মিয়ানমার-সেনাশাসনের নতুন সংস্করণের দিকে যাত্রা by আহসান হাবীব

আগামী ৭ নভেম্বর মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সামরিক জান্তা। দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনকে বেসামরিক শাসনের মুখোশের আড়ালে সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়ার পথ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।


বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারে ১৯৬২ সাল থেকে কোনো না কোনোভাবে সেনাশাসন চলছে। জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে তখন বেসামরিক সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। বর্তমান জান্তা ক্ষমতাসীন হয় ১৯৮৮ সালে। এ জান্তার অধীনে ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু জান্তা সেই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে দেয়।
দীর্ঘদিনের অচলাবস্থার পর মিয়ানমারে রাজনৈতিক পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। তা যে পুরোপুরি জান্তানিয়ন্ত্রিত পথেই হবে, তাতে সন্দেহ নেই। জান্তা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, নির্বাচনের পর বেসামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা হবে। কিন্তু নির্বাচনের পর কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে মিয়ানমার সরে আসবে তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এ বছর প্রণীত নতুন সংবিধান অনুযায়ী গঠিত হয়েছে শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদ, যা নিয়ন্ত্রণ করবেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করার ক্ষমতা এ পরিষদের আছে। আসলে নতুন সংবিধানের মাধ্যমে পর্দার আড়াল থেকে সেনাবাহিনী সরকারে তার ভূমিকা চিরস্থায়ী করার বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য নির্ধারিত। নির্বাচন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য জান্তা ইতিমধ্যে বিরোধী দলগুলোর ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ১০ মার্চ জান্তা নতুন আইন পাস করেছে, যাতে সু চি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না পান। নির্বাচনী আইন পক্ষপাতিত্বমূলক ও নিয়ন্ত্রণপ্রবণ দাবি করে তাঁর দল নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়। এ কারণে গত মে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে দলটি বিলুপ্ত করে দেয় সরকার।
সেনা কর্মকর্তারা চান, তাঁদের হাতে গড়া পছন্দসই দল ক্ষমতায় আসুক, যাতে তাঁরা আড়ালে থেকে তাঁদের প্রভাব অব্যাহত রাখতে পারেন। জান্তা সরকারের কয়েকজন সদস্য ইতিমধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর পদ ত্যাগ করেছেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবেই তাঁরা নিজেদের বেসামরিক ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করে জান্তা-সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিতে (ইউএসডিপি) সক্রিয় হচ্ছেন।
তা ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে দেশের সশস্ত্র জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে মিয়ানমার সরকার চীন ও থাইল্যান্ড সীমান্তে গত মার্চে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। মিয়ানমারের জনসংখ্যার প্রধান অংশ বামার (প্রায় ৬৮ শতাংশ) ছাড়াও প্রায় ১৩০টি জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সেখানে বাস করে। ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের ছয় দশক পরও পুরো ভূখণ্ডের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বেশ কয়েকটি জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৯ সাল থেকে জেনারেল খিন নিয়ুন্ট সশস্ত্র সংগ্রামরত বেশির ভাগ জাতিগোষ্ঠীকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করাতে সক্ষম হন। তবু বেশ কিছু গোষ্ঠী এখনো প্রতিরোধ জারি রেখেছে। জাতিগত সংখ্যালঘু অঞ্চলগুলো মানবিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে। মাদক পাচার, এইচআইভির বিস্তার, অস্ত্র পাচার এবং উদ্বাস্তু সমস্যা চীন, ভারত, থাইল্যান্ডসহ পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
