সুঁই সুতোয় নিপুণ কাজ তৈরি হচ্ছে বাহারি থ্রিপিস শাড়ি পাঞ্জাবি- নীলফামারীতে সরগরম কারুপল্লী by তাহমিন হক ববি

ঈদবাজারে বাহারি কাপড়ের জমিনে নকশা ফোটাতে সূচিশিল্পীদের অবসর নেই। অন্তহীন কাজ নিয়ে তারা দিন রাত পার করছে। হ্যান্ডিক্রাফটসে অভিজ্ঞ মেয়েদের সুঁইয়ের ফোঁড়ে লুকিয়ে আছে সুন্দর কারুকাজ। তাঁদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি চলে যাচ্ছে ঢাকার আলিশান শপিং সেন্টার কিংবা শপিং মলগুলোতে।


মূলত ঢাকার ব্যবসায়ীরা ক্যাটালগসহ বিভিন্ন ডিজাইন দেখিয়ে অর্ডার দিয়েছে। সালোয়ার-কামিজ-ওড়না-শাড়ির ওপর হাতের কাজ। কাজ করা হয় পাঞ্জাবি এবং ফতুয়ায়। শুধু এক রঙের কাপড়ের ওপর সুঁই দিয়ে সুতার রকমারি ডিজাইন। সঙ্গে রয়েছে চুমকি, পাথর, পাইপ, পুঁতি, গ্লাসের নিপুণ কারুকার্য। তৈরি হয় বাহারি সব পোশাক। অজপাড়াগাঁয়ের অবহেলিত মেয়েদের হাতে তৈরি হওয়া ওইসব সামগ্রী যে কাউকে মুগ্ধ করে। ডিজাইন শেষে ২০০ কিংবা ৩০০ টাকার কাপড়টি হয়ে যায় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের।
ঈদ সামনে রেখে উত্তরবঙ্গের নীলফামারীর বিভিন্ন এলাকায় হ্যান্ডিক্রাফটসের সূচিশিল্পীরা এখন মহাব্যস্ত সময় পার করছে। ঢাকা থেকে যেভাবে বড় বড় ফ্যাশন হাউসগুলো থেকে একের পর এক ডিজাইয়ের অর্ডার আসছে তাতে সব মিলিয়ে কারুশিল্প পল্লীগুলো সরগরম হয়ে উঠেছে। ঘরের ভেতর বা বাড়ির অঙ্গিনায় অথবা খোলা স্থানে যে যেভাবে পারছে বসে পড়ে শাড়ি বা সালোয়ার কামিজে হাতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এমন দৃশ্যপট প্রতি বছরের ঈদে দেখা মিললেও এবার এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্রী ও অসহায় শিশু শ্রমিকরাও। সুন্দর নিপুণ হাতে তারা নকশার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সারাবছরই তারা এ কাজ করে থাকলেও ঈদে ব্যস্ততা বেড়েছে অনেক।
নীলফামারীর সৈয়দপুরের শুধুমাত্র শাড়িতে কারুকাজ করছে ২২ হাজার শ্রমিক। এদের মধ্যে ১৭ হাজার নারী শ্রমিক। সৈয়দপুর উপজেলা এমব্রয়ডারি কারুশিল্প শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ওয়াকিল আহমেদ বলেন, ঢাকার সব ফ্যাশন হাউস, মার্কেট ও শপিংমলে সৈয়দপুরে বানানো এসব কারুশিল্পে শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এখানকার কারখানাগুলো থেকে সপ্তাহে ঢাকায় ৫০ হাজারেরও বেশি শাড়ি যায়। ঢাকা থেকে জর্জেট থানকাপড় এনে তাতে নিখুঁত সব কারুকাজ করা হচ্ছে।
এ ছাড়াও সৈয়দপুর উপজেলার ঢেলাপীর উত্তরা আবাসন প্রকল্পে একটু উঁকি দিলেই চোখে পড়ে থোকায় থোকায় গোল হয়ে বসে কাজ করছেন নারী, পুরুষ ও শিশুরা। প্রায় প্রতিটি ঘরের সামনে বসানো কাঠের তৈরি ফ্রেম। মেয়েরা নিপুণ হাতে সুঁই-সুতা দিয়ে চুমকি, পুঁথি ও জরির কাজ করছেন। তৈরি করছেন নানা নকশার জরির শাড়ি, ওড়না, থ্রি-পিস ও ব্লাউজ। প্রায় ৬ বছর ধরে এখানকার ১ হাজার পরিবার এ কাজ করে জীবনধারণ করছেন। অভাবকে জয় করেছেন তারা। শুধুমাত্র হাতের কাজ করেই সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন সংসারে। শিক্ষাবঞ্চিত শিশুরা সুযোগ পেয়েছে লেখাপড়ারও। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার ৩ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। আবাসনের বেবী আক্তার, কাজলী, পারভীন, শাহিদা জানান, তাদের শাড়িসহ চুমকি, পুঁথি ও জরি সরবরাহ করা হয়। কাজ শেষে মজুরি বাবদ তারা শাড়ি প্রতি ৬ শ’ থেকে ৭শ’ টাকা করে পেয়ে থাকে। ঈদ সামনে রেখে চাহিদা আর ব্যস্ততায় একটি শাড়িতে হাতের কাজ শেষ করতে কম পক্ষে ৫ দিন সময় লেগে যায়। তাদের কাজ করা শাড়ির চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি দিন দিন বাড়ছে এ কর্মে নিয়োজিত নারীদেরও সংখ্যা। আর এ কাজ করে অনেক নারীই এখন স্বাবলম্বী।
এদিকে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলা গ্রামেও কাপড়ে কাঠের তৈরি চারকোনাচি পাটাতনে বিভিন্ন রংয়ে আটকে বাহারি রং বেরংয়ের পাথর দিয়ে নকশা তৈরির কাজ চলছে। বালাগ্রাম মাইজালি গ্রামের তহিদুল ইসলামের মেয়ে রিমা আক্তার গ্রামে তার মতো সুমনা, তাপসী, লতাসহ অনেককে সঙ্গে নিয়ে এ কাজ করে আসছে। ঈদের কারণে কাজের চাপ বেড়েছে।
বাহারি ডিজাইনের শাড়ি, থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, ফতুয়াসহ বিশেষ করে মেয়েদের বিভিন্ন নকশার কাজ। যেসব উপকরণ দিয়ে নকশা তৈরি করা হয় সেগুলোর মধ্যে লেদার, জর্জেট, সাদা গোমপতি, গোমপতি, ওয়েব লেইস, হাফপাইস, কাঠি, সাদা পাথর, সাদালতি, চুমকি, বিস্কিট, টায়ার পুঁথি, বল, ফুল ইত্যাদি। এ কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকরা বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণে কারুশিল্পের মাধ্যমে হাতের কাজ করে নিজের ভাগ্য বদলানো সম্ভব। তারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে এবং নিজেরা উপার্জন করছে। প্রতি বছরের ঈদে তাদের অর্ডার বেড়ে যায় এবং তারা সময় মতো সরবরাহ করে থাকে। এখন তারা মহাব্যস্ত। এদের এ ব্যস্ততা দেখে বলতে হয় গ্রামীণ অর্থনীতিতে বুটিক শিল্প একটি অনন্য মাইলফলক।

No comments

Powered by Blogger.