সরল গরল-আগাম জামিন: নতুন রায়ের আলোকে আইন হোক by মিজানুর রহমান খান

আগাম জামিন প্রশ্নে আমাদের আপিল বিভাগ একটি মাইলফলক রায় দিয়েছেন। যে দুটি ঘটনার বরাতে আজকের এই লেখা, সেটা ওই রায়ের জোরে লিখতে উৎসাহিত হলাম। এই রায়ে আইনজীবীদের অনেকে ক্ষুব্ধ হতে পারেন। কারণ হাইকোর্ট জামিন না দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ‘ডাইরেকশন’ বা ‘নির্দেশনা’ নামে একটি ব্যবস্থা চালু করেছিলেন।


এই ব্যবস্থা সুবিধার চেয়ে অসুবিধা ও জটিলতা তৈরি করেছে অনেক বেশি। ডাইরেকশন প্রচলিত আইনে নেই। অথচ এই ‘ডাইরেকশন’ দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। এটা আসলে প্রচলিত আইনে শর্টসার্কিট তৈরি করেছিল। সে কারণে আমরা এই রায়কে স্বাগত জানাই। গণজামিনের সমালোচনা আমরা করেছি। আইনচ্যুত জামিন আমরা সুনজরে দেখিনি।
আগাম জামিন একসময় আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধিতে ছিল। এখন নেই। তবুও হাইকোর্ট তাঁর অসংজ্ঞায়িত সহজাত অধিকারে আগাম জামিন দিয়ে আসছেন। এর আগে প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিবন্ধে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন করার পক্ষে লিখেছিলাম। কেন দরকার সেটা ব্যাখ্যা করেছিলাম। আইন নেই, আইন দরকার, সেটা ভিন্ন বিষয়। নরহত্যার মতো কতিপয় গুরুতর অপরাধ অজামিনযোগ্য। সে কারণে আইন আদালতকে সতর্ক করেছে। আইন বলেছে, অজামিনযোগ্য অপরাধের দায়ে অভিযুক্তকে জামিন দিলে তার কারণ আদেশে লিখতে হবে। আগাম জামিন দিলেও লাগবে। নিয়মিত জামিন দিলেও কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। অন্তর্বর্তী আদেশেও কারণ লিখতে হবে। কিন্তু আমাদের আদালত-অঙ্গনে দুর্ভাগ্যজনক আওয়াজ উঠেছিল, অন্তর্বর্তী আদেশে কারণ লেখা লাগবে না। অথচ অন্তর্বর্তী আদেশেই সবকিছু সয়লাব।
আদালতের যেসব আদেশে কারণ লেখা থাকে না, সেসব আইনচ্যুত। অথচ এমন আইনচ্যুত আদেশের সংখ্যা কম নয়। বরং এটা এত বেশি যে সংসদের উচিত এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা। ফৌজদারি কার্যবিধিতে উচ্চ আদালত কিংবা নিম্ন আদালতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়নি। সব আদালতকেই কারণ লিখতে হবে।
অনেক দিন ধরে শুনে আসছিলাম, অধস্তন আদালতের বিচারকেরা অনেক সময় জামিনবিষয়ক হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সমস্যায় পড়েন। সেটা যে কী, তা এত দিন ছুঁয়ে দেখতে পারিনি। শুনতাম, হাইকোর্টের ডাইরেকশনে শ্যাল, মে ও উড-এর ব্যবহার কমন থাকে। আর এ নিয়ে জটিলতা বাধে। অনেক সময় শুনি ডাইরেকশনে যদি কমজোরি ‘মে’ কথাটিও থাকে, তাহলেও নিম্ন আদালত ভড়কে যান। তাঁরা সাধারণত জামিন অব্যাহত রাখার প্রবণতা দেখান। দুটো উদাহরণ দিই।
বরগুনার পাথরঘাটা থেকে একটি আগাম জামিনের আবেদন এল। হাইকোর্টের বিচারপতি এম এ ওয়াহাব মিয়া ও বিচারপতি জে বি এম হাসান ২৪ মার্চ ২০১০ আদেশ দেন, ‘বিচারিক আদালত ইতিমধ্যে মামলা আমলে নিয়েছেন। তাই আগাম জামিন দেওয়া যাবে না। তবে আসামিদের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করা হলো।’ আগাম জামিনকে বলা হয় ‘কনকারেন্ট জুরিসডিকসন্স’। এর মানে হলো, আগাম জামিন শুধু হাইকোর্টের সহজাত অধিকারের বিষয় নয়। আগাম জামিন জেলা শহরের যেকোনো দায়রা জজ আদালতও দিতে পারেন। তবে সুপ্রিম কোর্ট কখনো তাঁর বিচারিক, প্রশাসনিক বা অন্য কোনো উপায়ে দায়রা জজ আদালতকে আগাম জামিন প্রদানের অধিকার অনুশীলন করতে বলেছেন বলে আমাদের জানা নেই।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি বিচার বিভাগের ভেতর থেকেও আসতে পারে। আপিল বিভাগের সঙ্গে হাইকোর্টের ও তাদের সঙ্গে অধস্তন আদালতের সমন্বয় থাকতে হবে। উদ্বেগাকুলচিত্তে কখনো ভাবি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভ্যন্তরীণ হুমকির ছায়া কতটা বিস্তৃত হতে পারে? অধস্তন আদালত ও হাইকোর্টের মধ্যে অহেতুক দেয়াল সৃষ্টি আত্মঘাতী। দুটো স্তরই সংবিধানের সৃষ্টি। বিচারিক আদালতও সাংবিধানিক আদালত।
যা হোক, আমরা ২৪ মার্চের হাইকোর্টের ওই আদেশের প্রসঙ্গে আসি। আদালত সংশ্লিষ্ট আসামিদের আট সপ্তাহের জন্য প্রকারান্তরে জামিন দেন। এর নাম ডাইরেকশন-জামিন। কিন্তু আদেশে কোথাও জামিন কথাটির উল্লেখ থাকে না। হাইকোর্ট ওই সময়ের মধ্যে নিম্ন আদালতে তাঁদের ‘আত্মসমর্পণ’ করতে বলেন। অথচ আমরা এখানে আত্মসমর্পণ দেখি না। এটা শর্তসাপেক্ষ আত্মসমর্পণ কিংবা অসমর্পিত আত্মসমর্পণ। হাইকোর্টের ২৪ মার্চের আদেশে লেখা আছে, 'if they surrender before the court below as directed by this court it shall consider their prayer for bail.' এর মানে হলো যদি তাঁরা (আসামিরা) আত্মসমর্পণ করেন তাহলে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তাঁদের জামিন আবেদন বিবেচনা করবেন। ‘শ্যাল কনসিডার’-এর সরল অনুবাদ হলো, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করবেন। এ কথার ফলে নিম্ন আদালতের ওপর জামিন দিতে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে বলে আমাদের মনে হয় না। আসামিদের জামিন দিতেই হবে এমন নির্দেশনা আমরা ওই বাক্যে আপাতদৃষ্টিতে দেখি না।
১১ মে ২০১০। ওই আসামিরা পাথরঘাটার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম অমিত কুমার দের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর কী ঘটেছিল তা আমরা হাইকোর্টের ওই বেঞ্চের ভাষায় শুনব। এটা শোনার বিরল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ বিচারিক আদালত আসামিদের জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আসামিরা সেই আদেশের বিরুদ্ধে বরগুনার দায়রা জজ এম এন মোহাম্মদের আদালতে জামিনের আবেদন করেন। কিন্তু ১৩ মে দায়রা জজ তা নাকচ করেন। আসামিরা ফের হাইকোর্টে আসেন। ১ জুন ২০১০ ওই হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারিক আদালতকে ‘অবাধ্যতার’ জন্য কঠোরভাবে তিরস্কার করেন। বিচারপতি এম এ ওহাব মিয়া ও বিচারপতি জে বি এম হাসান সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ তাঁদের আদেশে লিখেছেন, ‘ইট শ্যাল কনসিডার দেয়ার প্রেয়ার ফর বেইল।—এ কথা লেখা সত্ত্বেও নিম্ন আদালত উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে আদৌ কোনো গুরুত্ব দিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয় না।’
