রিপোর্টারের ডায়েরি- বলী খেলা একটি আফসোস এবং ...
২৫ এপ্রিল বুধবার ॥ চট্টগ্রাম যাব। উপলক্ষ জব্বারের বলী খেলা। এ খেলা নিয়ে খুব আগ্রহ আমার ছিল না। তবে জানতাম, শতাধিক বছরের পুরনো ঐতিহ্য এটি। চট্টগ্রামের শুধু নয়, বাঙালী সংস্কৃতির অংশ। জব্বারের বলী খেলা নিয়ে বছরে একবার দারুণ মেতে উঠে চট্টলা।
গোটা শহর উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়। হঠাৎ মনে হলো, যোগ দেয়া যাক উৎসবে। একবারটি দেখে ফেললে মন্দ কি! সৌখিনের প্রস্তাবে তাই রাজি হয়ে গেলাম। সৌখিন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করে। ওই সংস্থার পক্ষে বেশ আগেভাগেই আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিল। আয়োজনের আগের দিন ২৪ এপ্রিল বাসে করে রওনা হলাম আমরা। দলে যোগ দিল ভোরের কাগজের কিশোর কুমার এবং দীপন নন্দী ছিল যায়যায়দিন থেকে। অন্যান্য পত্রিকা থেকে ছিল কয়েকজন। তবে নিউজ লিখে ওই দিনই পাঠানোর বাধ্যবাধকতা ছিল একা আমার। নিজ থেকেই নিয়েছিলাম এ দায়িত্ব। সঙ্গত কারণেই টেনশনটা আমার সঙ্গী হলো। ওকে নিয়ে সকাল বেলায় চট্টগ্রাম পৌঁছালাম। হোটেলটা চমৎকার। ভাল বিশ্রাম হলো। বিকেলে রওনা হলাম লালদীঘি ময়দানের দিকে।
না, যত বিশালটি মনে করেছিলাম লালদীঘি অতটা না। মোটামুুটি আয়তন। এর এক কোণে বলী খেলার মঞ্চ। প্রচ- দাবদাহ উপেক্ষা করে আমরা মঞ্চের পেছনের ঢালে চেয়ার পেতে বসি। তবে বসা আর হয় না। একটু পর পর উঠে যাই। বলীদের সঙ্গে কথা বলি। নোট নেই। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর খেলা শুরু হয়। আমি মল্লযুদ্ধ দেখি আর মনে মনে রিপোর্ট সাজাই। মনে মনে কারণ, ল্যাপটপ সঙ্গে নেইনি। আশা ছিল অন্যরা নেবে। সে আশায় গুড়েবালি। তারাও নেয়নি। সৌখিনের একটা আছে বটে। তবে ব্যবহার করে মজা পাই না। নেট সমস্যা। সর্বোপরি জনকণ্ঠের চট্টগ্রাম অফিস শুনেছি খুব কাছে। প্রয়োজনে ওখানে গিয়ে লেখা যাবেÑএমনটি মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম। ঢাকা থেকে এ বিষয়ে কথাও হয়েছিল চট্টগ্রাম অফিসের সঙ্গে। তবে অফিসের কারও নাম্বার মোবাইলে সেভ করা হয়নি। ধারণা ছিল, উৎসবস্থলে গেলে কাউকে না কাউকে পেয়ে যাব। তখন বিস্তারিত আলাপ করা যাবে। কিন্তু তাঁদের কাউকে আমার পাওয়া হয় না। পরে ঢাকায় ফোন করে চট্টগ্রাম অফিসের একজনের নাম্বার নেই। তাঁকে (নামটা মনে করতে পারছি না) জানাই, আমি তাঁদের শহরে। ইভেন্টটি কাভার করছি। আমার কণ্ঠে উত্তেজনা। কিন্তু ওপর প্রান্তে সেরকম কিছু লক্ষ্য করিনি। তাই মোটামুটির মধ্যে কথা শেষ করে খেলায় মনোযোগ দেই আমি। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে আসে সময়। সফরসঙ্গী সবাইকে আমি দ্রুত বের হওয়ার তাগাদা দেই। আরও কিছুক্ষণ থাকার পক্ষে কেউ কেউ। কিন্তু আমার পীড়াপীড়িতে বের হতে বাধ্য হয়। সিদ্ধান্ত হয়, হোটেলে গিয়েই লিখব। কিন্তু সমস্যা বাধায় আমাদের গাড়ির ড্রাইভার। আমাদের সবাইকে বলী খেলার মাঠে ঢুকিয়ে দিয়ে সে লাপাত্তা। গাড়িসহ মঞ্চের কাছে কোথাও তাঁর নোঙর করার কথা। কিন্তু সেটি সে করেনি। ফোন করলেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলে, জ্যাম যে ...। অর্থাৎ প্রচুর ট্রাফিক জ্যাম। সে জ্যাম ঠেলে আসছে। কিন্তু আসা আর হয় না। অনুমান করি, অসৎ ড্রাইভার খ্যাপে নেমে গেছে। আসতে দেরি হবে। এদিকে আমাদের হোটেল যথেষ্ট দূরে। কখন সেখানে যাব? কখন লিখব? টেনশনে পড়ে যাই। এমন সময় চট্টগ্রাম অফিস থেকে ফোন। কেউ একজন জানতে চান, আমি অফিসে যাব কিনা। সেখানে লিখব কিনা। এমন ফোন আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আমি জানিয়ে দেইÑআসছি। সে অনুযায়ী একজনের কাছ থেকে লোকেশন জেনে রিকশা নেই। কিন্তু বহু সময় ঘোরার পর যেখানে গিয়ে পৌঁছি। সেখানে অন্য অনেক মিডিয়া হাউস আছে। প্রেস ক্লাবও। শুধু নেই জনকণ্ঠ অফিস। এ অবস্থায় প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে আবার লোকেশনটা জিজ্ঞেস করি। তিনি জানেন না। আর যিনি জানেন, খুব বোঝা যাচ্ছিল, তাঁর অত সময় নেই। এরপরও এক শব্দে কিছু একটা বলে আমাকে ধন্য করলেন। রিকশাওয়ালা তার দেয়া লোকেশনে পৌঁছতে উল্টো প্যাডেল মারে। কিন্তু একটু যেতে না যেতেই নতুন বিপত্তি। এবার আমাকে বহনকারী রিকশার একটি চাকা পাশের রিকশার চাকার সঙ্গে আটকে যায়। ব্যস, শুরু হয়ে যায় কার দোষ কার গুণÑ সে বিচার। এখনই রায় এখনই ফাঁসি অবস্থা। বিচ্ছিরি কা-। তবু থামতে চায় না কেউ। এক পর্যায়ে দু’জন রিকশা থেকে নেমে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। আমি সেসবের কিছু তবু দেখি না। ঘড়ি দেখি। ‘জনকণ্ঠ’ লেখা একটি সাইনবোর্ড খোঁজে বেড়ায় আমার চোখ। কারণ নিউজ লিখে পাঠানোর সময় শেষ হয়ে আসছে। বেশ কিছু সময় পর পেছনের গাড়ির ঘন ঘন হর্নে দুই ড্রাইভার খ্যান্ত দেয়। চলতে শুরু করে রিকশা। কিন্তু যে বির্ল্ডিংয়ের নিচে থামে সেখানে অন্য মিডিয়ার নাম লেখা সাইনবোর্ড। ‘জনকণ্ঠ’ বলে কিছু নেই। তার মানে, আবার ভুল! আর তাহলে হচ্ছে না রিপোর্ট পাঠানো! হতাশা আমাকে গ্রাস করে। এ অবস্থায় শেষ চেষ্টা হিসেবে একজনকে জিজ্ঞেস করি, এ বিল্ডিংয়ে জনকণ্ঠের কোন অফিস কি আছে? ডুবতে ডুবতে খড়কুটো ধরে বেঁচে যাওয়া যেন। ভদ্রলোক জানান, আছে। তার কথামতো উপরে ওঠি আমি। একটি দরজায় গাম দিয়ে লাগানো স্টিকার চোখে পড়ে। তাতে লেখাÑ জনকণ্ঠ। ওইটুকু দেখেই মুগ্ধ আমি। কাল বিলম্ব না করে ভেতরে ঢুকে পড়ি। প্রথমে যার সঙ্গে দেখা হয় তিনি ‘আমি কেউ না’ ধরনের। অন্য একজনকে দেখিয়ে দেন। সেই জন, অনুমান করি, ‘খুব কেউ’। আশ্বস্ত হই। হাত বাড়িয়ে দিই তাঁর দিকেÑআমি মোরসালিন। মোরসালিন মিজান। ঢাকা অফিস থেকে এসেছি। একটু কষ্ট দিতে হচ্ছে আপনাদের। নিউজটা এখানেই লিখব। উত্তরে তিনি জানান, তাঁর সঙ্গেই ফোনে কথা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। সুতরাং খুব গোড়া থেকে শুরু করার দরকার পড়ে না। দুই এক কথার পর মুখ খুলিÑ লেখাটা শুরু করে দেই। আছে না ব্যবস্থা? জবাবে তিনি বলেন, কম্পিউটারে কাজ হচ্ছে। শেষ হলে বসতে পারবেন। কিন্তু শেষ আর হয় না। এ অবস্থায় তাঁর সামনের চেয়ারে বসে থাকাই ছিল কাজ আমার। ওদিকে সূর্য নতুন করে উঠছে না। তাই সৌখিনকে ফোন করে বলি গাড়ি পাঠাতে। ওর ল্যাপটপটা যতটা সম্ভব ঠিক করে রাখতে বলি। সবই শোনেন হোস্ট সাংবাদিক। দেখছি আপনার জন্য কি করা যায়Ñএমন একটা ভাবভঙ্গি তাঁর চোখে মুখে। এরই এক পর্যায়ে ব্যুরো চিফ মোয়াজ্জেম হোসেন অফিসে ঢোকেন। তাঁর সঙ্গে আগে একাধিকবার কথা হয়েছে। দেখা হয় প্রথমবারের মতো। আলাদা কক্ষে বসেন তিনি। ওখানে গিয়ে আগের মতোই হাত বাড়িয়ে দিয়েÑআমি মোরসালিন। মোরসালিন মিজান ...। এরপর দু’একটা প্রাসঙ্গিক আলাপ। অফিস খুঁজে বের করার ঝক্কির কথা জানাই তাঁকে। বলি, সব মিডিয়ার বিশাল বিশাল সাইন বোর্ড। জনকণ্ঠের দেখলাম না যে! উত্তরে তিনি বলেন, সবাই চেনে তো, তাই আর ...। মজার যুক্তি। তবে আমি মজা পাই না। বরং লেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি। এক পর্যায়ে ব্যুরো চিফ নিশ্চিত হতে চান, লিখতে কতক্ষণ লাগবে আমার। বলি, মোটামুটির মধ্যে উঠিয়ে ফেলব। কয়েক মিনিট হলেই চলবে। দিব্যি দেয়ার পর অন্যদের উদ্দেশ্যে শব্দ করেন তিনি। এর পরপরই আমার জন্য ত্যাগ স্বীকারে রাজি হন অন্যরা। কম্পিউটারে বসি আমি। এখানেও মজার অভিজ্ঞতা। কোন রিপোর্টার নিজে কম্পোজ করবেÑ ব্যাপারটা জেনে রীতিমতো অবাক হন কেউ কেউ। একাধিকবার বোঝানোর চেষ্টা করেন, আমি মুখে বললে ও কম্পোজ করে যাবে। ও মানে কম্পোজার। আমি বোঝলাম, চট্টগ্রাম অফিসের রিপোর্টাররা বলে যান, কম্পোজ করেন কম্পোজার। ঢাকায় বসে এমনটি কল্পনা করা না গেলেও ওখানকার নিয়ম এই। যাক, আমি লেখা শুরু করি। ফিচার বলে কথা। একটু রস ভাব ইত্যাদির দরকার হয়। কিন্তু সে সময় নেই। দিব্যির কথা মাথায় রেখে বিরতিহীন লিখে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যে লেখা শেষ হয়। ব্যুরো চিফের সামনে ফের গিয়ে বসি। এবার প্রথমে যার সামনে বসেছিলাম (ফের বলতে হচ্ছে, নাম মনে নেই) সেই রিপোর্টারকে উদ্দেশ করে ব্যুরো চিফ বলেন, ওনার (আমার) লেখাটা এট এ গ্ল্যান্স দেখে দাও। কাজটা করার জন্য ঢাকা অফিস থেকে অনেকেই বেতন নেন। এরপরও চট্টগ্রাম অফিসের ব্যাকুলতা দেখে ভালই লাগে। তবে জানি না কী ভেবে তাঁর অধীনস্থ সাংবাদিক নির্দেশটি শেষতক পালন করেননি। পালন করলে আমার লেখাটি নিশ্চয়ই আরও সুন্দর হতো। আফসোস! সে আফসোস নিয়েই গাড়িতে ওঠি। হ্যাঁ, এর মধ্যে গাড়ি চলে এসেছে। এরই মধ্যে এক কাপ চা ধ্বংস করা হয়ে গেছে চট্টগ্রাম অফিসের। এ জন্য চট্টগ্রাম অফিসকে ধন্যবাদ।
মোরসালিন মিজান
No comments