হাইকোর্টের রায় জাল করে ৬ আসামি ছাড়ানোর চেষ্টা by এম বদি-উজ-জামান ও তোফায়েল আহমদ
হাইকোর্টের ভুয়া রায় তৈরি করে একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ছয় আসামিকে কারাগার থেকে বের করে নেওয়ার অপচেষ্টার ভয়ংকর তথ্য পাওয়া গেছে। তবে কক্সবাজার জেলা জজ আদালত এবং কারা কর্তৃপক্ষের সতর্কতায় ওই কারামুক্তির চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
চাঞ্চল্যকর জালিয়াতির এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের এক কর্মচারীকে বদলি করা হয়েছে অন্যত্র।
একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় দণ্ডিত ছয় আসামিকে মুক্তি দিতে গত ১২ জুলাই আদালতের একটি নির্দেশ আসে কক্সবাজার কারাগারে। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষের সতর্কতার কারণেই আসামিরা আর বেরোতে পারেনি। কারা কর্তৃপক্ষের সন্দেহে তাদের মুক্তি আটকে যায়। কিন্তু ছয় আসামির খালাস পাওয়ার রায়টি 'আসল' না 'নকল' তার কূলকিনারা করতে পারছিল না কক্সবাজার জেলা জজ আদালত ও কারা কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি যাচাই করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হলেও এর উত্তর তিন সপ্তাহেও পাননি কক্সবাজার জেলা জজ আদালত। শেষ পর্যন্ত কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জালিয়াতির বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার এ কে এম শামসুল ইসলাম গত ৮ আগস্ট কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, ছয়জনকে খালাস দেওয়ার কথা উল্লেখ করা রায়টি ভুয়া। তিনি বলেন, 'এ মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট ২০০৬ সালে এক রায়ে ৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। তখন ডেথ রেফারেন্স ও আসামিপক্ষের করা ফৌজদারি আপিল নিষ্পত্তি করে হাইকোর্ট রায় দেন। ফলে একই মামলায় হাইকোর্টে নতুন করে ফৌজদারি আপিল করার সুযোগ নেই।' তিনি আরো বলেন, আসামিদের খালাস-সংক্রান্ত যে কাগজটি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা হয়- তাতে হাইকোর্টের যে স্মারক নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে, সেটিও নকল। তাই ওই কাগজটি কোনো রায় নয়। সেটা ভুয়া কাগজ। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার বলেন, এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা জজ আদালতকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। তবে এরই মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষ ও কক্সবাজার জেলা জজ আদালতকে টেলিফোনে জানানো হয়েছে বিষয়টি। তিনি বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে আদালত- সংশ্লিষ্ট কেউ জড়িত থাকলে, তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা যায়, ১৯৯১ সালের ২৫ আগস্ট কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের হোয়ানক ইউনিয়নের কেরনতলীতে দিনের বেলায় কালালীয়া গ্রামের পানচাষি আবুল হোসেনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মহেশখালী থানায় ২৫ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা (নম্বর-০৮(০৮)৯১) দায়ের করা হয়। এ মামলায় কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন বিচারক মো. মোতাজিদুর রহমান ২০০৩ সালের ২৩ আগস্ট রায় দেন। রায়ে ৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য ১৬ জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ আসামি হলো- আবদুল জব্বার, করিম দাদ সিকদার, মোহাম্মদ রশিদ, মেহের আলী, দেওয়ান আলী, আজগর আলী, হাসান আলী, রশিদ আহমদ ও বশির আহমদ। তারা কালালীয়া গ্রামের বাসিন্দা। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে রশিদ আহমদ ছাড়া বাকিরা কারাবন্দি। রশিদ আহমদ শুরু থেকেই পলাতক।
