দুর্নীতির মূলে বিটিসিএল!-সচিবের দাবি, প্রমাণ পাওয়া যায়নি by কাজী হাফিজ
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোসের ধারণা, ক্যারিয়ারদের দুর্নীতি বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়ার কারণেই আন্তর্জাতিক কল কমে গেছে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারদের জন্য এর আগে পোস্টপেইড ব্যবস্থা থাকায় তারা বেশি কল পাঠিয়ে সেই কলের চার্জ পরিশোধ না করে কেটে পড়ত।
এখন প্রি-পেইড ব্যবস্থা করে ওই অপকর্মের পথ বন্ধ করায় তারা কল কম পাঠাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক কল উদ্বেগজনক হারে কমছে। সরকার এই খাত থেকে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে। এ নিয়ে বিটিসিএলের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। গতকাল রবিবার সুনীল কান্তি বোস কল কমে যাওয়ার এই কারণ জানিয়ে বলেন, 'এর আরো কারণ আছে। আমরা সেসব খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আজ (রবিবার) এ বিষয়ে আমরা বৈঠক করেছি। বিটিসিএল ছাড়া দেশে বেসরকারি আন্তর্জাতিক গেটওয়ে রয়েছে। তাদের কলও কমছে। কেন কমছে তাও জানার চেষ্টা করছি। আমাদের বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে বিটিসিএলের বাইরে। বিটিসিএলে এ নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে এমন কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।'
তবে বিটিআরসি, দুদক এবং বিটিসিএলের দুর্নীতিবিরোধী অনেক কর্মকর্তার ধারণা, আন্তর্জাতিক কল নিয়ে দুর্নীতির মূলেই রয়েছে বিটিসিএল। আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বিটিসিএলের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হচ্ছে মহাখালী/কড়াইলস্থ আইটিএক্স ৫ ও ৭ এবং মগবাজারের আইটিএক্স ৩ ও ৬। এর মধ্যে মহাখালী/কড়াইলস্থ আইটিএক্স দুটি ভিওআইপি কারবারিদের ছিটমহল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই স্থাপনা মূলত পরিচালিত হচ্ছে একটি বিশেষ চক্রের মাধ্যমে। বিটিসিএল কর্তৃপক্ষের এবং দেশের টেলিযোগাযাগে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের এ স্থাপনাতে কোনো কর্তৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে না। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের একটি চক্র আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জের কল রেকর্ড ইচ্ছামতো মুছে দিচ্ছে বা কল বাইপাস করছে। কলের প্রকৃত যে হিসাব বিটিসিএলের পাওয়ার কথা, তা তারা পাচ্ছে না। প্রতিদিন কল ভলিউম প্রতিবেদন পাওয়ার কথা থাকলেও এখান থেকে তা পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে পাওয়া যায় গোঁজামিলে ভরা প্রতিবেদন। অজুহাত দেখানো হয় যান্ত্রিক ও কারিগরি ত্রুটির। অথচ এই এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা হয়েছে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান এরিকসনের মাধ্যমে, যাদের ইকুইপমেন্টের মান নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
বিটিসিএলের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, স্থানীয়ভাবে গ্রাহক পর্যায়ে কল রেকর্ড বা বিল মুছে ফেলার ঘটনা তাঁদের প্রতিষ্ঠানে নতুন নয়। তবে পার্থক্য হচ্ছে, স্থানীয় এসব কল রেকর্ড মুছে ফেললে সরকারের ক্ষতি লাখের অঙ্ক ছাড়ায় না। কিন্তু আন্তর্জাতিক কল রেকর্ড মুছে দিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে শত শত কোটি টাকার।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য রফিকুল ইসলাম গত ৭ আগস্ট এই প্রতিবেদককে বলেন, মহাখালীর আইটিএক্স দুটিতে কারিগরি যে সমস্যা ছিল তার সমাধান হয়েছে।
