সুস্থ শিক্ষক-ছাত্র রাজনীতির প্রত্যাশায় by আবদুল মান্নান
ক’দিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে বিভিন্ন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নামধারীদের দৌরাত্ম্য নিয়ে আমার একটি উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে লিখেছিলাম কিভাবে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কিছু অপরিণামদর্শী নেতাকর্মী নামধারীর কারণে বিভিন্ন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করেছিলাম পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য তিনি যেন হস্তক্ষেপ করেন। এই লেখা পড়ার পর কমপক্ষে শ’খানেক পরিচিত পাঠক আমাকে ফোনে জানিয়েছেনÑআমি যা লিখেছি তা পরিস্থিতির সামান্য অংশমাত্র। পুরো চিত্রটা আরও গুরুতর। তারা প্রায় সবাই প্রত্যাশা করেছেন, লেখাটা যেন প্রধানমন্ত্রী পড়েন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন এবং নির্দেশ দেন ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে এই ধরনের অপকর্মে যারাই লিপ্ত থাকে তাদের বিরুদ্ধে যেন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়। যাঁরা আমাকে ফোন করেছেন তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির অনুরাগী এবং কয়েকজন দলের মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তাও আছেন। তবে সবাই যে লেখাটা সমান গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন তা নয়। একজন সাবেক ছাত্রনেতা টেলিফোনে আমাকে রূঢ় ভাষায় বলেছেনÑকাজটা আমি ঠিক করিনি। তার মূল আপত্তির বিষয়টা হলো আমার লেখায় তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি । এটি অনস্বীকার্য একজন ভাল রাজনৈতিক নেতা হওয়ার গুণাবলী তার ছিল কিন্তু যে কোন কারণেই হোক তার সঙ্গে দলের দূরত্ব সৃষ্টি হওয়াতে তিনি বর্তমানে অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন। তিনি আবার তাঁর পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসবেন কি-না তা নির্ভর করে তার সঙ্গে দলের সম্পর্ক কতটুকু উন্নতি হবে তার ওপর ।
লেখাটি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। তারা প্রতিবাদসভা করেছে, আমাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে এবং উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট হতে আমার অপসারণ দাবি করেছে। উপাচার্য তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এটি তার এক্তিয়ারবহির্ভূত; কারণ আমি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে চ্যান্সেলরের একজন প্রতিনিধি। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে আমার অনেক সুহৃদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অনেক ছাত্র নেতা, যাদের মধ্যে অনেক ছাত্রলীগ নেতাও আছে তারা আমার কাছে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এবং বলেছেন ছাত্রলীগের এহেন ঘোষণায় তারা বিস্মিত এবং হতাশ। তারা সবাই অনুরোধ করেছেন, আমি যেন আমার লেখা বন্ধ না করি। তাদের বলেছি লেখা বন্ধ করার কোন কারণ ঘটেনি আর ছাত্ররা যা করেছে তা তাদের তারুণ্য ও আবেগের বহির্প্রকাশ হিসেবে দেখতে চাই। হয়ত তারা পরে তাদের ভুল বুঝতে পারবে এবং এও বুঝবে আমার লেখাটি যারা ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে দুর্বৃত্তপনা করে তাদের নিয়ে; ভাল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে নয়। রাতে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কয়েক নেতা ফোনে আমার কাছে তাদের অবস্থান তুলে ধরতে চেষ্টা করে এবং বলে যেসব অপকর্মের কথা আমি উল্লেখ করেছি তার সঙ্গে তারা জড়িত নয়। বর্তমানে তারা সংগঠনকে একটি ভাল ছাত্রসংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তাদের সাধুবাদ দিয়ে বলেছি, আমার লেখার বিষয়বস্তু এককভাবে তাদের নিজেদের ওপর টেনে নিয়ে যাওয়ার কারণ নেই। যেসব বিষয়ের কথা বলা হয়েছে তা বাংলাদেশব্যাপী প্রায় সব সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে এবং তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারের সুনাম এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি।
সরকারের একজন শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে এসব কথা আমি বলতেই পারি। প্রকৃত শুভাকাক্সক্ষীরা কখনও স্তাবক হয় না। তারা সরকারের ভাল কাজের প্রশংসা যেমন করে আবার মন্দ কাজের সমালোচনা করতেও পিছপা হয় না। তারা বিশ্বাস করে একজন উঁচু মাপের নেতা তার সমালোচককে তার বন্ধু মনে করবেন। আমার তরুণ বন্ধুদের বলেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে না গেলে আমার কোন ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই আর না যাই; আশা করব এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আসবে আর সেটা যদি না হয় তা হলে আগামীতে আমাদের আফসোস করতে হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি আমার শিক্ষকতা জীবনের শ্রেষ্ঠ একত্রিশ বছর কাটিয়েছি এবং বর্তমান ছাত্রনেতাদের পূর্বসূরিদের অবস্থান নির্বিঘœ করার জন্য আমি নিজে এবং অনেক সহকর্মী জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়েছেন। একটা বিষয় ভাল লেগেছে আর তা হলো যেসব নেতৃবৃন্দ আমার সঙ্গে কথা বলেছে তারা বেশ ভদ্রজনোচিত আচরণ করেছে এবং বলেছে তারা ওইদিনের ঘটনার জন্য দুঃখিত। জবাবে তাদের বলেছি, আমার লেখা যারা প্রকৃতঅর্থে সুস্থ ছাত্র রাজনীতি করতে চায় কখনও তাদের বিরুদ্ধে নয় বরং তাদের একজন শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে প্রত্যাশা করি; তারা তাদের যোগ্যতাবলে আগামীদিনে দেশের রাজনীতির হাল ধরবে এবং আওয়ামী লীগের হাতকে শক্তিশালী করবে। তাদের ওপর ভিত্তি করেই তো ভবিষ্যতের আওয়ামী লীগ গড়ে উঠবে। খবর নিয়ে জেনেছি যারা আমার সঙ্গে কথা বলেছে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র এবং একটি ছাত্র সংগঠনের ভাল নেতা হওয়ার সব গুণাবলীই তাদের আছে। তাদের জন্য এই মুহূর্তে আমার আশীর্বাদ ছাড়া দেয়ার আর তেমন কিছু নেই।
