সময়ের প্রতিধ্বনি-বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ ও ড. ইউনূস by মোস্তফা কামাল

শুরুতেই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির নেতা ইউলি ব্রান্টের একটি মন্তব্য তুলে ধরছি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, 'মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না।


যে বাঙালি মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।'
বিশ্বখ্যাত নেতা কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করেছেন হিমালয়ের সঙ্গে। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে (ন্যাম) যোগ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফিদেল কাস্ত্রো আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। বৈঠকের পর তিনি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মূল্যায়ন করেন এভাবে, 'আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতা হিমালয়ের মতো। তাঁকে দেখার পর আমার সে রকম অভিজ্ঞতাই হয়েছে।'
উপমহাদেশের বিখ্যাত লেখক নিরোদ সি. চৌধুরী 'আত্মঘাতী বাঙালি' শিরোনামে একটি বই লিখেছিলেন। বাঙালি সম্পর্কে তাঁর সেই উক্তিটি আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি। বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জনককে হত্যা করে বাঙালি সেই আত্মঘাতী চরিত্রটিই বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট করেছে। ব্যক্তিগত লোভ-লালসা, ঈর্ষা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা বাঙালি চরিত্রে অতিমাত্রায় প্রভাব বিস্তারের কারণেই এই জাতি নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করে। আর বিশ্বাসঘাকতা! এ বুঝি অতিলোভী বাঙালির প্রধান বৈশিষ্ট্য! তাই তো মীর জাফর, মোশতাকরা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। তবে ক্ষণজন্মা মানুষরা দেরিতে হলেও যথাযথভাবেই মূল্যায়িত হন, ইতিহাসের পাতায় চির অম্লান হয়ে থাকেন।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক ক্ষণজন্মা পুরুষ বঙ্গবন্ধু। তিনি জন্ম না নিলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের স্বীকৃতিও আমাদের বারবার সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ১৬ আগস্ট তাঁর সম্পর্কে ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলেছিল, 'শেখ মুজিব ছিলেন এক অলৌকিক ব্যক্তিত্ব।' দ্য টাইমসের মতে, 'তিনি এক মহান ব্যক্তিত্ব। সব কিছু সত্ত্বেও শেখ মুজিব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ জন্য যে তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশ কখনো বাস্তবে পরিণত হতো না।' আর ফিনান্সিয়াল টাইমসের মতে, 'মুজিব যদি না থাকতেন বাংলাদেশের জন্ম হতো না।'
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে টাইম ম্যাগাজিন, নিউজ উইক একাধিকবার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে অসংখ্য লিড নিউজ হয়েছে। সারা বিশ্বের কাছে তখন বাংলাদেশের চেয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি অনেক বেশি ছিল। সংগত কারণেই বিদেশিরা বাংলাদেশকে না চিনলেও বঙ্গবন্ধুকে চিনতেন। তাঁদের কাছে বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। আমি নিজেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফরে গিয়ে তার প্রমাণ পেয়েছি।
২০০৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটরস (আইভি) প্রোগ্রামের আওতায় আমেরিকা সফরে গিয়েছিলাম। তখন একটি আমেরিকান অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে শিকাগো যাওয়ার সময় সে দেশের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিশ্বের ১৮টি দেশে তাঁর বিশাল ব্যবসা। ব্যবসায়িক কাজে তাঁকে বেশির ভাগ সময়ই সফরের মধ্যে থাকতে হয়। রসিকতার ছলে তিনি বললেন, 'আমার দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই কাটে ফ্লাইটে।' তাঁকে দেখলাম, ফ্লাইটে নিজের আসনে বসেই ল্যাপটপ থেকে বেশ কিছু মেসেজ পাঠালেন। তারপর নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিজনেস পাতায় চোখ বোলালেন। একটা নিঃশ্বাস ফেলে তিনি মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, 'আমি কোন দেশের নাগরিক। আমি বললাম, বাংলাদেশের।' তিনি আমার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, 'ইউর গ্রেট লিডার শেখ মুজিব! ইয়েস, আই নো, হি ওয়াজ রিয়েলি এ ক্যারিজম্যাটিক লিডার!'
ঠিক একই চিত্র দেখেছি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষেত্রে। তিনি ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হয়ে দেশের জন্য এক বিরল সম্মান নিয়ে এসেছেন। এর পর থেকে বিশ্ব নতুনভাবে বাংলাদেশকে চিনেছে। তারই প্রমাণ পেলাম বেলজিয়াম সফরে গিয়ে। ওই বছরই ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমন্ত্রণে ব্রাসেলসে গিয়েছিলাম। সেখানকার এক নাগরিকের সঙ্গে পরিচয় হতেই তিনি জানতে চাইলেন, আমি কোন দেশের নাগরিক। আমি বাংলাদেশের নাম বলতেই তিনি বললেন, 'ওহ! ড. ইউনূসের দেশ!' তারপর তিনি আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, 'যে দেশে একজন ইউনূস জন্ম নিতে পারেন, সেই দেশ পিছিয়ে থাকতে পারে না। সেই দেশের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। আমি তোমার দেশকে হাজারটা স্যালুট করি।'
গর্বে আমার বুকটা ভরে গেল। শুধু ইউনূসের কারণে আমি বিদেশি এক নাগরিকের কাছে যে সম্মান পেয়েছি, তা কোনো দিন ভোলার নয়। একইভাবে ২০০৯ সালে অস্ট্রেলীয় সরকারের আমন্ত্রণে সে দেশে গিয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে দেখেছি, ড. ইউনূসকে তাঁরা কী পরিমাণ সম্মান করেন। তাঁর কারণে আমিও সেখানে বিশেষভাবে সম্মানিত হয়েছি। অথচ একসময় বাংলাদেশ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর দারিদ্র্যপীড়িত দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সেই অপবাদ দিতে বিদেশিরা এখন অনেকটাই কুণ্ঠিত।
অথচ আমরা প্রতিহিংসা ও ঈর্ষাপরায়ণ জাতি কিছুতেই ইউনূসকে সহ্য করতে পারছি না। ইউনূস কেন নোবেল পাবেন, তার জন্য তাঁকে শাস্তি পেতে হবে। নোবেল পাওয়াটাই যেন তাঁর বড় অপরাধ! সে জন্য তাঁকে শাস্তি দিচ্ছে সরকার। সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, সরকার ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাঁকে বধ না করা পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলতে থাকবে। সরকারের আর যেন কোনো কাজ নেই। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা বলেই ফেললেন, 'এ দেশে নোবেল পাওয়ার যোগ্য নাকি একমাত্র শেখ হাসিনা!' তাঁদের প্রশ্ন, 'ইউনূস কিভাবে নোবেল পান? তিনি তো গরিবের রক্ত চুষে টাকা বানিয়েছেন! আর শেখ হাসিনা শান্তিচুক্তি করে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন; তাঁর নোবেল কোথায় গেল?'
নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস সারা বিশ্বে সম্মান কুড়াচ্ছেন। বিশ্ববাসীর কাছে নতুন এক বাংলাদেশকে তুলে ধরছেন। তিনি বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে যাচ্ছেন বক্তৃতা দিতে। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন সমাজ বদলের। বক্তৃতা দিয়ে তিনি নতুন প্রজন্মকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখছেন। অথচ দেশের মাটিতে বারবার তিনি অপমানিত হচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাঁর তুখোড় সমালোচনা করছেন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তো ড. ইউনূসের নোবেল পাওয়া নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বললেন, 'নোবেল কিভাবে পায়, আপনারাও জানেন, আমরাও জানি। তাদের সঙ্গে খানাপিনা, পানাহার করলেই নোবেল পাওয়া যায়!'
সত্যিই দুঃখজনক, সৈয়দ আশরাফ! আপনার মতো উচ্চ শিক্ষিত একজন মানুষের মুখে এ কথা মানায় না। কাকে খুশি করার জন্য আপনি এসব বললেন? আপনি তো আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কাণ্ডারি ছিলেন। আপনাকেও এখন তোয়াজ করে চলতে হয়! আপনার কথা শুনে সেদিন বলতে ইচ্ছা করেছিল, 'আশরাফ সাহেব, এতই যদি সহজ হয়, একটা নোবেল পুরস্কার এনে দিন না! তাহলে অন্তত ড. ইউনূসকে নিয়ে টানাহেঁচড়াটা বন্ধ হবে!'
নোবেল পাওয়ার খেসারত দিতে হচ্ছে ড. ইউনূসকে পদে পদে। কেউ কেউ বলেন, তাঁর নোবেল পাওয়াটা দোষের নয়, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে নাকি তাঁকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। তিনি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাঁকে সামনে রেখে তৃতীয় শক্তি এখনো সক্রিয় রয়েছে। আমেরিকা তাঁর বিষয়টি মাথায় রেখেছে। দেশে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে ড. ইউনূসকে সামনে নিয়ে আসা হতে পারে! আর তাই আগেভাগে ইউনূসের ভাবমূর্তির ওপর কালিমা লেপন করা হচ্ছে, দেশের সাধারণ মানুষ যাতে তাঁকে নিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করতে না পারে।
শুধু তাই নয়, ড. ইউনূসের নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ বাংক তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এখন তাঁর আয়-রোজগার নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি হচ্ছে। নোবেল পুরস্কারের অর্থসহ তিনি বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা দিয়ে যে আয়-রোজগার করেন তার আয়কর কেন দেওয়া হয়নি- সেসব প্রশ্নও জোরেশোরে তোলা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। এসব দেখে জাতি হিসেবে আমাদের খুবই ছোট মনে হয়। হাত জোড় করে বলতে ইচ্ছা করে, ড. ইউনূস ক্ষমা করুন।
এ দেশে আইডল হিসেবে গণ্য করার মতো মানুষের সংখ্যা খুব কম। বাংলাদেশ ৪০ বছরে আর কিছু না পাক একজন নোবেল বিজয়ী ইউনূসকে তো পেয়েছে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি এখন পর্যন্ত আর কি আছে? ড. ইউনূস নতুন প্রজন্মের কাছে আইডল। আমি নিশ্চিত, ড. ইউনূসের প্রতি অপমান নতুন প্রজন্ম মেনে নিতে পারছে না। তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অপমানও কিন্তু এই প্রজন্ম মেনে নেয়নি।
পরিশেষে নিজের কথা দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। ড. ইউনূস নোবেল পাওয়ার পর আমার দুই ছেলেমেয়েকে বলেছিলাম, ড. ইউনূসের মতো মানুষ হতে হবে বাবা! অথচ এখন আমি ভীষণ ভয়ে আছি। কখন আবার ছেলেমেয়ের প্রশ্নের মুখে পড়ি। কারণ তাঁকে নিয়ে যা হচ্ছে! আর সেই প্রপাগান্ডা টিভি মিডিয়ার কল্যাণে তারা প্রতিনিয়তই দেখছে। এরপর যদি আমার ছেলেমেয়ে প্রশ্ন করে, বাবা, যাঁর এত দুর্নাম (সরকার ছড়াচ্ছে), আমরা কি তাঁর মতো হব?
তখন আমি কী জবাব দেব?
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.