ট্রেন চলে না সিডিউল বিপর্যয়, ৩০ ভাগ ইঞ্জিন মেয়াদোত্তীর্ণ- ঈদে ঘরে ফেরা-ও. কাদের বললেন ঈদে সিডিউল ঠিক রাখতে পারব না ॥ যাত্রী দুর্ভোগ চরমে by রাজন ভট্টাচার্য
মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে চলছে ৩০ ভাগের বেশি ট্রেন। এসব ইঞ্জিন দিয়ে দ্রুত গতিতে ট্রেন চলে না। যে কোন সময় ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণ থেকে শুরু করে এসি কামরা সঙ্কট চরমে। চালকসহ রেলওয়ের জনবল সমস্যা তো আছেই। কমলাপুর থেকে সময়মতো ছাড়াছে না ৫০ ভাগ মেইল ট্রেন।
বেশিরভাগ ট্রেন সময়মতো পৌঁছতে পারছে না। একারণে প্রায় ৬০ ভাগ ট্রেন বিলম্বে ছাড়ছে। গত এক সপ্তাহে আধা ঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে অনেক ট্রেন। ঈদ উপলক্ষে নতুন করে নামানো হয়েছে জোড়াতালির বিশেষ ট্রেন সার্ভিস। এই প্রেক্ষাপটে ঈদে রেলপথে চরম সিডিউল বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর্থাৎ এবারও ঘরমুখো যাত্রীদের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি নেই। আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়ে কথা জানিয়ে রেল মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ঈদে ট্রেনের সিডিউল ঠিক রাখতে পারব না’।
এ ছাড়া রাজধানীতে আছে ২৪টি অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং। সারাদেশে অনুমোদন ছাড়া লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা এক হাজার ৮৩টি। গেটম্যান ছাড়াই আছে দুই হাজার ২৩৬টি ক্রসিং। তিন বছরে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় নয় হাজার। এই প্রেক্ষাপটে ট্রেন দুর্ঘটনারও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। রেল সংশ্লিষ্টরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোতে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছেন।
কমলাপুরে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা
ট্রেনের টিকেট বিক্রি শেষ। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছে মানুষ। কমলাপুর রেলস্টেশনে টিকেট কাউন্টারগুলোতে এখন সুনশান নীরবতা বিরাজ করলেও প্লাট ফরমে হাজারো মানুষের ভিড় রাত-দিন। পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়ি ফিরছেন ঢাকার মানুষ।
সরেজমিন স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সঠিক সময়ে ট্রেনের দেখা মিলছে না। সকালের ট্রেন আসছে দুপুরে। দুপুরের ট্রেন বিকেলে। বিকেলের ট্রেন রাতে আসবে কি-না তা যাত্রীরা জানে না। যাত্রীদের অভিযোগ, রেল সেক্টরে একের পর এক মন্ত্রী বদল হলেও সঙ্কট কাটেনি। বিশেষ করে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়ের কারণে যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। যাত্রীরা মনে করছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের দৃশ্যমান কোন উন্নতি হয়নি।
দেখা গেছে, গত চারদিন কমলাপুর স্টেশনে সরেজমিন, বেশিরভাগ ট্রেনই নির্ধারিত সময়ে আসেনি। এ নিয়ে যাত্রীরা কমলাপুর রেলস্টেশন ম্যানেজারসহ মাস্টারের কাছেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অসহায় হয়ে অনেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারীদের কাছে রেলের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। নির্ধারিত সময়ে ট্রেন না আসার বিষয় স্বীকার করে কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার খায়রুল বাশার বলেন, নির্ধারিত সময়ে ট্রেন আসার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে। এক দিনে তো দীর্ঘদিনের সমস্যা নিরসন সম্ভব নয়।
যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সময়মতো ট্রেন ছেড়ে না গেলে যাত্রীরা অভিযোগ করবে এটা স্বাভাবিক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের এক কর্মকর্তাসহ কর্মচারীরা জানিয়েছেন, ট্রেনে ইঞ্জিন- কোচসহ অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এসব কারণে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। এদিকে শুক্র ও শনিবার চট্টগ্রাম ও সিলেটগামী দুটি ট্রেন ছাড়তে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর কেবিনের এসি নষ্ট হওয়ার কারণে এই জটিলতা দেখা দেয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালালেও শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ভোগান্তি পোহাতে হয় ঘরমুখো যাত্রীদের। রেল কর্মচারীরা জানিয়েছেন, সঙ্কটের কারণে এসি যুক্ত বাড়তি কামরা যুক্ত করার কোন সুযোগ নেই।
এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মোঃ আবু তাহের বলেন, সিডিউল বিপর্যয় যেন না হয় সেজন্য আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি। ঈদ উপলক্ষে যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষযটি মাথায় রেখেই ট্রেনে কিছুটা ধীরগতিতে চালাতে হবে। কোন কোন ট্রেনে যাত্রীরা ছাদে বা ইঞ্জিনের চারপাশে এমনভাবে বসেন, যে চালক সামনের কিছুই দেখতে পান না। ফলে দুর্ঘটনা এড়াতে বাধ্য হয়েই কম গতিতে ট্রেন চালাতে হয়।
রেলওয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য
রেলওয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে সারাদেশে ট্রেনের সিডিউল বিপয়য়ের প্রমাণ মিলেছে। তবে কমলাপুর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রেন চলাচলের সিডিউল তুলনামূলক ভাল বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে যাত্রীদের বক্তব্য আসলে ভিন্ন। যাত্রীরা বলছেন, সরকারী তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। অর্থাৎ কোন ট্রেন ছাড়তে এক ঘণ্টার বেশি বিলম্ব হলে সরকারী রেকর্ডে দেখানো হচ্ছে ১৫/২০ মিনিট।
সরকারী তথ্যে জানা গেছে, ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর বেশিরভাগ যথাসময় ছাড়ছে। ৫-১০ আগস্ট পর্যন্ত ৮৫-৯০ ভাগ পর্যন্ত সিডিউল মেনে ট্রেন চলাচলের রেকর্ড রয়েছে। তবে লোকাল ট্রেন ৮০-৮৫, মেইল ট্রেন ৫০ ভাগ সময়মতো ছেড়ে যাওয়া ও গন্তব্যে পৌঁছেছে।
এবারের ঈদেও ট্রেনের সিডিউল ঠিক থাকছে না। তাই ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি এবারও থেকেই যাচ্ছে। যথাসময় ট্রেন ছেড়ে যাবে না, কিংবা পৌঁছবে না-অনেকটা আগেভাগেই বিষয়টি অনুমান করা যাচ্ছিল। রবিবার বিষয়টি পরিষ্কার করলেন খোদ রেলমন্ত্রী নিজেই। রবিবার দুপুরে কমলাপুর রেলস্টেশনে রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের সিডিউল রাখতে পারব না। ঈদে সময়সূচী মেনে ট্রেন চালানো সম্ভব নয়।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, রেল সেক্টরে তুলনামূলক উন্নতি হলেও সঙ্কট কাটেনি। বগি ও ইঞ্জিনে সঙ্কট থাকায় ট্রেনের সিডিউল ঠিক রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া সঠিক সময়ে যাওয়ার চেয়ে নিশ্চিন্তে যেন মানুষ গন্তব্যে পৌঁছতে পারে সে বিষয়টিকেই আমি গুরুত্ব দিচ্ছি। তবে রবিবার কোন সিডিউল বিপর্যয় ঘটেনি বলে মন্ত্রী দাবি করেন। যদিও কমলাপুর রেলস্টেশন সূত্রে জানা যায়, রবিবার নির্ধারিত সময়ে ট্রেন আসেনি কমলাপুরে। চট্টলা ট্রেন ছেড়েছে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর। এছাড়া ঢাকা মেইল ৩ ঘণ্টা, কমিউটার এক্সপ্রেস এক ঘণ্টা, যমুনা ৩ ঘণ্টা ও অগ্নিবীণা ২ ঘণ্টা পর কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে গেছে। ট্রেনে লোকবলের জনবল সঙ্কট রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, লোকবলের সঙ্কট আমাকে মন্ত্রী বানিয়েছে। এজন্য সব বিষয় সমাধানের চেষ্টা আমাকেই করতে হবে।
এদিকে ট্রেনে দুর্ঘটনার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র ট্রেনে লাশ ফেলছে। বিষয়টি রহস্যজনক। এ নিয়ে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে, কেউ বলছে ট্রেনে হত্যাকা- ঘটছে। আবার কেউ বলছে বাইরে হত্যা করে রেল লাইনের পাশে রাখা হচ্ছে। তবে যোগাযোগমন্ত্রী শনিবার গাজীপুরের রেল লাইনের বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করেছেন। লাশ পাওয়া স্পটগুলো পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী রেলওয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং রেল লাইনের পাশে একটি পুলিশ ফাঁড়ি বাসানোর প্রতিশ্রুতি দেন।
