মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর-বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক by শাহরিয়ার কবির
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে ভারতকেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে। সীমান্ত বিরোধ, অভিন্ন নদীগুলোর জল বণ্টন সমস্যা ও বাণিজ্যিক ঘাটতিসহ যেসব সমস্যা উপলক্ষ করে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির সুযোগ পায়, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে
২০১১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চলি্লশতম বার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ভারতের কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদানেরও চলি্লশতম বার্ষিকী ২০১১ সাল। চলি্লশ বছর আগে বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। ভারতে ক্ষমতায় ছিল শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় কংগ্রেস। চলি্লশ বছর পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে। ভারতেও ক্ষমতায় রয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট, যার প্রধান হচ্ছেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী।
আমরা জানি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' ও 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' বাতিল করেছেন। সংবিধানের প্রারম্ভে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' (পরম করুণাময় আল্লাহর নামে) সংযোজন করেছেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছেন। এ ছাড়াও সংবিধানের 'রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' অধ্যায়ে যুক্ত করেছেন 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি।' গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের এই 'পাকিস্তানিকরণ' ও 'ইসলামীকরণ'-এর ফলে স্বাধীনতা লাভের পাঁচ বছরের ভেতর ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম আদর্শ হিসেবে গ্রহণকারী বাংলাদেশে ধর্মের নামে অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয় ঘটেছিল। পাকিস্তানের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক আদর্শের অনুসারী এসব দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতার যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তার জের এখনও চলছে।
জিয়াউর রহমানের পর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন জেনারেল এরশাদ। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির পাকিস্তানিকরণ আরও সংহত করার জন্য তিনি সংবিধানে ইসলামকে 'রাষ্ট্রধর্ম' ঘোষণা করেছেন। জেনারেল এরশাদের পর দুই দফা ক্ষমতায় ছিল জেনারেল জিয়ার সহধর্মিণী খালেদা জিয়ার বিএনপি। শেষবার ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জোট বেঁধে ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশকে আওয়ামী লীগশূন্য ও হিন্দুশূন্য করার জন্য সরকারি উদ্যোগে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সন্ত্রাস ঘটানো হয়েছে; বাংলাদেশের চলি্লশ বছরের ইতিহাসে এমন নৃশংসতা দেখা যায়নি। ভারত ও বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনৈতিক পালাবদলে আমরা লক্ষ্য করেছি, সাধারণভাবে দুই দেশে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন সম্প্রীতি ও সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। এর বিপরীত অবস্থা ঘটে যখন দুই দেশে ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারকারী বিজেপি ও বিএনপি ক্ষমতায় থাকে। তবে গত চলি্লশ বছরে দুই দেশে রাজনীতি, কূটনীতি, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, যা দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।
নদীবিধৌত বাংলাদেশের ৫৪টি নদী ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উজান ও ভাটির দেশের জল বণ্টনের সমস্যাকে দুই দেশ সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে ১৯৭২ সালেই গঠন করেছে যৌথ নদী কমিশন। এরপর রয়েছে দুই দেশের সীমান্তে ১৬২টি ছিটমহল, যার অস্বাভাবিক অবস্থান ১৯৪৭ সাল থেকে অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে কয়েকটি ছিটমহল বিষয়ে মীমাংসা হলেও অধিকাংশ এখনও বিরোধপূর্ণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত। দুই দেশের সমুদ্র সীমানাও যথাযথভাবে নির্ধারিত হয়নি। উত্তর-পূর্ব ভারতের গোলযোগপূর্ণ ৫টি রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। এসব রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসীদের জন্য এক সময় বাংলাদেশ নিরাপদ স্বর্গে পরিণত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান আমল থেকেই নাগা ও মিজো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশিক্ষণের ঘাঁটি হিসেবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহৃত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আসাম, মণিপুর ও ত্রিপুরার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা। অপরদিকে বাংলাদেশের জঙ্গি মৌলবাদীদের পাকিস্তান উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে কাশ্মীরে পাঠাচ্ছে জিহাদ করার জন্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠনের নেটওয়ার্ক ভারতের সীমান্তের রাজ্যগুলো থেকে আরম্ভ করে উত্তর প্রদেশের আলীগড় পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতিও বিশাল অঙ্কের। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সীমান্তের চোরাচালান। চোরাচালান শুধু পণ্য পাচারে সীমাবদ্ধ নয়; মানুষ, অস্ত্র ও মাদকসামগ্রী পাচার হচ্ছে প্রায় নির্বিঘ্নে। বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে বটে, তবে চোরাচালানির পরিমাণ এতে কমেছে_ পরিসংখ্যান এমনটি সাক্ষ্য দেয় না। চোরাচালান দমনের নামে সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সীমান্তে গুলি করে সাধারণ মানুষ হত্যার ঘটনা দুই দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য অত্যন্ত অস্বস্তিকর।
