বাংলাদেশের গণন-তন্ত্র! by শাহনেওয়াজ বিপ্লব
১. গণতন্ত্র কাকে বলে? গণতন্ত্রের যে প্রচলিত সংজ্ঞা, তা বলতে গেলে অচল আমাদের বাংলাদেশে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতারা গণতন্ত্র বলতে বোঝেন, যে গণনা বা যে সংখ্যাটা তাঁদের পক্ষে বা তাঁদের রাজনীতির অনুকূলে, সেটাই সঠিক; আর যে সংখ্যা বা হিসাবটা তিনি যে রাজনৈতিক দলের আরাধনা করেন, তার বিপক্ষে যায় তাহলে নেতারা সেটি ওই দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখেন।
উদাহরণ দেওয়া যায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকেই। গত ১১ মে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'গ্যালাপ' যখন জানাল যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় সরকারপ্রধান এবং তাঁর নেতৃত্বের প্রতি দেশের ৭৭ শতাংশ মানুষের আস্থা আছে, ওই সংবাদ পত্রিকাগুলোতে প্রকাশের পর ৭৭ সংখ্যার বন্দনায় মেতে উঠেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা থেকে শুরু করে কেবিনেট মন্ত্রীরা প্রায় সবাই। সংখ্যা ৭৭ আর ওয়াশিংটনের জরিপ প্রতিষ্ঠান 'গ্যালাপ' হঠাৎ করে তাদের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল। ওই সময় পত্রপত্রিকায় গ্যালাপের জরিপ বা পূর্বাভাস যে ভুল হয় না- আওয়ামী লীগ নেতাদের এ রকম বহু মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে।
মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে আমরা দেখলাম অন্য চিত্র। মে মাসের শেষের দিকে প্রকাশিত। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ঠিক কতজন নিহত হয়েছে এর সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করেনি সরকার। তবে তাদের হিসাবে ২০১১ সালে র্যাব ৪৩ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, যার কোনো বিচার হয়নি। এ ছাড়া র্যাব ব্যতীত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অপর বাহিনীগুলোর হেফাজতে ২১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া গুম হয়েছে ৩০ জন।
এ সামান্য হিসাব-নিকাশে প্রবল ক্ষুব্ধ হয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এ গণনা সঠিক নয় এবং একে একটা ঢালাও প্রতিবেদন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
২. বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের বদলে গণন-তন্ত্রের আরাধনায় নেমেছে। মূলত চলতি বছরের মার্চ থেকেই শুরু এই গণন-তন্ত্রের। বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই পক্ষেরই এক মরণপণ লড়াই শুরু হয়েছে কার পক্ষে কত লোক তা দেখানোর জন্য। বিএনপির মহাসমাবেশ বা বিশাল গণমিছিল করার কয়েক দিন পরই আওয়ামী লীগ আয়োজন করেছে মহাসমাবেশ বা মিছিলের। এ যেন সংখ্যার বিরুদ্ধে সংখ্যা দিয়ে টক্কর। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যদিও মিছিল-সমাবেশে কত লোক অংশগ্রহণ করেছে, সেসব সরকারের জনপ্রিয়তা মাপার একমাত্র মাপকাঠি নয়; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ বিষয়ে যেন এখন কোনো ছাড় নেই। বাংলাদেশে সরকারি দল অথবা বিরোধী দল, গণতন্ত্রের এসব প্রচলিত যুক্তিতর্কে মনোযোগী নয়। তাদের মতে গণতন্ত্রের অর্থই এখানে সংখ্যাতন্ত্র। রাস্তায় বা সমাবেশে সংখ্যা নামিয়ে গুনে নেওয়ার তন্ত্র। বিএনপির মহাসমাবেশে দুই লাখ লোক জমায়েত হলে আওয়ামী লীগকে পরের সপ্তাহে সমাবেশ করে তিন লাখ লোক জমায়েত করতেই হবে! রাজনীতির উদ্দেশ্য, আদর্শ অথবা পথ-পাথেয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর এখানে কোনো মাথাব্যথা নেই।
গত ২ মার্চ দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়েছে : '৭ মার্চ শোভাযাত্রায় শক্তি দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ'। খবরে লেখা হয়েছে : বিরোধী দলের ঢাকায় মহাসমাবেশ কর্মসূচির পাঁচ দিন আগে রাজধানীতে দলীয় শক্তিমত্তা দেখাতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ জন্য ৭ মার্চ ঢাকায় বড় ধরনের গণ-শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। দলীয় সূত্র জানায়, ১২ মার্চ ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ কর্মসূচি রয়েছে। এর আগে ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের গণমিছিলে ব্যাপক লোকসমাগম ঘটিয়ে বিরোধী দলকে চাপে ফেলার রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ উপলক্ষে এক প্রস্তুতি সভায় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'আগামী ৭ মার্চ ঢাকাকে মিছিলের নগরীতে পরিণত করা হবে।' সভায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, 'এমন মিছিল করব, সেই জনস্রোত দেখে খালেদা জিয়াসহ সবাই বুঝতে পারবে, জনগণ কোন দিকে আছে।'
এই হচ্ছে অবস্থা। বিরোধী দলের মিছিল বা সমাবেশের জবাবে কোমর বেঁধে সরকারি দলের লোক জমায়েত করা অথবা বিরোধী দলের সমাবেশে নানা কায়দায় বাধা দেওয়া, সরকারি ক্ষমতার প্রদর্শন ছাড়া আর কী বলা যায়! বিরোধী দল সরকারি নানা নীতি অথবা সরকারের অপশাসনের অভিযোগে মিছিল, মহাসমাবেশ করবেই। কিন্তু পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দলের মিছিল বা মহাসমাবেশের জবাবে সরকারি দলের মিছিলে লোক জমায়েতের এ রকম প্রাণপণ চেষ্টা আর কোথাও দেখা যায় না। বিরোধী দল মিছিল বা মহাসমাবেশ করছে, তাই আমরাও করব- এ ধরনের বালখিল্যপনা গণতন্ত্রে শোভনীয় নয়; কিন্তু বাস্তবতা হলো শোভনীয় না হলেও আমাদের দেশের রাজনীতিতে তা লোভনীয় তো বটেই। তাই বিএনপির মহাসমাবেশে যাতে বেশি লোক জমায়েত হতে না পারে সে জন্য পরিবহন বন্ধ করে বা হোটেলে থাকার অনুমতি না দিয়ে নানা রকম চেষ্টা সরকারি দল তো করেছেই এবং সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ তাদের শোভাযাত্রায় অকাতরে মানুষ আমদানি করেছে চারদিক থেকে।
তিন বছর আগে বাংলাদেশের নড়বড়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে 'পরিবর্তন'-এর কথা বলে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় এসেছে। এ তিন বছরে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তা যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও এ কথা ঠিক যে গণতন্ত্র ছেড়ে আওয়ামী লীগ এখন গণন-তন্ত্রকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আর গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যকে বাদ দিয়ে সংখ্যাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
shahnewazbiplob@hotmail.com
লেখক : গল্পকার, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত।
মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে আমরা দেখলাম অন্য চিত্র। মে মাসের শেষের দিকে প্রকাশিত। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ঠিক কতজন নিহত হয়েছে এর সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করেনি সরকার। তবে তাদের হিসাবে ২০১১ সালে র্যাব ৪৩ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, যার কোনো বিচার হয়নি। এ ছাড়া র্যাব ব্যতীত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অপর বাহিনীগুলোর হেফাজতে ২১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া গুম হয়েছে ৩০ জন।
এ সামান্য হিসাব-নিকাশে প্রবল ক্ষুব্ধ হয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এ গণনা সঠিক নয় এবং একে একটা ঢালাও প্রতিবেদন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
২. বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের বদলে গণন-তন্ত্রের আরাধনায় নেমেছে। মূলত চলতি বছরের মার্চ থেকেই শুরু এই গণন-তন্ত্রের। বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই পক্ষেরই এক মরণপণ লড়াই শুরু হয়েছে কার পক্ষে কত লোক তা দেখানোর জন্য। বিএনপির মহাসমাবেশ বা বিশাল গণমিছিল করার কয়েক দিন পরই আওয়ামী লীগ আয়োজন করেছে মহাসমাবেশ বা মিছিলের। এ যেন সংখ্যার বিরুদ্ধে সংখ্যা দিয়ে টক্কর। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যদিও মিছিল-সমাবেশে কত লোক অংশগ্রহণ করেছে, সেসব সরকারের জনপ্রিয়তা মাপার একমাত্র মাপকাঠি নয়; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ বিষয়ে যেন এখন কোনো ছাড় নেই। বাংলাদেশে সরকারি দল অথবা বিরোধী দল, গণতন্ত্রের এসব প্রচলিত যুক্তিতর্কে মনোযোগী নয়। তাদের মতে গণতন্ত্রের অর্থই এখানে সংখ্যাতন্ত্র। রাস্তায় বা সমাবেশে সংখ্যা নামিয়ে গুনে নেওয়ার তন্ত্র। বিএনপির মহাসমাবেশে দুই লাখ লোক জমায়েত হলে আওয়ামী লীগকে পরের সপ্তাহে সমাবেশ করে তিন লাখ লোক জমায়েত করতেই হবে! রাজনীতির উদ্দেশ্য, আদর্শ অথবা পথ-পাথেয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর এখানে কোনো মাথাব্যথা নেই।
গত ২ মার্চ দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়েছে : '৭ মার্চ শোভাযাত্রায় শক্তি দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ'। খবরে লেখা হয়েছে : বিরোধী দলের ঢাকায় মহাসমাবেশ কর্মসূচির পাঁচ দিন আগে রাজধানীতে দলীয় শক্তিমত্তা দেখাতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ জন্য ৭ মার্চ ঢাকায় বড় ধরনের গণ-শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। দলীয় সূত্র জানায়, ১২ মার্চ ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ কর্মসূচি রয়েছে। এর আগে ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের গণমিছিলে ব্যাপক লোকসমাগম ঘটিয়ে বিরোধী দলকে চাপে ফেলার রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ উপলক্ষে এক প্রস্তুতি সভায় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'আগামী ৭ মার্চ ঢাকাকে মিছিলের নগরীতে পরিণত করা হবে।' সভায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, 'এমন মিছিল করব, সেই জনস্রোত দেখে খালেদা জিয়াসহ সবাই বুঝতে পারবে, জনগণ কোন দিকে আছে।'
এই হচ্ছে অবস্থা। বিরোধী দলের মিছিল বা সমাবেশের জবাবে কোমর বেঁধে সরকারি দলের লোক জমায়েত করা অথবা বিরোধী দলের সমাবেশে নানা কায়দায় বাধা দেওয়া, সরকারি ক্ষমতার প্রদর্শন ছাড়া আর কী বলা যায়! বিরোধী দল সরকারি নানা নীতি অথবা সরকারের অপশাসনের অভিযোগে মিছিল, মহাসমাবেশ করবেই। কিন্তু পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দলের মিছিল বা মহাসমাবেশের জবাবে সরকারি দলের মিছিলে লোক জমায়েতের এ রকম প্রাণপণ চেষ্টা আর কোথাও দেখা যায় না। বিরোধী দল মিছিল বা মহাসমাবেশ করছে, তাই আমরাও করব- এ ধরনের বালখিল্যপনা গণতন্ত্রে শোভনীয় নয়; কিন্তু বাস্তবতা হলো শোভনীয় না হলেও আমাদের দেশের রাজনীতিতে তা লোভনীয় তো বটেই। তাই বিএনপির মহাসমাবেশে যাতে বেশি লোক জমায়েত হতে না পারে সে জন্য পরিবহন বন্ধ করে বা হোটেলে থাকার অনুমতি না দিয়ে নানা রকম চেষ্টা সরকারি দল তো করেছেই এবং সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ তাদের শোভাযাত্রায় অকাতরে মানুষ আমদানি করেছে চারদিক থেকে।
তিন বছর আগে বাংলাদেশের নড়বড়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে 'পরিবর্তন'-এর কথা বলে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় এসেছে। এ তিন বছরে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তা যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও এ কথা ঠিক যে গণতন্ত্র ছেড়ে আওয়ামী লীগ এখন গণন-তন্ত্রকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আর গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যকে বাদ দিয়ে সংখ্যাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
shahnewazbiplob@hotmail.com
লেখক : গল্পকার, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত।
No comments