পানির দেশে পানির তৃষ্ণা- আমির খান- অনুবাদ : এনামুল হক
আমির খান ভারতের একজন স্বনামধন্য চলচ্চিত্র তারকা। তবে শিল্পী হিসাবে তিনি নিজেকে একজন এন্টারটেইনারেই শুধু আবদ্ধ রাখেননি, সেই গ-ি অতিক্রম করে আরও বহুদূর ব্যাপ্ত হয়েছেন। ব্যতিক্রমী ধরনের ও সামাজিক ইস্যুনির্ভর ছায়াছবি নির্মাণ করে একজন শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতারও পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
ইদানীং তিনি বিভিন্ন স্পর্শকাতর সামাজিক সমস্যা নিয়ে টিভি চ্যানেলে উপস্থাপকের ভূমিকায় এসে প্রভূত অভিনন্দিত হয়েছেন। সম্প্রতি ভারতের পানি সমস্যা ও প্রতিকারের ওপর তাঁর লেখা একটি নিবন্ধ ‘দি হিন্দু’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এখানে সেটি তুলে ধরা হলো।
মানুষ পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে প্রাণের লক্ষণ সন্ধান করার সময় পানির অস্তিত্ব আছে কিনা দেখে। কোন গ্রহে পানির উপস্থিতি থাকা বলতে বুঝায় সেই গ্রহটি প্রাণ ধারণ করতে সক্ষম। আমরা জানি জীবন মানেই হচ্ছে পানি আর পানি মানেই জীবন।
ভারত পর্যাপ্ত পানির দেশ বলে বিবেচিত। তবে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয় এমন এলাকাসহ দেশের এক বিরাট অংশে পানির মারাত্মক অভাব দেখা দেয়। কোন কোন হিসাবে ভারতের পল্লী এলাকায় বসবাসরত মহিলারা পানি জোগাড় করে আনার জন্য প্রতিবছর গড়ে ১৪০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দেয়। এমনকি শহর এলাকায়ও মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য পৌরসভার সাপ্লাইয়ের পানি থাকা অতি সচরাচর ব্যাপার।
কেন এমন হয়? পানি যখন আমাদের পর্যাপ্ত তখন আমাদের সমস্ত পানি কোথায় যায়?
ঐতিহ্যগতভাবে ভারতীয় হিসাবে আমরা জানি কিভাবে পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হয়। তামিলনাড়ুর এরি ও ইউরানি (সনাতন যুগের পুকুর, দীঘি) থেকে শুরু করে রাজস্থানের জোহাদ পর্যন্ত গ্রাম বলুন শহর বলুন উভয় স্থানের মানুষ তাদের পানির প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রেখে কাজ করত। এই সম্মিলিত কর্মকা-ের ফলে পুকুর ও দীঘিগুলো পরিষ্কার রাখা হতো। দেয়াল বা পাড়গুলো মেরামত করা হতো এবং পানি ধারণের জায়গাগুলোতে কোনরূপ বাধাবিঘœ সৃষ্টি করতে দেয়া হতো না। এর ফলে পানির সঙ্গে আমাদের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
ব্রিটিশদের আগমনের ফলে পানির যৌথ মালিকানা ও যৌথ ব্যবহারের জায়গায় চালু হলো কেন্দ্রীভূত মালিকানা। পুকুর, দীঘি, খাল বিল জনসাধারণ নয় বরং সরকারের গণপূর্ত বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণ করত। এর জন্য জনগণের ওপর কর ধার্য করা হতো কিংবা পানি ব্যবহারের জন্য অর্থ দিতে তাদের বাধ্য করা হতো। বিশেষজ্ঞরা এ ঘটনাকে ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন হিসাবে দেখে থাকেন। হাজার হাজার পুকুর, দীঘি, জলাশয়ে তলানি জমে মজে গেল, আগাছা গজিয়ে ছেয়ে গেল। কালক্রমে এগুলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেল। শহরাঞ্চলের জলাশয়গুলো অন্য কাজে ব্যবহার করা হতে লাগল। স্বাধীনতার পর এই ধারণাটি আরও জোরদার হয়ে উঠল। জলাশয়ের অস্তিত্ব আছে বা ছিল এমন বিপুল পরিমাণ জমি বিভিন্ন ধরনের নির্মাণের কাজে ব্যবহারের জন্য পুনরুদ্ধার করা হলো। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, দিল্লীতে এক সময় লেকের সংখ্যা ছিল ৮শ’। আজ ১০টিরও কম টিকে আছে। অন্যান্য শহরের পরিস্থিতিও এ থেকে ভিন্ন কিছু নয়।
পানি ধারণ করে রাখতে আমাদের অস্বীকৃতি এবং যেসব জমিতে আমাদের জলাশয়গুলোর অস্তিত্ব ছিল সেগুলোর প্রতি আমাদের অন্তত ক্ষুধার উল্টো দিক হলো বন্যা। লেক, দিঘী, পুকুর যেগুলো আমাদের বৃষ্টির পানি ধারণ করে রাখত সেগুলো এখন কংক্রিটের জঙ্গলের অংশে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টির পানি ক্রমবর্ধমান হারে প্রায়শ বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং আমাদের নগরীগুলোকে বিপন্ন করে তুলেছে।... কোন কোন ক্ষেত্রে প্লাবিত করছে যেমন ঘটেছিল ২০০৫ সালের ২৬ জুলাই মুম্বাইয়ে। এসব ঘটনা কেবল বৃদ্ধিই পাবে মাত্র।
পানি সঙ্কট
ভারতের বড় নগরীগুলো তাদের চারপাশের গ্রামাঞ্চলের নদ-নদী ও হ্রদ থেকে শত শত কিলোমিটার ধরে আঁকাবাঁকাভাবে যাওয়া পাইপলাইন দিয়ে পানি সংগ্রহ করে। এর ফলে এসব নদ-নদীর চারপাশে বসবাসরত জনগণ নিজেদের পানি থেকে বঞ্চিত হয়। ভাতসা নদীর ৫২ শতাংশ পানি মুম্বাই নগরীতে সরবরাহ করা হয়। অথচ নদীর দুই তীরে বসবাসরত শাহপুরের জনগণ নিজেদের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য ট্যাঙ্কারের ওপর নির্ভর করে। একে কেবল নিষ্ঠুর প্রহসন বলেই আখ্যায়িত করা চলে। অথচ তারপরও আমরা শহরমুখী মানুষের ঢল সম্পর্কে অভিযোগ করে থাকি।
আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চল বিশেষত যেগুলো বারোমেসে নদ-নদীর কাছাকাছি নয় সেগুলোর মানুষ নলকূপ বসিয়ে নিজেদের পানির চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে এসেছে। ভূগর্ভস্থ পানি মাত্রাতিরিক্ত হারে আহরণের ফলে পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষকদের মধ্যে নলকূপ গভীর থেকে গভীরতর পরিসরে স্থাপনের প্রতিযোগিতা চলে। অন্ধ্র প্রদেশের কোন কোন গ্রামে অধিবাসীর সংখ্যা যত না তার চেয়ে বেশি হলো নলকূপের সংখ্যা। কোন একটি গ্রামের এক কৃষক ‘বোরওয়েল রেড্ডী’ নামে পরিচিত। কারণ সে নিজে ৬০টিরও বেশি নলকূপ বসিয়েছে যার সবই এখন শুকিয়ে গেছে। এইভাবে বাতিকগ্রস্ত হয়ে নলকূপ বসিয়ে চলার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নাটকীয়ভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। এদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলে এখন ভূগর্ভের পানির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং বিশাল এলাকা আজ যাকে বলে ডার্ক জোনের অধীনে চলে আসছে। ডার্ক জোন বলতে বুঝায় এমন এলাকা যেখানে ভূগর্ভের পানি বিপজ্জনক রকমের নিম্ন স্তরে চলে এসেছে।
আমরা যেভাবে আমাদের জলাশয়গুলোর দূষণ ঘটিয়ে চলেছি তাহলো প্রাণের এই উৎসের প্রতি আমাদের অমর্যাদা প্রদর্শনের আরেকটি রূপ। আমরা আমাদের নদ-নদীগুলোকে পৌর পয়ঃনিষ্কাশন ও শিল্পের বর্জ্য অপসারণের জন্য খোলা নর্দমা হিসাবে ব্যবহার করে থাকি। ভারতের বহু নদ-নদী বিশাল জায়গাজুড়ে এখন কার্যত মৃত। নদ-নদীর পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা দেখে বোঝা যায় সে নদী কি পরিমাণ জীবন ধারণ করতে সক্ষম। কিন্তু এসব নদ-নদীর দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা শূন্য। দিল্লী থেকে আগ্রা ও মথুরা হয়ে এতাওয়া পর্যন্ত যমুনা নদীর ৮শ’ কিলোমিটারের গোটা জায়গাটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। শত শত কোটি রুপী পরিষ্কার করার কাজে ব্যয় করা সত্ত্বেও পবিত্র গঙ্গা নদীর অবস্থা কিছুমাত্র ভিন্ন নয়।
শিল্প বর্জ্যরে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া আরও বেশি সর্বনাশা। আমরা আমাদের নদ-নদীকে নিষ্কাশন ব্যবস্থা হিসাবে কাজে লাগিয়ে পানিতে সিসা ও পারদের মতো ভারী ধাতব পদার্থসহ নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থ মিশ্রণের সুযোগ করে দিচ্ছি। নদীর পানি শুধু যে খাওয়ার পানি সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে তা নয়, চাষাবাদের কাজেও ব্যবহার করা হয়। দিল্লীভিত্তিক এনজিও টক্সিসলিংক পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে যে বেশ কিছু শাকসবজিতে সিসার পরিমাণ অনুমোদিত মাত্রার অনেক বেশি। অনুরূপভাবে মাছে পারদের দূষণ বেশ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। অববাহিকা এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় নদী ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জ করে থাকে। এইভাবে নদীর পানিতে মিশে থাকা বিষাক্ত পদার্থ নদীর গমন পথে থাকা প্রকাশ্য কূপ ও নলকূপগুলোর পানিকেও দূষিত করে।
এই দূষণের সবচেয়ে বিপজ্জজনক রূপটি হলো যাকে বলা হয় ডিপওয়েন ইঞ্জেকশন। এই পদ্ধতিতে শিল্পকারখানাগুলো দূষণ পরিশোধন কারখানার পিছনে অর্থ ব্যয় বাঁচানোর জন্য পৃথিবীর গভীরে দূষিত পদার্থগুলো ইনজেক্ট করে বা পাঠিয়ে দেয় এবং এইভাবে ভূগর্ভের পানিকেও দূষিত করে।
বৃষ্টির পানি সংগ্রহ
আমাদের পানির দূষণ ঘটানো বন্ধ করা এবং পানি সংরক্ষণের লক্ষ্যে কাজ করা জরুরী প্রয়োজন। সৌভাগ্যবশত শহর ও গ্রাম উভয় স্থানে এই কাজটা যে সাফল্যের সঙ্গে করা হচ্ছে তার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। রালেগান সিদ্ধিতে আন্না হাজারের কাজ, রাজস্থানে তরুণ ভারত সংঘের কাজ এবং অন্য আরও শত শত লোকের কর্মকা-ের উদ্দেশ্য হচ্ছে বৃষ্টির পানি ফুটিয়ে বা নিঃশেষিত হতে না দেয়া। এদের কাজের কোনটাই রকেট বিজ্ঞান নয় আবার নতুন কিছু নয়। বরং এতে সনাতন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করা হয়। কমিউনিটিভিত্তিক বৃষ্টির পানি সংগ্রহের মূল উপাদান হলো কমিউনিটি সৃষ্টি ও গড়ে তোলা। দু’একজন ধনী কৃষককে যদি গভীর নলকূপ বসিয়ে ক্ষেতে পানি দেয়ার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ কাজ করতে পারে না। হিউরি বাজারের মতো গ্রামগুলোতে পঞ্চায়েতরা কৃষিতে নলকূপের পানি ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। এই পদক্ষেপ এবং তার পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও ব্যবহারের পথে খরাপ্রবণ হিউরি বাজার এক বিরল গ্রামে পরিণত হয়েছে যেখানে ৫০ জনেরও বেশি কৃষিজীবী আছে যাদের জমির পরিমাণ সামান্য অথচ তারা আজ লাখপতি।
