শ্রদ্ধাঞ্জলি-শুদ্ধতার সাধক by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
শিলালিপির ৩ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারে কিছুটা রসিকতা করে শিমুল সালাহ্উদ্দিনকে বলেছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, ‘১৮ শ্রাবণ আমার জন্ম হলো, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হলো ২২ শ্রাবণ। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত হয়ে মারা গেলেন যে এইবার আমি মারা যেতে পারি, একজন আসছে।’ রসিকতা বটেই,
এবং এতে স্বাক্ষর আছে তাঁর চিরাচরিত পরিহাসপ্রিয়তার। কিন্তু কিছুটা কি অহংকারও নেই এই উচ্চারণে—যে অহংকার গরিমা নয়, আত্মম্ভরিতাও নয়; বরং যে অহংকার নিজের কৃত্য নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষার, এবং রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতার উত্তরাধিকারে এক উজ্জ্বল অংশীদারির? এবং রবীন্দ্রনাথের মতোই, সাহিত্যের নানান ভূগোলে পথ কেটে কেটে যাওয়া পরিব্রাজনার?
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের সে রকম কোনো দীর্ঘ পরিশ্রমলব্ধ গবেষণাগ্রন্থ নেই, যে রকম আছে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে, অথবা মানিক বন্দোপাধ্যায় অথবা নজরুল ইসলামকে নিয়ে, কিন্তু রবীন্দ্রসাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে তাঁর রবীন্দ্রনাথ (২০০১) বইটি মান্নান সৈয়দকে জানার জন্য দরকারি। এ গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথকে তাঁর ‘গল্পে উপন্যাসে নাটকে প্রবন্ধে কাব্যনাট্যে’ তিনি দেখেছেন ‘অবিরলভাবে পারম্পর্যহীন’ কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও বলেছেন, ‘কিন্তু তাঁর তাবৎ পারম্পর্যহীনতাকে ধরে আছে এক পরম্পরা। তা মানুষ প্রকৃতি বিশ্বস্রষ্টাকে একটি তাৎপর্যে অন্বিত করার পরম্পরা’ (নয়) মান্নান সৈয়দের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং নাটক পড়ে আমারও মনে হয়েছে, তাঁর লেখাতেও আছে এ রকম এক আপাত-পারম্পর্যহীনতা এবং ‘মানুষ প্রকৃতি আর বিশ্বস্রষ্টাকে একটি তাৎপর্যে অন্বিত করার’ পরম্পরা। ১৯৬৭ সালে বেরুল তাঁর জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ, পরাবাস্তবের পশ্চিমা জমিতে যা নিয়ে এল বাংলার রহস্যময় রাত্রি আর কুয়াশা, জ্যোৎস্না আর নিমগ্নতার আভাস। অথচ এক বছর পর প্রকাশিত তাঁর সত্যের মতো বদমাশ গল্পগ্রন্থে প্রতিফলিত হলো তাঁর চারদিকের পরিত্রাণহীন বাস্তবতা অথবা মনোবাস্তবতা। পরম্পরা কোথায় এ দুই কাজে? অথবা আরও চার বছর পর যে তিনি লিখলেন শুদ্ধতম কবি, জীবনানন্দ দাশের ওপর প্রায় সেমিনাল একটি গ্রন্থ, তার সঙ্গে আগের দুটি গ্রন্থের পরম্পরাটাই বা কোথায়? পরম্পরার পরিবর্তে সৃষ্টিশীলতার দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছুটে যাওয়া, নতুন নতুন নির্মাণে