কল্পকথার গল্প-জানমাল নিজ দায়িত্বে রাখুন by আলী হাবিব
এ দেশের মানুষ কি ভোলাভালা! কোনো কিছুই কি মনে থাকে না? হতে পারে। একটা গল্পের কথা মনে পড়ছে। ভুলোমন বাঙালির গল্প। গল্পটা যে সময়ের, তখন রাস্তাঘাটে ছেলেমেয়েরা হাত ধরাধরি করে হাঁটত না। সে এক অন্য রকম সময় ছিল।
নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে মেয়েদের বাড়ির বাইরে যাওয়া ছিল বারণ। নানা নিষেধের বেড়াজালে আটকে ছিল জীবন। এমনকি রাত গভীর হওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রীর দেখা কিংবা কথাও হতো না। সে রকম কোনো একসময়ে এক রাশভারী ভদ্রলোক শ্বশুরবাড়ি গেছেন স্ত্রীকে আনতে। সে সময় আবার ট্রেনে-বাসে-স্টিমারে মেয়েদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা থাকত। তো, ভদ্রলোক স্ত্রীকে আনতে গেছেন। নিঃসন্দেহে শ্বশুরবাড়িতে চর্ব্যচূষ্যে দু-চার দিন আপ্যায়িত হয়েছেন। এরপর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছেন। সে আমলে বাস-ট্রেন-স্টিমারের বাইরে প্রধান বাহন তো ছিল গরু বা ঘোড়ার গাড়ি। যা হোক, কোনো এক জায়গা থেকে বাসে উঠে নিজের বাড়ির স্ট্যান্ডে নামতে হবে। ভদ্রলোক বাস থেকে নেমেছেন। নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন। বাড়িতে যাওয়ার পর বউদিরা যখন জানতে চাইলেন গিন্নি কোথায়, ভদ্রলোক নিতান্ত বিস্মিত হয়ে বললেন- তাই তো, তাই তো! বিস্মিত হওয়ারই কথা। আজকের দিনে কি এটা বিশ্বাস করা যায়? যায় না।
এই ভুলোমন বাঙালিকে নিয়ে সবার সব চিন্তা। দুশ্চিন্তায় আছেন পরমেশ্বরও। তিনি নারদকে পাঠিয়েছেন বাঙালির অবস্থা দেখতে। এবার আর চিত্রগুপ্তকে বাংলাদেশে পাঠাতে সাহস করেননি তিনি। আগেরবার তাঁকে নাকি মর্ত্যের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভীষণভাবে টেনে ধরেছিল। অন্যদিকে খবরের কাগজের সাহিত্য সাময়িকীতে এক বাঙালি কবি লিখেছেন, 'ললনা এখানে জাদু জানে সখা এক আঁখি ইশারায়/ শত বছরের সংযম বাঁধ কোথায় টুটিয়া যায়।' অনেক চিন্তা করে তাই নারদকে পাঠানো হয়েছে। নারদ অনেক কিছু ক্রিটিক্যালি বিশ্লেষণ করতে পারেন। মর্ত্যে পাঠানোর আগে নারদকে সব কিছু ভালোমতো গুছিয়ে বলে দেওয়া হয়েছে। সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। আজকাল মর্ত্যের নিয়মকানুন অনেক বদলে গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে তো খুবই সাবধানে থাকতে হয়। তাঁকে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যেখানেই তিনি থাকবেন, সব সময় স্বর্গের সঙ্গে যাতে যোগাযোগ রাখতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। অবশ্য নারদেরও এটা প্রথম মর্ত্যে আসা নয়।
মর্ত্যে এবার নারদের নতুন অ্যাসাইনমেন্টে আসা। আগেরবারের মতোই তাঁর এবারের জায়গাটিও বাংলাদেশ। এবার তাঁকে পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তার বিষয়ে পরমেশ্বরের কাছে রিপোর্ট করার জন্য। নারদ বাংলাদেশে এসে প্রতিদিন একটি রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন। আজকাল সব কিছুই লিক হয়ে যায়। নারদের পাঠানো রিপোর্ট লিক হতেও সময় লাগেনি। নারদ তাঁর রিপোর্ট যেভাবে পাঠিয়েছেন, সেটাই এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো।
