আওয়ামী ভেকধারীই আওয়ামী লীগের ক্ষতি করছে সাবধান by মমতাজ লতিফ

দেশে দুই ধরনের ঘটনা হঠাৎ করেই ঘটে চলেছে। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায় দু’টির পেছনে উদ্দেশ্য আছে এবং সেজন্য ঘটনাগুলো পরিকল্পিত। একদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রথমবার শিক্ষকদের নেতৃত্বে ধর্মঘট বা পাঠদান কর্মসূচী বন্ধ করা হয়েছে যে কাজটি সচরাচর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা পেছানো বা টিউশন ফি না বাড়ানো অথবা জাতীয়


কোন অনাকাক্সিক্ষত বড় ঘটনার প্রতিবাদে সংঘটিত হতে দেখা গেছে। এবার দুই বা তিন বছর যেসব উপাচার্যদের মেনে নিয়ে সব শিক্ষকেরা চাকরি করছিলেন, সেই উপাচার্যদের পদত্যাগের দাবিতে সরকারের শেষ এক/দেড় বছরে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষকেরা ধর্মঘট শুরু করেছেন, একটি পরিচয়ে তাঁরা সবাই এক তাঁরা মহাজোট সরকারবিরোধী দলগুলোর যথা জামায়াত, জামায়াতের সৃষ্ট হিযবুত তাহ্্রীর বা জামায়াত মিত্র বিএনপির সমর্থক। এতে কোথাও কোথাও আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত এমন শিক্ষকও আছেন, যাঁদের দীর্ঘদিন মেনে নেবার পর ভিসির পদত্যাগ দাবি সন্দেহের উদ্রেক না করে পারে না।
অপরদিকে হঠাৎ করে বিভিন্ন পেশাজীবীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে সাংবাদিকেরা! আবার ছাত্রলীগ নামধারী দুই দলের মধ্যে মারামারি, সংঘর্ষ, এমন কি সংঘর্ষে এক ছাত্রের মৃত্যু হওয়া সরকারকে বিব্রত করার নামান্তর বলেই অনেকে সন্দেহ পোষণ করছেন। সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধ বা আওয়ামী লীগ বিরোধীদের দ্বারা মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের বিরোধিতা করা, মুক্তিযুদ্ধপন্থী মহাজোট সরকারকে অস্থিতিশীলতায় ফেলে তাদের দ্বারা গৃহীত উন্নয়ন কাজকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা খুবই স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে যায়। সম্ভবত এ কারণে সরকারের উন্নয়ন কাজে বাধাদানের লক্ষ্যে দ্বিতীয় কৌশলÑকাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ কারণে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নামধারী কিন্তু প্রকৃত পক্ষে যারা আওয়ামী লীগের খোন্দকার মোশতাক, তারা শোনা যাচ্ছে প্রচুর অর্থ ও সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে সরকারী দলপন্থীর বেশে সরকারী দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনে অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং সাংবাদিক নির্যাতন, নিজ দলের সঙ্গে সংঘর্ষ, নিজ দলের সদস্য বা ছাত্র হত্যা ইত্যাদি অপকর্ম করে সরকারী দলের ভাবমূর্তি ম্লান করার কাজটি সুসম্পন্ন করছে। সরকারও উত্তম পন্থা অবলম্বন