ইতিউতি-যে দিনটি কখনোই ভোলা যায় না by আতাউস সামাদ

রমনা পার্কের পূর্ব পাশে তেমাথাটার দক্ষিণ দিকে পুরনো ধাঁচের যে সুন্দর বাংলোবাড়িটা আছে, সেটার কথা মার্চের ২৫ অথবা ২৬ তারিখে মনে পড়লে গা এখনো শিউরে ওঠে। একসময় বাড়িটা ছিল রাষ্ট্রীয় বিশেষ অতিথিশালা। পাকিস্তান জমানায় একবার এবং বাংলাদেশ আমলে আরেকবার ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এ বাড়িতে অতিথি হিসেবে থেকেছেন।


নয়া চীনের বিশ্বখ্যাত প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এখানে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। পাকিস্তানি সেনাশাসক সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এবং তাঁরই যে সুযোগ্য চেলা তাঁকে হটিয়ে তদানীন্তন পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছিল, সেই শয়তান এবং রক্তপিপাসু জেনারেল ইয়াহিয়া খানও প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঢাকায় এলে এ বাংলোয় উঠত।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ১৭ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত এ বাড়িতেই ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠক হয়েছিল, পাকিস্তানে সেনা শাসনের পরিবর্তে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের এবং শেখ মুজিব-প্রদত্ত আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে সংবিধান রচনার দাবি বাস্তবায়ন নিয়ে। জুলফিকার আলী ভুট্টো ও মুমতাজ দৌলতানার মতো কূটচরিত্রের পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতারাও পর্যায়ক্রমে ওই আলোচনায় অংশ নেন। ২৪ মার্চ ১৯৭১ এমন একটা খবরও ছড়িয়ে পড়ে যে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে একটা খসড়া চুক্তির কাঠামো নিয়ে ঐকমত্য হয়েছে। পরবর্তীকালে আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকেই জানা গেছে, কথা হয়েছিল যে ইয়াহিয়া খানের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল পীরজাদা ২৫ মার্চ সকালে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের চুক্তির খসড়া হস্তান্তর করবেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের দেওয়া সেই আশ্বাস ছিল একটা সাংঘাতিক ধাপ্পা। সেদিন তাঁরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। রমনার ওই রাষ্ট্রীয় বিশেষ অতিথিশালা বা প্রেসিডেন্টস রেস্ট হাউস থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁর দলবল নিয়ে চলে যান কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে। তারপর সেদিন দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা পিলখানায় ইপিআরের বাঙালি সৈনিক ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে অবস্থানরত পুলিশ সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সামরিক আক্রমণ শুরু করে। রক্তে ভেসে যায় ঢাকা শহর। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায়ও, বিশেষ করে সীমান্ত ফাঁড়িগুলোতে বাঙালি ইপিআর সদস্য ও পুলিশের ওপর তারা হামলা চালায়। চট্টগ্রামে শুরু হয় বাঙালিদের প্রতিরোধ। এভাবেই শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ ও নৃশংস গণহত্যার অভিযান আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ তাঁর নিজ দেশে ফিরে এলে রমনার ওই বিশেষ অতিথিশালাটি তিনি ব্যবহার করা শুরু করেন, জনগণ ও বিদেশ থেকে আসা অতিথিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। সেই সময়ই তিনি এর নামকরণ করেন 'গণভবন'। আমার মনে হয়, এই ঐতিহাসিক বাড়িটাকে আমাদের ইতিহাসের 'অঙ্গ' এবং 'ঐতিহ্যের নিদর্শন' হিসেবে সংরক্ষণ করা উচিত।
বিদেশি সাংবাদিকরাসহ আমরা রিপোর্টাররা যাঁরা মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের খবর সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত ছিলাম, তাঁরা সবাই সকাল ৯টা-১০টার মধ্যে রমনা পার্কের পাশে ওই বাড়ির রাস্তায় এসে জমা হতাম। দিনের আলোচনা শেষে শেখ মুজিবসহ তাঁর সহায়তাকারী আওয়ামী লীগের নেতারা সেখান থেকে বের হয়ে না আসা পর্যন্ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করতাম। তাঁরা চলে যাওয়ার সময় দু-চার কথা বলে যেতেন। সেই সময় আওয়ামী লীগের আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলনও চলছিল। ফলে পরিস্থিতি ছিল টান টান উত্তেজনায় ভরা। আর যাতায়াত করার জন্য বাহন পাওয়া ছিল মুশকিল। এর ওপর পুরো রমনা এলাকায় ছিল ইয়াহিয়া খানের জন্য মিলিটারি পাহারা। সব মিলিয়ে আমাদের কাজটা কঠিন ছিল। তবে