সমস্যা রয়েছে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের। হিন্দি সিনেমা ও টিভি সিরিয়াল হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে কলকাতা ও মুম্বাইয়ের সব টেলিভিশন চ্যানেল সুলভ হলেও বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল ভারতে দেখা যায় না। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে গ্রন্থ, পত্রিকা ও অন্যান্য প্রকাশনার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে ভারতের সব বই ও পত্রিকা অত্যন্ত সহজলভ্য হলেও ভারতে বাংলাদেশের বই ও পত্রিকা এখনও দুষ্প্রাপ্য।
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ভেতর টানাপড়েন সত্ত্বেও দুই দেশ অভিন্ন সভ্যতা, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের উত্তরাধিকারী। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৮৮ ভাগ ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান। ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বাঙালি জনসংখ্যা ১০ কোটিরও বেশি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগে বাংলাদেশ ও ভারত এক দেশ ছিল। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার সঙ্গে পূর্ব বাংলার কোনো সীমানা ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি অভিন্ন। উত্তরাধিকার ও অর্জন অভিন্ন। চণ্ডীদাস, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনায় আলোকিত হয়েছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ শুধু নয়, ভারতেরও বিশাল জনগোষ্ঠী। ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের ভাণ্ডার থেকে নেওয়া হয়েছে।
দুই
২০০৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৯-এর জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর মহাজোট সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর '৭২-এর সংবিধান পুনর্বহালের প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছে এবং পাঠ্যপুস্তক ও প্রচার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে রাজধানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণ ছিল সচেতন নাগরিক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবি। ২০১১ সালে সরকার এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মহাজোট সরকার প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা_ যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের সরকারিভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে বিজয়ের উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য। একইভাবে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতের সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দফতরে একই সময় একই উদ্দেশ্যে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের। সরকারি উদ্যোগে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের সফর নিয়মিতভাবে দুই দেশ আয়োজন করছে। বাংলাদেশের ছাত্রদের বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য। প্রতি বছর বাংলাদেশের ৩০০ ছাত্র উচ্চতর শিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে ভারতে পড়তে যাচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৪০০ মুক্তিযোদ্ধা-সন্তানদের ভারত সরকার প্রতি বছর বৃত্তি দিচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং '৭২-এর সংবিধানের মূলনীতিগুলো পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ বানচাল করার জন্য বিএনপি ও জামায়াত বলছে, মহাজোট সরকার নাকি ভারতের নির্দেশে এসব করছে। সাম্প্রদায়িকতা শুধু বাংলাদেশে নয়, সমগ্র উপমহাদেশে দক্ষিণপন্থি, প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মব্যবসায়ীদের রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার এবং সুযোগ পেলেই এই অস্ত্র তারা ব্যবহার করে। উপমহাদেশে এই অস্ত্র রাজনৈতিকভাবে প্রথম ব্যবহার করেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা। বিভিন্ন সময় তারা তাদের সাম্প্রদায়িক বিভাজন নীতি_ 'ভাগ কর, শাসন কর' প্রয়োগ করতে গিয়ে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে মদদ জুগিয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও হানাহানি উস্কে দিয়েছে।