মননের পড়ে থাকা জমি ভরে তোলা—এই তো তাঁর সৃষ্টির আপাত লক্ষণ। কবিতাতেই তাঁর কত পালাবদল, যদিও পরাবাস্তবের একটা সূক্ষ্ম সুর তিনি বরাবরই বাজিয়ে গেছেন; প্রকাশ্যে-আড়ালে কবিতার রোমান্টিক চেতনার স্ফুরণ হতে দিয়েছেন। কিন্তু মাতাল সেরেনাদ আর মাছ সিরিজ কি সমগোত্রীয়? তাদের দ্যোতনা কি অভিন্ন? জীবনের পথে হাঁটতে হাঁটতেও তিনি হঠাৎ বাঁক ফিরেছেন। হঠাৎ ষাট পার হয়ে নাটকে অভিনয় করেছেন। বিচিত্র পোশাক পরেছেন। কিন্তু তাঁর লেখালেখির বা জীবনের আপাত-পারম্পর্যহীনতার পেছনে যে মানুষ, প্রকৃতি আর বিশ্বস্রষ্টার একটি নিকষিত রূপ অন্বেষণ এক পরম্পরার জোগান দিয়েছিল, তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। কোন মানুষ আছে তাঁর সাহিত্যজুড়ে? এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না, হয়তো অনেক কথায় যায়—অনিকেত আধুনিক মানুষ, অস্থির রোমান্টিক মানুষ, মাতাল, প্রেমিক অথবা পরিব্রাজক অথবা স্বপ্নে পাওয়া মানুষ। তাঁর নিজের মতো, ভিড়ের মধ্যে একা মানুষ। কোন প্রকৃতি ছিল তাঁর দ্রষ্টব্য? কোন প্রকৃতিকে তিনি হাত বাড়িয়ে ধরেছেন? সে কি জীবনানন্দীয় বাংলার, নাকি নগরের গোলধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া বিপন্ন প্রকৃতি? নাকি প্রকৃতির ভেতরে-বাইরে আকীর্ণ এক অতিপ্রকৃতি? এবং কোন বিশ্বস্রষ্টাকে? রবীন্দ্রনাথের মতো কোনো একান্ত জীবনদেবতা? প্রথা এবং চর্চার ঈশ্বর? নাকি সব প্রশংসা তাঁর—এর কিছুটা রোমান্টিক, কিছুটা রহস্যময় স্রষ্টা? পরম্পরার এই জায়গাটাতে এসে কিছুটা বিতর্ক তাঁকে ঘিরে ধরেছে। কিন্তু বিতর্কে যাননি তাঁরা যাঁরা মান্নান সৈয়দকে পড়ে আসছেন সেই জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ থেকে। ওই গ্রন্থেই লুকিয়ে আছে তাঁর নানা মাত্রায় ছড়িয়ে থাকা জীবনের রহস্যগুলোকে জানা।
পরম্পরার একটি সূত্র—প্রকৃতি—তাঁকে নিয়ে গেছে জীবনানন্দের কাছে। জীবনানন্দকে তিনি দেখেছেন শুদ্ধতম কবি হিসেবে, কিন্তু শুদ্ধতম কবির কোথাও তিনি শুদ্ধতার কোনো সংজ্ঞা দেননি। শুদ্ধতম কোন অর্থে? জীবনানন্দের ছন্দ কি সর্বত্র শুদ্ধ? সনেটের গঠন, স্তবকে স্তবকে কবিতার প্রবাহ, সবই কি শুদ্ধ? নাকি এই শুদ্ধতা তাঁর অনুভূতির, বোধের; জীবনের রহস্যগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে সেগুলোকে পড়ার এক অকৃতিম আবেগের? আমার মনে হয়েছে, এই শেষোক্ত চিন্তাটি শুদ্ধতার আর সব চিন্তা থেকে গভীরতর ছিল। জীবনানন্দে এসে যে বাংলা কবিতা এক অসামান্য রূপ অর্জন করল, এই রূপই তো শুদ্ধতার।
জন্মাদ্ধ কবিতাগুচ্ছ-এ জীবনানন্দ আছেন, কিন্তু জীবনানন্দের বাংলা? একটা রূপান্তর ঘটেছে এর কবিতাগুলোতে। যে পরাবাস্তবের একটা চাঁদর মান্নান সৈয়দ বিছিয়ে দেন পরিচিত দৃশ্যাবলির ওপর, সেটি তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। কিন্তু এরও পরম্পরা আছে এবং সেটি জীবনানন্দ হয়ে আছে রবীন্দ্রনাথে। রূপান্তর, কিন্তু বিষয়ান্তর নয়।
