মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা প্রসঙ্গে by অধ্যক্ষ এম.এ আউয়াল সিদ্দিকী
শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা প্রশাসন, যোগ্য শিক্ষকম-লী ও কারিকুলামের ওপর নির্ভর করে মানসম্মত শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষার জন্য মনোরম পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামোও দরকার। এর যে কোনটি দুর্বল হলে সুফল তেমন আশা করা যায় না। প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত ফল লাভের জন্য এসব বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয়কে তিন ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমনÑ(১) শিশু বিদ্যালয়, (২) প্রাথমিক বিদ্যালয় ও (৩) উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়।
শিশু বিদ্যালয় : এই বিদ্যালয়টি হবে শিশুদের মনোবিকাশের উপযোগী বিদ্যালয়। এর মূল উদ্দেশ্য হবে ‘শিশুকে দৈহিক ও মানসিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তোলা।’ এটি হবে শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রবেশের প্রস্তুতি পর্ব। এ ধরনের বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ৩টি শ্রেণী থাকতে পারে। যেমনÑ(১) নার্সারী (২) ১ম শ্রেণী ও (৩) ২য় শ্রেণী। উন্নত দেশগুলোতে পাড়া, মহল্লা, শিল্প কারখানা সর্বত্রই এক শ্রেণী, দুই শ্রেণী ও তিন শ্রেণী বিশিষ্ট অসংখ্য বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয় সাধারণত বেসরকারীভাবে স্থানীয় জনগণ, ধর্মীয়গোষ্ঠী ও বিশেষ সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। আর্থিক দায়-দায়িত্বও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতারাই বহন করে থাকে। তাছাড়া স্থানীয় সরকার এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে।
গ্রাম এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো অনেক দূরে দূরে অবস্থিত। দূরত্বের কারণে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দূর-দূরান্তের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যেতে পারে না। তাছাড়া পিতা-মাতাও সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অল্প বয়সে দূরবর্তী স্কুলে পাঠাতে চান না। এ কারণে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হতে অনেক বয়স পার হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নির্ধারিত বয়সে পড়ালেখা আরম্ভ করতে পারে না। তাই নিরাপদ পরিবেশে শিশুদের মনোবিকাশের উপযোগী প্রাক-প্রাথমিক শিশু বিদ্যালয় প্রতিটি গ্রাম মহল্লায় প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন। বড় বড় গ্রামে একাধিক শিশু বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। কেবল তাহলেই শিশুরা যথাসময়ে পড়ালেখা আরম্ভ করতে পারবে। শিক্ষা সম্প্রসারণ ও নিরক্ষরতা দূরীকরণেও এ ধরনের বিদ্যালয় বিশেষ সহায়ক হবে।
প্রাক-প্রাথমিক শিশু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও অর্থায়নের দায়িত্ব জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার ওপর ন্যস্ত করতে হবে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় : প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব পুরোপুরি সরকারকে নিতে হবে। নিম্ন প্রাথমিক স্তরে নার্সারী হতে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের ব্যবস্থা থাকবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানেও ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান খুবই শোচনীয়। শুরুতেই গলদ থাকলে প্রত্যাশিত মানসম্মত শিক্ষা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তাই প্রাথমিক শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। শিক্ষককে দায়িত্বশীল হতে হবে। নিজ কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিক্ষক তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা তা পরিদর্শনের জন্য শিক্ষা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা পরিষদকে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। স্থানীয় জনসাধারণকেও লক্ষ্য রাখতে হবে বিদ্যালয়টি সঠিকভাবে চলছে কিনা। শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা পরিষদ ও স্থানীয শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে অনীহা, অবহেলা, গাফিলতি বা শৈথিল্য পরিলক্ষিত হলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত করতে হবে। এ কাজটি করতে পারেন সচেতন অভিভাবক, শিক্ষানুরাগী ও সমাজহিতৈষী ব্যক্তিগণ। বিদ্যালয়ের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখার লক্ষ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়েই একটি অভিভাবক সমিতি থাকা দরকার।
উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় : উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো আপগ্রেড প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এ স্তরে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। বর্তমানে এ স্তরটিকে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় বলা হয়। এই শিক্ষা স্তরটি মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতি পর্ব এবং উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণের সমাপনী স্তর। কাজেই শিক্ষাব্যবস্থায় এ স্তরটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। চূড়ান্ত পর্যায়ে এই বিদ্যালয়ে নার্সারী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের ব্যবস্থা থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার দাবি দীর্ঘদিনের। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা সর্বস্তরের মানুষেরই দাবি। অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব পুরোপুরি সরকার গ্রহণ করবে এটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা। প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্পন্ন ও দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যেই বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন-১৯৭৪, বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন-১৯৮৬, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০০ এবং জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০এ পাথমিক শিক্ষাকে ৮ বছর মেয়াদী করার সুপারিশ করা হয়েছে। এমনকি পাকিস্তান আমলে গঠিত ১৯৫৭ ও ১৯৫৯ সালের শিক্ষা কমিশনও ৮ বছর মেয়াদী প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করে। জাতীয় শিক্ষা কমিশন-২০০৩ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত গঠিত অধিকাংশ শিক্ষা কমিশন ও কমিটি ৫ বছরের স্থলে ৮ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ৮ বছর মেয়াদী করার যুক্তিযুক্ত কারণÑপ্রাথমিক শিক্ষা দেশের একটি বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য সমাপনী স্তর। এই স্তরের শিক্ষা শেষে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে জীবন ও জীবিকার জন্য বিভিন্ন পেশা গ্রহণসহ শ্রমবাজারে প্রবেশের চিন্তা করতে হয়। খুব সম্ভবত এসব বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ বছর মেয়াদী করার বিষয় সুপারিশ করা হয়েছিল।” বাস্তবতাও তাই। এ কারণেই প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্পন্ন করার লক্ষ্যে অষ্টমমান পর্যন্ত উন্নীত করা খুবই জরুরী।
প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার লক্ষ্যে নিম্নেবর্ণিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও সহজ হবে।
১.একটি আইনের মাধ্যমে বর্তমান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে অষ্টমমান সরকারী অথবা বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় করা যেতে পারে। এ জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে। এই বিদ্যালয়গুলোতে পরবর্তীতে নিম্ন প্রাথমিক শাখা সংযোগ করতে হবে। ২. দেশে অনেক মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে যেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষার্থী নেই এবং নিকটবর্তী ঘন ঘন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকায় স্কুলটির প্রয়োজনীয়তাও তেমন নেই। এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও আপগ্রেড সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেয়া হলে স্বেচ্ছায় অনেকেই এগিয়ে আসতে পারে। ৩. অষ্টমমান পর্যন্ত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর পাঠদানের অনুমতি নেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষার্থী ও কোয়ালিটি শিক্ষক আছে। আপগ্রেড সরকারী বা বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সুযোগ দেয়া হলে এসব প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে পারে। ৪. অষ্টমমান আপগ্রেড প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুযোগ দেয়া হলে বা আহ্বান জানালে জনসাধারণের প্রচেষ্টাতেও পঞ্চমমান পর্যন্ত বিদ্যমান সরকারী ও বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বহুসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করে নেয়া যাবে। অর্থাৎ বহুক্ষেত্রেই জনসাধারণ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করে দেবে। ৫. মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিম্ন মাধ্যমিক শাখা (৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণী) প্রাথমিক শাখা হিসাবে গণ্য হবে এমন বিধান করতে হবে। ৬. পঞ্চমমান পর্যন্ত বিদ্যমান প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে পর্যায়ক্রমে অষ্টমমান আপগ্রেড সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