কিন্তু বিটিসিএলের পরিচালক (আন্তর্জাতিক) শরীফুজ্জামান গতকাল জানান, এরিকসন ওই আইটিএক্স দুটির কারিগরি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক কল চুরির তদন্তে নেমে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত এক মাসে বিটিসিএলের কাছে তাদের ২৮টি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সব কটির তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। দুদক সুনির্দিষ্টভাবে এসব ক্যারিয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিতে বিটিসিএলকে গত ৩ জুলাই চিঠি দেয়। এই ক্যারিয়ারগুলো প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বাকি রেখে এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ৮ জুলাইয়ের মধ্যে এসব ক্যারিয়ারের আবেদনপত্র, চুক্তিপত্র, ব্যাংক গ্যারান্টি, কার্যাদেশ প্রদান, সার্কিট চালু, বিল প্রদান, বকেয়া ও তার পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত ব্যবস্থা ইত্যাদি তথ্য চেয়েছিল। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত দুটি ক্যারিয়ার সম্পর্কে কোনো তথ্য সরবরাহ করেনি বিটিসিএল। দুদক সূত্র জনায়, যে ২৬টি ক্যারিয়ার সম্পর্কে নথিপত্র পাঠানো হয়েছে, তা এখনো পরীক্ষা করা শুরু হয়নি। এসব নথি যদি অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ হয়, তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুটি ক্যারিয়ার সম্পর্কে কোনো তথ্য না পাঠানোর বিষয়ে বিটিসিএলের পরিচালক (আন্তর্জাতিক) শরীফুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদের পর এই দুই ক্যারিয়ার সম্পর্কেও তথ্য পাঠানো হবে। এসব তথ্য সংগ্রহ করতে সময় লাগছে। তাঁর দাবি, ২৬টি ক্যারিয়ার সম্পর্কে দুদককে সম্পূর্ণ তথ্যই দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিটিসিএলের কয়েকজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে জানান, দুদকের চিঠি পাওয়ার পরপরই এসব আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার সম্পর্কে বেশ কিছু ফাইল সরিয়ে ফেলার ঘটনা ঘটে। এর আগে ভিওআইপির অবৈধ কারবারে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন অপকর্মে অভিযুক্ত বিটিসিএলের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার তদারকিতে এ ঘটনা ঘটে। দুদককে যেসব তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে, তা আংশিক ও অসম্পূর্ণ।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এসব কর্মকর্তার ধারণা, বিটিসিএল বা আগের বিটিটিবির বিরুদ্ধে কখনো তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে অপকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন নজির নেই। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক কল চুরির তদন্তের বিষয়ে দুদকের বর্তমান উদ্যোগও মাঝপথে থেমে যাবে।
এর আগে বিটিসিএল এবং মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার কারণে আন্তর্জাতিক কলের চোরাকারবারিদের শনাক্ত ও কলের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণ নির্ণয়ে ব্যর্থ হয় বিটিআরসি কমিশনার এ টি এম মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি। বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাইদ খান গত ২২ নভেম্বর জাতীয় সংসদের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অভিযোগ করেন, ভিওআইপির অবৈধ কারবারিরা তাঁদের কম্পানিতেই রয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতাধর হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু করা যাচ্ছে না। তিনি নিজেও জীবনের হুমকির মুখে রয়েছেন। এই অভিযোগের পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটির প্রধান গত ৫ জুন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠনো এক চিঠিতে এই অসহযোগিতার কথা জানিয়ে দেন।
