অরণ্যে রোদন-জনতার মন কি পড়তে পারেন তাঁরা? by আনিসুল হক
আমি যে শহরে বসে এই লেখাটা লিখছি, আইওয়া সিটি, এটা যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া প্রদেশের একটা ছোট্ট শহর। বাঙালি পাঠকের কাছে শহরটা অপরিচিত নয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ছবির দেশে, কবিতার দেশে বইয়ে এই শহরের আর তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আছে।
আরেকটা বই আছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের, সুদূর ঝর্নার জলে, এই শহরে তিনি যে বহু বছর আগে এসেছিলেন, তরুণ লেখক হিসেবে, তার প্রেক্ষাপটে লেখা। মার্গারিট নামের এক ফরাসি তরুণীর সঙ্গে ওই লেখকের বন্ধুত্ব হয়েছিল, পরে মেয়েটি নিখোঁজ হয়, আর তাকে কোনো দিনও পাওয়া যায়নি। শঙ্খ ঘোষের বই আছে ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম—এই শহরে লেখালেখির কর্মসূচিতে তাঁর আগমন আর বিভিন্ন দেশের লেখকদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা ও আলোকচিত্র নিয়ে। বাংলাদেশ থেকে হুমায়ূন আহমেদ এসেছিলেন এই কর্মসূিচতে, তাঁর মে ফ্লাওয়ার বইটা কি এই বিষয় নিয়ে? আমাদের দেশ থেকে লেখক মঞ্জু সরকার, কবি মুহাম্মদ রফিক আর রুবি রহমানও এর আগের বছরগুলোয় এই মাস তিনেকের আবাসিক কর্মশালায় অংশ নিয়ে দেশে ফিরে গেছেন। কবি মোহাম্মদ রফিকের এ বিষয়ের বইটার নাম দূরের দেশ নয় আয়ওয়া।
প্রথম দিনে যখন প্রায় ৩২টা দেশের ৩৬ জন লেখক নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলেন, তখন আমি সুনীল আর মার্গারিটের কথা পাড়লাম। এখন যাঁরা ওই দপ্তরের কর্মকর্তা, তাঁরা মার্গারিটের কাহিনিটা জানেন না, সত্যি এমন কিছু ঘটেছিল নাকি? তাঁরা মুখটাকে শোকার্ত করে ভুরুটা ওপরে তোলেন। সুনীল অনেক বছর আগে এসেছিলেন, কর্মসূচিটা অব্যাহত আছে, ৪৩ বছর ধরে হচ্ছে, লোক বদলে যায়, ফলে অতীতের সাক্ষী কাউকে পাওয়া যায় না। কিন্তু সুনীলের বইয়ে পড়া সেই আইওয়া নদীটা আছে। আমি যে হোটেলে উঠেছি, আইওয়া হাউস হোটেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই, তার জানালার ঠিক নিচেই নদীটা, দুটো সেতুর নিচ দিয়ে কলকল করে বয়ে যাচ্ছে।
নদী দেখতে কার না ভালো লাগে।
আমাদের অবশ্য মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা কপোতাক্ষ নদ-এর কথাই বেশি করে মনে পড়বে।
আইওয়া স্টেটের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা খুব মিল আছে। ইন্টারনেটে গুগলে ‘আইওয়া’ আর ‘বাংলাদেশ’ দিলেই মিলটার কথা অনেকবার পাওয়া যাবে। সাদৃশ্যটা হলো, আইওয়া রাজ্য আর বাংলাদেশের আয়তন প্রায় সমান, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। আরেকটা মিল আছে, ২০০৬ সালে এই শহরে টর্নেডো আঘাত হেনেছিল আর ২০০৮ সালে হয়েছিল বিরাট বন্যা। সেই বন্যার পানির দাগ এখনো লেগে আছে শহরের গায়।
আর অমিলটা?
বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি আর পুরো আইওয়া রাজ্যের জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। এই যে আইওয়া সিটিতে বসে আছি, এটা আসলে একটা বিশ্ববিদ্যালয় শহর, লোকসংখ্যা ৬৮ হাজার, এর মধ্যে অনেকেই ছাত্র।
এ কারণেই, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন আইওয়ায় এসেছিলেন, নিউইয়র্ক থেকে কবি অ্যালেন গিনসবার্গ তাঁকে ডাক পাঠিয়েছিলেন, সুনীল, তুমি কলকাতার ছেলে, ওই গণ্ডগ্রামে পড়ে থাকবে কী করে, নিউইয়র্ক চলে এসো।
আমি বসে বসে এই বৈপরীত্যের কথা ভাবি। একটা দেশে কত সম্পদ আর মানুষ কত কম। বাস চলছে, বাসে লোক নেই। বড় বড় শপিং মল, লোক কই। অন্যদিকে, দেশ থেকে সারাক্ষণ ফোনে আর ই-মেইলে খবর পাচ্ছি, আমাদের শপিং মলগুলোর সামনে বিশাল জট লেগে গেছে। হাটবাজারে শুধু মানুষ আর মানুষ। প্রথম আলোর ইন্টারনেট সংস্করণে ছবি দেখলাম, ঢাকার রাস্তা যানজটে স্থবির হয়ে গেছে। আরেকটা ছবি দেখলাম, সেটাও খুব মজার, সব পুরোনো বাস রং করা হচ্ছে, এগুলো সব ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হবে।
ঢাকার জনসংখ্যা আসলে কত, আমি জানি না। তবে শুধু ঢাকা থেকেই প্রায় এক কোটি মানুষ পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়বে। তাহলে কত গাড়ি, ঘোড়া, ট্রেন, বাস, স্টিমার লঞ্চ দরকার হবে? যতগুলো গাড়ি বের হবে, সবগুলোকে ধারণ করার মতো রাস্তাঘাট কি আমাদের আছে? অবশ্যই নেই। তার পরিণতি হবে অবশ্যম্ভাবী যানজট। একসময় সব স্থবির হয়ে পড়বে। কালিয়াকৈর, চন্দ্রা থেকে শুরু করে টাঙ্গাইল পর্যন্ত মহাসড়ক একসময় হয়ে পড়বে ছবির মতো নিশ্চল। ওদিকে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ থেকে শুরু করে মিরেরসরাই যানজট লাগবে অমোচনীয় রকমের। তবু ভালো, সরকার মহাসড়কে এক মাইল পরপর পুলিশ আর কমিউনিটি পুলিশ মোতায়েন করেছে যানজটের অবসানে একটা শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য। কিন্তু একটা গাড়ি কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যদি একপাশের লেইন বন্ধ করে দেয়, তার প্রতিক্রিয়া পড়ে মাইলের পর মাইল।
আমাদের যত গাড়ি আছে, তত রাস্তা কি আছে ঢাকা শহরে? আশার কথা, সরকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করার কথা ভাবছে। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ মানুষের যোগাযোগের জন্য আসলে একটা সমন্বিত গণপরিবহন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া দরকার। ঢাকার বাইরে গার্মেন্টস কারখানাগুলোকে সরিয়ে নেওয়া, যেখানে-সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ গড়তে না দেওয়া আর ঢাকার বাইরের শহরগুলোকে শিক্ষার শহর, চিকিৎসার শহর, শিল্পনগর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া দরকার। তারপর আমাদের বহু কিছু দরকার হবে—আকাশরেল, পাতালরেল, চক্র সড়ক, নৌপরিবহন আর দরকার হবে অনেক উড়াল সেতু। বড় বড় সেতু না বানিয়ে হয়তো মোড়গুলোতে ছোট ছোট সেতুর কথা ভাবা যায়।
অন্যদিকে আমাদের বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসমস্যার সমাধানের জন্যও পদক্ষেপ নিতে হবে জরুরিভাবে। আমেরিকায় এখন নির্বাচনের মৌসুম, সামনে আছে মধ্যবর্তী নির্বাচন। তার আগে পরিচালিত বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে, রিপাবলিকানরা ১০ শতাংশ ভোটে এগিয়ে আছে জরিপে, যেটা বহু দশক পরে ঘটল। জনমত জরিপে একটা দল আরেকটা দলের এতটা পেছনে নাকি সাম্প্রতিককালে আর কখনো পড়েনি। প্রেসিডেন্ট ওবামাও জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের কাছে হেরে যাবে, এটাই হচ্ছে ভবিষ্যদ্বাণী।
পরিবর্তনের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছিলেন ওবামা। পরিবর্তন কথাটা বলা সোজা, করা কঠিন। বাংলাদেশেও দিনবদলের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছে শেখ হাসিনার সরকার। তার জনপ্রিয়তার পারদের কী অবস্থা?