নিম্ন মাধ্যমিক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিম্ন মাধ্যমিক শাখাকে প্রাথমিক শাখায় রূপান্তরিত করে অষ্টমমান আপগ্রেড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করা যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে দেশের সকল পঞ্চমমনা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে অষ্টমমান আপগ্রেড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করতে হবে।
পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা পর্ষদ : ৫ম শ্রেণীর কোর্স সমাপনীতে প্রাথমিক বিদ্যালয় সমাপনী পরীক্ষা বা প্রাইমারী স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (চৎরসধৎু ঝপযড়ড়ষ ঈবৎঃরভরপধঃব ঊীধসরহধঃরড়হ সংক্ষেপে চঝঈ) এবং ৮ম শ্রেণীর কোর্স সমাপনীতে উচ্চ প্রাথমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা (ঐরমযবৎ চৎরসধৎু ঈবৎঃরভরপধঃব ঊীধসরহধঃরড়হ সংক্ষেপে ঐচঈ) অনুষ্ঠিত হবে। যেমনটি রয়েছে মাধ্যমিক স্তরে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফেকেট পরীক্ষা ঝবপড়হফধৎু ঝপযড়ড়ষ ঈবৎঃরভরপধঃব ঊীধসরহধঃরড়হ সংক্ষেপে ঝঝঈ) এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা (ঐরমযবৎ ঝবপড়হফধৎু ঈবৎঃরভরপধঃব ঊীধসরহধঃরড়হ সংক্ষেপে ঐঝঈ) . মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের মতো প্রাথমিক স্তরের এ দু’টি পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনার জন্য প্রতি বিভাগে একটি করে ‘প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড’ বা প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করা যেতে পারে। এছাড়া সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য বড় বড় বিভাগে একাধিক বোর্ড স্থাপন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ঢাকা বিভাগের ময়মনসিংহে ১টি, চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লায় ১টি এবং খুলনা বিভাগের যশোরে ১টি করে অতিরিক্ত বোর্ড স্থাপন করা যেতে পারে। পরীক্ষা পরিচালনা ছাড়াও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডগুলোর ন্যায় অন্যান্য কার্যক্রমও এ বোর্ডগুলোর ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে।
পাঠ্যসূচী : উচ্চ প্রাথমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষার জন্য ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর মতো ৭ম ও ৮ম শ্রেণীর সমন্বিত পাঠ্যসূচী করা যেতে পারে। এতে যথাসময়ে কোর্স সমাপন ও ফাইনাল পরীক্ষা গ্রহণ সহায়ক হবে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
শিশু বিদ্যালয় : এই বিদ্যালয়টি হবে শিশুদের মনোবিকাশের উপযোগী বিদ্যালয়। এর মূল উদ্দেশ্য হবে ‘শিশুকে দৈহিক ও মানসিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তোলা।’ এটি হবে শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রবেশের প্রস্তুতি পর্ব। এ ধরনের বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ৩টি শ্রেণী থাকতে পারে। যেমনÑ(১) নার্সারী (২) ১ম শ্রেণী ও (৩) ২য় শ্রেণী। উন্নত দেশগুলোতে পাড়া, মহল্লা, শিল্প কারখানা সর্বত্রই এক শ্রেণী, দুই শ্রেণী ও তিন শ্রেণী বিশিষ্ট অসংখ্য বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয় সাধারণত বেসরকারীভাবে স্থানীয় জনগণ, ধর্মীয়গোষ্ঠী ও বিশেষ সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। আর্থিক দায়-দায়িত্বও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতারাই বহন করে থাকে। তাছাড়া স্থানীয় সরকার এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে।
গ্রাম এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো অনেক দূরে দূরে অবস্থিত। দূরত্বের কারণে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দূর-দূরান্তের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যেতে পারে না। তাছাড়া পিতা-মাতাও সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অল্প বয়সে দূরবর্তী স্কুলে পাঠাতে চান না। এ কারণে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হতে অনেক বয়স পার হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নির্ধারিত বয়সে পড়ালেখা আরম্ভ করতে পারে না। তাই নিরাপদ পরিবেশে শিশুদের মনোবিকাশের উপযোগী প্রাক-প্রাথমিক শিশু বিদ্যালয় প্রতিটি গ্রাম মহল্লায় প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন। বড় বড় গ্রামে একাধিক শিশু বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। কেবল তাহলেই শিশুরা যথাসময়ে পড়ালেখা আরম্ভ করতে পারবে। শিক্ষা সম্প্রসারণ ও নিরক্ষরতা দূরীকরণেও এ ধরনের বিদ্যালয় বিশেষ সহায়ক হবে।