এ এক অপূর্ব দেশ পরমেশ্বর। এখানে সবাই সবার উপকার করার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। কিছু মানুষ আবার বংশদণ্ড হাতে সদা প্রস্তুত। ঈদের সময় রাস্তায় এই সব মানুষের দেখা পেয়ে একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। পরে দেখা গেল, এরা সবাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক। কিন্তু তারা এভাবে বংশদণ্ড হাতে রাস্তায় দণ্ডায়মান কেন? আমার মনে ভাবনার উদ্রেক হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটু নিরীহ গোছের দেখতে এমন একজনের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে চাইলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, আপনার হাতে বংশদণ্ড কেন? তিনি যা জবাব দিলেন তাতে আমার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তাঁর দেওয়া জবাব থেকে আমি জানতে পারলাম, তিনি নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত আছেন। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা একসময় খুব আলোড়ন তুলেছিল শুনেছি। কিন্তু এই সময়ে এসেও বাঁশের লাঠি দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, এমন কথা শুনিনি। পরমেশ্বর, ঢাকা শহরে এসে আমি কেবল একটি জিনিসই শুনেছি, সেটা হচ্ছে নিরাপত্তা। নিরাপত্তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। শুধু নিজের নয়, পরিবারের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তা কম নয়। 'নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে কলিশন হয়'- এমন একটা কবিতা আছে বাংলা পাঠ্য বইয়ে। এখানে পরমেশ্বর, কারো জীবনের নিরাপত্তা নেই। ঢাকা শহরে কখন বাস রাস্তা থেকে ফুটপাতে উঠে যায়, খানাখন্দে পড়ে, তার ঠিক নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাস্তাগুলোর যে হাল, তাতে বলা যেতে পারে, এখানে মানুষ জীবন হাতে নিয়েই চলাফেরা করে। এখন ঈদের সময়। বাঙালি ভীষণ উৎসবপ্রিয় জাতি। উৎসবের আনন্দ স্বজনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে বাঙালি সব সময় উদ্গ্রীব। আর কিছু না হোক, ঈদের সময় বাড়ির দিকে বাঙালি যাবেই।
কিন্তু সব ভুলে বাড়ির দিকে ছুটলে তো হবে না। নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবতে হবে। সিকিউরিটি ফার্স্ট! আগে নিরাপত্তা, তারপর বাড়ির দিকে ছোটা। ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেলে তো চলবে না। আবার বাড়িতে যেতে হলে টিকিট চাই। এ এক আজব দেশ, পরমেশ্বর। এখানে ঈদের টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তা শেষ হয়ে যায়। কী আশ্চর্য, কাউন্টারে শেষ হয়ে যাওয়া টিকিট আবার বাইরে পাওয়া যায়। এখানে অনেক বাজার আছে। কাউন্টারে শেষ হয়ে যাওয়া টিকিট বাইরে যেখানে পাওয়া যায়, সেই বাজারকে এখানে বলা হয় কালোবাজার। ঈদের সময় আর সব বাজারের সঙ্গে ঘরে ফেরার এই টিকিটের বাজারও জমজমাট। কিন্তু কালোবাজারে টিকিট পেলেই যে নির্বিঘ্নে বাড়িতে ফেরা হবে, সে নিশ্চয়তা নেই। ঈদের সময় লক্কড়ঝক্কড় অনেক গাড়ি বাস্তায় নামানো হয়। সেই গাড়িতে জীবন হাতে করে অনেককে বাড়ির পথ ধরতে হয়। ওই যে বাঙালির আবেগ। সেই আবেগ নিয়ে অদ্ভুত এক ব্যবসা। সারা বছর ধরে এই বাড়ি ফেরার মৌসুমের অপেক্ষায় থাকেন অনেক পরিবহন ব্যবসায়ী। তার পরও অনেক কথা থেকে যায়, পরমেশ্বর। কবি লিখেছেন, 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।' সত্যিই তা-ই। এখানে রাস্তার কাজের দেখভাল করতে মন্ত্রীকে রাস্তাঘাটে ছুটে বেড়াতে হয়। অনেকে মনে করছেন, মন্ত্রীর মুখের কথায় কাজ হচ্ছে না বলেই তাঁকে সব ফেলে রাস্তায় রাস্তায় ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। কী আর করা! কয়েক বছর আগে সংস্কারপন্থী বলে কিছু রাজনীতিকের নাম শোনা গিয়েছিল। এখন সংস্কারপন্থী পথমন্ত্রীর দেখা মেলে বাংলাদেশে। 