাকেন আরো ছয় কর্মকর্তা!-মন্ত্রীর নাম করেই টাকা তোলা হতো by ভূঁইয়া নজরুল

চট্টগ্রামের সিআরবি পাহাড়ের ওপরে রেলওয়ের আদি বাংলোটি পদাধিকার বলে পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধার বাসভবন হলেও এখানে জিএম ছাড়াও রেলের আরো ছয়জন উচ্চ পদের কর্মকর্তা থাকেন। এসব কর্মকর্তার আবার প্রত্যেকের নামে ঢাকায় রেলওয়ের বাংলো বরাদ্দ রয়েছে।


অভিযোগ পাওয়া গেছে, নিজের বাংলোতে ছয়জন কর্মকর্তাকে থাকতে দিয়ে তাঁদের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের কর্মকাণ্ড চালাতেন ইউসুফ আলী মৃধা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের জানুয়ারি মাসে জিএম হিসেবে বাংলোটি বরাদ্দ পাওয়ার পরই সেখানে অন্য কর্মকর্তাদের থাকার সুযোগ করে দেন ইউসুফ আলী মৃধা। পরে ওই বছরের ১৮ মে বাংলোটিতে ডাকাতির পর কয়েকজন কর্মকর্তা ভয়ে চলে গেলেও আরো একাধিক কর্মকর্তা ওই বাংলোতে ওঠেন।
কে কে থাকেন- খোঁজ নিতে গতকাল শুক্রবার বিকেলে ওই বাংলোয় গিয়ে দেখা যায়, রেলওয়ে নিয়োজিত আনসার মোহাম্মদ ইসমাইল ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু বাংলোটির ভেতরে লাইট ও ফ্যান চলছে। তা দেখে ভেতরের লোকদের ডেকে দেওয়ার কথা বললেও ইসমাইল বলেন, 'ভেতরে কেউ নেই। একটু আগে প্রধান প্রকৌশলী ভেতর দিয়ে বন্ধ করে পেছনের দরজায় তালা লাগিয়ে বের হয়ে গেছেন। আর বাবুর্চি কিংবা আয়াদের কেউ এখন নেই।' পেছনের দরজায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো তালা নেই এবং ভেতরের লোকদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও কেউ কোনো সাড়াশব্দ করেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জিএমের বাংলোতে থাকা রেলের ছয় কর্মকর্তা হলেন- প্রধান অর্থ-উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা গৌর চন্দ্র রায়, প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আখতারুজ্জামান হায়দার, প্রধান প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক, প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান, প্রধান প্রকৌশলী (বৈদ্যুতিক) শাফাউদ্দিন আহমেদ ও বিভাগীয় কারখানা তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদ।
জিএমের বাংলোতে থাকার কথা স্বীকার করে বিভাগীয় কারখানা তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদ গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা যাঁরা এই বাংলোতে থাকি, তাঁদের প্রত্যেকের নামে ঢাকায় বাংলো বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু আমাদের পরিবার ঢাকায় থাকে আর আমাদের কর্মস্থল এখানে। তাই আমরা জিএমের সম্মতিতে এই বাংলোতে থাকছি। তবে এই বাংলোটি জিএমের জন্য নির্ধারিত।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক কর্মকর্তা বলেন, 'জিএমের নামে ঢাকার শাহজাহানপুরে রেলওয়ে অফিসার্স কোয়ার্টার ডি-১ বরাদ্দ রয়েছে এবং সেই বাংলোতেই তাঁর পরিবার থাকে। আর এখানে তাঁর পরিবার না থাকায় বিশাল এই বাংলোটিতে আমরা ছয় কর্মকর্তা থাকছি।'
এই বাংলোটি শুধু জিএমের জন্য বরাদ্দ- এ কথা জানিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'আইনত এই বাংলোতে জিএম ছাড়া অন্য কারো থাকার কোনো সুযোগ নেই। পদাধিকার বলে শুধু জিএম এখানে থাকতে পারেন। যুগ যুগ ধরে এই প্রথাই চলে আসছে। আগে কখনো এভাবে অন্যদের থাকার সুযোগ ছিল না।'
জিএম নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য ঊর্ধ্বতন রেল কর্মকর্তাদের নিজের বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন জানিয়ে রফিক চৌধুরী নামের অপর এক শ্রমিক নেতা বলেন, 'অধিনস্ত এসব কর্মকর্তাদের দিয়ে অবৈধভাবে কাজ করার সুবিধার কথা বিবেচনা করেই তাঁদের থাকার সুযোগ দিয়েছেন জিএম।'
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল রেলের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) মোহাম্মদ সোলায়মান চৌধুরী, চিফ পার্সোনাল অফিসার গাউস আল মনির ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোকসেদুল আরেফীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁদের কেউ মোবাইল ফোন ধরেননি।
জানা যায়, ১৮২০ সালে সিআরবিতে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলের রেল প্রধানের বাসভবনের জন্য ১৯০৩ সালে পাহাড়ের ওপরে এই বাংলোটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৪৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের প্রধানের বাসভবন, ১৯৬০ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ের চেয়ারম্যানের বাসভবন এবং ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রধানের বাসভবন ছিল এটি। ১৯৮২ সালে রেলওয়েকে পূর্ব ও পশ্চিম দুই ভাগে ভাগ করার পর এই বাংলোটি পূর্বাঞ্চলের জিএমের বাংলো হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
রেলমন্ত্রীর নামেই টাকা উঠাতেন জিএম : রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দেওয়ার নাম করেই চট্টগ্রাম থেকে টাকা উঠাতেন পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা। নিয়োগ বাণিজ্যের অপরাধে রেলওয়ের সুনামক্ষুন্নের কারণে তাঁকে অপসারণের দাবি জানানো হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়।
সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী মোখলেছুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'এ পর্যন্ত একটি পদেও টাকা ছাড়া নিয়োগ হয়নি। রেলমন্ত্রীকে দিতে হবে- এই কথা বলেই চাকরি-প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলতেন জিএম ইউসুফ আলী মৃধা।' তিনি আরো বলেন, 'আমরা চাই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীরা বের হয়ে আসুক। এতে জিএম ও এপিএস যদি মন্ত্রীর নাম ব্যবহারও করে থাকেন, তাহলে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তা বের হয়ে আসবে।'
ঘুষ বাণিজ্যে মন্ত্রীর নাম ব্যবহার করা হচ্ছে, এই বিষয়টি গত ১২ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রীর কাছে ফ্যাক্সযোগে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ফ্যাক্স পাঠানোর পর গত ২৮ মার্চ রেলওয়ে সংগ্রাম পরিষদের ১৪ জন প্রতিনিধি রেলভবনে রেলমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হলে আজ রেলওয়ের সুনাম এভাবে নষ্ট হতো না।
রেল পরিচালনার স্বার্থে আগামী ১০ দিনের মধ্যে বাকি নিয়োগ শেষ করার দাবি জানিয়েছেন সংগ্রাম পরিষদের নেতারা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, মামলার কারণে স্টেশন মাস্টার, গার্ড, অফিস করণিকসহ কিছু পদে লোক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। রেল পরিচালনার স্বার্থে এসব মামলা নিষ্পত্তি করে জরুরি লোক নিয়োগ দেওয়া হোক।

No comments

Powered by Blogger.