রেল মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা দুই হাজার ৪৯৫টি। এর মধ্যে অনুমোদিত লেভেল ক্রসিং আছে এক হাজার ৪১২টি। অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং এক হাজার ৮৩টি। এর মধ্যে গেটম্যান ছাড়াই চলছে দুই হাজার ২৩৬টি লেভেল ক্রসিং। এছাড়া ঢাকা মহানগরীতে মোট লেভেল ক্রসিং আছে ৩৭টি। অনুমোদন নেই ২৪টির। ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন। যে কোন সময় এসব রেল ক্রসিংয়ে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।
তিন বছরে প্রায় ৯শ’ দুর্ঘটনা
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিগত তিন বছরে প্রায় ৯শ’ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটেছে লেভেল ক্রসিংগুলোতে। অনুমোদন ছাড়া ক্রসিংগুলোতে দুর্ঘটনার প্রবণতা যেমন আছে তেমনি অনুমোদিত রেল ক্রসিংয়েও আছে।
রাজধানীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে রয়েছে মগবাজার, মালিবাগ, খিলগাঁও, সায়েদাবাদ, মহাখালী, টিটিপাড়া, গোপীবাগ, বনানী। এর মধ্যে তুলনামূলক বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে খিলগাঁও, মালিবাগ ও বনানী লেভেল ক্রসিংয়ে। সাম্প্রতি বাসসহ অন্যান্য পরিবহনের সঙ্গে এসব ক্রসিংয়ে ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ব্যস্ততম খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ে ট্রেন দুর্ঘটনার আশঙ্কা এখন আরও বেশি। একদিকে ঈদ কেন্দ্র করে পরিবহনের বাড়তি চাপ। অন্যদিকে রেলগেটের তিন পাশে হিউম্যান হলারসহ নিষিদ্ধ ইজি বাইকের একাধিক সারির লাইন। এসব পরিবহনও মূল রাস্তার ওপরে রাখা হয়। সব মিলিয়ে দীর্ঘ সময় আটকে থাকতে হয় ক্রসিংয়ের কারণে। ট্রেন আসার সময় রেললাইনে যানবাহন পরিষ্কার করতে হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক পুলিশদের। প্রশ্ন উঠেছে-রাস্তায় শত শত অবৈধ পরিবহনের পার্কিং কিভাবে চলছে। এর নেপথ্যে কারা?
রেলওয়ের নানা সমস্যা
রেলওয়ের বেশিরভাগ চালকের বয়স ৫০-এর বেশি। চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়ার গড় বয়স ৪৮। পূর্ণাঙ্গ চালক হতে সময় লাগে ১০ বছর। সারাদেশে দুই হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। রেললাইন আছে তিন হাজার ৯৭৩ কিলোমিটার। ইতোমধ্যে ৯টি শাখা লাইন বন্ধ হয়ে গেছে। সারাদেশে মোট রেল স্টেশনের সংখ্যা ৪৪০টি। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বন্ধ ১১৯, আংশিক বন্ধ ৪১। রেলওয়ের মোট ইঞ্জিনের সংখ্যা ২৯৪টি। এর মধ্যে ৩০ ভাগের বেশি ইঞ্জিন চলাচলের অনুপযোগী। সারাদেশে প্রতিদিন চলাচল করে ২৮১টির বেশি ট্রেন।
এ ছাড়া রাজধানীতে আছে ২৪টি অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং। সারাদেশে অনুমোদন ছাড়া লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা এক হাজার ৮৩টি। গেটম্যান ছাড়াই আছে দুই হাজার ২৩৬টি ক্রসিং। তিন বছরে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় নয় হাজার। এই প্রেক্ষাপটে ট্রেন দুর্ঘটনারও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। রেল সংশ্লিষ্টরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোতে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছেন।
কমলাপুরে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা
ট্রেনের টিকেট বিক্রি শেষ। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছে মানুষ। কমলাপুর রেলস্টেশনে টিকেট কাউন্টারগুলোতে এখন সুনশান নীরবতা বিরাজ করলেও প্লাট ফরমে হাজারো মানুষের ভিড় রাত-দিন। পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়ি ফিরছেন ঢাকার মানুষ।
সরেজমিন স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সঠিক সময়ে ট্রেনের দেখা মিলছে না। সকালের ট্রেন আসছে দুপুরে। দুপুরের ট্রেন বিকেলে। বিকেলের ট্রেন রাতে আসবে কি-না তা যাত্রীরা জানে না। যাত্রীদের অভিযোগ, রেল সেক্টরে একের পর এক মন্ত্রী বদল হলেও সঙ্কট কাটেনি। বিশেষ করে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়ের কারণে যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। যাত্রীরা মনে করছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের দৃশ্যমান কোন উন্নতি হয়নি।
