টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন-হিসাব মহানিয়ন্ত্রক অফিসে ২৩ খাতে ঘুষ দিতে হয়

অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে হিসাব মহানিয়ন্ত্রক অফিস (সিজিএ)। এই অফিসে ২৩ খাতে ঘুষ দিতে হয়। এসব খাতে ১ থেকে ১০ শতাংশ হারে ঘুষ দিয়ে কাজ সমাধান করতে হয়। ঘুষ না দিলে কাজ হয় না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।


গতকাল রবিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে টিআইবি আয়োজিত 'হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ : উত্তরণের উপায়' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। সিজিএ অফিসের ওপর এবারই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে গবেষণা করেছে টিআইবি। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এ গবেষণা করা হয়েছে।
এই গবেষণা প্রতিবেদনকে সঠিক বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, সিজিএ অফিসে অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে, এটা সাধারণ মানুষের উপলব্ধি। গবেষণা প্রতিবেদনটি সঠিক। এটা মেনে নেওয়া উচিত হবে। এ ছাড়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্প ও ঠিকাদারির এক লাখ টাকা বিলের মধ্যে হিসাব ও মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে ঘুষ দিতে হয়। পাঁচ লাখ টাকা বিলের মধ্যে ১ থেকে দেড় শতাংশ হারে ঘুষ দিতে হয়। পাঁচ থেকে ২০ লাখ টাকার মধ্যে ০.৫০ থেকে ১ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়। আর ২০ লাখ টাকার ওপরে ০.২০ থেকে ০.৫০ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়। একই সঙ্গে ঈদ ও পূজার সময়ে যেকোনো বিলে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ এবং মে ও জুন মাসে যেকোনো বিলে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়।
আবার অনেক অফিস ও কর্মকর্তার ব্যক্তিগত হিসাবে গরমিলের কারণে তাঁরাই ঘুষ নিতে সিজিএ অফিসকে প্ররোচিত করেন। এ ছাড়া সেবাগ্রহীতা অফিসগুলো নির্দিষ্ট সময়ের আগে কাজ করাতে ঘুষ দিয়ে থাকে। সিজিএ অফিসে একাধিকবার যাতায়াত খরচ ও সময় ব্যয় বাঁচাতেও অনেকে ঘুষ দিয়ে থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৩টি খাতের মধ্যে নতুন বেতন স্কেল সংযোজন খাতে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। প্রথম বেতন খাতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা, বোনাস উত্তোলন খাতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা, ঠিকাদারি বিলে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া গাড়ির তেল, গ্যাস ও রক্ষণাবেক্ষণ বিলে ১০ শতাংশ, ইন্টারনেট ও টেলিফোনে ২ শতাংশ, কুরিয়ার বিলে ১ শতাংশ, শ্রমিক মজুরির বিলে ১ শতাংশ, টিএ, ডিএ বিলে ১ থেকে ১০ শতাংশ, কন্টিনজেন্সি বিলে ০.২ শতাংশ, পেনশন খাতে ১ থেকে ১০ শতাংশ, টাইম স্কেলে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। একই সঙ্গে কর্মচারীর চাকরি স্থায়ীকরণ ৫০ থেকে ১০০ টাকা, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা, এলপিসি ১০০ থেকে ৫০০ টাকা, জিপিএফ অ্যাকাউন্ট স্লিপ ২০ থেকে ১০০ টাকা, জিপিএফের টাকা অগ্রিম উত্তোলন ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা, কনসালট্যান্টের বিল ১০ থেকে ১৫ শতাংশ, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা ৫০ থেকে ২০০ টাকা, পোশাক ভাতা ১০ শতাংশ, কম্পিউটার বিল এন্ট্রি ১০ থেকে ২০ টাকা, চেক ডেলিভারি ২০ থেকে ৫০ টাকা এবং ভুল সংশোধনে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়।
নতুন বেতন স্কেল সংযোজন করাতে গেজেটেড কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া ননগেজেটেড কর্মকর্তাদের এক হাজার, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের এক হাজার ২০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। একই সঙ্গে সমস্যাসম্পন্ন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দুই হাজার টাকা এবং মাস্টাররোল কর্মচারীদের এক দিনের বেতন ঘুষ দিতে হয়।
আবার যেসব অফিসে কন্টিনজেন্সি খরচ বেশি, সেখানে ঘুষের লেনদেন বেশি। বিল পাস করাতে বিলের ১ থেকে ৫ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়। বিলের অঙ্ক বড় হলে ৩ থেকে ৭ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিজিএ অফিসে সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে- হালনাগাদ আইনের অভাব, দক্ষ জনবলের অভাব, সমন্বয়হীনতা, জবাবদিহিতার অভাব এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও গ্রেডিং সমস্যা। আর এসব সমস্যার কারণে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর্থিক বিবরণে সঠিক চিত্র পাওয়া যায় না। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
নিয়োগ, পদায়ন ও বদলিতেও অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র খুঁজে পেয়েছে টিআইবি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে চুক্তিভিত্তিক সিজিএ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন সিজিএ পদে শূন্যতা রয়েছে। তিন বছর পর বদলি করার নিয়ম থাকলেও ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাবে একই অফিসে কর্মরত থাকেন। এ ছাড়া দলীয় লোক নিয়োগে কর্মচারী সমিতির অবৈধ প্রভাব, ঘুষ গ্রহণ এবং স্বজনপ্রীতি রয়েছে।
তবে গবেষণায় উঠে আসা অভিযোগ মানতে নারাজ সিজিএ অফিসের চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শাহজালাল। তিনি বলেন, যেসব বিল সিজিএ অফিস পাস করে না, সেগুলোর জন্যও সিজিএর নামে দুর্নাম রটানো হচ্ছে। দীর্ঘদিন এ বিভাগে পদায়ন নেই। এ ছাড়া এ বিভাগে লোকবল বাড়ানো হয়নি। তাই ক্ষুধার্ত লোক দিয়ে ভালো কাজ আশা করা যায় না। তিনি বলেন, এ প্রতিবেদনের ৯৫ শতাংশ তথ্য ভুল আছে। বাকি ৫ শতাংশ তথ্য সঠিক রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.