সম্প্রতি ডেইলি স্টার-নেলসেন জরিপে দেখা যাচ্ছে, সরকারের জনপ্রিয়তা কমছে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার পারদও নিম্নমুখী। যদিও এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে এখনো আওয়ামী লীগই জয়লাভ করবে বলে ওই জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে। তবু ওই জরিপ বলছে, এই সরকারের ১০০ দিনের মাথায় সরকারের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট ছিলেন যেখানে ৬২ শতাংশ মানুষ, এক বছরের মাথায় এসে তা দাঁড়ায় ৫৩ শতাংশে, দেড় বছরের মাথায় সেটা আরও কমেছে, সেই অঙ্কটা এখন ৪৯। অন্যদিকে বিএনপি আর বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাও এরই মধ্যে খানিকটা বেড়েছে।
বলছিলাম, আমাদের জনসংখ্যা বেশি, খুবই বেশি, অন্যদিকে সম্পদ খুব কম। আমরা চাইলেই আমাদের সব রাস্তাঘাট বহুতল করতে পারব না, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান রাতারাতি করতে পারব না, কিন্তু এ বিষয়ে আমরা আন্তরিক আর সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষটাকে দায়িত্ব দিচ্ছি, আমরা কাজ করছি, তার প্রমাণ তো রাখতে হবে। আমি মনে করি, আমাদের গণযোগাযোগব্যবস্থা হওয়া উচিত নৌপরিবহন আর রেলপথকেন্দ্রিক, সড়কপথ-নির্ভরতার ঊর্ধ্বে আমাদের উঠতেই হবে। আর এসব ক্ষেত্রে আমরা দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছি না, তার প্রমাণও রাখতে হবে।
বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, দ্রব্যমূল্য, যোগাযোগব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, আইনশৃঙ্খলা একটা সরকারের জনপ্রিয়তার নির্ধারক। এসবই কষ্টসাপেক্ষ, কখনো কখনো সময়সাপেক্ষ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসবের বাস্তবায়নে দরকার হয় আর্থিক সংস্থান। কিন্তু কতগুলো বিষয় আছে, যার সঙ্গে টাকা-পয়সার সম্পর্ক নেই, দরকার নেই বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বা কারিগরি অভিজ্ঞতা, কিন্তু যার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আছে জনিপ্রয়তার। বাংলাদেশের মানুষ ক্ষমতার দর্প একেবারেই পছন্দ করে না। আর ডা. ইকবালের মিছিল থেকে গুলির মামলা থেকে ডা. ইকবাল আর বর্তমান এমপি নুরুন্নবী চৌধুরীকে অব্যাহতি দেওয়া না-দেওয়ার সঙ্গে বাজেটের কোনো সম্পর্ক নেই, যেমন নুরুন্নবী চৌধুরীর পিস্তলের গুলিতে খুনের ঘটনায় কাকে আসামি করা হবে, কাকে করা হবে না, তা নির্ধারণের জন্য রকেট সায়েন্স দরকার হয় না, কোটি কোটি ডলারও লাগে না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তগুলো জনগণ খুবই সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে। তেমনি সাংসদের বেতন থেকে আইকর কাটা হবে না বা তাঁরা দুই কোটি টাকার গাড়ি ৫০ লাখ টাকায় আনবেন—এসব খবরও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। আমরা চাইলেই আমাদের উপকূলকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ ফুট উঁচু বানাতে পারব না, কিন্তু সরকার চাইলেই সাংসদের গাড়ির সর্বোচ্চ মূল্য ২০ লাখ টাকায় সীমিত করে দিতে পারে। এসব ছোটখাটো বিষয় থেকে অনেক বড় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় জনমনে।
বাংলাদেশ একটা ঐতিহাসিক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে শুরু করে সামরিক আইনকে বেআইনি ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমরা জাতি হিসেবে আমাদের কলঙ্কচিহ্নগুলো মুছে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। কিন্তু এর সবই ভেস্তে যাবে, যদি সরকার সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয়। মানুষ নিরাপত্তা চায়, নিজের জীবনের নিরাপত্তা, মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য চায় চলায়-বলায়, শিক্ষায়-দীক্ষায় কর্মক্ষেত্রে, মানুষ কাজ চায়, দুটো ডাল-ভাত খেয়ে নিজ গৃহে শান্তিতে ঘুমোতে চায়, ঈশ্বরী পাটুনির মতো তার চাওয়া—আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে। সেই দুধ-ভাতে যদি উৎপাত দেখা দেয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেও জনপ্রিয়তা হ্রাসের সুনামি থেকে নিজেকে রক্ষা করা যাবে না। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনায় বেশ সাফল্যই দেখিয়েছিল, কিন্তু তারা যা করতে ব্যর্থ হয়েছিল তা হলো, তাদের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্থানে স্থানে তৈরি হয়েছিল গডফাদার। তার পরিণতি কী হয়েছিল, ২০০১-এর নির্বাচনের ফলই তা বলে দেবে। আজকে সারা দেশে ছাত্রলীগ যা করছে, তা জনমনে নানা শঙ্কা আর নিরাপত্তাহীনতার বোধই কেবল তৈরি করছে। অন্যদিকে আমরা যখন বলছি গণতন্ত্রকে স্থায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কথা, অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখলের পথ চিরতরে রুদ্ধ করার কথা, তখন যেন এটাও মনে রাখি, গণতন্ত্র মানে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, গণতন্ত্র মানে বিরোধী দলকেও কথা বলতে দেওয়া, বিরোধী দলের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানো। এই প্রসঙ্গে ডেইলি স্টার-নেলসেন জরিপের একটা রায়ও বিরোধী দলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, দেশের মানুষ প্রায় একযোগে চায় বিরোধী দল সংসদে যোগ দিক। অন্যদিকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের এও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সংবাদপত্রবিহীন সরকার আর সরকারবিহীন সংবাদপত্র—এই দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে হলে ১৭৮৭ সালে টমাস জেফারসন কোনো দ্বিধা ছাড়াই সরকারছাড়া সংবাদপত্রকে বেছে নিতেন। সংবাদমাধ্যমকে কোনোভাবে বল্গা পরানোর দুরভিসন্ধি যেন সরকারের মাথায় এক মুহূর্তের জন্য না আসে।
আইওয়া সিটিতে অল্প কজনই বাঙালি আছে। কর্ণটকি সংগীতের সাধক বাংলাদেশি মেঘনা আমিনের বাসায় আমরা কজন সমবেত হয়েছিলাম শনিবার রাতে। বাংলাদেশ থেকে সদ্য আসা ইংরেজি ভাষার লেখিকা শবনম নাদিয়া গান ধরলেন—‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে। জানি নে তোর ধনরতন, আছে কিনা রানীর মতোন, শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে।’
আমার মা, আমার বাংলাদেশ ধনরত্নে রানি নয় আমরা জানি, কিন্তু এই দেশে জন্মেছি, এই আলোতেই নয়ন রেখে নয়ন মুদতে আমরা চাই। আমাদের দেশটাকে চিরদিন ভিখারিনী সাজে দেখতেও কি ভালো লাগে? আমাদের নেতাদের চৈতন্য যেন সদা-উদীত থাকে। আসন্ন ঈদ সবার ভালো থাকুক, হাজার মাইল দূর থেকে সেই শুভেচ্ছা জানাই।
আইওয়া সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
anisulhoque1971@gmail.com
প্রথম দিনে যখন প্রায় ৩২টা দেশের ৩৬ জন লেখক নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলেন, তখন আমি সুনীল আর মার্গারিটের কথা পাড়লাম। এখন যাঁরা ওই দপ্তরের কর্মকর্তা, তাঁরা মার্গারিটের কাহিনিটা জানেন না, সত্যি এমন কিছু ঘটেছিল নাকি? তাঁরা মুখটাকে শোকার্ত করে ভুরুটা ওপরে তোলেন। সুনীল অনেক বছর আগে এসেছিলেন, কর্মসূচিটা অব্যাহত আছে, ৪৩ বছর ধরে হচ্ছে, লোক বদলে যায়, ফলে অতীতের সাক্ষী কাউকে পাওয়া যায় না। কিন্তু সুনীলের বইয়ে পড়া সেই আইওয়া নদীটা আছে। আমি যে হোটেলে উঠেছি, আইওয়া হাউস হোটেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই, তার জানালার ঠিক নিচেই নদীটা, দুটো সেতুর নিচ দিয়ে কলকল করে বয়ে যাচ্ছে।
নদী দেখতে কার না ভালো লাগে।
আমাদের অবশ্য মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা কপোতাক্ষ নদ-এর কথাই বেশি করে মনে পড়বে।
আইওয়া স্টেটের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা খুব মিল আছে। ইন্টারনেটে গুগলে ‘আইওয়া’ আর ‘বাংলাদেশ’ দিলেই মিলটার কথা অনেকবার পাওয়া যাবে। সাদৃশ্যটা হলো, আইওয়া রাজ্য আর বাংলাদেশের আয়তন প্রায় সমান, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। আরেকটা মিল আছে, ২০০৬ সালে এই শহরে টর্নেডো আঘাত হেনেছিল আর ২০০৮ সালে হয়েছিল বিরাট বন্যা। সেই বন্যার পানির দাগ এখনো লেগে আছে শহরের গায়।
আর অমিলটা?
বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি আর পুরো আইওয়া রাজ্যের জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। এই যে আইওয়া সিটিতে বসে আছি, এটা আসলে একটা বিশ্ববিদ্যালয় শহর, লোকসংখ্যা ৬৮ হাজার, এর মধ্যে অনেকেই ছাত্র।
এ কারণেই, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন আইওয়ায় এসেছিলেন, নিউইয়র্ক থেকে কবি অ্যালেন গিনসবার্গ তাঁকে ডাক পাঠিয়েছিলেন, সুনীল, তুমি কলকাতার ছেলে, ওই গণ্ডগ্রামে পড়ে থাকবে কী করে, নিউইয়র্ক চলে এসো।
আমি বসে বসে এই বৈপরীত্যের কথা ভাবি। একটা দেশে কত সম্পদ আর মানুষ কত কম। বাস চলছে, বাসে লোক নেই। বড় বড় শপিং মল, লোক কই। অন্যদিকে, দেশ থেকে সারাক্ষণ ফোনে আর ই-মেইলে খবর পাচ্ছি, আমাদের শপিং মলগুলোর সামনে বিশাল জট লেগে গেছে। হাটবাজারে শুধু মানুষ আর মানুষ। প্রথম আলোর ইন্টারনেট সংস্করণে ছবি দেখলাম, ঢাকার রাস্তা যানজটে স্থবির হয়ে গেছে। আরেকটা ছবি দেখলাম, সেটাও খুব মজার, সব পুরোনো বাস রং করা হচ্ছে, এগুলো সব ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হবে।
ঢাকার জনসংখ্যা আসলে কত, আমি জানি না। তবে শুধু ঢাকা থেকেই প্রায় এক কোটি মানুষ পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়বে। তাহলে কত গাড়ি, ঘোড়া, ট্রেন, বাস, স্টিমার লঞ্চ দরকার হবে? যতগুলো গাড়ি বের হবে, সবগুলোকে ধারণ করার মতো রাস্তাঘাট কি আমাদের আছে? অবশ্যই নেই। তার পরিণতি হবে অবশ্যম্ভাবী যানজট। একসময় সব স্থবির হয়ে পড়বে। কালিয়াকৈর, চন্দ্রা থেকে শুরু করে টাঙ্গাইল পর্যন্ত মহাসড়ক একসময় হয়ে পড়বে ছবির মতো নিশ্চল। ওদিকে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ থেকে শুরু করে মিরেরসরাই যানজট লাগবে অমোচনীয় রকমের। তবু ভালো, সরকার মহাসড়কে এক মাইল পরপর পুলিশ আর কমিউনিটি পুলিশ মোতায়েন করেছে যানজটের অবসানে একটা শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য। কিন্তু একটা গাড়ি কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যদি একপাশের লেইন বন্ধ করে দেয়, তার প্রতিক্রিয়া পড়ে মাইলের পর মাইল।
আমাদের যত গাড়ি আছে, তত রাস্তা কি আছে ঢাকা শহরে? আশার কথা, সরকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করার কথা ভাবছে। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ মানুষের যোগাযোগের জন্য আসলে একটা সমন্বিত গণপরিবহন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া দরকার। ঢাকার বাইরে গার্মেন্টস কারখানাগুলোকে সরিয়ে নেওয়া, যেখানে-সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ গড়তে না দেওয়া আর ঢাকার বাইরের শহরগুলোকে শিক্ষার শহর, চিকিৎসার শহর, শিল্পনগর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া দরকার। তারপর আমাদের বহু কিছু দরকার হবে—আকাশরেল, পাতালরেল, চক্র সড়ক, নৌপরিবহন আর দরকার হবে অনেক উড়াল সেতু। বড় বড় সেতু না বানিয়ে হয়তো মোড়গুলোতে ছোট ছোট সেতুর কথা ভাবা যায়।
অন্যদিকে আমাদের বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসমস্যার সমাধানের জন্যও পদক্ষেপ নিতে হবে জরুরিভাবে। আমেরিকায় এখন নির্বাচনের মৌসুম, সামনে আছে মধ্যবর্তী নির্বাচন। তার আগে পরিচালিত বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে, রিপাবলিকানরা ১০ শতাংশ ভোটে এগিয়ে আছে জরিপে, যেটা বহু দশক পরে ঘটল। জনমত জরিপে একটা দল আরেকটা দলের এতটা পেছনে নাকি সাম্প্রতিককালে আর কখনো পড়েনি। প্রেসিডেন্ট ওবামাও জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের কাছে হেরে যাবে, এটাই হচ্ছে ভবিষ্যদ্বাণী।
পরিবর্তনের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছিলেন ওবামা। পরিবর্তন কথাটা বলা সোজা, করা কঠিন। বাংলাদেশেও দিনবদলের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছে শেখ হাসিনার সরকার। তার জনপ্রিয়তার পারদের কী অবস্থা?