দুদকের অভিযোগগুলো : দুদকের উপপরিচালক এস এম সাহিদুর রহমান গত ৩ জুলাই আন্তর্জাতিক কল নিয়ে নানা দুর্নীতির অভিযোগ উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র/তথ্য সরবরাহের অনুরোধ জানিয়ে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি লেখেন। চিঠির স্মারক নম্বর ১৭৬৬০। এ চিঠির অনুলিপি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বিটিআরসির চেয়ারম্যানকেও পাঠানো হয়। দুদকের অভিযোগগুলো হচ্ছে, বিটিসিএলের বৈদেশিক টেলিযোগাযোগ অঞ্চলের আওতায় মহাখালী ও মগবাজারস্থ আইটিএঙ্গুলোর সিডিআর (কল ডিটেইল রেকর্ড) ডিভাইস অকার্যকর রেখে বৈদেশিক কলের ডাটা তাতে ধারণ না করা, সিডিআর অকার্যকর করার আগের সিডিআর গায়েব করা, বিটিসিএলের 'এসটিএম' এবং 'ই-১' অবৈধভাবে ব্যবহার করে ভিওআইপির মাধ্যমে কল টার্মিনেশন করে কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা, বৈদেশিক ক্যারিয়ার নিয়োগের ক্ষেত্রে ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে বিটিসিএল তথা রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষর, লোকাল এজেন্টের মাধ্যমে বৈদেশিক ক্যারিয়ার কর্তৃক বিটিসিএলের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এবং বৈদেশিক ক্যারিয়ারগুলোর কাছে শত শত কোটি টাকা বকেয়া থাকার পরও বিশেষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করা।
দুদকের চিঠিতে আরো বলা হয়, 'সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বিটিসিএলের নিম্নবর্ণিত ক্যারিয়ারসমূহের আবেদনপত্র, চুক্তিপত্র, ব্যাংক গ্যারান্টি, কার্যাদেশ প্রদান, সার্কিট চালু, বিল প্রদান, বকেয়া ও তার পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত ব্যবস্থা ইত্যাদি তথ্যসংবলিত নথিসমূহের সত্যায়িত ফটোকপি পাওয়া ও পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। অতএব, জরুরি ভিত্তিতে আগামী ৮ জুলাই ২০১২ তারিখের মধ্যে এসব রেকর্ডপত্র/তথ্যাদি দুদকে পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে অনুরোধ করা হলো।'
যে ২৮টি ক্যারিয়ার সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে দুদক : দুদক যে ২৮টি ক্যারিয়ার সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে সেগুলো হচ্ছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিস্টোকল সার্ভিসেস, স্কাই হাই, ফিউজন, আইএজিই ফোন ও এন টেল। যুক্তরাজ্যের অ্যাক্সেফ টেল, রাইয়ান টেল, সিম্পল টেল, জিডিএক্সসি, লাইকা টেল, মনি ইন্টারপ্রাইজ, টেলিলিংক ও ওয়েস্টার্ন নেটওয়ার্ক। সিঙ্গাপুরের ডিজি টেক, এইচএসি জাপান, আই পাওয়ার, এনটিএস গ্লোবাল, ওয়ান ওয়ার্ল্ড, শাইন ওয়ার্ল্ড ও বিডিএইউ। হংকংয়ের আইসিএম গ্রুপ। কানাডার মাই এরবা, ইকো ক্যারিয়ার, ইবসেস, প্রাইম টেল ও শ্যাম লিমিটেড। মালয়েশিয়ার দেশি ডিজিটাল এবং অস্ট্রেলিয়ার ওয়ার্ল্ডটেল প্রাইভেট লিমিটেড।
এর মধ্যে অ্যারিস্টোকল সার্ভিসেস ও স্কাই হাই, অ্যাক্সেফ টেল, রাইয়ান টেল ও সিম্পল টেল, সিঙ্গাপুরের ডিজি টেক, এইচএসি জাপান, আই পাওয়ার, এনটিএস গ্লোবাল, ওয়ান ওয়ার্ল্ড ও শাইন ওয়ার্ল্ড, মাই এরবা এবং আইসিএম গ্রুপের মোট ২৪৪ কোটি টাকা বাকি থাকায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বিটিসিএলের হিসাবে এই ১৩টি ক্যারিয়ারের কাছে ২৪৪ কোটি টাকা পাওনার বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ মাত্র ৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরের আই পাওয়ারের ৪৩ লাখ চার হাজার ৬৬৮ মার্কিন ডলারের বা ৩৫ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি যে ভুয়া তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। সোনালী ব্যাংকের বাড্ডা শাখা থেকে এই ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি ম্যানেজ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে বাড্ডা থানায় মামলা হয়েছে।