এ অবস্থায় মিয়ানমারে দ্রুত সত্যিকারের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমন পরিবর্তন সহজও নয়। দেশের ভেতরে বিরোধী শক্তিগুলোর নেতা-কর্মীদের ওপর দমননীতি চালানোর ফলে সংগঠিত বিরোধী শক্তি নেই বললেই চলে। আর অর্থনীতির নাজুক অবস্থার কারণে জনগণের প্রতিদিনের সংগ্রাম যেখানে বেঁচে থাকার পথ খোঁজা, সেখানে বড় ধরনের রাজনৈতিক উত্থানের চিন্তা এই মুহূর্তে কঠিন।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বছরের পর বছর ধরে অস্ত্র ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি রেখে জান্তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলা যায়নি। পূর্ব-এশীয় দেশগুলো চেষ্টা করেছে রাজনৈতিকভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত হতে। নিষেধাজ্ঞা যেমন কাজে আসেনি, সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টাও ফলদায়ক হয়নি। আসিয়ানের গঠনমূলক সম্পর্ক রক্ষার নীতির পেছনে যুক্তি দেখানো হয়, অর্থনৈতিক উন্নতি আরও গণতন্ত্র নিয়ে আসবে—এর সামান্যতম ইতিবাচক ফল এখনো দেখা যায়নি। একই যুক্তিতে ১৯৯৭ সালের মে মাসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক আসিয়ানে মিয়ানমারের যোগ দেওয়ার পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ফরাসি বহুজাতিক কোম্পানি টোটাল এখন মিয়ানমারে সামরিক জান্তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। এখানেও মানবাধিকার পরিস্থিতির বিবেচনার ওপরে স্থান পেয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থ।
মিয়ানমারে শাসনপদ্ধতি সংস্কারের জন্য সবচেয়ে কার্যকর চাপ প্রয়োগ করার সামর্থ্য রয়েছে চীন ও ভারতের। মিয়ানমারের রাজনীতিতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে সবচেয়ে বড় বৈদেশিক প্রভাবসম্পন্ন দেশ হলো চীন। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ১৯৮৮ সালের বিক্ষোভে প্রায় তিন হাজার মানুষ মারা যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের দূরত্ব বেড়ে যায়। এর পর মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব ক্রমাগত বেড়েছে। মিয়ানমার তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসসমৃদ্ধ। চীনের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এগুলোর প্রয়োজন। এ জন্য সামরিক সরকারের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন। অন্যদিকে, চীনের নিজের স্বার্থেও মিয়ানমারে এক ধরনের স্থিতিশীলতা দরকার, মিয়ানমার রাষ্ট্র পুরোপুরি ভেঙে পড়লে তাতে চীনেরও বড় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি, বিপুলসংখ্যক চীনা নাগরিক দেশটিতে আসছে, বসতি স্থাপন করছে। মিয়ানমারে সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশও চীন। বিনিয়োগ ও নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নে তাই খুব বেশি অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক দমন-পীড়ন দেখতে চায় না চীন। তাই আসলে এক ধরনের ভারসাম্যতা বজায় রেখে চলছে—গণতন্ত্রের পক্ষে চীনের দিক থেকে কোনো চাপ নেই, তবে তারা খুব বেশি দমন-পীড়নেরও বিরোধী।
মিয়ানমারের প্রশ্নে ভারতের নীতিতে সাম্প্রতিককালে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৮৮ সালে যখন মিয়ানমার বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, তখন ভারতীয় সরকারের অনেকে গণতন্ত্রকামী আন্দোলনের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৯৮০-এর দশক ও ১৯৯০-এর দশকের প্রথম ভাগে মিয়ানমার বিষয়ে ভারত জাতিসংঘে বেশ কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। মিয়ানমারের নির্বাসিত রাজনৈতিক কর্মীদের আশ্রয়ও দিয়েছিল। কিন্তু গত এক দশকে ভারতের অবস্থান পুরো বিপরীতমুখী হয়ে পড়েছে। ২০০৭ সালে জান্তাবিরোধী ‘গেরুয়া বিপ্লব’-এর সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হলেও ভারত নীরব থাকে। বর্তমানে ভারত মিয়ানমারের কাছ থেকে নানা সম্পদ কিনছে, সামরিক জান্তাকে রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, এমনকি মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে। রাজনৈতিক বিরোধ ছাড়াও ভারত চীনকে প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। চীন দুনিয়াব্যাপী একের পর এক তেল-গ্যাসবিষয়ক চুক্তি বাগিয়ে নিচ্ছে, তাই ভারতও প্রবলভাবে মিয়ানমারের পেট্রোলিয়াম সম্পদ পেতে চায়।