আইন অনুযায়ী নিম্ন আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে পাঠাতে হয়। এ কারণে কক্সবাজার জেলা জজ আদালত থেকে ৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে পাঠানো হয়। এটি ডেথ রেফারেন্স নম্বর ৯২/২০০৩ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় হাইকোর্টে। একই সঙ্গে কারাবন্দি আসামিরাও নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে, যা ৩৩০১/২০০৩ নম্বর ফৌজদারি আপিল হিসেবে হাইকোর্টে রেকর্ডভুক্ত হয়। এই ডেথ রেফারেন্স ও ফৌজদারি আপিলের ওপর শুনানি হয় বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে। হাইকোর্ট ২০০৬ সালের ১৬ মার্চ রায় দেন। রায়ে আসামিদের সাজা কমিয়ে প্রত্যেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এ রায়ের কপি ওই সময় পাঠানো হয় কক্সবাজার জেলা জজ আদালত ও কারাগারে। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেছে কি না এর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
হাইকোর্টের দেওয়া ওই রায়ের প্রায় ছয় বছর পর হঠাৎ করে গত ১২ জুলাই কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের একটি নির্দেশ যায় কারাগারে, যাতে ছয় আসামিকে মুক্তি দিতে বলা হয়। এ নির্দেশের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় হাইকোর্টের একটি রায়ের কপি। এ বছরের ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি তারিখ উল্লেখ করে উপস্থাপন করা ওই রায়ে ছয় আসামিকে খালাস দেখানো হয়। রায়ের কপিতে একাধিক স্থানে ঘষামাজা ও ফ্লুইড ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া ২০০৬ সালের আপিলের রায়ের কপির সঙ্গে হুবহু মিল রেখে শুধু আদেশের স্থানে আসামিদের মুক্তির আদেশ উল্লেখ করা হয়েছে।
জানা যায়, আবদুল জব্বার, মেহের আলী, দেওয়ান আলী, আজগর আলী, হাসান আলী ও বশির আহমদকে খালাস দেখিয়ে হাইকোর্টের একটি রায় বানিয়ে তা কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আল মাহমুদ ফায়জুল কবীরের আদালতে উপস্থাপন করেন ওই আদালতের সেরেস্তা সহকারী আলী আকবর। সেখানে দেখানো হয়, হাইকোর্ট থেকে রায়ের (স্মারক নম্বর ২২৫৫৩, তারিখ ৩১ মে, ২০১২) কপি এসেছে। এতে দেখানো হয়, ৩৮১/২০০৭ নম্বর ফৌজদারি আপিলের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি এম এ হাই ও বিচারপতি আবদুর রাজ্জাকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ছয় আসামিকে খালাস দিয়েছেন। এরপর ছয় আসামির মুক্তির চিঠিতে বিচারক সই করলে তা পাঠানো হয় কারাগারে। এ চিঠি পাওয়ার পর কক্সবাজার কারাগারের সুপার মো. মোকাম্মেল হোসেন আসামিদের মুক্তি দিতে জেলার রফিকুল কাদেরকে নির্দেশ দেন। আসামিদের মুক্তি দেওয়ার আগে কারাগারে রক্ষিত মামলার নথি খুঁজে দেখেন জেলার। ওই নথিতে আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ সংবলিত ২০০৬ সালের হাইকোর্টের রায়ের কপি পাওয়া যায়। এর পরই জেলার আসামিদের মুক্তি না দিয়ে আটকে দেন। সেই সঙ্গে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ফৌজদারি আপিল (নম্বর ৩৮১/২০০৭) বিষয়ে জেলা জজ আদালতের মতামত জানতে চান। এরপর ওই রায়ের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কক্সবাজার জেলা জজ আদালত থেকে ১৭ জুলাই একটি চিঠি পাঠানো হয় সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে। কিন্তু রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে কোনো মতামত পাননি জেলা আদালত।