প্রতি বছর কয়েক লাখ মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারত যায় এবং প্রায় সমসংখ্যক ভারতীয় বাংলাদেশে আসে। ভিসা নিয়ে ভোগান্তি দুই দেশের নিরীহ নাগরিকদেরই পোহাতে হয়। যারা চোরাচালানি, দুষ্কৃতকারী, জঙ্গি বা সন্ত্রাসী তারা ভিসা ছাড়াই যাতায়াত করে। পাসপোর্ট-ভিসা বা কাঁটাতারের বেড়া তাদের জন্য কোনো বাধা নয়। যে কারণে আমরা কয়েক বছর ধরে বলছি, দুই দেশের ভেতর ভিসা প্রথা তুলে দেওয়া হোক। একবারে না হলেও ধাপে ধাপে এই ভোগান্তির অবসান হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ সরকার পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বাড়ি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। একইভাবে চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়, সঙ্গীতশিল্পী শচীন দেব বর্মণ, অভিনয়শিল্পী সুচিত্রা সেন, বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসু, স্বাধীনতা সংগ্রামী সরোজিনী নাইডুসহ অন্য বিপ্লবীদের বাড়ি বাংলাদেশ সরকার যদি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে দুই দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার সম্পর্কে আগামী প্রজন্মের ধারণা সমৃদ্ধ হবে। একই সঙ্গে এগুলো দুই দেশের পর্যটকদেরও আকর্ষণের স্থান হবে।
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে ভারতকেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে। সীমান্ত বিরোধ, অভিন্ন নদীগুলোর জলবণ্টন সমস্যা ও বাণিজ্যিক ঘাটতিসহ যেসব সমস্যা উপলক্ষ করে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির সুযোগ পায়, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। এসব সমস্যা নিরসন না হলে দুই দেশের উগ্র দক্ষিণপন্থি ও সাম্প্রদায়িক শক্তি লাভবান হবে। বাংলাদেশের দুটি সমুদ্রবন্দর ভারত ও অন্য প্রতিবেশীরা ব্যবহারের সুযোগ পেলে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে_ এটা দু'দেশের বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের তুলে ধরতে হবে। ভারতকে নৌ ও সড়ক যোগাযোগে ট্রানজিট দেওয়া হলে বাংলাদেশও কম লাভবান হবে না। একইভাবে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের বিকাশ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেও প্রয়োজন। বাংলাদেশ মডারেট বা লিবারেল মুসলিম রাষ্ট্র হলে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসী রাজনীতির উত্থানের পথ সুগম হবে। পাকিস্তানের মডেলে ১৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশেও যদি মাশরুমের মতো জঙ্গি মৌলবাদের চাষ আরম্ভ হয়_ ভারত কেন, আমেরিকা, ইউরোপ কেউ নিরাপদ থাকবে না।
বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে এগিয়ে আসতে হবে বিশ্বব্যাপী বিপন্ন ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের আদর্শ রক্ষার জন্য। বিভিন্ন দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থি, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা যেভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে, তা প্রতিহত করার জন্য গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি দায়বদ্ধ দেশগুলোর সরকার ও নাগরিক সমাজকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ বিপর্যয় আজ আমাদের অস্তিত্বের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবেলার পাশাপাশি সামাজিক বিপর্যয় মোকাবেলার প্রস্তুতিও আমাদের নিতে হবে। ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের চেয়ে আরও ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয় বিশ্বসভ্যতার অগ্রযাত্রার পথে হিমালয়সম বাধা হিসেবে বিরাজ করছে। এ বাধা অতিক্রমের ক্ষেত্রে ভারত অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করবে_ এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
শাহরিয়ার কবির :সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা
আমরা জানি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' ও 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' বাতিল করেছেন। সংবিধানের প্রারম্ভে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' (পরম করুণাময় আল্লাহর নামে) সংযোজন করেছেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছেন। এ ছাড়াও সংবিধানের 'রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' অধ্যায়ে যুক্ত করেছেন 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি।' গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের এই 'পাকিস্তানিকরণ' ও 'ইসলামীকরণ'-এর ফলে স্বাধীনতা লাভের পাঁচ বছরের ভেতর ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম আদর্শ হিসেবে গ্রহণকারী বাংলাদেশে ধর্মের নামে অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয় ঘটেছিল। পাকিস্তানের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক আদর্শের অনুসারী এসব দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতার যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তার জের এখনও চলছে।
জিয়াউর রহমানের পর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন জেনারেল এরশাদ। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির পাকিস্তানিকরণ আরও সংহত করার জন্য তিনি সংবিধানে ইসলামকে 'রাষ্ট্রধর্ম' ঘোষণা করেছেন। জেনারেল এরশাদের পর দুই দফা ক্ষমতায় ছিল জেনারেল জিয়ার সহধর্মিণী খালেদা জিয়ার বিএনপি। শেষবার ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জোট বেঁধে ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশকে আওয়ামী লীগশূন্য ও হিন্দুশূন্য করার জন্য সরকারি উদ্যোগে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সন্ত্রাস ঘটানো হয়েছে; বাংলাদেশের চলি্লশ বছরের ইতিহাসে এমন নৃশংসতা দেখা যায়নি। ভারত ও বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনৈতিক পালাবদলে আমরা লক্ষ্য করেছি, সাধারণভাবে দুই দেশে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন সম্প্রীতি ও সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। এর বিপরীত অবস্থা ঘটে যখন দুই দেশে ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারকারী বিজেপি ও বিএনপি ক্ষমতায় থাকে। তবে গত চলি্লশ বছরে দুই দেশে রাজনীতি, কূটনীতি, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, যা দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।
