বাজেটে করারোপ

দুর্বল-দলনের সহজ পথে হাঁটা উচিত নয় ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে করের আওতা অনেক বাড়ানো হয়েছে। বাজেটে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। তাই বাজেটের ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপরই বেশি জোর দিয়েছে।


আর তা করতে গিয়ে সহজ পথটাই বেছে নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর-ফাঁকিবাজদের করের আওতায় আনার জোরদার প্রচেষ্টার বদলে তারা সাধারণ মানুষের ওপর নিত্যনতুন নানা ধরনের করের বোঝা চাপিয়ে চলেছে। মোবাইল ফোনের বিলের ওপর করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মুনাফা থেকে উৎসে কর কেটে নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। পণ্য ও সেবার ওপর করারোপ তো আছেই। অন্যদিকে এবারও বাজেটে সেই কর-ফাঁকিবাজদের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রয়েছে। এনবিআরের একশ্রেণীর অসৎ কর্মকর্তা-কমচারীর যোগসাজশে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহতই থেকে যাচ্ছে।
বাজেটের সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক হলো, করযোগ্য সর্বনিম্ন আয়সীমা। এক বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বাড়লেও সর্বনিম্ন করযোগ্য আয় এক লাখ ৮০ হাজার টাকাই রয়ে গেছে। এটি হলো দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। রাজধানী ও বড় শহরগুলোতে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট বা বাড়ির এমন অনেক মালিক রয়েছেন, যাঁরা আয়কর দেন না। এমন অনেক দোকানমালিক বা ব্যবসায়ী আছেন, যাঁদের মাসিক আয় এক লাখ টাকারও বেশি, অথচ তাঁরা কর দেন না। তাঁদের করের আওতায় আনার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয় না। অথচ বছরে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা আয় করেন যে চাকরিজীবী, তাঁকে আয়কর দিতেই হবে। কারণ তাঁর আয় অপ্রদর্শিত রাখার কোনো সুযোগ নেই। সেই চাকরিজীবীর মাসিক আয় কত? ১৫ হাজার টাকা। ঢাকায় যেনতেন একটি টিনশেড ঘর ভাড়া নিতে গেলেও যেখানে সাত-আট হাজার টাকার বেশি লাগে, সেখানে এই চাকরিজীবীর তো পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়েপরে বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর। সন্তানের লেখাপড়া, বিনোদনের কথা তাঁর পক্ষে ভাবাই সম্ভব নয়। তাঁকেও আয়কর দিতে হবে। এ বছর নূ্যনতম আয়করও দুই হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করা হয়েছে। অতএব, এই চাকরিজীবীকে তিন হাজার টাকাই আয়কর দিতে হবে। যে সরকার নিজেকে 'গরিববান্ধব' বলে দাবি করে, সেই সরকারের অর্থনীতি বিশারদরা এর পক্ষে কী যুক্তি দেবেন? শুধু করারোপের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই দুর্বলরাই বেশি মার খাচ্ছেন। বিদ্যুৎ চুরি ঠেকানো যায় না। আর সেই চুরির দায় মেটাতে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের মাথায় বোঝা চাপানো হচ্ছে। একই অবস্থা গ্যাস, পানি ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সেবার ক্ষেত্রেও। কাজেই দুর্বলের মাথায়ই বাড়তি বোঝা চাপানোর এই যে সহজ পথ, এটি পরিত্যাগ করা প্রয়োজন। আমরাও বৈদেশিক উৎসের মুখোমুখি হয়ে থাকার কিংবা পরনির্ভরশীল থাকার পক্ষে নই। আমরাও আমাদের উন্নয়ন ব্যয় নিজেরাই মেটাতে চাই। কিন্তু কর আদায়ের বর্তমান বৈষম্যমূলক নীতির আমরা বিরোধিতা করছি। এ জন্য আমাদের কর আদায় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী, উন্নত ও কার্যকর করার যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। বিত্তবানরা কর ফাঁকি দেবে, আর উপায়ান্তরহীন দুর্বলরা করের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হবে- এটা কারো কাম্য হতে পারে না। তাই আমরা প্রস্তাবিত বাজেটে করারোপের যে সিদ্ধান্তগুলো রয়েছে, সেগুলো পুনর্বিবেচনার দাবি করছি।

No comments

Powered by Blogger.