সম্প্রতি ডেইলি স্টার-নেলসেন জরিপে দেখা যাচ্ছে, সরকারের জনপ্রিয়তা কমছে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার পারদও নিম্নমুখী। যদিও এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে এখনো আওয়ামী লীগই জয়লাভ করবে বলে ওই জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে। তবু ওই জরিপ বলছে, এই সরকারের ১০০ দিনের মাথায় সরকারের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট ছিলেন যেখানে ৬২ শতাংশ মানুষ, এক বছরের মাথায় এসে তা দাঁড়ায় ৫৩ শতাংশে, দেড় বছরের মাথায় সেটা আরও কমেছে, সেই অঙ্কটা এখন ৪৯। অন্যদিকে বিএনপি আর বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাও এরই মধ্যে খানিকটা বেড়েছে।
বলছিলাম, আমাদের জনসংখ্যা বেশি, খুবই বেশি, অন্যদিকে সম্পদ খুব কম। আমরা চাইলেই আমাদের সব রাস্তাঘাট বহুতল করতে পারব না, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান রাতারাতি করতে পারব না, কিন্তু এ বিষয়ে আমরা আন্তরিক আর সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষটাকে দায়িত্ব দিচ্ছি, আমরা কাজ করছি, তার প্রমাণ তো রাখতে হবে। আমি মনে করি, আমাদের গণযোগাযোগব্যবস্থা হওয়া উচিত নৌপরিবহন আর রেলপথকেন্দ্রিক, সড়কপথ-নির্ভরতার ঊর্ধ্বে আমাদের উঠতেই হবে। আর এসব ক্ষেত্রে আমরা দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছি না, তার প্রমাণও রাখতে হবে।
বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, দ্রব্যমূল্য, যোগাযোগব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, আইনশৃঙ্খলা একটা সরকারের জনপ্রিয়তার নির্ধারক। এসবই কষ্টসাপেক্ষ, কখনো কখনো সময়সাপেক্ষ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসবের বাস্তবায়নে দরকার হয় আর্থিক সংস্থান। কিন্তু কতগুলো বিষয় আছে, যার সঙ্গে টাকা-পয়সার সম্পর্ক নেই, দরকার নেই বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বা কারিগরি অভিজ্ঞতা, কিন্তু যার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আছে জনিপ্রয়তার। বাংলাদেশের মানুষ ক্ষমতার দর্প একেবারেই পছন্দ করে না। আর ডা. ইকবালের মিছিল থেকে গুলির মামলা থেকে ডা. ইকবাল আর বর্তমান এমপি নুরুন্নবী চৌধুরীকে অব্যাহতি দেওয়া না-দেওয়ার সঙ্গে বাজেটের কোনো সম্পর্ক নেই, যেমন নুরুন্নবী চৌধুরীর পিস্তলের গুলিতে খুনের ঘটনায় কাকে আসামি করা হবে, কাকে করা হবে না, তা নির্ধারণের জন্য রকেট সায়েন্স দরকার হয় না, কোটি কোটি ডলারও লাগে না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তগুলো জনগণ খুবই সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে। তেমনি সাংসদের বেতন থেকে আইকর কাটা হবে না বা তাঁরা দুই কোটি টাকার গাড়ি ৫০ লাখ টাকায় আনবেন—এসব খবরও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। আমরা চাইলেই আমাদের উপকূলকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ ফুট উঁচু বানাতে পারব না, কিন্তু সরকার চাইলেই সাংসদের গাড়ির সর্বোচ্চ মূল্য ২০ লাখ টাকায় সীমিত করে দিতে পারে। এসব ছোটখাটো বিষয় থেকে অনেক বড় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় জনমনে।