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি/ আমি যে সড়ক সংস্কারের পন্থী'- এটাই যেন পথমন্ত্রীর নির্বাণ মন্ত্র। প্রতিদিন যেন তিনি এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে পথে পথে ছুটে বেড়াচ্ছেন। দেশের মিডিয়ায় সে খবর ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। আগে আগে ছুটছেন মন্ত্রী, তাঁর পেছনে টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরা। এরই মধ্যে কিছু রাস্তায় মানুষ ধানের চারা লাগিয়ে অভিনব এক প্রতিবাদ করেছে। না করেই বা উপায় কি, কাদা-পানিতে ডুবে থাকা সেই সব রাস্তা দেখে বোঝার উপায় নেই সেটা রাস্তা, নাকি রোপা আমন ধানের ক্ষেত। এবার ঈদে এসব রাস্তা দিয়েও অনেক মানুষকে বাড়িতে ফিরতে হবে। এসব রাস্তা দিয়ে যাঁরা বাড়িতে ঈদের আনন্দ প্রিয়জনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে যাবেন এবং এসব রাস্তা দিয়েই ফিরে আসবেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা হাতের মুঠোয় জীবনটা নিয়ে পাড়ি দেবেন এই পথ।
না হয় নির্বিঘ্নেই পাড়ি দেওয়া গেল এই দুস্তর পারাবার। কিন্তু পরমেশ্বর, ঢাকার বাড়ির দুশ্চিন্তা যে থেকেই যায়। ঢাকার বাড়িতে তো তালা লাগিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার কী হবে? বাড়িগুলোর নিরাপত্তা কে দেবে? ঈদের ছুটিতে এসব বাড়িতে তালা ভেঙে চুরি হবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে?
রাজধানী ঢাকার তালা ঝোলানো খালি বাড়ির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়া না গেলেও একটি সদুপদেশ পাওয়া গেছে, পরমেশ্বর। নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী জনগণকে চমৎকার একটি কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে নসিহত করেছেন। তিনি বলেছেন, ঘরমুখো মানুষ যেন নিজেদের বাড়িতে ভালোমতো তালা লাগাতে ভুল না করে। এই মহতী বচন শুনে দেশের তাবৎ মানুষের লাগে বিষম বিস্ময়। অনেক আগে আমি যখন বাংলাদেশে আসি, তখন বাসে উঠে একটি বাণী লেখা দেখেছিলাম। সব বাসের ভেতরে লেখা থাকত, মালামাল নিজ দায়িত্বে রাখুন। 'বডি মিস্ত্রি নিতাই আর রং-তুলিতে খগেন' যুগের অবসান হয়েছে। এ দেশে এখন বিলাসবহুল বাস চলে। কিন্তু আগের দিনে বাসের মধ্যে যা লেখা থাকত, তা-ই যেন নতুন করে ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। সে আমলে বাস থেকে নামার দরজার মুখে লেখা থাকত, 'কিছু ফেলে গেলেন কি?' এখন ঘরমুখো মানুষের চিন্তা, ঘরে ভালোমতো তালা লাগানো হয়েছে কি? অনেক দিন পর এখন এখানকার রাস্তাঘাট দেখে আর মন্ত্রীবচন শুনে মনে হয়, 'মালামাল নিজ দায়িত্বে রাখুন' জাতীয় বাক্য বদল করার সময় এসেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই তো বদলে যায়। এখন ঘরমুখো মানুষকে একটি মন্ত্র শিখিয়ে দেওয়া প্রয়োজন- জানমাল নিজ দায়িত্বে রাখুন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে এক কবি অনেককাল আগে লিখে গেছেন, 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে...।' আধুনিক এক কবি ভালো করে তালা লাগানোর এই মন্ত্রীবচন স্মরণীয় করে রাখতে লিখেছেন, 'ঈদ এসেছে এবার সবার বাড়ি ফেরার পালা/ ফেরার আগে ভালো করে লাগান ঘরে তালা।'
শুনছি, ঈদের অনুষ্ঠানে এই কবিতাটিতে নাকি সুর সংযোজন করা হয়েছে। টেলিভিশনের ঈদ অনুষ্ঠানমালায় একটি ব্যান্ড নাকি গানটি গাইবে। সাধু উদ্যোগ!