হেয়ার রোডে সরকারি লোকজন দেখা যেত। কিন্তু ২৫ মার্চ ১৯৭১_দুপুর ১২টার দিকে রমনার রাষ্ট্রীয় অতিথিশালার কাছে যেতে যেতেই উপলব্ধি করি, এলাকাটি নীরব। ওই বাড়ির গেটে অন্য দিনের মতো গাদা গাদা সশস্ত্র সেনা প্রহরীও নেই। বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে অল্প কয়েকজন। হেঁটে ভয়ে ভয়ে তাদের কাছাকাছি গিয়ে জিজ্ঞেস করায় তারা বলল, সদর সাহেবসহ (ইয়াহিয়া খান) কেউই নেই ভেতরে। তারা জানি কোথায় গেছে। কিন্তু কোথায় যে গেছে সেই খবরটা কিছুতেই বলল না। এরপর দ্রুত পায়ে জাতীয় প্রেসক্লাব, পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল (বর্তমানে শেরাটন), যেখানে ভুট্টো ও অন্য পাকিস্তানি নেতারা থাকতেন_এসব জায়গায় ছোটাছুটি করতে লাগলাম। বিকেলের দিকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে গিয়ে জানলাম, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তাঁর দলবল সকালে যে হোটেল থেকে বেরিয়েছে তখন থেকে আর ফেরেনি। এর মধ্যেই তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার রিপোর্টার বন্ধুবর জোয়াদুর রহমান ছুটে এসে বললেন, ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে গেছেন। এতক্ষণ আমাদের মধ্যে ছিল কী হচ্ছে তা জানার জন্য আগ্রহ ও উত্তেজনা। এখন তা রূপ নিল শঙ্কায়। ইয়াহিয়া খান চলে গেছেন, ভুট্টো লাপাত্তা, তাহলে কি সব আলোচনা ভেস্তে গেল? ছুটলাম ধানমণ্ডি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির দিকে। সেখানে জনারণ্য। সন্ধ্যার খানিকক্ষণ পর আগরতলা মামলায় শেখ সাহেবের এক সামরিক সহ-অভিযুক্তের কাছ থেকে শুনলাম, পাকিস্তানি মিলিটারিরা 'ক্র্যাকডাউন' বা সামরিক হামলার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং তারা আজ রাতেই আক্রমণ শুরু করবে। অনেক চেষ্টা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দুটো কথা বলতে সমর্থ হলে তাঁর মুখেও একই আশঙ্কার কথা শুনলাম। তাঁদের ভয় এক অতি ভয়ংকর বাস্তবে রূপ নিল।
সে রাতে ধানমণ্ডির পুরনো ৩২ নম্বর সড়ক থেকে নয়াপল্টনে আমাদের নিজ বাড়িতে ফেরার সময় জায়গায় জায়গায় দেখলাম, উৎসাহী লোকজন রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করছেন পাকিস্তানি মিলিটারিদের বাধা দেওয়ার জন্য। তবে পাকিস্তানিদের ট্যাংক ও আর্মার্ড ক্যারিয়ার এসব ব্যারিকেড ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয় আর পাকিস্তানি সৈনিকদের বৃষ্টির মতো গুলির বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষ বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। তবে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাঙালি পুলিশরা অনেকক্ষণ যুদ্ধ করেছিলেন। পাকিস্তানিরা শেষ পর্যন্ত পুলিশ লাইনসের ব্যারাকগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমরা সেই রাত ও তারপর সারা দিন ধরে গুলি, শেল ও মর্টারের আওয়াজ শুনেছি এবং আগুনের লেলিহান শিখা দেখেছি।
২৫ মার্চ দিন এবং ২৬ মার্চ রাত ও দিনের সেইসব ভয়াল স্মৃতি এবং মানবেতিহাসের জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার কথা মনে পড়ে রমনার ঐতিহাসিক বাড়িটি দেখলে। ওদিক দিয়ে কিছুদিন আগেও প্রায়ই যাওয়া-আসা করতাম। এখনো যাই মাঝেমধ্যে। তবে ভয়ংকর ও জঘন্য ওইসব ঘটনার পাশাপাশি এতদসত্ত্বেও এও মনে পড়ে, বাংলাদেশের মানুষ অকুতোভয়ে সেদিনই প্রতিরোধ শুরু করেছিল এবং সেই রাত থেকেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা ও বাঙালি জাতি জয়ী হয়েছেন। এ কথা ভেবে গর্বে বুক ভরে যায়, আর শহীদদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসায় শির অবনত হয়, চোখ পানিতে ভরে আসে।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের স্মৃতি আমাদের মনে অমর হয়ে আছে এবং থাকবে। কিন্তু পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের শহীদদের খাঁটি সম্মান জানাতে চাই, তাহলে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং বিপদমুক্ত রাখার জন্য সততার সঙ্গে কঠিন পরিশ্রম করে যেতে হবে। বিদ্যার্জনে আন্তরিক হতে হবে, সাহসের সঙ্গে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার অবশ্য কর্তব্যে নিয়োজিত হতে হবে এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক নিরাপদ সমাজ গড়তে হবে। খুনি, ঠক, লুটেরা, মিথ্যাবাদী ও ভণ্ডদের সচেতনভাবেই এ কাজগুলো থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। আমাদের বাংলাদেশ সোনার মানুষদের দেশ হোক।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.