আবদুল মান্নান সৈয়দও সন্ধান করেছেন শুদ্ধতার। কবিতায়, গল্পে এবং মননশীল সাহিতচর্চায়। তাঁর কবিতা একই সঙ্গে অনুভূতির এবং চিন্তার; তাঁর গল্প আলোড়নের, সংক্ষুব্ধতার এবং সংবেদের, তাঁর প্রবন্ধ খাঁটি মেধা ও মননের। আর জীবনে তিনি শুদ্ধতার চর্চা করেছেন স্পষ্টবাদিতার, মাঝে মাঝে দুর্মুখতায়; এবং নিজের বিশ্বাসকে নিজের ভেতরে রেখে তা নিয়ে অনর্থক কথা অপচয়ের সংকল্পে।
শুদ্ধতার এই সাধকের প্রতি শ্রদ্ধা।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের সে রকম কোনো দীর্ঘ পরিশ্রমলব্ধ গবেষণাগ্রন্থ নেই, যে রকম আছে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে, অথবা মানিক বন্দোপাধ্যায় অথবা নজরুল ইসলামকে নিয়ে, কিন্তু রবীন্দ্রসাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে তাঁর রবীন্দ্রনাথ (২০০১) বইটি মান্নান সৈয়দকে জানার জন্য দরকারি। এ গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথকে তাঁর ‘গল্পে উপন্যাসে নাটকে প্রবন্ধে কাব্যনাট্যে’ তিনি দেখেছেন ‘অবিরলভাবে পারম্পর্যহীন’ কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও বলেছেন, ‘কিন্তু তাঁর তাবৎ পারম্পর্যহীনতাকে ধরে আছে এক পরম্পরা। তা মানুষ প্রকৃতি বিশ্বস্রষ্টাকে একটি তাৎপর্যে অন্বিত করার পরম্পরা’ (নয়) মান্নান সৈয়দের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং নাটক পড়ে আমারও মনে হয়েছে, তাঁর লেখাতেও আছে এ রকম এক আপাত-পারম্পর্যহীনতা এবং ‘মানুষ প্রকৃতি আর বিশ্বস্রষ্টাকে একটি তাৎপর্যে অন্বিত করার’ পরম্পরা। ১৯৬৭ সালে বেরুল তাঁর জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ, পরাবাস্তবের পশ্চিমা জমিতে যা নিয়ে এল বাংলার রহস্যময় রাত্রি আর কুয়াশা, জ্যোৎস্না আর নিমগ্নতার আভাস। অথচ এক বছর পর প্রকাশিত তাঁর সত্যের মতো বদমাশ গল্পগ্রন্থে প্রতিফলিত হলো তাঁর চারদিকের পরিত্রাণহীন বাস্তবতা অথবা মনোবাস্তবতা। পরম্পরা কোথায় এ দুই কাজে? অথবা আরও চার বছর পর যে তিনি লিখলেন শুদ্ধতম কবি, জীবনানন্দ দাশের ওপর প্রায় সেমিনাল একটি গ্রন্থ, তার সঙ্গে আগের দুটি গ্রন্থের পরম্পরাটাই বা কোথায়? পরম্পরার পরিবর্তে সৃষ্টিশীলতার দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছুটে যাওয়া, নতুন নতুন নির্মাণে মননের পড়ে থাকা জমি ভরে তোলা—এই তো তাঁর সৃষ্টির আপাত লক্ষণ। কবিতাতেই তাঁর কত পালাবদল, যদিও পরাবাস্তবের একটা সূক্ষ্ম সুর তিনি বরাবরই বাজিয়ে গেছেন; প্রকাশ্যে-আড়ালে কবিতার রোমান্টিক চেতনার স্ফুরণ হতে দিয়েছেন। কিন্তু মাতাল সেরেনাদ আর মাছ সিরিজ কি সমগোত্রীয়? তাদের দ্যোতনা কি অভিন্ন? জীবনের পথে হাঁটতে হাঁটতেও তিনি হঠাৎ বাঁক ফিরেছেন। হঠাৎ ষাট পার হয়ে নাটকে অভিনয় করেছেন। বিচিত্র পোশাক পরেছেন। কিন্তু তাঁর লেখালেখির বা জীবনের আপাত-পারম্পর্যহীনতার