প্রাক-প্রাথমিক শিশু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও অর্থায়নের দায়িত্ব জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার ওপর ন্যস্ত করতে হবে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় : প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব পুরোপুরি সরকারকে নিতে হবে। নিম্ন প্রাথমিক স্তরে নার্সারী হতে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের ব্যবস্থা থাকবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানেও ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান খুবই শোচনীয়। শুরুতেই গলদ থাকলে প্রত্যাশিত মানসম্মত শিক্ষা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তাই প্রাথমিক শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। শিক্ষককে দায়িত্বশীল হতে হবে। নিজ কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিক্ষক তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা তা পরিদর্শনের জন্য শিক্ষা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা পরিষদকে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। স্থানীয় জনসাধারণকেও লক্ষ্য রাখতে হবে বিদ্যালয়টি সঠিকভাবে চলছে কিনা। শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা পরিষদ ও স্থানীয শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে অনীহা, অবহেলা, গাফিলতি বা শৈথিল্য পরিলক্ষিত হলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত করতে হবে। এ কাজটি করতে পারেন সচেতন অভিভাবক, শিক্ষানুরাগী ও সমাজহিতৈষী ব্যক্তিগণ। বিদ্যালয়ের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখার লক্ষ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়েই একটি অভিভাবক সমিতি থাকা দরকার।
উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় : উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো আপগ্রেড প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এ স্তরে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। বর্তমানে এ স্তরটিকে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় বলা হয়। এই শিক্ষা স্তরটি মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতি পর্ব এবং উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণের সমাপনী স্তর। কাজেই শিক্ষাব্যবস্থায় এ স্তরটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। চূড়ান্ত পর্যায়ে এই বিদ্যালয়ে নার্সারী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের ব্যবস্থা থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার দাবি দীর্ঘদিনের। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা সর্বস্তরের মানুষেরই দাবি। অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব পুরোপুরি সরকার গ্রহণ করবে এটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা। প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্পন্ন ও দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যেই বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন-১৯৭৪, বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন-১৯৮৬, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০০ এবং জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০এ পাথমিক শিক্ষাকে ৮ বছর মেয়াদী করার সুপারিশ করা হয়েছে। এমনকি পাকিস্তান আমলে গঠিত ১৯৫৭ ও ১৯৫৯ সালের শিক্ষা কমিশনও ৮ বছর মেয়াদী প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করে। জাতীয় শিক্ষা কমিশন-২০০৩ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত গঠিত অধিকাংশ শিক্ষা কমিশন ও কমিটি ৫ বছরের স্থলে ৮ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ৮ বছর মেয়াদী করার যুক্তিযুক্ত কারণÑপ্রাথমিক শিক্ষা দেশের একটি বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য সমাপনী স্তর। এই স্তরের শিক্ষা শেষে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে জীবন ও জীবিকার জন্য বিভিন্ন পেশা গ্রহণসহ শ্রমবাজারে প্রবেশের চিন্তা করতে হয়। খুব সম্ভবত এসব বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ বছর মেয়াদী করার বিষয় সুপারিশ করা হয়েছিল।” বাস্তবতাও তাই। এ কারণেই প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্পন্ন করার লক্ষ্যে অষ্টমমান পর্যন্ত উন্নীত করা খুবই জরুরী।
প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার লক্ষ্যে নিম্নেবর্ণিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও সহজ হবে।