মিয়ানমারের শাসকেরা আশ্বস্ত বোধ করতে পারেন, পশ্চিমা বা এশীয় দেশগুলো অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞামূলক পদক্ষেপ নিলেও চীন বা ভারতের সহযোগিতার দুয়ার তাদের জন্য খোলা। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য মিয়ানমারের জান্তার ওপর চাপ দিতে চীন ও ভারতের ওপর বাদবাকি দুনিয়ার চাপ অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
সেনাবাহিনীর ভয় ছিল, সু চি এখনো অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষত গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষের তাঁর প্রতি জোরালো সমর্থন আছে। অবশ্য শহরের অনেকে মনে করেন, সু চি-সমর্থিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নিলে তাঁদের অবস্থার আরও উন্নতি হতো। সু চির আপসহীন অবস্থানের সমালোচনাও করেন অনেকে। গণতন্ত্রকামী শিবিরের অবস্থাও ভালো নয়। নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে অনেক কঠিন শর্তাবলি পূরণ করতে হয়, যার অন্যতম হলো প্রার্থীপ্রতি ৫০০ ডলার ফি জমা দেওয়া। এ অর্থ দেশটির বেশির ভাগ মানুষের ছয়/সাত মাসের আয়েরও অধিক। প্রধান দুটি গণতন্ত্রকামী দল জানিয়েছে, নানা অন্তরায় পেরিয়ে তারা যত প্রার্থী দাঁড় করাতে পেরেছে, তা সরকার সমর্থক প্রধান দুই দলের এক-দশমাংশ। তবু আগামী নির্বাচন সেনাবাহিনী কতটা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে। ১৯৯০-এর মতো অবাধ নির্বাচন সরকার সমর্থকদের জয়ের নিশ্চয়তা দেয় না। বিরোধী শিবিরের প্রতি আন্তরিক সমর্থন হয়তো জনগণের নেই, কিন্তু সেনাবাহিনী ও সেনানিয়ন্ত্রিত বেসামরিক সংগঠনকে তো মাঝেমধ্যে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করেছে জনগণ।
নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসছে তত দমন-পীড়ন বাড়তে থাকলেও বিরোধীদলীয় অনেক রাজনীতিক মনে করেন, দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য ভালো সুযোগ তৈরি হয়েছে এই নির্বাচনে। এই নির্বাচন পুরোপুরি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বা পক্ষপাতহীন হওয়া সম্ভব না হলেও আশা করা যায় তা সামরিক বাহিনীর কিছু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাবে। মিয়ানমারের শাসনের যেকোনো ধরনের বেসামরিকীকরণই তাঁদের কাছে ইতিবাচক। নতুন নেতৃত্ব হয়তো সত্যিকারের উন্নয়নের প্রতি অধিকতর উৎসাহী হবে এবং বর্তমান সেনাশাসকদের চেয়ে কম গোপনীয়তাপ্রিয় হবে।
নির্বাচন সামনে রেখে মিয়ানমারের সরকার জনগণের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও জোরালো করছে। গেরুয়া বিপ্লবের পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে সত্যি, বহু রাজনৈতিক বন্দীর আটকাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সামরিক জান্তা প্রতিবেশীদের ওপর নজরদারির এক ব্যবস্থা চালু করেছে, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বাধ্য করা হয় প্রতিবেশীদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে। সামনের নির্বাচন কোনো ধরনের বিপত্তি ছাড়াই সম্পন্ন করা এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকা মানবাধিকার আন্দোলন দমনের এটাও এক পথ। পাঁচ কোটি ৮০ লাখ জনসংখ্যার দেশটির জনগণকে আতঙ্কে রাখার এই কৌশল আপাতত কাজ দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আতঙ্কের এই পরিবেশে বহু মানুষ নীরব থাকছে। কিন্তু সব সময় তো আর মানুষকে দমন করে রাখা যায় না। আতঙ্কের পরিবেশেও মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী কর্মীরা হাল ছেড়ে না দেওয়ার প্রত্যয় দেখাচ্ছেন।
আহসান হাবীব: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.