করেছে, সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার ও তদন্ত করে বিচারে আসামিদের সোপর্দ করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই কনসালট্যান্সি করেন, তাঁরা সঠিক পরিমাণে ট্যাক্স দিয়ে ওই অর্থকে সাদা করেছেন কিনা, সেটি কিন্তু সরকার দেখতে পারে। দেশের বড় বড় কাজÑ সেতু, রাস্তাঘাট নির্মাণে গুণগত মানোন্নয়নে, যানজট নিরসনে, উন্নত স্বল্প ফুয়েলের যান তৈরিতে তাঁরা গবেষণা করছেন কিনা, তাও দেখা দরকার। যানজট নিরসনে একজন দরিদ্র সিএনজি চালকের উদ্ভাবন বা দেশীয় প্রযুক্তিতে ভাল মানের গাড়ির ইঞ্জিন অথবা গাড়ি তৈরি করে ধোলাইখাল অঞ্চলে অবস্থিত কারখানার কম শিক্ষিত যন্ত্রকৌশলবিদরা আমাদের জাতীয় উন্নয়নে যে অবদান রাখছে, তার সমান উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক প্রকৌশলীরা করেছেন বলে জনমানুষের জানা নেই। উচ্চ শিক্ষিত বিজ্ঞান বা মানবিক, সামাজিক, শিক্ষার শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক’দু’জন ‘হিমু’ বা ‘মিসির আলী’ বা ‘শুভ্র’ তৈরি করছেন কিনা, জানা নেই। তাঁরা যদি হুমায়ূন আহমেদের মানবিক, কৌতূহলী, ঔচিত্যবোধ সম্পন্ন এক দু’জন শিক্ষার্থীও তৈরি করেন, নিজেরাও মানবিক, সামাজিক দায়িত্বসম্পন্ন হন, তাহলেও বোধ হয় এই একুশ শতকে কারও নির্দেশে শিক্ষকের পক্ষে বেমানান বড় কোন কারণ ছাড়াই ধর্মঘটে শিক্ষার্থীদের জন্য নিষ্ফলা দিনগুলো উপহার দিতেন না এবং জাতীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতেন না।
সম্প্রতি বার এ্যাসোসিয়েশন নির্বাচনেও এই একই আওয়ামীবেশী আওয়ামী লীগের শত্রুদের মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় দেখে বোঝা যায় এদের একটি অংশ মহাজোট সরকার কর্তৃক গৃহীত যুদ্ধাপরাধী বিচারের মতো বিশাল ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের একটি কার্যক্রমকে বিন্দুমাত্র মূল্য দেয় না! নতুবা যারা রেজাউর রহমান, মতিন খসরুদের, তানিয়া আমীরকে ভোট দেয় তারাই এই প্যানেলের অন্যদের ভোট দেয় না, তা হবে কেন? প্যানেল বার বার পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কারণ যাই হোক যুদ্ধাপরাধী বিচারের সময় যুদ্ধাপরাধীদের মিত্রদের ভোট দিয়ে জেতানো কোনক্রমে কাক্সিক্ষত নয়। তাঁরা কি অবহিত নন যে, স্বাধীনতার ৪১ বছর পর ’৭১-এর মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার কাজ শুরু হয়েছে তাদের উপযুক্ত দ-ে দ-িত করতে ট্রাইব্যুনাল সমর্থ না হলে বিএনপি-জামায়াত, এসব অর্থ-বিত্তশালী যুদ্ধাপরাধী, তাদের গু-া-ক্যাডাররা মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের ওপর ’৭১-এর মতই চরম আঘাত হানবে! আইনজীবীদের মধ্যে এ বিচারের বিষয়টি কি জোরালোভাবে অনুভূত হয়নি? তাই যদি হয় তাহলে আইন শিক্ষার ফল এমন ঔচিত্যবোধ বিরোধিতার জন্ম দেয় কিভাবে?