১.একটি আইনের মাধ্যমে বর্তমান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে অষ্টমমান সরকারী অথবা বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় করা যেতে পারে। এ জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে। এই বিদ্যালয়গুলোতে পরবর্তীতে নিম্ন প্রাথমিক শাখা সংযোগ করতে হবে। ২. দেশে অনেক মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে যেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষার্থী নেই এবং নিকটবর্তী ঘন ঘন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকায় স্কুলটির প্রয়োজনীয়তাও তেমন নেই। এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও আপগ্রেড সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেয়া হলে স্বেচ্ছায় অনেকেই এগিয়ে আসতে পারে। ৩. অষ্টমমান পর্যন্ত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর পাঠদানের অনুমতি নেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষার্থী ও কোয়ালিটি শিক্ষক আছে। আপগ্রেড সরকারী বা বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সুযোগ দেয়া হলে এসব প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে পারে। ৪. অষ্টমমান আপগ্রেড প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুযোগ দেয়া হলে বা আহ্বান জানালে জনসাধারণের প্রচেষ্টাতেও পঞ্চমমান পর্যন্ত বিদ্যমান সরকারী ও বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বহুসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করে নেয়া যাবে। অর্থাৎ বহুক্ষেত্রেই জনসাধারণ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করে দেবে। ৫. মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিম্ন মাধ্যমিক শাখা (৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণী) প্রাথমিক শাখা হিসাবে গণ্য হবে এমন বিধান করতে হবে। ৬. পঞ্চমমান পর্যন্ত বিদ্যমান প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে পর্যায়ক্রমে অষ্টমমান আপগ্রেড সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
নিম্ন মাধ্যমিক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিম্ন মাধ্যমিক শাখাকে প্রাথমিক শাখায় রূপান্তরিত করে অষ্টমমান আপগ্রেড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করা যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে দেশের সকল পঞ্চমমনা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে অষ্টমমান আপগ্রেড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করতে হবে।
পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা পর্ষদ : ৫ম শ্রেণীর কোর্স সমাপনীতে প্রাথমিক বিদ্যালয় সমাপনী পরীক্ষা বা প্রাইমারী স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (চৎরসধৎু ঝপযড়ড়ষ ঈবৎঃরভরপধঃব ঊীধসরহধঃরড়হ সংক্ষেপে চঝঈ) এবং ৮ম শ্রেণীর কোর্স সমাপনীতে উচ্চ প্রাথমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা (ঐরমযবৎ চৎরসধৎু ঈবৎঃরভরপধঃব ঊীধসরহধঃরড়হ সংক্ষেপে ঐচঈ) অনুষ্ঠিত হবে। যেমনটি রয়েছে মাধ্যমিক স্তরে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফেকেট পরীক্ষা ঝবপড়হফধৎু ঝপযড়ড়ষ ঈবৎঃরভরপধঃব ঊীধসরহধঃরড়হ সংক্ষেপে ঝঝঈ) এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা (ঐরমযবৎ ঝবপড়হফধৎু ঈবৎঃরভরপধঃব ঊীধসরহধঃরড়হ সংক্ষেপে ঐঝঈ) . মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের মতো প্রাথমিক স্তরের এ দু’টি পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনার জন্য প্রতি বিভাগে একটি করে ‘প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড’ বা প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করা যেতে পারে। এছাড়া সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য বড় বড় বিভাগে একাধিক বোর্ড স্থাপন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ঢাকা বিভাগের ময়মনসিংহে ১টি, চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লায় ১টি এবং খুলনা বিভাগের যশোরে ১টি করে অতিরিক্ত বোর্ড স্থাপন করা যেতে পারে। পরীক্ষা পরিচালনা ছাড়াও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডগুলোর ন্যায় অন্যান্য কার্যক্রমও এ বোর্ডগুলোর ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে।
পাঠ্যসূচী : উচ্চ প্রাথমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষার জন্য ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর মতো ৭ম ও ৮ম শ্রেণীর সমন্বিত পাঠ্যসূচী করা যেতে পারে। এতে যথাসময়ে কোর্স সমাপন ও ফাইনাল পরীক্ষা গ্রহণ সহায়ক হবে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
No comments