দেখা গেছে, গত চারদিন কমলাপুর স্টেশনে সরেজমিন, বেশিরভাগ ট্রেনই নির্ধারিত সময়ে আসেনি। এ নিয়ে যাত্রীরা কমলাপুর রেলস্টেশন ম্যানেজারসহ মাস্টারের কাছেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অসহায় হয়ে অনেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারীদের কাছে রেলের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। নির্ধারিত সময়ে ট্রেন না আসার বিষয় স্বীকার করে কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার খায়রুল বাশার বলেন, নির্ধারিত সময়ে ট্রেন আসার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে। এক দিনে তো দীর্ঘদিনের সমস্যা নিরসন সম্ভব নয়।
যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সময়মতো ট্রেন ছেড়ে না গেলে যাত্রীরা অভিযোগ করবে এটা স্বাভাবিক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের এক কর্মকর্তাসহ কর্মচারীরা জানিয়েছেন, ট্রেনে ইঞ্জিন- কোচসহ অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এসব কারণে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। এদিকে শুক্র ও শনিবার চট্টগ্রাম ও সিলেটগামী দুটি ট্রেন ছাড়তে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর কেবিনের এসি নষ্ট হওয়ার কারণে এই জটিলতা দেখা দেয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালালেও শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ভোগান্তি পোহাতে হয় ঘরমুখো যাত্রীদের। রেল কর্মচারীরা জানিয়েছেন, সঙ্কটের কারণে এসি যুক্ত বাড়তি কামরা যুক্ত করার কোন সুযোগ নেই।
এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মোঃ আবু তাহের বলেন, সিডিউল বিপর্যয় যেন না হয় সেজন্য আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি। ঈদ উপলক্ষে যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষযটি মাথায় রেখেই ট্রেনে কিছুটা ধীরগতিতে চালাতে হবে। কোন কোন ট্রেনে যাত্রীরা ছাদে বা ইঞ্জিনের চারপাশে এমনভাবে বসেন, যে চালক সামনের কিছুই দেখতে পান না। ফলে দুর্ঘটনা এড়াতে বাধ্য হয়েই কম গতিতে ট্রেন চালাতে হয়।
রেলওয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য
রেলওয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে সারাদেশে ট্রেনের সিডিউল বিপয়য়ের প্রমাণ মিলেছে। তবে কমলাপুর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রেন চলাচলের সিডিউল তুলনামূলক ভাল বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে যাত্রীদের বক্তব্য আসলে ভিন্ন। যাত্রীরা বলছেন, সরকারী তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। অর্থাৎ কোন ট্রেন ছাড়তে এক ঘণ্টার বেশি বিলম্ব হলে সরকারী রেকর্ডে দেখানো হচ্ছে ১৫/২০ মিনিট।
সরকারী তথ্যে জানা গেছে, ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর বেশিরভাগ যথাসময় ছাড়ছে। ৫-১০ আগস্ট পর্যন্ত ৮৫-৯০ ভাগ পর্যন্ত সিডিউল মেনে ট্রেন চলাচলের রেকর্ড রয়েছে। তবে লোকাল ট্রেন ৮০-৮৫, মেইল ট্রেন ৫০ ভাগ সময়মতো ছেড়ে যাওয়া ও গন্তব্যে পৌঁছেছে।
এবারের ঈদেও ট্রেনের সিডিউল ঠিক থাকছে না। তাই ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি এবারও থেকেই যাচ্ছে। যথাসময় ট্রেন ছেড়ে যাবে না, কিংবা পৌঁছবে না-অনেকটা আগেভাগেই বিষয়টি অনুমান করা যাচ্ছিল। রবিবার বিষয়টি পরিষ্কার করলেন খোদ রেলমন্ত্রী নিজেই। রবিবার দুপুরে কমলাপুর রেলস্টেশনে রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের সিডিউল রাখতে পারব না। ঈদে সময়সূচী মেনে ট্রেন চালানো সম্ভব নয়।