এদিকে আবার গার্মেন্ট শিল্প অঞ্চল যখন মোটামুটি শান্ত, তখন ইউরোপীয় ক্রেতা ব্যবসায়ীর বড় একটি দল গার্মেন্ট শিল্পের অস্থিরতা নিয়ে মহাবিচলিত হয়ে এ দেশে চলে এসে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্বেগ জানিয়ে দু’দু’টি চিঠি দিয়ে ফেলল এবং এক আমিনুল নামের শ্রমিক নেতার মৃত্যু নিয়ে তদন্ত ও বিচার দাবি করল! গুজব আছে, ওই নেতাটির সঙ্গে জামায়াত কানেকশন ছিল, যাই থাকুক সব মৃত্যুর তদন্ত ও বিচার হতে হবে, তবে কোন দাবি কি উদ্দেশ্যে কখন করা হচ্ছে, তা বের করাও প্রয়োজন হবে। ইউরোপের মন্দা অবস্থার সময় এতগুলো বড় বড় ক্রেতা কি লাভের লক্ষ্যে এ দেশে এসেছে, তা শুধুমাত্র গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য দরদের কারণে বলে মনে হয় না। কেননা, এ সরকারই গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন দ্বিগুণেরও বেশি করেছে গত দু’বছর আগে। এই ক্রেতাদের অন্য কোন দেশ প্রভাবিত করেছে কিনা, তারও তদন্ত হওয়া দরকার। কারণ গত দু’বছর আগে বা কখনই এরা এ দেশে একত্রে আসেনি এবং প্রধানমন্ত্রীকে পত্র দেবার এমন কোন যৌক্তিক কারণ না থাকলেও তারা পত্র দিয়েছে। এটা ঠিক যে গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চলে ঘরভাড়া বেড়ে গেছে, খাদ্যমূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে গার্মেন্ট শ্রমিকেরা সমস্যায় পড়েছেন। এটি গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা-নেত্রী, মালিক ও সরকার মিলে সমাধান করবে।
এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারবিরোধীরা, জামায়াত, যুদ্ধাপরাধীরা, তাদের দেশী মিত্র বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বুকে ছুরি মারা খন্দকার মোশতাকবেশী ছদ্ম আওয়ামী লীগার, জঙ্গী হিযবুত তাহ্্রীর, খালেদা-তারেকপন্থী গণতন্ত্র নস্যাতকারী বিএনপির একটি গোষ্ঠী এবং বিদেশী একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশের উন্নয়নে কর্মরত মুক্তিযুদ্ধপন্থী মহাজোট সরকারকে একদিকে সংবিধান সম্মত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার প্রয়াসে ও গণতন্ত্র অনুশীলনের পথে বাধা দান করছে। অপরদিকে বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়নের পথেও অন্তরায় সৃষ্টি করছে। দেখেশুনে মনে হয় ১৯৭৪-এ বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে যেমন দেশী-বিদেশী শত্রুরা একজোট হয়েছিল, এখনও যেন তার কন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও দেশী-বিদেশী, স্বদলে, ভিন্ন দলে দেশীয়রা ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধপন্থী সব দলের যেমন ঐক্যবদ্ধ একটি জোটে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিতে হবে, তেমনি শত্রুকে শনাক্ত করে তাদের আগামী নির্বাচনে পরাজিত করার জন্য তৃণমূলে জেলায় উপজেলায় জনপ্রিয়, যোগ্য, সৎ ও দক্ষ প্রার্থীদের এখুনি বাছাই করতে হবে এবং স্থানীয় উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে সাথে রাখার জন্য বাংলাদেশ কনসার্টের মতো আরও কনসার্ট ও অন্য পন্থায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান প্রচার করতে হবে। বিএনপির মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসীদের গণতন্ত্র, নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস রেখে রাজনীতি চর্চা করতে আহ্বান জানাতে হবে।
পদ্মা সেতু, আমিনুলের নিহত হওয়া, গার্মেন্টে অস্থিরতার দোহাই যা এখন প্রকৃতপক্ষে তেমন নেই, মানবাধিকার পরিস্থিতি, বুয়েটসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ধর্মঘট, সাংবাদিক নির্যাতন, ছাত্রলীগ নামধারীদের সংঘর্ষ এইসব কিছুকে কেন যেন ’৭৪-’৭৫-এর অবস্থার দিকে টেনে নিয়ে যাবার প্রচেষ্টা বলে সন্দেহ হয়। সরকার, মুক্তিযুদ্ধপন্থী সব দল, সুশীল সমাজ, তরুণ প্রজন্ম, জনগণÑসবাইকে সতর্ক ও কৌশলী সময়োপযোগী ’৭১-এর মতো দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। সময়ের এক ফোঁড়টি দিতে হবে, দশ ফোঁড়ের সময় নেই, শত্রুরা অদূরে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক

No comments

Powered by Blogger.