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
এই ভুলোমন বাঙালিকে নিয়ে সবার সব চিন্তা। দুশ্চিন্তায় আছেন পরমেশ্বরও। তিনি নারদকে পাঠিয়েছেন বাঙালির অবস্থা দেখতে। এবার আর চিত্রগুপ্তকে বাংলাদেশে পাঠাতে সাহস করেননি তিনি। আগেরবার তাঁকে নাকি মর্ত্যের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভীষণভাবে টেনে ধরেছিল। অন্যদিকে খবরের কাগজের সাহিত্য সাময়িকীতে এক বাঙালি কবি লিখেছেন, 'ললনা এখানে জাদু জানে সখা এক আঁখি ইশারায়/ শত বছরের সংযম বাঁধ কোথায় টুটিয়া যায়।' অনেক চিন্তা করে তাই নারদকে পাঠানো হয়েছে। নারদ অনেক কিছু ক্রিটিক্যালি বিশ্লেষণ করতে পারেন। মর্ত্যে পাঠানোর আগে নারদকে সব কিছু ভালোমতো গুছিয়ে বলে দেওয়া হয়েছে। সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। আজকাল মর্ত্যের নিয়মকানুন অনেক বদলে গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে তো খুবই সাবধানে থাকতে হয়। তাঁকে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যেখানেই তিনি থাকবেন, সব সময় স্বর্গের সঙ্গে যাতে যোগাযোগ রাখতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। অবশ্য নারদেরও এটা প্রথম মর্ত্যে আসা নয়।
মর্ত্যে এবার নারদের নতুন অ্যাসাইনমেন্টে আসা। আগেরবারের মতোই তাঁর এবারের জায়গাটিও বাংলাদেশ। এবার তাঁকে পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তার বিষয়ে পরমেশ্বরের কাছে রিপোর্ট করার জন্য। নারদ বাংলাদেশে এসে প্রতিদিন একটি রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন। আজকাল সব কিছুই লিক হয়ে যায়। নারদের পাঠানো রিপোর্ট লিক হতেও সময় লাগেনি। নারদ তাঁর রিপোর্ট যেভাবে পাঠিয়েছেন, সেটাই এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো।
এ এক অপূর্ব দেশ পরমেশ্বর। এখানে সবাই সবার উপকার করার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। কিছু মানুষ আবার বংশদণ্ড হাতে সদা প্রস্তুত। ঈদের সময় রাস্তায় এই সব মানুষের দেখা পেয়ে একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। পরে দেখা গেল, এরা সবাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক। কিন্তু তারা এভাবে বংশদণ্ড হাতে রাস্তায় দণ্ডায়মান কেন? আমার মনে ভাবনার উদ্রেক হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটু নিরীহ গোছের দেখতে এমন একজনের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে চাইলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, আপনার হাতে বংশদণ্ড কেন? তিনি যা জবাব দিলেন তাতে আমার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তাঁর দেওয়া জবাব থেকে আমি জানতে পারলাম, তিনি নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত আছেন। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা একসময় খুব আলোড়ন তুলেছিল শুনেছি। কিন্তু এই সময়ে এসেও বাঁশের লাঠি দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, এমন কথা শুনিনি। পরমেশ্বর, ঢাকা শহরে এসে আমি কেবল একটি জিনিসই শুনেছি, সেটা হচ্ছে নিরাপত্তা। নিরাপত্তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। শুধু নিজের নয়, পরিবারের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তা কম নয়। 'নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে কলিশন হয়'- এমন একটা কবিতা আছে বাংলা পাঠ্য বইয়ে। এখানে পরমেশ্বর, কারো জীবনের নিরাপত্তা নেই। ঢাকা শহরে কখন বাস রাস্তা থেকে ফুটপাতে উঠে যায়, খানাখন্দে পড়ে, তার ঠিক নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাস্তাগুলোর যে হাল, তাতে বলা যেতে পারে, এখানে মানুষ জীবন হাতে নিয়েই চলাফেরা করে। এখন ঈদের সময়। বাঙালি ভীষণ উৎসবপ্রিয় জাতি। উৎসবের আনন্দ স্বজনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে বাঙালি সব সময় উদ্গ্রীব। আর কিছু না হোক, ঈদের সময় বাড়ির দিকে বাঙালি যাবেই।
কিন্তু সব ভুলে বাড়ির দিকে ছুটলে তো হবে না। নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবতে হবে। সিকিউরিটি ফার্স্ট! আগে নিরাপত্তা, তারপর বাড়ির দিকে ছোটা। ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেলে তো চলবে না। আবার বাড়িতে যেতে হলে টিকিট চাই। এ এক আজব দেশ, পরমেশ্বর। এখানে ঈদের টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তা শেষ হয়ে যায়। কী আশ্চর্য, কাউন্টারে শেষ হয়ে যাওয়া টিকিট আবার বাইরে পাওয়া যায়। এখানে অনেক বাজার আছে। কাউন্টারে শেষ হয়ে যাওয়া টিকিট বাইরে যেখানে পাওয়া যায়, সেই বাজারকে এখানে বলা হয় কালোবাজার। ঈদের সময় আর সব বাজারের সঙ্গে ঘরে ফেরার এই টিকিটের বাজারও জমজমাট। কিন্তু কালোবাজারে টিকিট পেলেই যে নির্বিঘ্নে বাড়িতে ফেরা হবে, সে নিশ্চয়তা নেই। ঈদের সময় লক্কড়ঝক্কড় অনেক গাড়ি বাস্তায় নামানো হয়। সেই গাড়িতে জীবন হাতে করে অনেককে বাড়ির পথ ধরতে হয়। ওই যে বাঙালির আবেগ। সেই আবেগ নিয়ে অদ্ভুত এক ব্যবসা। সারা বছর ধরে এই বাড়ি ফেরার মৌসুমের অপেক্ষায় থাকেন অনেক পরিবহন ব্যবসায়ী। তার পরও অনেক কথা থেকে যায়, পরমেশ্বর। কবি লিখেছেন, 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।' সত্যিই তা-ই। এখানে রাস্তার কাজের দেখভাল করতে মন্ত্রীকে রাস্তাঘাটে ছুটে বেড়াতে হয়। অনেকে মনে করছেন, মন্ত্রীর মুখের কথায় কাজ হচ্ছে না বলেই তাঁকে সব ফেলে রাস্তায় রাস্তায় ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। কী আর করা! কয়েক বছর আগে সংস্কারপন্থী বলে কিছু রাজনীতিকের নাম শোনা গিয়েছিল। এখন সংস্কারপন্থী পথমন্ত্রীর দেখা মেলে বাংলাদেশে। 