শহরগুলোতেও আবাসন সমিতিগুলো বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও ব্যবহারে সংঘবদ্ধ হয়েছে। তারা পৌরসভার পানির ওপর নিজেদের নির্ভরশীলতা বহুলাংশে কমিয়ে দিয়েছে। আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে ৫০ মিটার দূরে একটি হাউজিং সোসাইটির বৃষ্টির পানি ব্যবহারের ফলে তাদের পৌরসভার পানির ব্যবহার ৪০ শতাংশ কমে গেছে। ২০০৩ সালে চেন্নাইয়ে এক আইএএস অফিসার শান্তা শীলা নায়ার তৎকালীন আইয়াডিমএকে সরকারের সমর্থনপুষ্ট হয়ে তার এলাকার বৃষ্টির পানি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেন এবং এইভাবে পানি সঙ্কটকে নাগালের বাইরে চলে যাওয়া প্রতিহত করেন। এ সমস্ত দৃষ্টান্তই আমাদের বলে যে সমস্যার সমাধান সহজ এবং যা আমাদের হাতের মুঠোয়। আমাদের শুধু যে কাজটা করতে হবে তাহলো দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভুগে আসল কাজে নেমে পড়া।
সর্বোপরি, আমাদের এই সমস্যা থেকে আত্মপ্রসাদ পাওয়ার কারণ আছে। আমাদের কাছে পানি অফুরন্ত বলে মনে হয় এবং এখন পর্যন্ত আমাদের সবারই যেকোন মূল্যেই হোক না অন্তত কিছু না কিছু পরিমাণ পানি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ অবস্থা সব সময় থাকবে না। আমাদের সামনে যে বিপদ ঘনিয়ে আসছে তা চিহ্নিত করতে পারা জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন। ভূতের আছরের মতো এ বছর খরা যেভাবে আমাদের পিছু নিয়েছে তাতে কি শহর কি গ্রাম সর্বত্রই আমাদের ভারতীয়দের সজাগ হয়ে উঠে আজ থেকেই পানিকে মর্যাদা দেয়ার, সেটি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে কাজ করা উচিত। জয় হিন্দ। সত্যমেভ জয়তে।
মানুষ পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে প্রাণের লক্ষণ সন্ধান করার সময় পানির অস্তিত্ব আছে কিনা দেখে। কোন গ্রহে পানির উপস্থিতি থাকা বলতে বুঝায় সেই গ্রহটি প্রাণ ধারণ করতে সক্ষম। আমরা জানি জীবন মানেই হচ্ছে পানি আর পানি মানেই জীবন।
ভারত পর্যাপ্ত পানির দেশ বলে বিবেচিত। তবে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয় এমন এলাকাসহ দেশের এক বিরাট অংশে পানির মারাত্মক অভাব দেখা দেয়। কোন কোন হিসাবে ভারতের পল্লী এলাকায় বসবাসরত মহিলারা পানি জোগাড় করে আনার জন্য প্রতিবছর গড়ে ১৪০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দেয়। এমনকি শহর এলাকায়ও মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য পৌরসভার সাপ্লাইয়ের পানি থাকা অতি সচরাচর ব্যাপার।
কেন এমন হয়? পানি যখন আমাদের পর্যাপ্ত তখন আমাদের সমস্ত পানি কোথায় যায়?
ঐতিহ্যগতভাবে ভারতীয় হিসাবে আমরা জানি কিভাবে পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হয়। তামিলনাড়ুর এরি ও ইউরানি (সনাতন যুগের পুকুর, দীঘি) থেকে শুরু করে রাজস্থানের জোহাদ পর্যন্ত গ্রাম বলুন শহর বলুন উভয় স্থানের মানুষ তাদের পানির প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রেখে কাজ করত। এই সম্মিলিত কর্মকা-ের ফলে পুকুর ও দীঘিগুলো পরিষ্কার রাখা হতো। দেয়াল বা পাড়গুলো মেরামত করা হতো এবং পানি ধারণের জায়গাগুলোতে কোনরূপ বাধাবিঘœ সৃষ্টি করতে দেয়া হতো না। এর ফলে পানির সঙ্গে আমাদের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
ব্রিটিশদের আগমনের ফলে পানির যৌথ মালিকানা ও যৌথ ব্যবহারের জায়গায় চালু হলো কেন্দ্রীভূত মালিকানা। পুকুর, দীঘি, খাল বিল জনসাধারণ নয় বরং সরকারের গণপূর্ত বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণ করত। এর জন্য জনগণের ওপর কর ধার্য করা হতো কিংবা পানি ব্যবহারের জন্য অর্থ দিতে তাদের বাধ্য করা হতো। বিশেষজ্ঞরা এ ঘটনাকে ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন হিসাবে দেখে থাকেন। হাজার হাজার পুকুর, দীঘি, জলাশয়ে তলানি জমে মজে গেল, আগাছা গজিয়ে ছেয়ে গেল। কালক্রমে এগুলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেল। শহরাঞ্চলের জলাশয়গুলো অন্য কাজে ব্যবহার করা হতে লাগল। স্বাধীনতার পর এই ধারণাটি আরও জোরদার হয়ে উঠল। জলাশয়ের অস্তিত্ব আছে বা ছিল এমন বিপুল পরিমাণ জমি বিভিন্ন ধরনের নির্মাণের কাজে ব্যবহারের জন্য পুনরুদ্ধার করা হলো। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, দিল্লীতে এক সময় লেকের সংখ্যা ছিল ৮শ’। আজ ১০টিরও কম টিকে আছে। অন্যান্য শহরের পরিস্থিতিও এ থেকে ভিন্ন কিছু নয়।
পানি ধারণ করে রাখতে আমাদের অস্বীকৃতি এবং যেসব জমিতে আমাদের জলাশয়গুলোর অস্তিত্ব ছিল সেগুলোর প্রতি আমাদের অন্তত ক্ষুধার উল্টো দিক হলো বন্যা। লেক, দিঘী, পুকুর যেগুলো আমাদের বৃষ্টির পানি ধারণ করে রাখত সেগুলো এখন কংক্রিটের জঙ্গলের অংশে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টির পানি ক্রমবর্ধমান হারে প্রায়শ বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং আমাদের নগরীগুলোকে বিপন্ন করে তুলেছে।... কোন কোন ক্ষেত্রে প্লাবিত করছে যেমন ঘটেছিল ২০০৫ সালের ২৬ জুলাই মুম্বাইয়ে। এসব ঘটনা কেবল বৃদ্ধিই পাবে মাত্র।
পানি সঙ্কট
ভারতের বড় নগরীগুলো তাদের চারপাশের গ্রামাঞ্চলের নদ-নদী ও হ্রদ থেকে শত শত কিলোমিটার ধরে আঁকাবাঁকাভাবে যাওয়া পাইপলাইন দিয়ে পানি সংগ্রহ করে। এর ফলে এসব নদ-নদীর চারপাশে বসবাসরত জনগণ নিজেদের পানি থেকে বঞ্চিত হয়। ভাতসা নদীর ৫২ শতাংশ পানি মুম্বাই নগরীতে সরবরাহ করা হয়। অথচ নদীর দুই তীরে বসবাসরত শাহপুরের জনগণ নিজেদের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য ট্যাঙ্কারের ওপর নির্ভর করে। একে কেবল নিষ্ঠুর প্রহসন বলেই আখ্যায়িত করা চলে। অথচ তারপরও আমরা শহরমুখী মানুষের ঢল সম্পর্কে অভিযোগ করে থাকি।
আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চল বিশেষত যেগুলো বারোমেসে নদ-নদীর কাছাকাছি নয় সেগুলোর মানুষ নলকূপ বসিয়ে নিজেদের পানির চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে এসেছে। ভূগর্ভস্থ পানি মাত্রাতিরিক্ত হারে আহরণের ফলে পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষকদের মধ্যে নলকূপ গভীর থেকে গভীরতর পরিসরে স্থাপনের প্রতিযোগিতা চলে। অন্ধ্র প্রদেশের কোন কোন গ্রামে অধিবাসীর সংখ্যা যত না তার চেয়ে বেশি হলো নলকূপের সংখ্যা। কোন একটি গ্রামের এক কৃষক ‘বোরওয়েল রেড্ডী’ নামে পরিচিত। কারণ সে নিজে ৬০টিরও বেশি নলকূপ বসিয়েছে যার সবই এখন শুকিয়ে গেছে। এইভাবে বাতিকগ্রস্ত হয়ে নলকূপ বসিয়ে চলার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নাটকীয়ভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। এদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলে এখন ভূগর্ভের পানির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং বিশাল এলাকা আজ যাকে বলে ডার্ক জোনের অধীনে চলে আসছে। ডার্ক জোন বলতে বুঝায় এমন এলাকা যেখানে ভূগর্ভের পানি বিপজ্জনক রকমের নিম্ন স্তরে চলে এসেছে।
আমরা যেভাবে আমাদের জলাশয়গুলোর দূষণ ঘটিয়ে চলেছি তাহলো প্রাণের এই উৎসের প্রতি আমাদের অমর্যাদা প্রদর্শনের আরেকটি রূপ। আমরা আমাদের নদ-নদীগুলোকে পৌর পয়ঃনিষ্কাশন ও শিল্পের বর্জ্য অপসারণের জন্য খোলা নর্দমা হিসাবে ব্যবহার করে থাকি। ভারতের বহু নদ-নদী বিশাল জায়গাজুড়ে এখন কার্যত মৃত। নদ-নদীর পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা দেখে বোঝা যায় সে নদী কি পরিমাণ জীবন ধারণ করতে সক্ষম। কিন্তু এসব নদ-নদীর দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা শূন্য। দিল্লী থেকে আগ্রা ও মথুরা হয়ে এতাওয়া পর্যন্ত যমুনা নদীর ৮শ’ কিলোমিটারের গোটা জায়গাটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। শত শত কোটি রুপী পরিষ্কার করার কাজে ব্যয় করা সত্ত্বেও পবিত্র গঙ্গা নদীর অবস্থা কিছুমাত্র ভিন্ন নয়।
শিল্প বর্জ্যরে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া আরও বেশি সর্বনাশা। আমরা আমাদের নদ-নদীকে নিষ্কাশন ব্যবস্থা হিসাবে কাজে লাগিয়ে পানিতে সিসা ও পারদের মতো ভারী ধাতব পদার্থসহ নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থ মিশ্রণের সুযোগ করে দিচ্ছি। নদীর পানি শুধু যে খাওয়ার পানি সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে তা নয়, চাষাবাদের কাজেও ব্যবহার করা হয়। দিল্লীভিত্তিক এনজিও টক্সিসলিংক পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে যে বেশ কিছু শাকসবজিতে সিসার পরিমাণ অনুমোদিত মাত্রার অনেক বেশি। অনুরূপভাবে মাছে পারদের দূষণ বেশ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। অববাহিকা এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় নদী ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জ করে থাকে। এইভাবে নদীর পানিতে মিশে থাকা বিষাক্ত পদার্থ নদীর গমন পথে থাকা প্রকাশ্য কূপ ও নলকূপগুলোর পানিকেও দূষিত করে।
এই দূষণের সবচেয়ে বিপজ্জজনক রূপটি হলো যাকে বলা হয় ডিপওয়েন ইঞ্জেকশন। এই পদ্ধতিতে শিল্পকারখানাগুলো দূষণ পরিশোধন কারখানার পিছনে অর্থ ব্যয় বাঁচানোর জন্য পৃথিবীর গভীরে দূষিত পদার্থগুলো ইনজেক্ট করে বা পাঠিয়ে দেয় এবং এইভাবে ভূগর্ভের পানিকেও দূষিত করে।
বৃষ্টির পানি সংগ্রহ
আমাদের পানির দূষণ ঘটানো বন্ধ করা এবং পানি সংরক্ষণের লক্ষ্যে কাজ করা জরুরী প্রয়োজন। সৌভাগ্যবশত শহর ও গ্রাম উভয় স্থানে এই কাজটা যে সাফল্যের সঙ্গে করা হচ্ছে তার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। রালেগান সিদ্ধিতে আন্না হাজারের কাজ, রাজস্থানে তরুণ ভারত সংঘের কাজ এবং অন্য আরও শত শত লোকের কর্মকা-ের উদ্দেশ্য হচ্ছে বৃষ্টির পানি ফুটিয়ে বা নিঃশেষিত হতে না দেয়া। এদের কাজের কোনটাই রকেট বিজ্ঞান নয় আবার নতুন কিছু নয়। বরং এতে সনাতন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করা হয়। কমিউনিটিভিত্তিক বৃষ্টির পানি সংগ্রহের মূল উপাদান হলো কমিউনিটি সৃষ্টি ও গড়ে তোলা। দু’একজন ধনী কৃষককে যদি গভীর নলকূপ বসিয়ে ক্ষেতে পানি দেয়ার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ কাজ করতে পারে না। হিউরি বাজারের মতো গ্রামগুলোতে পঞ্চায়েতরা কৃষিতে নলকূপের পানি ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। এই পদক্ষেপ এবং তার পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও ব্যবহারের পথে খরাপ্রবণ হিউরি বাজার এক বিরল গ্রামে পরিণত হয়েছে যেখানে ৫০ জনেরও বেশি কৃষিজীবী আছে যাদের জমির পরিমাণ সামান্য অথচ তারা আজ লাখপতি।
শহরগুলোতেও আবাসন সমিতিগুলো বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও ব্যবহারে সংঘবদ্ধ হয়েছে। তারা পৌরসভার পানির ওপর নিজেদের নির্ভরশীলতা বহুলাংশে কমিয়ে দিয়েছে। আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে ৫০ মিটার দূরে একটি হাউজিং সোসাইটির বৃষ্টির পানি ব্যবহারের ফলে তাদের পৌরসভার পানির ব্যবহার ৪০ শতাংশ কমে গেছে। ২০০৩ সালে চেন্নাইয়ে এক আইএএস অফিসার শান্তা শীলা নায়ার তৎকালীন আইয়াডিমএকে সরকারের সমর্থনপুষ্ট হয়ে তার এলাকার বৃষ্টির পানি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেন এবং এইভাবে পানি সঙ্কটকে নাগালের বাইরে চলে যাওয়া প্রতিহত করেন। এ সমস্ত দৃষ্টান্তই আমাদের বলে যে সমস্যার সমাধান সহজ এবং যা আমাদের হাতের মুঠোয়। আমাদের শুধু যে কাজটা করতে হবে তাহলো দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভুগে আসল কাজে নেমে পড়া।
সর্বোপরি, আমাদের এই সমস্যা থেকে আত্মপ্রসাদ পাওয়ার কারণ আছে। আমাদের কাছে পানি অফুরন্ত বলে মনে হয় এবং এখন পর্যন্ত আমাদের সবারই যেকোন মূল্যেই হোক না অন্তত কিছু না কিছু পরিমাণ পানি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ অবস্থা সব সময় থাকবে না। আমাদের সামনে যে বিপদ ঘনিয়ে আসছে তা চিহ্নিত করতে পারা জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন। ভূতের আছরের মতো এ বছর খরা যেভাবে আমাদের পিছু নিয়েছে তাতে কি শহর কি গ্রাম সর্বত্রই আমাদের ভারতীয়দের সজাগ হয়ে উঠে আজ থেকেই পানিকে মর্যাদা দেয়ার, সেটি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে কাজ করা উচিত। জয় হিন্দ। সত্যমেভ জয়তে।
No comments