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, রেল সেক্টরে তুলনামূলক উন্নতি হলেও সঙ্কট কাটেনি। বগি ও ইঞ্জিনে সঙ্কট থাকায় ট্রেনের সিডিউল ঠিক রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া সঠিক সময়ে যাওয়ার চেয়ে নিশ্চিন্তে যেন মানুষ গন্তব্যে পৌঁছতে পারে সে বিষয়টিকেই আমি গুরুত্ব দিচ্ছি। তবে রবিবার কোন সিডিউল বিপর্যয় ঘটেনি বলে মন্ত্রী দাবি করেন। যদিও কমলাপুর রেলস্টেশন সূত্রে জানা যায়, রবিবার নির্ধারিত সময়ে ট্রেন আসেনি কমলাপুরে। চট্টলা ট্রেন ছেড়েছে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর। এছাড়া ঢাকা মেইল ৩ ঘণ্টা, কমিউটার এক্সপ্রেস এক ঘণ্টা, যমুনা ৩ ঘণ্টা ও অগ্নিবীণা ২ ঘণ্টা পর কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে গেছে। ট্রেনে লোকবলের জনবল সঙ্কট রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, লোকবলের সঙ্কট আমাকে মন্ত্রী বানিয়েছে। এজন্য সব বিষয় সমাধানের চেষ্টা আমাকেই করতে হবে।
এদিকে ট্রেনে দুর্ঘটনার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র ট্রেনে লাশ ফেলছে। বিষয়টি রহস্যজনক। এ নিয়ে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে, কেউ বলছে ট্রেনে হত্যাকা- ঘটছে। আবার কেউ বলছে বাইরে হত্যা করে রেল লাইনের পাশে রাখা হচ্ছে। তবে যোগাযোগমন্ত্রী শনিবার গাজীপুরের রেল লাইনের বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করেছেন। লাশ পাওয়া স্পটগুলো পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী রেলওয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং রেল লাইনের পাশে একটি পুলিশ ফাঁড়ি বাসানোর প্রতিশ্রুতি দেন।
রেল মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা দুই হাজার ৪৯৫টি। এর মধ্যে অনুমোদিত লেভেল ক্রসিং আছে এক হাজার ৪১২টি। অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং এক হাজার ৮৩টি। এর মধ্যে গেটম্যান ছাড়াই চলছে দুই হাজার ২৩৬টি লেভেল ক্রসিং। এছাড়া ঢাকা মহানগরীতে মোট লেভেল ক্রসিং আছে ৩৭টি। অনুমোদন নেই ২৪টির। ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন। যে কোন সময় এসব রেল ক্রসিংয়ে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।
তিন বছরে প্রায় ৯শ’ দুর্ঘটনা
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিগত তিন বছরে প্রায় ৯শ’ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটেছে লেভেল ক্রসিংগুলোতে। অনুমোদন ছাড়া ক্রসিংগুলোতে দুর্ঘটনার প্রবণতা যেমন আছে তেমনি অনুমোদিত রেল ক্রসিংয়েও আছে।
রাজধানীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে রয়েছে মগবাজার, মালিবাগ, খিলগাঁও, সায়েদাবাদ, মহাখালী, টিটিপাড়া, গোপীবাগ, বনানী। এর মধ্যে তুলনামূলক বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে খিলগাঁও, মালিবাগ ও বনানী লেভেল ক্রসিংয়ে। সাম্প্রতি বাসসহ অন্যান্য পরিবহনের সঙ্গে এসব ক্রসিংয়ে ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ব্যস্ততম খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ে ট্রেন দুর্ঘটনার আশঙ্কা এখন আরও বেশি। একদিকে ঈদ কেন্দ্র করে পরিবহনের বাড়তি চাপ। অন্যদিকে রেলগেটের তিন পাশে হিউম্যান হলারসহ নিষিদ্ধ ইজি বাইকের একাধিক সারির লাইন। এসব পরিবহনও মূল রাস্তার ওপরে রাখা হয়। সব মিলিয়ে দীর্ঘ সময় আটকে থাকতে হয় ক্রসিংয়ের কারণে। ট্রেন আসার সময় রেললাইনে যানবাহন পরিষ্কার করতে হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক পুলিশদের। প্রশ্ন উঠেছে-রাস্তায় শত শত অবৈধ পরিবহনের পার্কিং কিভাবে চলছে। এর নেপথ্যে কারা?
রেলওয়ের নানা সমস্যা
রেলওয়ের বেশিরভাগ চালকের বয়স ৫০-এর বেশি। চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়ার গড় বয়স ৪৮। পূর্ণাঙ্গ চালক হতে সময় লাগে ১০ বছর। সারাদেশে দুই হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। রেললাইন আছে তিন হাজার ৯৭৩ কিলোমিটার। ইতোমধ্যে ৯টি শাখা লাইন বন্ধ হয়ে গেছে। সারাদেশে মোট রেল স্টেশনের সংখ্যা ৪৪০টি। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বন্ধ ১১৯, আংশিক বন্ধ ৪১। রেলওয়ের মোট ইঞ্জিনের সংখ্যা ২৯৪টি। এর মধ্যে ৩০ ভাগের বেশি ইঞ্জিন চলাচলের অনুপযোগী। সারাদেশে প্রতিদিন চলাচল করে ২৮১টির বেশি ট্রেন।
No comments