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি/ আমি যে সড়ক সংস্কারের পন্থী'- এটাই যেন পথমন্ত্রীর নির্বাণ মন্ত্র। প্রতিদিন যেন তিনি এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে পথে পথে ছুটে বেড়াচ্ছেন। দেশের মিডিয়ায় সে খবর ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। আগে আগে ছুটছেন মন্ত্রী, তাঁর পেছনে টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরা। এরই মধ্যে কিছু রাস্তায় মানুষ ধানের চারা লাগিয়ে অভিনব এক প্রতিবাদ করেছে। না করেই বা উপায় কি, কাদা-পানিতে ডুবে থাকা সেই সব রাস্তা দেখে বোঝার উপায় নেই সেটা রাস্তা, নাকি রোপা আমন ধানের ক্ষেত। এবার ঈদে এসব রাস্তা দিয়েও অনেক মানুষকে বাড়িতে ফিরতে হবে। এসব রাস্তা দিয়ে যাঁরা বাড়িতে ঈদের আনন্দ প্রিয়জনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে যাবেন এবং এসব রাস্তা দিয়েই ফিরে আসবেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা হাতের মুঠোয় জীবনটা নিয়ে পাড়ি দেবেন এই পথ।
না হয় নির্বিঘ্নেই পাড়ি দেওয়া গেল এই দুস্তর পারাবার। কিন্তু পরমেশ্বর, ঢাকার বাড়ির দুশ্চিন্তা যে থেকেই যায়। ঢাকার বাড়িতে তো তালা লাগিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার কী হবে? বাড়িগুলোর নিরাপত্তা কে দেবে? ঈদের ছুটিতে এসব বাড়িতে তালা ভেঙে চুরি হবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে?
রাজধানী ঢাকার তালা ঝোলানো খালি বাড়ির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়া না গেলেও একটি সদুপদেশ পাওয়া গেছে, পরমেশ্বর। নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী জনগণকে চমৎকার একটি কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে নসিহত করেছেন। তিনি বলেছেন, ঘরমুখো মানুষ যেন নিজেদের বাড়িতে ভালোমতো তালা লাগাতে ভুল না করে। এই মহতী বচন শুনে দেশের তাবৎ মানুষের লাগে বিষম বিস্ময়। অনেক আগে আমি যখন বাংলাদেশে আসি, তখন বাসে উঠে একটি বাণী লেখা দেখেছিলাম। সব বাসের ভেতরে লেখা থাকত, মালামাল নিজ দায়িত্বে রাখুন। 'বডি মিস্ত্রি নিতাই আর রং-তুলিতে খগেন' যুগের অবসান হয়েছে। এ দেশে এখন বিলাসবহুল বাস চলে। কিন্তু আগের দিনে বাসের মধ্যে যা লেখা থাকত, তা-ই যেন নতুন করে ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। সে আমলে বাস থেকে নামার দরজার মুখে লেখা থাকত, 'কিছু ফেলে গেলেন কি?' এখন ঘরমুখো মানুষের চিন্তা, ঘরে ভালোমতো তালা লাগানো হয়েছে কি? অনেক দিন পর এখন এখানকার রাস্তাঘাট দেখে আর মন্ত্রীবচন শুনে মনে হয়, 'মালামাল নিজ দায়িত্বে রাখুন' জাতীয় বাক্য বদল করার সময় এসেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই তো বদলে যায়। এখন ঘরমুখো মানুষকে একটি মন্ত্র শিখিয়ে দেওয়া প্রয়োজন- জানমাল নিজ দায়িত্বে রাখুন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে এক কবি অনেককাল আগে লিখে গেছেন, 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে...।' আধুনিক এক কবি ভালো করে তালা লাগানোর এই মন্ত্রীবচন স্মরণীয় করে রাখতে লিখেছেন, 'ঈদ এসেছে এবার সবার বাড়ি ফেরার পালা/ ফেরার আগে ভালো করে লাগান ঘরে তালা।'
শুনছি, ঈদের অনুষ্ঠানে এই কবিতাটিতে নাকি সুর সংযোজন করা হয়েছে। টেলিভিশনের ঈদ অনুষ্ঠানমালায় একটি ব্যান্ড নাকি গানটি গাইবে। সাধু উদ্যোগ!
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments