দুই দু’গুণে পাঁচ-ব্রিটেনের রানির হীরকজয়ন্তী by আতাউর রহমান
ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের হীরকজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে সে দেশে এ মাসের ২ তারিখ থেকে চার দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য উৎসব হয়েছিল, যেটার রেশ এখনো চলছে। অবশ্য এলিজাবেথ রানিই হতে পারতেন না, যদি না তাঁর পিতৃব্য অষ্টম অ্যাডওয়ার্ড ডিভোর্সি মিসেস সিম্পসনের প্রেমে পড়ে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করায় তাঁর বাবা ষষ্ঠ জর্জ ব্রিটেনের রাজা হতেন।
সে যা হোক। আমি আশির দশকে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনে প্রথম সচিবের পদমর্যাদায় সাড়ে চার বছর কর্মরত ছিলাম বিধায় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ব্যাপারে আমার নিজস্ব কিছু মজার স্মৃতি আছে। কিন্তু সেগুলো রোমন্থনের আগে রানির জীবনে সংঘটিত কিছু উপাখ্যান উপস্থাপন করে নিই:
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পুরো নাম হচ্ছে এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি। তিনি ১৯৬৫ সালে একবার গিয়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে, রাষ্ট্রীয় সফরে। পশ্চিম জার্মানির সে সময়ের প্রেসিডেন্ট হেনরিক ল্যুবক ইংরেজি ভাষাটা তেমন জানতেন না। হেনরিক এয়ারপোর্টে এসেছেন রানিকে অভ্যর্থনা জানাতে। রানি উড়োজাহাজ থেকে নামতেই তিনি এগিয়ে এসে ভদ্রতা রক্ষার্থে রানির কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ‘হাউ আর ইউ’ বলার পরিবর্তে বলে বসলেন, ‘হু আর ইউ’। অর্থাৎ ‘আপনি কেমন আছেন’ এর পরিবর্তে ‘আপনি কে?’
রানিও কম যান না, তিনি মৃদুহাস্যে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আই অ্যাম এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি অব লন্ডন’, ‘আমি হচ্ছি লন্ডন থেকে আগত এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি।’
প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল, বারান্তরে রানি রাষ্ট্রীয় সফরে পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন থেকে নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে গিয়েছিলেন। তখন আমাদের এখানকার দৈনিক সংবাদ-এর হেডলাইন ছিল এই: ‘রানি বন থেকে হেগে গেলেন।’ এটা নিয়ে তখন খুব হাসাহাসিও হয়েছিল।
গেল শতাব্দীর সত্তরের দশকে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইয়াকুবু গওয়ন। তিনি একবার রাষ্ট্রীয় সফরে বিলেতে গেছেন। সে দেশের প্রচলিত রাষ্ট্রাচার অনুযায়ী রানি এলিজাবেথ তাঁকে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া রেলস্টেশনে অভ্যর্থনা জানিয়ে রাষ্ট্রীয় অশ্ববাহিত শকটে করে বাকিংহাম প্রাসাদে নিয়ে যেতে এসেছেন। সম্মানিত অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে রানি যেই না শকটে উপবেশন করেছেন, অমনি একটি ঘোড়া সশব্দে বাতকর্ম করে দিল, যেটাকে ইংরেজিতে ফার্টিং বলে। রানির ভদ্রতা ও শালীনতাবোধ এতটাই প্রবল যে তিনি ঘোড়ার এই ব্যবহারে মনে মনে লজ্জিত হয়ে ভাবলেন, সম্মানিত অতিথির কাছে এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা দরকার। তাই তিনি মুচকি হেসে প্রেসিডেন্ট গওয়নের উদ্দেশে ‘আমি ক্ষমা চাচ্ছি, আপনার শুরুটা খুব ভালো হলো না’ বলতেই গওয়ন নাকি তৎক্ষণাৎ বলে উঠেছিলেন, ‘আপনার ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া আমি ভেবেছিলাম, ওটা একটি ঘোড়ার কাণ্ড।’
কথায় বলে, রাজদর্শন নাকি পুণ্যের। বিলেতে আমার সাড়ে চার বছরব্যাপী অবস্থানকালে রাজদর্শন অর্থাৎ রানিদর্শন হয়েছে সর্বসাকুল্যে চারবার—দুবার রানির গার্ডেন পার্টিতে, একবার ইভনিং পার্টিতে ও একবার রানির কাছে আমাদের নতুন রাষ্ট্রদূত কর্তৃক পরিচয়পত্র প্রদানকালে তাঁর সহগামী হওয়ায়। রানি বছরে একবার বসন্তকালের বিকেলে বিলেতসহ কমনওয়েলথভুক্ত ৫৪টি দেশের বিলেতে বসবাসরত নর-নারীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হাজার কয়েক লোককে বাকিংহাম প্রাসাদের ভেতরের বাগানে খোলা আকাশের নিচে চা-চক্রে নিমন্ত্রণ করেন এবং তখন তিনি অত্যন্ত ‘বিল্যাকসড’ভাবে পূর্বনির্ধারিত সময়ের ভেতরে যতটা সম্ভব আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে এলোপাতাড়িভাবে কথাবার্তা বলে বেড়ান। আর ইভনিং পার্টিতে প্রাসাদের হল রুমে বিভিন্ন দেশের নির্দিষ্টসংখ্যক কূটনীতিবিদকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। সেবার রানি তাঁর স্বামী, ছেলে প্রিন্স চার্লস ও ডায়ানা একসঙ্গে ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে করমর্দন ও কুশল বিনিময় করছিলেন। একপর্যায়ে প্রিন্স চার্লস পেশাদার কূটনীতিক আমাদের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত প্রয়াত ফকরুদ্দিন অহমদকে বাংলাদেশ মূলত একটি কৃষিপ্রধান দেশ বিধায় সহাস্যে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘আর ইউ এ ফারমার?’ অর্থাৎ ‘আপনি কি একজন কৃষক?’ রাষ্ট্রদূত ‘নো, আই অ্যাম নট’ বলে দেখলাম একটুখানি মন খারাপ করে আছেন। ততক্ষণে চার্লস সামনে এগিয়ে গেছেন। আমি তাই ব্যাপারটাকে হালকা করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রদূতকে বললাম, ‘স্যার, প্রিন্স একদিক দিয়ে যথার্থই বলেছেন। কৃষিপ্রধান দেশের প্রতিনিধিত্বকারী রাষ্ট্রদূতও একজন কৃষকই তো হওয়ার কথা।’ রাষ্ট্রদূত আমার কথায় হেসে ফেললেন।
বাকি রইল মুক্তিযোদ্ধা ও লে. জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলীর (বর্তমানে প্রয়াত) বাকিংহাম প্যালেসে রানির কাছে পরিচয়পত্র প্রদানের উপাখ্যান। দূতাবাস থেকে রাজকীয় অশ্ববাহিত তিনটি শকটে করে রাষ্ট্রদূত ও তাঁর সহযাত্রী আমরা চারজন কর্মকর্তা বাকিংহাম প্রাসাদের ভেতরে রানির খাস দপ্তরে ঢুকতেই কিছুক্ষণের মধ্যে অনুভব করলাম, গলার রস যেন একদম শুকিয়ে গেছে। হাজার হোক, বাকিংহাম প্যালেস ও রাজদর্শন বলে কথা! রাষ্ট্রদূতও খানিকটা ভড়কে গেছেন মনে হলো। কারণ, প্রটোকলটা ছিল এ রকম: প্রথমে রাষ্ট্রদূত রানির সঙ্গে পরিচিত হবেন; অতঃপর আমরা একজন একজন করে যাব, তিনি আমাদের নাম ধরে পরিচয় করিয়ে দেবেন। পূর্বাহ্নে একপর্যায়ে আমাদের তিনি বলে রাখলেন, ‘আমি যদি আপনাদের কারও নাম বলতে ভুল করি, তাহলে আমাকে কনট্রাডিক্ট করবেন না। আর ঘটলও ঠিক তাই। আমি যখন রানির সঙ্গে পরিচিত হতে উপনীত হলাম, তখন তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘হি ইজ মিস্টার লিয়াকত আলী খাঁন...।’
অর্থাৎ তিনি আমাকে তখনো পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দিলেন আর কি। হা হা হা!
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পুরো নাম হচ্ছে এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি। তিনি ১৯৬৫ সালে একবার গিয়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে, রাষ্ট্রীয় সফরে। পশ্চিম জার্মানির সে সময়ের প্রেসিডেন্ট হেনরিক ল্যুবক ইংরেজি ভাষাটা তেমন জানতেন না। হেনরিক এয়ারপোর্টে এসেছেন রানিকে অভ্যর্থনা জানাতে। রানি উড়োজাহাজ থেকে নামতেই তিনি এগিয়ে এসে ভদ্রতা রক্ষার্থে রানির কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ‘হাউ আর ইউ’ বলার পরিবর্তে বলে বসলেন, ‘হু আর ইউ’। অর্থাৎ ‘আপনি কেমন আছেন’ এর পরিবর্তে ‘আপনি কে?’
রানিও কম যান না, তিনি মৃদুহাস্যে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আই অ্যাম এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি অব লন্ডন’, ‘আমি হচ্ছি লন্ডন থেকে আগত এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি।’
প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল, বারান্তরে রানি রাষ্ট্রীয় সফরে পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন থেকে নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে গিয়েছিলেন। তখন আমাদের এখানকার দৈনিক সংবাদ-এর হেডলাইন ছিল এই: ‘রানি বন থেকে হেগে গেলেন।’ এটা নিয়ে তখন খুব হাসাহাসিও হয়েছিল।
গেল শতাব্দীর সত্তরের দশকে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইয়াকুবু গওয়ন। তিনি একবার রাষ্ট্রীয় সফরে বিলেতে গেছেন। সে দেশের প্রচলিত রাষ্ট্রাচার অনুযায়ী রানি এলিজাবেথ তাঁকে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া রেলস্টেশনে অভ্যর্থনা জানিয়ে রাষ্ট্রীয় অশ্ববাহিত শকটে করে বাকিংহাম প্রাসাদে নিয়ে যেতে এসেছেন। সম্মানিত অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে রানি যেই না শকটে উপবেশন করেছেন, অমনি একটি ঘোড়া সশব্দে বাতকর্ম করে দিল, যেটাকে ইংরেজিতে ফার্টিং বলে। রানির ভদ্রতা ও শালীনতাবোধ এতটাই প্রবল যে তিনি ঘোড়ার এই ব্যবহারে মনে মনে লজ্জিত হয়ে ভাবলেন, সম্মানিত অতিথির কাছে এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা দরকার। তাই তিনি মুচকি হেসে প্রেসিডেন্ট গওয়নের উদ্দেশে ‘আমি ক্ষমা চাচ্ছি, আপনার শুরুটা খুব ভালো হলো না’ বলতেই গওয়ন নাকি তৎক্ষণাৎ বলে উঠেছিলেন, ‘আপনার ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া আমি ভেবেছিলাম, ওটা একটি ঘোড়ার কাণ্ড।’
