আশরাফুলের ঈদ কেটেছে পথে ঘাটে, মানুষ টেনে by মুনিফ আম্মার

কপাল থেকে ঝরছে ঘাম। গায়ে জড়ানো শীর্ণ জামাও ঘামে ভেজা। ভরদুপুরের রোদ মাথায় আশরাফুল দ্রুত পা চালাচ্ছে রিকশার প্যাডেলে। রিকশায় তখন এক বড় সাহেব বসে আছেন। সাহেবের গা থেকে সুগন্ধ ভেসে আসছে।

চারপাশের ছড়িয়ে পড়ছে সে সুবাস। সুবাসটুকু কেবল পাচ্ছে না রিকশা চালক আশরাফুল। তার মুখ থেকে তখন বেরিয়ে আসে, ‘কতো সাহেব এমন রিকশায় ওঠে। তাদের গায়ে কতো সুন্দর জামা থাকে। সেন্ট মেরে আসে। সেগুলি দেখে আমার কি হবে? আমারতো রিকশা চালিয়েই খেতে হবে।” স্পষ্ট, শুদ্ধ বাংলায় একজন রিকশা চালক (!) আশরাফুলের মুখে এমন অভিমানের কথা শুনে খানিকটা থেমে যেতে হয়। পরের কথা থেকে জানা যায় অনেক কিছু। বেরিয়ে আসে আশরাফুলের রিকশা চালক (!) হওয়ার ঘটনা।
আশরাফুলের বাড়ি পদ্মার ওপারে, সিরাজগঞ্জে। বয়স আর কতই বা হবে? আঠারো কি উনিশ। দরিদ্র এক পরিবারে জন্ম। তিন ভাই আর এক বোনের মাঝে আশরাফুল সবার ছোট। ছোট বলেই তুলনামূলক আদরের ভাগটা ওর জন্যই বেশি ছিল। কিন্তু নিয়তি এমন, আদরের আশরাফুলকেই পথে নামিয়েছে রিকশা চালাতে, পেট চালাতে।

প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে কত টাকা আয় হয়, আশরাফুলকে যখন এমন প্রশ্ন করি, তখন সে থেমে যায় খানিকটা সময়ের জন্য। দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বলে, “আমি তো প্রতিদিন রিকশা চালাই না। মাঝে মাঝে চালাই।” তো বাকি সময়টা কী করো? প্রশ্নের বিপরীতে উত্তর এলো, “পড়াশোনা করি, ইনটারমেডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে। পেটের দায়ে আর পড়াশোনার খরচ জোগাতে মাঝে মাঝে রিকশা চালাই”

কথা শুরু হলো আশরাফুল মুখ থেকে। দুঃখ আর কষ্টে মাখা কথা, তবে বেশ শক্তিতে ভরপুর। খানিকটা অভিমানও আছে সেই কথায়। “আমাদের তো ভাগ্যই এমন। গরিবের ঘরে জন্মেছি। আর তাইতো আমার মতোই ইন্টারে পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীকে প্রতিদিন কলেজে পৌঁছে দিই রিকশা চালিয়ে। তারা জানতেও পারে না, এই আমি তাদের মতোই একজন, ইন্টারে পড়ি। কী দুর্ভাগ্য আমার!”

আশরাফুলের চোখে জল। গলায় রাখা গামছায় মুছে নিল। “চোখের জল আর গায়ের ঘাম শরীর বেয়ে কখন যে মাটিতে গড়িয়ে তার খবর কি কেউ রাখে?” আশরাফুলের প্রশ্ন। এমন প্রশ্নের উত্তর নেই জেনে সে আবার বলতে থাকে, “ফার্স্ট ইয়ারে খুব একটা ভালো রেজাল্ট করতে পারি নি। সংসারের পিছুটান, শরীরও বাধ সাধে মাঝে মাঝে। পড়াশোনার অতো সময় কই আমার? গ্রামে থাকলে হাল চাষের কাজে নেমে পড়ি। কি রোদ, কি বৃষ্টি সারাদিন ক্ষেতের কাজ শেষে রাতের বেলায় পড়ায় কি আর মন বসানো যায়? রেজাল্টটা এজন্যই ভালো করতে পারি নি।”

কণ্ঠে তার আত্মবিশ্বাসও প্রচুর। ভবিষ্যতের রেজাল্ট নিয়ে আশাবাদিও খুব। কষ্ট হোক না যতই, পড়াশোনাটা তার ঠিক ভাবেই শেষ করা চাই। আর তাইতে ঈদের এই সময়ে আশরাফুলের আর বন্ধুরা যখন উৎসবে মেতে আছে, আশরাফুল তখন ঢাকার অলিগলিতে রিকশা চালাচ্ছে। দু’টো পয়সার জন্য, যা দিয়ে চলবে সংসার আর পড়াশোনার খরচ।”

পরিবারের আর খোঁজ খবর জানতে চাওয়ার আগে নিজেই বলে উঠলো, “আমারও তো মা বাবা আছে। ঈদের দিনে তারাও তো আমার দিকে তাকিয়ে আছে।  যদিও ঈদ আমাদের কাছে বিশেষভাবে ধরা দেয় না, তবুও ছোট ছেলেটিকে কাছে না পেয়ে মায়ের এই দিনটি কেমন যাবে, তা আমি বুঝি। কিন্তু কী করা? আমরা তো আর সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাই নি।”
   
“খুব কষ্ট করে বড় হচ্ছি ভাই। রিকশা চালাই, পড়াশোনাও চালাই, আবার সংসারও চালাই।” সংসারে কথা বলতে গিয়ে আবারো থেমে গেলো আশরাফুল। হয়তো নিজের কষ্ট নিজের কাছে রাখতেই তার থেমে যাওয়া। অথবা, পথে ঘাটে মানুষের কাছে কষ্টের কথা বলে কী হবে, তাই বলে আর কি লাভ। এরপর অনেকটা সময় ধরে জানতে চাইলাম আশরাফুলের অনেক কথা। কিন্তু অভিমানী আশরাফুলের মুখ থেকে বেরুলো না আর কিছুই। কেবল বললো, “শুনে কি হবে? আমার তো রিকশাই চালাতে হবে।”

 আর কো কথা জানার সাহসও হলো না। কেবল নিজের উপর রাগ হলো আমার। আমাদের সমাজ কেন আশরাফুলদের রিকশা চালাতে বাধ্য করে? কেন তার শিক্ষার্থী পরিচয় ছাপিয়ে ‘রিকশা চালক (!)’ পরিচয় মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়?  ভাবনায় ছেদ পড়ে আশরাফুলের হাসিতে। বলে, “কি ভাবছেন ভাই? এটাই তো নিয়ম, এমন হওয়াই স্বাভাবিক।” বলতে বলতে হাতের মুঠোয় একটি একটি কাগজ গুঁজে দিল। খুলে দেখি তাতে একটি মোবাইল নম্বর লেখা।

হঠাৎ পাশ থেকেই ডাক এলো, “এই রিকশা যাবা?” আশরাফুল মুখ ফেরালো সেদিকেই। “সময় পেলে ফোন দিয়েন” বলেই আবারো রিকশার প্যাডেলে পা চালালো উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী আশরাফুল।

ঈদের দিন মিরপুরে আশরাফুলের সঙ্গে স্বল্প সময়ে তার সম্পর্কে জানা হলো না আমার কিছুই। কেবল জানলাম, একজন শিক্ষার্থী আশরাফুল রিকশা চালায় পড়াশোনার জন্য। মা বাবাকে ছেড়ে তার ঈদ কাটে ঢাকার পথে ঘাটে, মানুষ টেনে...।

No comments

Powered by Blogger.