বাকি ১৫টি ক্যারিয়ারের মধ্যে মাত্র দুটির ৬৯ হাজার মার্কিন ডলারের বা ৫৬ লাখ ৯ হাজার ৭০০ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টির তথ্য বিটিসিএলের হিসাব শাখার নথিতে রয়েছে। অন্যদিকে এই ১৫ ক্যারিয়ারের কাছে বিটিসিএল বা সরকারের পাওনা রয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক কল উদ্বেগজনক হারে কমছে। সরকার এই খাত থেকে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে। এ নিয়ে বিটিসিএলের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। গতকাল রবিবার সুনীল কান্তি বোস কল কমে যাওয়ার এই কারণ জানিয়ে বলেন, 'এর আরো কারণ আছে। আমরা সেসব খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আজ (রবিবার) এ বিষয়ে আমরা বৈঠক করেছি। বিটিসিএল ছাড়া দেশে বেসরকারি আন্তর্জাতিক গেটওয়ে রয়েছে। তাদের কলও কমছে। কেন কমছে তাও জানার চেষ্টা করছি। আমাদের বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে বিটিসিএলের বাইরে। বিটিসিএলে এ নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে এমন কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।'
তবে বিটিআরসি, দুদক এবং বিটিসিএলের দুর্নীতিবিরোধী অনেক কর্মকর্তার ধারণা, আন্তর্জাতিক কল নিয়ে দুর্নীতির মূলেই রয়েছে বিটিসিএল। আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বিটিসিএলের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হচ্ছে মহাখালী/কড়াইলস্থ আইটিএক্স ৫ ও ৭ এবং মগবাজারের আইটিএক্স ৩ ও ৬। এর মধ্যে মহাখালী/কড়াইলস্থ আইটিএক্স দুটি ভিওআইপি কারবারিদের ছিটমহল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই স্থাপনা মূলত পরিচালিত হচ্ছে একটি বিশেষ চক্রের মাধ্যমে। বিটিসিএল কর্তৃপক্ষের এবং দেশের টেলিযোগাযাগে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের এ স্থাপনাতে কোনো কর্তৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে না। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের একটি চক্র আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জের কল রেকর্ড ইচ্ছামতো মুছে দিচ্ছে বা কল বাইপাস করছে। কলের প্রকৃত যে হিসাব বিটিসিএলের পাওয়ার কথা, তা তারা পাচ্ছে না। প্রতিদিন কল ভলিউম প্রতিবেদন পাওয়ার কথা থাকলেও এখান থেকে তা পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে পাওয়া যায় গোঁজামিলে ভরা প্রতিবেদন। অজুহাত দেখানো হয় যান্ত্রিক ও কারিগরি ত্রুটির। অথচ এই এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা হয়েছে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান এরিকসনের মাধ্যমে, যাদের ইকুইপমেন্টের মান নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
বিটিসিএলের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, স্থানীয়ভাবে গ্রাহক পর্যায়ে কল রেকর্ড বা বিল মুছে ফেলার ঘটনা তাঁদের প্রতিষ্ঠানে নতুন নয়। তবে পার্থক্য হচ্ছে, স্থানীয় এসব কল রেকর্ড মুছে ফেললে সরকারের ক্ষতি লাখের অঙ্ক ছাড়ায় না। কিন্তু আন্তর্জাতিক কল রেকর্ড মুছে দিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে শত শত কোটি টাকার।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য রফিকুল ইসলাম গত ৭ আগস্ট এই প্রতিবেদককে বলেন, মহাখালীর আইটিএক্স দুটিতে কারিগরি যে সমস্যা ছিল তার সমাধান হয়েছে।
কিন্তু বিটিসিএলের পরিচালক (আন্তর্জাতিক) শরীফুজ্জামান গতকাল জানান, এরিকসন ওই আইটিএক্স দুটির কারিগরি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক কল চুরির তদন্তে নেমে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত এক মাসে বিটিসিএলের কাছে তাদের ২৮টি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সব কটির তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। দুদক সুনির্দিষ্টভাবে এসব ক্যারিয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিতে বিটিসিএলকে গত ৩ জুলাই চিঠি দেয়। এই ক্যারিয়ারগুলো প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বাকি রেখে এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ৮ জুলাইয়ের মধ্যে এসব ক্যারিয়ারের আবেদনপত্র, চুক্তিপত্র, ব্যাংক গ্যারান্টি, কার্যাদেশ প্রদান, সার্কিট চালু, বিল প্রদান, বকেয়া ও তার পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত ব্যবস্থা ইত্যাদি তথ্য চেয়েছিল। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত দুটি ক্যারিয়ার সম্পর্কে কোনো তথ্য সরবরাহ করেনি বিটিসিএল। দুদক সূত্র জনায়, যে ২৬টি ক্যারিয়ার সম্পর্কে নথিপত্র পাঠানো হয়েছে, তা এখনো পরীক্ষা করা শুরু হয়নি। এসব নথি যদি অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ হয়, তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুটি ক্যারিয়ার সম্পর্কে কোনো তথ্য না পাঠানোর বিষয়ে বিটিসিএলের পরিচালক (আন্তর্জাতিক) শরীফুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদের পর এই দুই ক্যারিয়ার সম্পর্কেও তথ্য পাঠানো হবে। এসব তথ্য সংগ্রহ করতে সময় লাগছে। তাঁর দাবি, ২৬টি ক্যারিয়ার সম্পর্কে দুদককে সম্পূর্ণ তথ্যই দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিটিসিএলের কয়েকজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে জানান, দুদকের চিঠি পাওয়ার পরপরই এসব আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার সম্পর্কে বেশ কিছু ফাইল সরিয়ে ফেলার ঘটনা ঘটে। এর আগে ভিওআইপির অবৈধ কারবারে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন অপকর্মে অভিযুক্ত বিটিসিএলের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার তদারকিতে এ ঘটনা ঘটে। দুদককে যেসব তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে, তা আংশিক ও অসম্পূর্ণ।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এসব কর্মকর্তার ধারণা, বিটিসিএল বা আগের বিটিটিবির বিরুদ্ধে কখনো তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে অপকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন নজির নেই। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক কল চুরির তদন্তের বিষয়ে দুদকের বর্তমান উদ্যোগও মাঝপথে থেমে যাবে।
এর আগে বিটিসিএল এবং মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার কারণে আন্তর্জাতিক কলের চোরাকারবারিদের শনাক্ত ও কলের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণ নির্ণয়ে ব্যর্থ হয় বিটিআরসি কমিশনার এ টি এম মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি। বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাইদ খান গত ২২ নভেম্বর জাতীয় সংসদের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অভিযোগ করেন, ভিওআইপির অবৈধ কারবারিরা তাঁদের কম্পানিতেই রয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতাধর হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু করা যাচ্ছে না। তিনি নিজেও জীবনের হুমকির মুখে রয়েছেন। এই অভিযোগের পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটির প্রধান গত ৫ জুন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠনো এক চিঠিতে এই অসহযোগিতার কথা জানিয়ে দেন।
দুদকের অভিযোগগুলো : দুদকের উপপরিচালক এস এম সাহিদুর রহমান গত ৩ জুলাই আন্তর্জাতিক কল নিয়ে নানা দুর্নীতির অভিযোগ উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র/তথ্য সরবরাহের অনুরোধ জানিয়ে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি লেখেন। চিঠির স্মারক নম্বর ১৭৬৬০। এ চিঠির অনুলিপি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বিটিআরসির চেয়ারম্যানকেও পাঠানো হয়। দুদকের অভিযোগগুলো হচ্ছে, বিটিসিএলের বৈদেশিক টেলিযোগাযোগ অঞ্চলের আওতায় মহাখালী ও মগবাজারস্থ আইটিএঙ্গুলোর সিডিআর (কল ডিটেইল রেকর্ড) ডিভাইস অকার্যকর রেখে বৈদেশিক কলের ডাটা তাতে ধারণ না করা, সিডিআর অকার্যকর করার আগের সিডিআর গায়েব করা, বিটিসিএলের 'এসটিএম' এবং 'ই-১' অবৈধভাবে ব্যবহার করে ভিওআইপির মাধ্যমে কল টার্মিনেশন করে কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা, বৈদেশিক ক্যারিয়ার নিয়োগের ক্ষেত্রে ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে বিটিসিএল তথা রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষর, লোকাল এজেন্টের মাধ্যমে বৈদেশিক ক্যারিয়ার কর্তৃক বিটিসিএলের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এবং বৈদেশিক ক্যারিয়ারগুলোর কাছে শত শত কোটি টাকা বকেয়া থাকার পরও বিশেষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করা।
দুদকের চিঠিতে আরো বলা হয়, 'সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বিটিসিএলের নিম্নবর্ণিত ক্যারিয়ারসমূহের আবেদনপত্র, চুক্তিপত্র, ব্যাংক গ্যারান্টি, কার্যাদেশ প্রদান, সার্কিট চালু, বিল প্রদান, বকেয়া ও তার পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত ব্যবস্থা ইত্যাদি তথ্যসংবলিত নথিসমূহের সত্যায়িত ফটোকপি পাওয়া ও পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। অতএব, জরুরি ভিত্তিতে আগামী ৮ জুলাই ২০১২ তারিখের মধ্যে এসব রেকর্ডপত্র/তথ্যাদি দুদকে পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে অনুরোধ করা হলো।'
যে ২৮টি ক্যারিয়ার সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে দুদক : দুদক যে ২৮টি ক্যারিয়ার সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে সেগুলো হচ্ছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিস্টোকল সার্ভিসেস, স্কাই হাই, ফিউজন, আইএজিই ফোন ও এন টেল। যুক্তরাজ্যের অ্যাক্সেফ টেল, রাইয়ান টেল, সিম্পল টেল, জিডিএক্সসি, লাইকা টেল, মনি ইন্টারপ্রাইজ, টেলিলিংক ও ওয়েস্টার্ন নেটওয়ার্ক। সিঙ্গাপুরের ডিজি টেক, এইচএসি জাপান, আই পাওয়ার, এনটিএস গ্লোবাল, ওয়ান ওয়ার্ল্ড, শাইন ওয়ার্ল্ড ও বিডিএইউ। হংকংয়ের আইসিএম গ্রুপ। কানাডার মাই এরবা, ইকো ক্যারিয়ার, ইবসেস, প্রাইম টেল ও শ্যাম লিমিটেড। মালয়েশিয়ার দেশি ডিজিটাল এবং অস্ট্রেলিয়ার ওয়ার্ল্ডটেল প্রাইভেট লিমিটেড।
এর মধ্যে অ্যারিস্টোকল সার্ভিসেস ও স্কাই হাই, অ্যাক্সেফ টেল, রাইয়ান টেল ও সিম্পল টেল, সিঙ্গাপুরের ডিজি টেক, এইচএসি জাপান, আই পাওয়ার, এনটিএস গ্লোবাল, ওয়ান ওয়ার্ল্ড ও শাইন ওয়ার্ল্ড, মাই এরবা এবং আইসিএম গ্রুপের মোট ২৪৪ কোটি টাকা বাকি থাকায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বিটিসিএলের হিসাবে এই ১৩টি ক্যারিয়ারের কাছে ২৪৪ কোটি টাকা পাওনার বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ মাত্র ৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরের আই পাওয়ারের ৪৩ লাখ চার হাজার ৬৬৮ মার্কিন ডলারের বা ৩৫ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি যে ভুয়া তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। সোনালী ব্যাংকের বাড্ডা শাখা থেকে এই ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি ম্যানেজ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে বাড্ডা থানায় মামলা হয়েছে।
বাকি ১৫টি ক্যারিয়ারের মধ্যে মাত্র দুটির ৬৯ হাজার মার্কিন ডলারের বা ৫৬ লাখ ৯ হাজার ৭০০ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টির তথ্য বিটিসিএলের হিসাব শাখার নথিতে রয়েছে। অন্যদিকে এই ১৫ ক্যারিয়ারের কাছে বিটিসিএল বা সরকারের পাওনা রয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা।
No comments