বিবিয়ানা বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে সামিটের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে সরকার by রশীদ মামুন
বিবিয়ানা-১ বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে সরকার এবং সামিট পাওয়ার লিমিটেড পরস্পর বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রের ‘জমির লিজ চুক্তি’ রেজিস্ট্রি করে না দেয়ায় সামিট বলছে তারা অর্থ সংস্থানের সময়সীমা (ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং) এর জন্য চুক্তি অনুযায়ী সময় (ডে টু ডে এক্সটেনশন) পাবে।
অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং এর সঙ্গে বিদ্যুত কেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদনের কোন সম্পর্ক নেই। কাজেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তাদের বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আনতে হবে। না হলে চুক্তির ধারা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পাওয়ার সেল সূত্র বলছে, রবিবার সামিটকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে আজ সোমবারের মধ্যে তাদের জমি রেজিস্ট্রি করে নিতে হবে। যদিও সামিটের পক্ষ থেকে আগেই চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে ঈদের পর তারা বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য জমি রেজিস্ট্রি করে নেবে। বিদ্যুত মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, চুক্তি স্বাক্ষরের ১৫ মাস পরেও সামিট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে পারেনি। নিকট ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হচ্ছে না। কাজেই সামিটের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার জন্য যেসব আইনগত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দূর করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়া হচ্ছে। যাতে সামিট বিষয়টিকে আর অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে না পারে। অন্যদিকে সামিটের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকার ১৫ মাসেও জমি দিতে না পারায় তারা ব্যাংক ঋণ সংগ্রহ করতে পারেনি। সামিট বলছে, সরকারের অদক্ষতার দায় আমাদের ওপর চাপানো যাবে না। অন্যদিকে বিদ্যুত বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সে কোথায় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য টাকা পাবে তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিদ্যুত কেন্দ্রটি উৎপাদনে আনতে হবে।
রবিবার চিঠি দেয়ার কথা স্বীকার করে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মাহবুব সারওয়ার-ই-কায়নাত বলেন, আজ সোমবারের মধ্যে তাদের জমি রেজিস্ট্রি করে নিতে বলা হয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়া হয়নি এমন অজুহাত যাতে তুলতে না পারে সে জন্য জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং এর জন্য জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়ার পর তারা ডে টু ডে এক্সটেনশন হিসেবে সামিট ছয় মাস সময় পাবে। কিন্তু ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং এর সঙ্গে বিদ্যুত কেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদনের (সিওডি) কোন সম্পর্ক নেই। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, সামিট কোথায় টাকা পাবে না পাবে; তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। তাদের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে তারা বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করে আগামী বছর মার্চের মধ্যে সিম্পল সাইকেল উৎপাদনে আনবে। এখন সে নিজের টাকা দিয়ে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে, না ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে সেটা তাদের বিষয়। তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেন, মেঘনাঘাট-৪৫০ মেগাওয়াটের ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং শেষ হয়েছিল ২৬ মাস পর কিন্তু ততক্ষণে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে ছিল। চুক্তিতে এসব বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা যাতে বুঝতে পারি তারা বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য অর্থ যোগাড় করতে পেরেছে, এই জন্য ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং এর কথা বলা হয়।
কেন বিদ্যুত কেন্দ্রটির চুক্তি স্বাক্ষরের ১৫ মাস পরে এসে জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়া হচ্ছেÑ জানতে চাইলে মাহবুব সারওয়ার-ই-কায়নাত দেরি হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, এক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ, রেজিস্ট্রি করতে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক বেশি সময় নিয়েছেন। যখন কোনভাবেই স্থানীয় পর্যায় থেকে কাজটির সমাধান হচ্ছিল না তখন পাওয়ার সেল হস্তক্ষেপ করে গত ৩০ এপ্রিল জমি পিডিবির নামে রেজিস্ট্রি করে নেয়। কিন্তু এখন যখন জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে চাচ্ছি তখন তারা নিতে চাচ্ছে না বলে তিনি অভিযোগ করেন।
পাওয়ার সেল সূত্র বলছে, গত সোমবার বিদ্যুত কেন্দ্রটির জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়ার কথা থাকলেও সামিট নিতে রাজি হয়নি। তারা পাল্টা চিঠি দিয়ে ঈদের পর জমি নেয়ার কথা জানিয়েছে।
অন্যদিকে একই বিষয় নিয়ে সামিট চেয়ারম্যান আজিজ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়ার পরেও তারা ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং এর জন্য ১১ মাস সময় পাবেন। ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং শেষ হওয়ার পর বিদ্যুত কেন্দ্রটি ২৬ মাসের মধ্যে উৎপাদনে আনতে হবে। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালকের বক্তব্য উদ্ধৃত করে সিওডির সঙ্গে ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং এর কোন সম্পর্ক আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা উনার ব্যক্তিগত বক্তব্য। যদি ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং এর সঙ্গে কোন সম্পর্ক না থাকবে তাহলে এটা চুক্তিতে রাখা হলো কেন। তিনি বলেন, জমি রেজিস্ট্রি করে না দেয়া পর্যন্ত ব্যাংক আমাদের ঋণ দিতে চাচ্ছে না। সরকারের অদক্ষতার দায় আমরা তো নিতে পারি না। বিবিয়ানা-১ বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উৎপাদনে আনা সম্ভব হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, টাকা সংগ্রহ না করে আমি কিভাবে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করব।
বিবিয়ানা-১ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য পিডিবির সঙ্গে সামিট গত বছর ৫ মে চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুত কেন্দ্রটির সিম্পল সাইকেল আগামী বছর মার্চে উৎপাদনে আসার কথা। আর কমবাইন্ড সাইকেল উৎপাদনে আসবে ওই বছর মে মাসে। সে হিসেবে এখন বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য সামিট আর মাত্র ৮ মাস সময় পাবে। কিন্তু ৮ মাসের মধ্যে ৩০০ থেকে ৪৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। আর যেখানে সামিট বলছে তাদের কাছে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নেই।
বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, সামিটের জমি পিডিবির নামে রেজিস্ট্রি হওয়ার প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা হয়েছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ করতে কেন এত সময় লাগল তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বিদ্যুত বিভাগের এক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, এই দেরির পেছনে অন্য কোন কারণ অবশ্যই রয়েছে। এর সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের জবাবদিহিতা না থাকায় জমি রেজিস্ট্রি হতে বেশি সময় লেগেছে। তিনি বলেন, ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং এর অর্থ হচ্ছে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সামিট যার যার কাছ থেকে ঋণ নেয়ার জন্য চুক্তি করবে সেই চুক্তিপত্রের ফটোকপি কোম্পানিটি সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেবে। এর মাধ্যমে পিডিবি, সরকার কেউ কোনভাবে লাভবান হচ্ছে না। যা শুধু আত্মতৃপ্তির বিষয় যে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে পিডিবি চেয়ারম্যান আব্দুল ওহাব এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং এর সঙ্গে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার সময়ের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, কবে বিদ্যুত কেন্দ্রের ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিং হলো বা না হলো তার সঙ্গে উৎপাদনের দিনের পরিবর্তন হওয়ার কোন বিধান চুক্তিতে নেই।
No comments