এ অবস্থায় গত ৭ আগস্ট কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের মতামত জানতে চাওয়া হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে রেজিস্ট্রার কার্যালয়। খোঁজ পড়ে সংশ্লিষ্ট ফাইলটির (ডেথ রেফারেন্স ৯২/২০০৩, ফৌজদারি আপিল ৩৩০১/২০০৩)। রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে ওই দিনই টেলিফোনে যোগাযোগ করা হয় কক্সবাজার জেলা জজ আদালতে। তাদের ১৭ জুলাই পাঠানো চিঠির অনুলিপি ফ্যাক্স করতে বলার পর ফ্যাক্সযোগে তা পাঠানো হয়। এরপর ৮ আগস্ট রেজিস্ট্রার কার্যালয় মূল মামলার নথি ও সংশ্লিষ্ট ফৌজদারি আপিল ইত্যাদি পর্যালোচনা করে। একই সঙ্গে ২২৫৫৩ নম্বর স্মারকমূলে কী চিঠি কোথায় পাঠানো হয়েছে, তার খোঁজ করা হয়। তাতে দেখা যায়, ২২৫৫৩ নম্বর স্মারকমূলে একটি চিঠি চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতে ১৬ মে পাঠানো হয়েছে। একটি দেওয়ানি মামলায় হাইকোর্টের আদেশের কপি সেটা। সুতরাং হাইকোর্ট থেকে ৩১ মে ২২৫৫৩ নম্বর স্মারকে পাঠানো চিঠি বা আদেশটি ভুয়া। পরে আলোচিত ছয় আসামির খালাস-সংক্রান্ত রায়টি 'ভুয়া' ঘোষণা করে কক্সবাজার জেলা জজ আদালতকে তা টেলিফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়। জেলা জজ আদালত থেকে কারাগারকে জানানো হয়, রায়টি নকল।
এ জালিয়াতি প্রসঙ্গে জেল সুপার মোকাম্মেল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গত ১২ জুলাই কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের স্মারক নং-২২৭ সূত্রে খুনের মামলায় দণ্ডিত ছয় আসামিকে মুক্তি দেওয়ার একটি চিঠি পাই। সেই চিঠিতে হাইকোর্ট বিভাগের স্মারক নম্বর ২২৫৫৩, তারিখ-৩১ মে ২০১২ এবং ফৌজদারি আপিল নম্বর-৩৮১/২০০৭ মূলে আসামিদের খালাস দেওয়ার রায়ের কপিও পাঠানো হয়।' হাইকোর্টের রায়ের ওই কপিতে ছয় আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।' মোকাম্মেল হোসেন আরো বলেন, 'এ রকম চিঠি পেয়ে দণ্ডিত ছয় আসামি মুক্তির ব্যবস্থা নিতে বলি জেলারকে।' পরে জেলার দণ্ডিত আসামিদের কাগজপত্র যাচাই করতে গিয়ে ২০০৬ সালে নিষ্পত্তিকৃত আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের তথ্য খুঁজে পান।
জেলার রফিকুল কাদের কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কথিত ফৌজদারি আপিল নম্বর-৩৮১/২০০৭-এর রায়ের কপি পর্যালোচনা করে ভুয়া রায় হিসেবে সন্দেহ হয়। এ কারণে দণ্ডিত আসামিদের মুক্তি না দিয়ে বিষয়টি ওই দিনই কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে লিখিতভাবে জানানো হয়।'
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা অরবিন্দু ভট্টাচার্য কালের কণ্ঠকে জানান, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তা সহকারী আলী আকবর হাইকোর্টের চিঠি ও মামলার খালাসের রায়ের কপি বিচারক আল মাহমুদ ফায়জুল কবীরের সামনে উত্থাপন করে বিচারকের স্বাক্ষর নিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। তিনি বলেন, চাঞ্চল্যকর এ জালিয়াতির ঘটনায় কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতের সংশ্লিষ্ট সেরেস্তা সহকারী আলী আকবরকে তাৎক্ষণিক উখিয়া উপজেলা আদালতের হিসাব সহকারী পদে বদলি করা হয়েছে। আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের চিঠি পাওয়ার পর আরো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
No comments