কথায় বলে, রাজদর্শন নাকি পুণ্যের। বিলেতে আমার সাড়ে চার বছরব্যাপী অবস্থানকালে রাজদর্শন অর্থাৎ রানিদর্শন হয়েছে সর্বসাকুল্যে চারবার—দুবার রানির গার্ডেন পার্টিতে, একবার ইভনিং পার্টিতে ও একবার রানির কাছে আমাদের নতুন রাষ্ট্রদূত কর্তৃক পরিচয়পত্র প্রদানকালে তাঁর সহগামী হওয়ায়। রানি বছরে একবার বসন্তকালের বিকেলে বিলেতসহ কমনওয়েলথভুক্ত ৫৪টি দেশের বিলেতে বসবাসরত নর-নারীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হাজার কয়েক লোককে বাকিংহাম প্রাসাদের ভেতরের বাগানে খোলা আকাশের নিচে চা-চক্রে নিমন্ত্রণ করেন এবং তখন তিনি অত্যন্ত ‘বিল্যাকসড’ভাবে পূর্বনির্ধারিত সময়ের ভেতরে যতটা সম্ভব আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে এলোপাতাড়িভাবে কথাবার্তা বলে বেড়ান। আর ইভনিং পার্টিতে প্রাসাদের হল রুমে বিভিন্ন দেশের নির্দিষ্টসংখ্যক কূটনীতিবিদকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। সেবার রানি তাঁর স্বামী, ছেলে প্রিন্স চার্লস ও ডায়ানা একসঙ্গে ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে করমর্দন ও কুশল বিনিময় করছিলেন। একপর্যায়ে প্রিন্স চার্লস পেশাদার কূটনীতিক আমাদের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত প্রয়াত ফকরুদ্দিন অহমদকে বাংলাদেশ মূলত একটি কৃষিপ্রধান দেশ বিধায় সহাস্যে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘আর ইউ এ ফারমার?’ অর্থাৎ ‘আপনি কি একজন কৃষক?’ রাষ্ট্রদূত ‘নো, আই অ্যাম নট’ বলে দেখলাম একটুখানি মন খারাপ করে আছেন। ততক্ষণে চার্লস সামনে এগিয়ে গেছেন। আমি তাই ব্যাপারটাকে হালকা করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রদূতকে বললাম, ‘স্যার, প্রিন্স একদিক দিয়ে যথার্থই বলেছেন। কৃষিপ্রধান দেশের প্রতিনিধিত্বকারী রাষ্ট্রদূতও একজন কৃষকই তো হওয়ার কথা।’ রাষ্ট্রদূত আমার কথায় হেসে ফেললেন।
বাকি রইল মুক্তিযোদ্ধা ও লে. জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলীর (বর্তমানে প্রয়াত) বাকিংহাম প্যালেসে রানির কাছে পরিচয়পত্র প্রদানের উপাখ্যান। দূতাবাস থেকে রাজকীয় অশ্ববাহিত তিনটি শকটে করে রাষ্ট্রদূত ও তাঁর সহযাত্রী আমরা চারজন কর্মকর্তা বাকিংহাম প্রাসাদের ভেতরে রানির খাস দপ্তরে ঢুকতেই কিছুক্ষণের মধ্যে অনুভব করলাম, গলার রস যেন একদম শুকিয়ে গেছে। হাজার হোক, বাকিংহাম প্যালেস ও রাজদর্শন বলে কথা! রাষ্ট্রদূতও খানিকটা ভড়কে গেছেন মনে হলো। কারণ, প্রটোকলটা ছিল এ রকম: প্রথমে রাষ্ট্রদূত রানির সঙ্গে পরিচিত হবেন; অতঃপর আমরা একজন একজন করে যাব, তিনি আমাদের নাম ধরে পরিচয় করিয়ে দেবেন। পূর্বাহ্নে একপর্যায়ে আমাদের তিনি বলে রাখলেন, ‘আমি যদি আপনাদের কারও নাম বলতে ভুল করি, তাহলে আমাকে কনট্রাডিক্ট করবেন না। আর ঘটলও ঠিক তাই। আমি যখন রানির সঙ্গে পরিচিত হতে উপনীত হলাম, তখন তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘হি ইজ মিস্টার লিয়াকত আলী খাঁন...।’
অর্থাৎ তিনি আমাকে তখনো পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দিলেন আর কি। হা হা হা!
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।
No comments