নদীবিধৌত বাংলাদেশের ৫৪টি নদী ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উজান ও ভাটির দেশের জল বণ্টনের সমস্যাকে দুই দেশ সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে ১৯৭২ সালেই গঠন করেছে যৌথ নদী কমিশন। এরপর রয়েছে দুই দেশের সীমান্তে ১৬২টি ছিটমহল, যার অস্বাভাবিক অবস্থান ১৯৪৭ সাল থেকে অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে কয়েকটি ছিটমহল বিষয়ে মীমাংসা হলেও অধিকাংশ এখনও বিরোধপূর্ণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত। দুই দেশের সমুদ্র সীমানাও যথাযথভাবে নির্ধারিত হয়নি। উত্তর-পূর্ব ভারতের গোলযোগপূর্ণ ৫টি রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। এসব রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসীদের জন্য এক সময় বাংলাদেশ নিরাপদ স্বর্গে পরিণত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান আমল থেকেই নাগা ও মিজো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশিক্ষণের ঘাঁটি হিসেবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহৃত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আসাম, মণিপুর ও ত্রিপুরার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা। অপরদিকে বাংলাদেশের জঙ্গি মৌলবাদীদের পাকিস্তান উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে কাশ্মীরে পাঠাচ্ছে জিহাদ করার জন্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠনের নেটওয়ার্ক ভারতের সীমান্তের রাজ্যগুলো থেকে আরম্ভ করে উত্তর প্রদেশের আলীগড় পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতিও বিশাল অঙ্কের। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সীমান্তের চোরাচালান। চোরাচালান শুধু পণ্য পাচারে সীমাবদ্ধ নয়; মানুষ, অস্ত্র ও মাদকসামগ্রী পাচার হচ্ছে প্রায় নির্বিঘ্নে। বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে বটে, তবে চোরাচালানির পরিমাণ এতে কমেছে_ পরিসংখ্যান এমনটি সাক্ষ্য দেয় না। চোরাচালান দমনের নামে সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সীমান্তে গুলি করে সাধারণ মানুষ হত্যার ঘটনা দুই দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য অত্যন্ত অস্বস্তিকর।
সমস্যা রয়েছে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের। হিন্দি সিনেমা ও টিভি সিরিয়াল হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে কলকাতা ও মুম্বাইয়ের সব টেলিভিশন চ্যানেল সুলভ হলেও বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল ভারতে দেখা যায় না। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে গ্রন্থ, পত্রিকা ও অন্যান্য প্রকাশনার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে ভারতের সব বই ও পত্রিকা অত্যন্ত সহজলভ্য হলেও ভারতে বাংলাদেশের বই ও পত্রিকা এখনও দুষ্প্রাপ্য।
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ভেতর টানাপড়েন সত্ত্বেও দুই দেশ অভিন্ন সভ্যতা, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের উত্তরাধিকারী। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৮৮ ভাগ ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান। ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বাঙালি জনসংখ্যা ১০ কোটিরও বেশি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগে বাংলাদেশ ও ভারত এক দেশ ছিল। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার সঙ্গে পূর্ব বাংলার কোনো সীমানা ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি অভিন্ন। উত্তরাধিকার ও অর্জন অভিন্ন। চণ্ডীদাস, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনায় আলোকিত হয়েছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ শুধু নয়, ভারতেরও বিশাল জনগোষ্ঠী। ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের ভাণ্ডার থেকে নেওয়া হয়েছে।
দুই
২০০৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৯-এর জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর মহাজোট সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর '৭২-এর সংবিধান পুনর্বহালের প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছে এবং পাঠ্যপুস্তক ও প্রচার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে রাজধানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণ ছিল সচেতন নাগরিক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবি। ২০১১ সালে সরকার এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মহাজোট সরকার প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা_ যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের সরকারিভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে বিজয়ের উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য। একইভাবে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতের সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দফতরে একই