বাংলাদেশ একটা ঐতিহাসিক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে শুরু করে সামরিক আইনকে বেআইনি ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমরা জাতি হিসেবে আমাদের কলঙ্কচিহ্নগুলো মুছে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। কিন্তু এর সবই ভেস্তে যাবে, যদি সরকার সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয়। মানুষ নিরাপত্তা চায়, নিজের জীবনের নিরাপত্তা, মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য চায় চলায়-বলায়, শিক্ষায়-দীক্ষায় কর্মক্ষেত্রে, মানুষ কাজ চায়, দুটো ডাল-ভাত খেয়ে নিজ গৃহে শান্তিতে ঘুমোতে চায়, ঈশ্বরী পাটুনির মতো তার চাওয়া—আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে। সেই দুধ-ভাতে যদি উৎপাত দেখা দেয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেও জনপ্রিয়তা হ্রাসের সুনামি থেকে নিজেকে রক্ষা করা যাবে না। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনায় বেশ সাফল্যই দেখিয়েছিল, কিন্তু তারা যা করতে ব্যর্থ হয়েছিল তা হলো, তাদের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্থানে স্থানে তৈরি হয়েছিল গডফাদার। তার পরিণতি কী হয়েছিল, ২০০১-এর নির্বাচনের ফলই তা বলে দেবে। আজকে সারা দেশে ছাত্রলীগ যা করছে, তা জনমনে নানা শঙ্কা আর নিরাপত্তাহীনতার বোধই কেবল তৈরি করছে। অন্যদিকে আমরা যখন বলছি গণতন্ত্রকে স্থায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কথা, অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখলের পথ চিরতরে রুদ্ধ করার কথা, তখন যেন এটাও মনে রাখি, গণতন্ত্র মানে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, গণতন্ত্র মানে বিরোধী দলকেও কথা বলতে দেওয়া, বিরোধী দলের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানো। এই প্রসঙ্গে ডেইলি স্টার-নেলসেন জরিপের একটা রায়ও বিরোধী দলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, দেশের মানুষ প্রায় একযোগে চায় বিরোধী দল সংসদে যোগ দিক। অন্যদিকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের এও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সংবাদপত্রবিহীন সরকার আর সরকারবিহীন সংবাদপত্র—এই দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে হলে ১৭৮৭ সালে টমাস জেফারসন কোনো দ্বিধা ছাড়াই সরকারছাড়া সংবাদপত্রকে বেছে নিতেন। সংবাদমাধ্যমকে কোনোভাবে বল্গা পরানোর দুরভিসন্ধি যেন সরকারের মাথায় এক মুহূর্তের জন্য না আসে।
আইওয়া সিটিতে অল্প কজনই বাঙালি আছে। কর্ণটকি সংগীতের সাধক বাংলাদেশি মেঘনা আমিনের বাসায় আমরা কজন সমবেত হয়েছিলাম শনিবার রাতে। বাংলাদেশ থেকে সদ্য আসা ইংরেজি ভাষার লেখিকা শবনম নাদিয়া গান ধরলেন—‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে। জানি নে তোর ধনরতন, আছে কিনা রানীর মতোন, শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে।’
আমার মা, আমার বাংলাদেশ ধনরত্নে রানি নয় আমরা জানি, কিন্তু এই দেশে জন্মেছি, এই আলোতেই নয়ন রেখে নয়ন মুদতে আমরা চাই। আমাদের দেশটাকে চিরদিন ভিখারিনী সাজে দেখতেও কি ভালো লাগে? আমাদের নেতাদের চৈতন্য যেন সদা-উদীত থাকে। আসন্ন ঈদ সবার ভালো থাকুক, হাজার মাইল দূর থেকে সেই শুভেচ্ছা জানাই।
আইওয়া সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
anisulhoque1971@gmail.com
No comments