এসব ঘটনার কয়েকদিন পরই বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছেÑবেশ কয়েকটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি, শিক্ষক-ছাত্রদের মুখোমুখি অবস্থান, ছাত্র নিহত, দলীয় সঙ্কীর্ণতা ইত্যাদি ঘটনা বিবেচনায় রেখে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির লাগাম টেনে ধরতে যাচ্ছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপটে ১৯৮৬ সালের মন্ত্রিসভা বৈঠকের একটি সিদ্ধান্ত নিয়েও সরকার নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে বলে জানা গেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি সীমিত করার কথাই ভাবছে সরকার। বুঝতে পারছি না এই সংবাদে কেউ আবার সরকারকেই অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে কিনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, আগামীতেও হবে । তবে শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে দু’একটি মন্তব্য ছাড়া তেমন কিছু একটা লেখা হয় না । এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির একটা গৌরবোজ্জ্বল অতীত আছে । বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলো স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। এরশাদ বিচারপতি সাত্তারকে হঠিয়ে দেশে সামরিক আইন জারি করলে তার বিরুদ্ধে প্রথম রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল বের করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে এরশাদ দেশে জরুরী আইন জারি করেন এবং সব বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন । চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সভা করে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রাখবে। শিক্ষকদের পেশাগত দাবিদাওয়া পূরণের আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ভূমিকা ছিল বেশ জোড়াল। এক সময় এই ফেডারেশনের বার্ষিক সম্মেলনে শিক্ষা বিষয়ক যে সব সেমিনার হতো তা ছিল আন্তর্জাতিক মানের। এখন এসব কর্মকা- তেমন একটা চোখে পড়ে না যদিও এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা আগের যে কোন সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে। তবে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় আর তা হচ্ছেÑকোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুসংখ্যক শিক্ষক তাদের ক্ষুদ্রস্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার করা এবং তাদের বিপথগামী করা প্রসঙ্গ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট তার বড় উদাহারণ। শিক্ষকদের কোন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন হতেই পারে তবে তাতে কখনও ছাত্রদের ব্যবহার করা কাম্য নয়। এতে একটি খারাপ নজির স্থাপন করা হয় এবং এক সময় পুরো পরিস্থিতি আর শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। এতে নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়।
কিছুদিন আগে অবাক হয়েছিলাম একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে অচিরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যার অর্থ ছাত্রদের নিয়ে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন। যিনি এ কথাটি অবলীলাক্রমে বললেন তাঁর একমাত্র আকাক্সক্ষা উপাচার্যের পদটি দখল করা যা বর্তমান উপাচার্য বহাল থাকলে সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য, এমন একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কাছ হতে প্রত্যাশিত নয় । উপাচার্য পদে আসীন হওয়ার উচ্চাভিলাষ থাকতেই পারে তবে তা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অর্জিত হওয়া প্রত্যাশিত। আর এসব খায়েশ পূরণে কোন ছাত্র সংগঠনকে সম্পৃক্ত করা কোনভাবেই উচিত নয় । আরও একটি বিষয় সম্প্রতি ঘটছে আর তা হচ্ছে কিছু কিছু শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বাইরে নানা সংগঠনের জন্ম দিয়ে তা নিজেদের ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে ব্যবহার করা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এসব সংগঠন আবার জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহারে পিছপা হয় না। কেউ বলে তাদের এই সংগঠনের উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা আর কেউ বলেন, তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ফিরিয়ে আনতে চায়। আসলে তাদের দৃষ্টি উপাচার্যের পদটির দিকে। কখনও কখনও তাঁরা প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁদের এহেন অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকা-ের ফলে পরোক্ষভাবে লাভবান হয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। এ কাজগুলো যাঁরা করেন তাঁদের সংখ্যা হাতেগোনা কিন্তু তাঁদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সুতরাং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতির লাগাম টেনে ধরার আগে প্রথমে কিছ সংখ্যক শিক্ষকের এসব কর্মকা- বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা চিন্তা করতে হবে। কেবল ছাত্র-শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রকৃতঅর্থে আদর্শ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারে। প্রত্যেকটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের সম্পত্তি । এসব জাতীয় প্রতিষ্ঠান গরিব জনগণের অর্থে পরিচালিত হয় । একটি বিশ্ববিদ্যালয় একদিনের জন্যও অনির্ধারিতভাবে বন্ধ থাকলে তা একটি বড় ধরনের জাতীয় ক্ষতি। আমার অনুজপ্রতিম ছাত্র এবং সহকর্মীদের কাছে অনুরোধÑকখনও নিজেদের ক্ষুদ্র ও গোষ্ঠী স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিপদগ্রস্ত করে তুলবেন না। সব পাঠককে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা ।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক
No comments