সময় একই উদ্দেশ্যে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের। সরকারি উদ্যোগে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের সফর নিয়মিতভাবে দুই দেশ আয়োজন করছে। বাংলাদেশের ছাত্রদের বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য। প্রতি বছর বাংলাদেশের ৩০০ ছাত্র উচ্চতর শিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে ভারতে পড়তে যাচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৪০০ মুক্তিযোদ্ধা-সন্তানদের ভারত সরকার প্রতি বছর বৃত্তি দিচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং '৭২-এর সংবিধানের মূলনীতিগুলো পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ বানচাল করার জন্য বিএনপি ও জামায়াত বলছে, মহাজোট সরকার নাকি ভারতের নির্দেশে এসব করছে। সাম্প্রদায়িকতা শুধু বাংলাদেশে নয়, সমগ্র উপমহাদেশে দক্ষিণপন্থি, প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মব্যবসায়ীদের রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার এবং সুযোগ পেলেই এই অস্ত্র তারা ব্যবহার করে। উপমহাদেশে এই অস্ত্র রাজনৈতিকভাবে প্রথম ব্যবহার করেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা। বিভিন্ন সময় তারা তাদের সাম্প্রদায়িক বিভাজন নীতি_ 'ভাগ কর, শাসন কর' প্রয়োগ করতে গিয়ে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে মদদ জুগিয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও হানাহানি উস্কে দিয়েছে।
প্রতি বছর কয়েক লাখ মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারত যায় এবং প্রায় সমসংখ্যক ভারতীয় বাংলাদেশে আসে। ভিসা নিয়ে ভোগান্তি দুই দেশের নিরীহ নাগরিকদেরই পোহাতে হয়। যারা চোরাচালানি, দুষ্কৃতকারী, জঙ্গি বা সন্ত্রাসী তারা ভিসা ছাড়াই যাতায়াত করে। পাসপোর্ট-ভিসা বা কাঁটাতারের বেড়া তাদের জন্য কোনো বাধা নয়। যে কারণে আমরা কয়েক বছর ধরে বলছি, দুই দেশের ভেতর ভিসা প্রথা তুলে দেওয়া হোক। একবারে না হলেও ধাপে ধাপে এই ভোগান্তির অবসান হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ সরকার পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বাড়ি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। একইভাবে চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়, সঙ্গীতশিল্পী শচীন দেব বর্মণ, অভিনয়শিল্পী সুচিত্রা সেন, বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসু, স্বাধীনতা সংগ্রামী সরোজিনী নাইডুসহ অন্য বিপ্লবীদের বাড়ি বাংলাদেশ সরকার যদি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে দুই দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার সম্পর্কে আগামী প্রজন্মের ধারণা সমৃদ্ধ হবে। একই সঙ্গে এগুলো দুই দেশের পর্যটকদেরও আকর্ষণের স্থান হবে।
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে ভারতকেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে। সীমান্ত বিরোধ, অভিন্ন নদীগুলোর জলবণ্টন সমস্যা ও বাণিজ্যিক ঘাটতিসহ যেসব সমস্যা উপলক্ষ করে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির সুযোগ পায়, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। এসব সমস্যা নিরসন না হলে দুই দেশের উগ্র দক্ষিণপন্থি ও সাম্প্রদায়িক শক্তি লাভবান হবে। বাংলাদেশের দুটি সমুদ্রবন্দর ভারত ও অন্য প্রতিবেশীরা ব্যবহারের সুযোগ পেলে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে_ এটা দু'দেশের বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের তুলে ধরতে হবে। ভারতকে নৌ ও সড়ক যোগাযোগে ট্রানজিট দেওয়া হলে বাংলাদেশও কম লাভবান হবে না। একইভাবে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের বিকাশ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেও প্রয়োজন। বাংলাদেশ মডারেট বা লিবারেল মুসলিম রাষ্ট্র হলে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসী রাজনীতির উত্থানের পথ সুগম হবে। পাকিস্তানের মডেলে ১৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশেও যদি মাশরুমের মতো জঙ্গি মৌলবাদের চাষ আরম্ভ হয়_ ভারত কেন, আমেরিকা, ইউরোপ কেউ নিরাপদ থাকবে না।
বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে এগিয়ে আসতে হবে বিশ্বব্যাপী বিপন্ন ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের আদর্শ রক্ষার জন্য। বিভিন্ন দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থি, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা যেভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে, তা প্রতিহত করার জন্য গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি দায়বদ্ধ দেশগুলোর সরকার ও নাগরিক সমাজকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ বিপর্যয় আজ আমাদের অস্তিত্বের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবেলার পাশাপাশি সামাজিক বিপর্যয় মোকাবেলার প্রস্তুতিও আমাদের নিতে হবে। ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের চেয়ে আরও ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয় বিশ্বসভ্যতার অগ্রযাত্রার পথে হিমালয়সম বাধা হিসেবে বিরাজ করছে। এ বাধা অতিক্রমের ক্ষেত্রে ভারত অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করবে_ এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
শাহরিয়ার কবির :সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা
No comments