উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের প্রস্তাব বিশেষজ্ঞ কমিটির! by আরিফুজ্জামান তুহিন
কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি ঠিক করতে সরকার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করেছিল। সেই কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে দেশের দুই কয়লাখনি দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বড়পুকুরিয়ায় প্রথমে পরীক্ষামূলক (পাইলট) একটি উন্মুক্ত খনি করা হবে।
সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন সফল হলে ফুলবাড়ীতেও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে। সরকারের মনোনীত ১৫ জন বিশেষজ্ঞের প্রণীত খসড়া প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির আহ্বায়ক পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ার উত্তর পাশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য একটি পরীক্ষামূলক খনি করা হবে। এখানে সফলতা এলে ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে।' উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সব থেকে বেশি ভয় পানির স্তর নিয়ন্ত্রণে রাখা, ক্ষতিগ্রস্তদের ঠিকমতো পুনর্বাসন করা ও অর্থনৈতিকভাবে এর সম্ভাব্যতা নিরূপণ করা। এ কারণে পরীক্ষামূলকভাবে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য একটি খনি করার পরামর্শ দিয়েছি আমরা।' তিনি বলেন, 'এখন সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর, ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা চালাতে হবে। যদি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়, তাহলে অবশ্যই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়ায়।' বাংলাদেশে কি উন্মুক্ত খনি করা সম্ভব- এ প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, 'উন্মুক্ত খনি করা সম্ভব, অবশ্যই সম্ভব। এটা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে বাংলাদেশের জন্য।'
বিশেষজ্ঞ কমিটির দেওয়া খসড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এশিয়া এনার্জি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারে জোর দিয়ে আসছে। কারণ এই পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন বেশি লাভজনক। এ কারণে এশিয়া এনার্জি তাদের প্রচারপত্রে বারবার বলে আসছে, এর বিপরীতে সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। খসড়া প্রতিবেদনে এশিয়া এনার্জির দেওয়া এ তথ্যকে ভ্রান্ত অভিহিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে যেসব প্রযুক্তি রয়েছে, তা ব্যবহার করে সুড়ঙ্গ (আন্ডারগ্রাউন্ড) পদ্ধতিতে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। প্রতিবেদনে উন্মুক্ত খনি সম্পর্কে বলা হয়, উন্মুক্ত খনি কম খরচে করা যায়, কিন্তু এ পদ্ধতিতে পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি হয়।
এশিয়া এনার্জির প্রচারপত্রের তথ্য ও সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটির দেওয়া তথ্যের মধ্যে ওই বিস্তর ফারাক সম্পর্কে জানতে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে গত ৮ মে এশিয়া এনার্জির বাংলাদেশের তথ্য কর্মকর্তা মাহমুদ হাফিজের কাছে ই-মেইল করা হয়। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি তার কোনো জবাব দেননি।
ফুলবাড়ী বাদে অন্য তিনটি কয়লা খনি খালাসপির, দীঘিপাড়া ও জামালগঞ্জে উন্মুক্ত খনি হচ্ছে না। সেখানে সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে প্রতিবেদনে উন্মুক্ত পদ্ধতি ছাড়াও কয়লাকে গ্যাসে পরিণত করে উত্তোলনের ব্যাপারে ইতিবাচক মন্তব্য করেছে কমিটি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন, 'খালাসপির, দীঘিপাড়া ও জামালগঞ্জ কয়লা খনি সুড়ঙ্গ পদ্ধতি বা কোল বেইজড মিথেন পদ্ধতিতে করতে হবে। কারণ এসব অঞ্চলে কয়লা মাটির অনেক নিচে। ওখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব নয়।'
সূত্র জানায়, উন্মুক্ত কয়লা খনির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। এ কমিটির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ওপর ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট তৎকালীন বিডিআর গুলি চালালে তিনজন নিহত হয়। এরপর দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে এক সমাবেশে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দেন, যদি তাঁর দল সরকার গঠন করে তাহলে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তেল গ্যাস কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাংলাদেশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার সুযোগ নেই। জাতীয় কমিটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এ তথ্যপ্রমাণ সরকারকে দিয়েছে। সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে তারা কোনো ধরনের উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করবে না।' তাহলে বিশেষজ্ঞ কমিটি কেন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারে সুপারিশ চূড়ান্ত করছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যাঁরা উন্মুক্ত খনির কথা বলছেন, তাঁরা কম্পানির লোক। এঁরা সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছেন। এসব কথাবার্তা উঠলে এশিয়া এনার্জির লন্ডনের শেয়ারের দাম বাড়ে। এশিয়া এনার্জি লন্ডন শেয়ার বাজার থেকে বাংলাদেশকে দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। এ কারণে তাঁরা এসব কথাবার্তা বলে থাকেন।' তিনি আরো বলেন, সারা পৃথিবীতে উন্মুক্ত খনি বন্ধ হচ্ছে। কয়েক দিন আগে ফিলিপাইনে একটা উন্মুক্ত খনি বন্ধ হয়েছে। এসব কম্পানি যেসব দেশের উদাহরণ তুলে ধরে উন্মুক্ত খনি করার প্রস্তাব দিয়ে থাকে, সেসব দেশেই এখন উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে। আনু মুহাম্মদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী 'কানাডার একটি উন্মুক্ত খনির বিরোধিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ খনিটি হলে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে পানির স্তর নিচে নেমে যাবে।' তিনি বলেন, 'এই যখন অবস্থা তখন আমরা উন্মুক্ত খনির জন্য নানা রকম বিশেষজ্ঞ ধার করে আনছি, যা দুঃখজনক।
কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি ঠিক করার জন্য ১৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ড. এম মনোয়ার হোসেন, বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মাহমুদ আলম, বুয়েটের কেমিক্যাল বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিজ বিভাগের অধ্যাপক মো. সুলতানুল ইসলাম, বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম বদরুজ্জামান, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) মো. সেফাউল আলম, এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ারের সম্পাদক মোল্লা মো. আমজাদ হাসেন, সাবেক যুগ্ম সচিব বেনু গোপাল দে, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. শাহজাহান, বাংলাদেশ ভূ-তাত্তি্বক জরিপ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ড. মুহা. নেহাল উদ্দিন, পশ্চিম অঞ্চলীয় গ্যাস কম্পানির সাবেক পরিচালক এ কে এম সামসুদ্দিন, বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান, ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডাব্লিউএম)-এর উপ-নির্বাহী পরিচালক আবু সালেহ খান ও বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কম্পানি লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক (ভূ-তত্ত্ব) মীর মো. আবদুল হান্নান।
বিশেষজ্ঞ কমিটি সূত্রে জানা গেছে, খুব শিগগির তাঁরা সরকারের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
No comments