এরপর হাইকোর্ট বেঞ্চ লিখেছেন, ‘দায়রা জজের বোঝা উচিত ছিল যে হাইকোর্ট অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও মামলার সামগ্রিক তথ্য ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়েই হাইকোর্ট জামিন দিতে আদেশ দিয়েছিলেন।’ আমরা জানতে পেরেছি, আদম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আসামিরা ওই মামলায় অজামিনযোগ্য ধারায় অভিযুক্ত হয়েছিল। তাহলে এখানে কিন্তু আমরা হাইকোর্টের আদেশে কোনো ‘কারণ’ দেখতে পাইনি।
হাইকোর্ট লিখেছেন, ‘দুই বিচারকের অবশ্যই সচেতন থাকার কথা যে হাইকোর্টের যেকোনো পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা মেনে চলা তাঁদের জন্য বাধ্যতামূলক। হাইকোর্টের আদেশ না মানায় তাঁরা হাইকোর্টের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। আবেদনকারী ও জনগণের চোখে হাইকোর্টের কর্তৃত্ব হেয়প্রতিপন্ন করেছেন। আমরা বিস্মিত, দুই বিচারক কী করে এমন আচরণ দেখাতে পারলেন। তাঁদের এই আচরণ আদালত অবমাননা ছাড়া কিছুই নয়। যা হোক, তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা না করে এ ধরনের অশ্রদ্ধা ভবিষ্যতে আর না দেখানোর জন্য সতর্ক করে দেওয়া হলো। আমরা আশা করি, অমিত কুমার দে এবং এম এন মোহাম্মদের জন্য এটা একটা শিক্ষা হবে। ব্যক্তিগতভাবে এই আদেশের অনুলিপি তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো।’ তবে আমরা পাথরঘাটা চৌকির বিচারিক হাকিমের সঙ্গে একমত। তিনি তাঁর আদেশে যথার্থ লিখেছেন, ‘মহামান্য হাইকোর্ট জামিন দিতে কোনো পর্যবেক্ষণ দেননি।’
আমরা এখানে দেখলাম, হাইকোর্ট নিজেই বলেছেন, তাঁরা আগাম জামিন দিতে পারেননি। কারণ মামলাটি আমলে নেওয়া হয়েছিল। নিয়ম হলো, অভিযোগপত্র দাখিল হলে আগাম জামিন হবে না। এখানে পরের আরেকটি ধাপে যায় মামলাটি। আদালত আমলেও নিয়ে নেন। তদুপরি ডাইরেকশনের আড়ালে আগাম জামিন নয়, আসামিরা কার্যত স্থায়ী জামিন পেলেন।
একবার আমি একটি লেখায় লিখেছিলাম, হাইকোর্ট জামিন দেননি কিন্তু যা দিয়েছেন তা জামিনের বাপ। অর্থাৎ জামিন না দিলে কী হবে, প্রকারান্তরে যদি একই সুবিধাই দেওয়া হয়, তাহলে নামে কী আসে-যায়। শেক্সপিয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তিটিকে শুধু আমজনতার বোঝার সুবিধার জন্য ওভাবে ভাবার্থে তরজমা করে দিয়েছিলাম।
এবার আমি আপনাদের আরেকটি উদাহরণ দেখাব, এর নাম জামিনের বাপ বললেও কম বলা হবে। এতক্ষণ আপনারা ‘শ্যাল’ জটিলতা দেখলেন। এবার আপনারা দেখবেন দৃশ্যত ‘উড’ কী করে।
গ্রামের নাম আফরা। গ্রামটি যশোর জেলার চৌগাছা থানায়। গত ১ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টা। আফরা গ্রামে এক তরুণ খুন হয়। নিহত রাসেল ওরফে সোহাগ বয়সে উনিশ-কুড়ি। দুর্বৃত্তরা যখন হামলা চালায় তখন সে হয়তো লেখাপড়া করছিল। কারণ তাঁর সামনে ছিল পরীক্ষা। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছিল। জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে নিজ বাড়িতে খুন হয় সোহাগ।
এই হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামি ১৮ দিন পলাতক থাকেন। গত ১৯ এপ্রিল তাঁরা বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা ও বিচারপতি জে বি এম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চে আগাম জামিনের আবেদন করেন। আদালত আসামিদের আট সপ্তাহের মধ্যে দায়রা জজ আদালত, যশোরে আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। দায়রা জজ, যশোরকে তাঁরা আদেশ দেন যে, 'if they surrender before the court below as directed by this court it would consider their prayer for bail.' পাথরঘাটার সঙ্গে চৌগাছার মামলাসংক্রান্ত আদেশের তফাত হলো, আসামিরা হাইকোর্টের আদেশের ৪৫ দিন পর ৩ জুন ২০১০ যশোরের দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এবারে আমরা দেখি, হাইকোর্টের বেঁধে দেওয়া আট সপ্তাহ সময় মধ্য জুনে পেরিয়ে গেছে। সেই আসামিরা আত্মসমর্পণও করেছেন। অথচ তাঁরা ‘জামিন’ পাচ্ছেন না। আবার অন্য রকম ‘জামিন’ পাচ্ছেন। তাঁরা জামিনে নেই। কথা সত্য। তাঁরা জামিনে আছেন, কথা সত্য। কথাটি স্ববিরোধী মনে হলো? এটাও সত্য। পাঁচ আসামি তাঁদের এক আইনজীবীর জিম্মায় আছেন।
যশোরের দায়রা জজ আসামিদের জামিন দেননি, আবার তাঁদের জেলহাজতেও প্রেরণ করেননি। মোটকথা, দায়রা জজ কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। এখানেও প্রকারান্তরে ডাইরেকশন চালু হয়েছে। আসামিরা দেখছেন, তাঁরা জামিন পাচ্ছেন না। আবার জামিন পাচ্ছেন। অন্যদিকে বাদীপক্ষের মনের অবস্থা সবচেয়ে বেশি সঙ্গিন। তাঁরা দেখছেন, আগাম জামিন লাভের পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। অথচ সন্দেভাজন খুনিরা নিহতের স্বজনদের সামনে বুক চেতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অভিযোগপত্র দাখিল হলে কোনো অভিযুক্ত আগাম জামিন পাবেন না। পাথরঘাটায় বিচারিক আদালতকে চূড়ান্ত আদেশ দিতে দেখলাম। কিন্তু যশোরে আমরা দেখছি একটি ঝুলন্ত অবস্থা। যা প্রচলিত আইন বা রেওয়াজ, কোনো কিছুই সমর্থন করে না। দালিলিকভাবেই দেখতে পাই একটি জামিন আদেশ প্রশ্নে বিচারিক আদালতের বহুবিধ স্ববিরোধিতা ফুটে উঠেছে। যশোর আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শওকত হোসেনের সঙ্গে গতকাল টেলিফোনে আলাপ হলো। তিনি বললেন, ‘জামিন না দিয়ে কাউকে জিম্মায় দেওয়া আইনে নেই। কিন্তু এখানে এটা রেওয়াজ হিসেবে চলছে।’
যশোরের দায়রা জজ আদালত সোহাগ হত্যাকাণ্ডের আসামিদের গত ৩ জুন প্রথম আদেশ দেন। এতে উল্লেখ করেন যে, ‘সার্বিক বিবেচনায় আগামী ধার্য তারিখ পর্যন্ত আসামিগণকে তাঁদের নিয়োজিত এডভোকেট গোলাম মোস্তফার ব্যক্তিগত জিম্মায় প্রদান করা হলো।’ ধার্য তারিখ ছিল গত ১১ জুলাই। এদিন আদালত লিখলেন যে, ‘আসামিগণ বিজ্ঞ আইনজীবীর জিম্মায় আছে। তাঁরা ডকে হাজির। এলসিআর না আসায় আসামিদের ‘‘জিম্মার’’ আবেদন এক মাস বর্ধিত করা হল। আগামী ১১ আগস্ট জামিন শুনানি। এলসিআর তলব দেওয়া হোক।’ এলসিআর অর্থ লোয়ার কোর্ট রেকর্ড। সংশ্লিষ্ট মামলার নথি আদালত অঙ্গনে ‘এলসিআর’ হিসেবে পরিচিত। দায়রা জজ এই আবেদন তৃতীয়বারের মতো শোনেন গত ১১ আগস্ট। এদিনও তিনি জামিনের আবেদন নিষ্পত্তি করেননি। তবে তিনি তাঁর আদেশে লিখেছেন, ‘আসামিরা আইনজীবীর জিম্মায় আছে এবং ডকে হাজির। এলসিআর সামিল হয় নাই। আগামী ২৫ আগস্ট ‘জামিন’ শুনানি।’ সবশেষ গত ২৫ আগস্ট দায়রা জজ লিখেছেন, ‘১-৫ নং আসামিগণ আইনজীবীর জিম্মায় আছে। বিজ্ঞ আইনজীবী সময়ের প্রার্থনা করেছে। সময় মঞ্জুর হলো। ‘জামিন’ ১৫ দিন বর্ধিত হলো। আগামী ০৯/০৯/১০ ইং ‘জামিন’ শুনানী।’ আমরা দালিলিকভাবে দেখতে পাচ্ছি, চারটি আদেশে দৃশ্যত একটি বিচিত্র অবস্থা ফুটে উঠেছে। এই চারটি আদেশের সত্যায়িত অনুলিপি আমাদের হাতে আছে। আমরা কী দেখলাম। আমরা দেখলাম, একই আদেশে লেখা হলো জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হলো। একই আদেশে লেখা হলো জামিনের শুনানি আগামী ৯ অক্টোবরে হবে। খুনের আসামিকে জামিন না দিয়ে জিম্মায় দেওয়ার আইন বা রেওয়াজ কোনোটিই নেই।
গল্প এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। যশোর আদালতের নথি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, গত ১০ আগস্ট ২০১০ ওই এলসিআর দায়রা জজ আদালতের ক্লার্ক মো. আমিনুর রহমান প্রাপ্তি স্বীকার করেন। পরদিন আদালতে এই মামলার জামিন শুনানির জন্য ধার্য ছিল। এবং আদালতের ২৫ আগস্টের আদেশে লেখা আছে, নথি পেশ করা হয়নি। আমিনুরের সঙ্গে কথা হলো ফোনে। তাঁর ব্যাখ্যা মোটেই সন্তোষজনক নয়। পরে শুনলাম গত ৩ জুন যখন দায়রা আদালত প্রথম আদেশ দেন যে নথি হাজির করা হোক। তখনো নথি আদালতে ছিল। এর প্রমাণ আছে। বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে।
গত ৬ জুন (লিখিত রায় পাওয়া গেছে আগস্টের শেষে) আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক লিখেছেন, হাইকোর্ট পলাতকের জন্য আগাম জামিন বিবেচনা করতে গিয়ে হয় নির্দিষ্ট করা নীতির ভিত্তিতে জামিন দেবেন কিংবা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করবেন। কিন্তু এর কোনোটিই করা হবে না। অথচ পুলিশ, যাদের কর্তব্যই হলো আসামী গ্রেপ্তার করা, তাঁদের নির্দেশ (উল্লিখিত দুটি ক্ষেত্রেই যা ছিল) দেয়া হবে গ্রেপ্তার করা যাবে না, সেটা কিন্তু আমাদের জানা কোনো আইনে নেই।’ আমরা মনে করি, এই রায়ের আলোকে নির্দিষ্ট আইন করতে হবে। আগাম জামিনসংক্রান্ত এই রায় নিয়ে আমার একটু ভিন্নমত রয়েছে। সেটা পরে লিখব। তবে এই মুহূর্তে এই ডাইরেকশন বন্ধে আইন সংশোধনের জোর সুপারিশ করি। আপিল বিভাগের রায় যথেষ্ট নয়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.