পেছনে যে মানুষ, প্রকৃতি আর বিশ্বস্রষ্টার একটি নিকষিত রূপ অন্বেষণ এক পরম্পরার জোগান দিয়েছিল, তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। কোন মানুষ আছে তাঁর সাহিত্যজুড়ে? এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না, হয়তো অনেক কথায় যায়—অনিকেত আধুনিক মানুষ, অস্থির রোমান্টিক মানুষ, মাতাল, প্রেমিক অথবা পরিব্রাজক অথবা স্বপ্নে পাওয়া মানুষ। তাঁর নিজের মতো, ভিড়ের মধ্যে একা মানুষ। কোন প্রকৃতি ছিল তাঁর দ্রষ্টব্য? কোন প্রকৃতিকে তিনি হাত বাড়িয়ে ধরেছেন? সে কি জীবনানন্দীয় বাংলার, নাকি নগরের গোলধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া বিপন্ন প্রকৃতি? নাকি প্রকৃতির ভেতরে-বাইরে আকীর্ণ এক অতিপ্রকৃতি? এবং কোন বিশ্বস্রষ্টাকে? রবীন্দ্রনাথের মতো কোনো একান্ত জীবনদেবতা? প্রথা এবং চর্চার ঈশ্বর? নাকি সব প্রশংসা তাঁর—এর কিছুটা রোমান্টিক, কিছুটা রহস্যময় স্রষ্টা? পরম্পরার এই জায়গাটাতে এসে কিছুটা বিতর্ক তাঁকে ঘিরে ধরেছে। কিন্তু বিতর্কে যাননি তাঁরা যাঁরা মান্নান সৈয়দকে পড়ে আসছেন সেই জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ থেকে। ওই গ্রন্থেই লুকিয়ে আছে তাঁর নানা মাত্রায় ছড়িয়ে থাকা জীবনের রহস্যগুলোকে জানা।
পরম্পরার একটি সূত্র—প্রকৃতি—তাঁকে নিয়ে গেছে জীবনানন্দের কাছে। জীবনানন্দকে তিনি দেখেছেন শুদ্ধতম কবি হিসেবে, কিন্তু শুদ্ধতম কবির কোথাও তিনি শুদ্ধতার কোনো সংজ্ঞা দেননি। শুদ্ধতম কোন অর্থে? জীবনানন্দের ছন্দ কি সর্বত্র শুদ্ধ? সনেটের গঠন, স্তবকে স্তবকে কবিতার প্রবাহ, সবই কি শুদ্ধ? নাকি এই শুদ্ধতা তাঁর অনুভূতির, বোধের; জীবনের রহস্যগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে সেগুলোকে পড়ার এক অকৃতিম আবেগের? আমার মনে হয়েছে, এই শেষোক্ত চিন্তাটি শুদ্ধতার আর সব চিন্তা থেকে গভীরতর ছিল। জীবনানন্দে এসে যে বাংলা কবিতা এক অসামান্য রূপ অর্জন করল, এই রূপই তো শুদ্ধতার।
জন্মাদ্ধ কবিতাগুচ্ছ-এ জীবনানন্দ আছেন, কিন্তু জীবনানন্দের বাংলা? একটা রূপান্তর ঘটেছে এর কবিতাগুলোতে। যে পরাবাস্তবের একটা চাঁদর মান্নান সৈয়দ বিছিয়ে দেন পরিচিত দৃশ্যাবলির ওপর, সেটি তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। কিন্তু এরও পরম্পরা আছে এবং সেটি জীবনানন্দ হয়ে আছে রবীন্দ্রনাথে। রূপান্তর, কিন্তু বিষয়ান্তর নয়।
আবদুল মান্নান সৈয়দও সন্ধান করেছেন শুদ্ধতার। কবিতায়, গল্পে এবং মননশীল সাহিতচর্চায়। তাঁর কবিতা একই সঙ্গে অনুভূতির এবং চিন্তার; তাঁর গল্প আলোড়নের, সংক্ষুব্ধতার এবং সংবেদের, তাঁর প্রবন্ধ খাঁটি মেধা ও মননের। আর জীবনে তিনি শুদ্ধতার চর্চা করেছেন স্পষ্টবাদিতার, মাঝে মাঝে দুর্মুখতায়; এবং নিজের বিশ্বাসকে নিজের ভেতরে রেখে তা নিয়ে অনর্থক কথা অপচয়ের সংকল্পে।
শুদ্ধতার এই সাধকের প্রতি শ্রদ্ধা।
No comments