এ যুগের বিদ্যাসাগর ইমন by আশরাফুল ইসলাম
কোনো বিষয় বা শব্দের সঙ্গে সার্থক প্রতিতুলনা করার সুযোগ সহসাই ঘটে না আমাদের। তবে কদাচিৎ ঘটেও যায় সবকিছুর অলক্ষ্যেই।
ব্যস্ত নগর জীবনে আমরা কতটাই বা নজর দেই চারপাশের অসঙ্গতির দিকে।
সমাজের হাজারো বিচ্যুতির মাঝেও কিছু ঘটনা মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন যে কোনো মানুষকে নাড়া দেয়। কিছু না করতে পারলেও অন্তত: করার আকাঙ্খা যোগায়।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তেমনি এক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটে।
আমাদের অনেকেরই এ থেকে শিক্ষা নেওয়ার কিছু রয়েছে, এমন ধারণায় বিষয়টি এখানে অবতারণার প্রয়াস পেয়েছে।
প্রতিদিনের ন্যায় শনিবার দিবাগত রাতেও রাজধানীর চিত্র দেখতে বাংলানিউজের টিম ঢাকার রাজপথে। সঙ্গে ছিলেন বাংলানিউজের আলোকচিত্রী শোয়েব মিথুন।
রাজধানীর অন্যতম প্রবেশপথ উত্তরা থেকেই শুরু হবে রাতের ঢাকা পরিভ্রমণ-এমনটাই চূড়ান্ত হলো মিথুন ও আমার মধ্যে।
সারাদিনের প্রচন্ড যানজট কিংবা খরতাপের বালাই কোনোটাই নেই, রাতের শুরুতে ১০টার দিকে সামান্য বৃষ্টিপাতও হয়েছে, তাই বাতাসের কিছুটা হিমেল আলিঙ্গনে বেশ আরামেই পার হচ্ছিল রাতের সময়, যদিও তখনও মুখোমুখি হয়নি কোনো সংবাদের।
রাতের ফাঁকা রাস্তায় দুর্দান্ত ট্রাকের বায়ুঝাপ্টা আর চাঁদের আলো বেশ রোমাঞ্চেরই সঞ্চার করছিল মনে।
আমাদের গন্তব্য রাজধানী ঢাকার উত্তর সীমান্ত আব্দুল্লাহপুর। গাড়ি থেকে নেমে পায়চারি করছি সেই সঙ্গে চোখ কাজ করছে সংবাদ সন্ধানে। অনেক সময় পার করলেও আশায় গুড়েবালি।
রাত তখন তিনটে বেঁজে ২০ মিনিট হবে। গাড়ি ঘুরিয়ে অফিসে ফিরবো, তাই আমাদের সিএনজির চালককে ডাকছিলাম। ঠিক সেই সময় চোখে পড়ে পাশের সিএনজি পাম্পের একপাশে একটি চা-পানের দোকানের দিকে।
আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যাই। কারণ গভীররাতে ওই চা’য়ের দোকানে বিক্রেতা হিসেবে যাকে দেখা গেলো, তা দেখে বিস্মিত হলাম। পাঁচ কি ছয় বছরের এক শিশু, ক্ষীণকায় দেহ, চোখ দু’টি কোটরে ঢুকে গেছে।
‘তন্দ্রায় ঢুলু ঢুলু’ অবস্থায় চা’র কাপে গরম পানি ঢালছে ওই শিশু। চিনি, দুধ দিয়ে চামচ দিয়ে নাড়তে গিয়ে পড়ি পড়ি অবস্থা। বিস্ময় নিয়ে দেখছিলাম তাকে, তবে তখনো এতটা বিস্মিত হইনি, যতটানা হলাম ওর সঙ্গে কথা বলার পর।
ওর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তার নাম ইমন। বাড়ি নোয়াখালির রায়পুরে। শৈশবে এক কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে গত মাস তিনেক আগে সে পাড়ি জমিয়েছে ঢাকায়।
জীবন সংগ্রামী এই শিশুটির বাবা পারু মিয়া কয়েক মাস আগে দ্বিতীয় বিয়ে করে নিরুদ্দেশ। ২ বোন ১ ভাই আর মা জোসনা বেগমকে বাঁচাতে, তাদের মুখে দু’বেলা আহার যোগাতে ইমনের এই ঢাকা আসা।
মামাতো ভাই মুহিমের সঙ্গে থেকে তারই চা-পানের দোকানে কাজ করছে সে। বেতন নির্ধারিত নেই। খাবার আর কাপড় ছাড়া নগদ কোনো অর্থ পায় না ইমন। দু’মাস পর পর ইমনের মা’য়ের কাছেই টাকা পাঠায় মুহিম।
আব্দুল্লাহপুর আরএস ফিলিং স্টেশনের প্রবেশ পথে ডান দিকের ভাসমান এই দোকানে ইমনকে কাজ করতে হয় রাতের বেলায়। দিনের বেলায় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিশ্রাম! এরপর থেকে টানা সারারাত চা-পান-সিগারেট বিক্রি করতে হয়।
ঘুম ঘুম চোখে ইমন বাংলানিউজকে জানায়, তার বাবা যখন একসঙ্গে ছিল তখন সে স্থানীয় সোনালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা বিয়ে করে চলে গেলে তাদের সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। এত অল্প বয়েসে পরিবারের সবাইকে ছেড়ে চলে এলেও কষ্ট নেই ইমনের।
‘মা’য়ের দু:খ-কষ্ট দূর করতেই তার এত দূর আসা। বড় কিছু হওয়ার স্বপ্নও নেই তার। কেবল মা’য়ের মুখটা যেন থাকে হাসিতে, এটাই তার চাওয়া।’
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় পারিবারিক বন্ধন দিন দিন হালকা হচ্ছে। সন্তানরা বড় হয়ে বৃদ্ধ মা-বাবাকে রেখে আসছে বৃদ্ধাশ্রমে। কেউবা খোঁজও রাখছে না।
বহুযুগ পূর্বে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মা’য়ের জন্য বিশাল নদী পাড়ি দিয়েছিলেন। মা’য়ের জন্য সন্তানদের আত্মত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত কদাচিৎ দেখা যায়।
তবে শিশু ইমনের মাতৃপ্রেমের এমন দৃষ্টান্ত আমাদের বর্তমান পঙ্কিল সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যাসাগরের সঙ্গে খানিকটা তুলনা করলে ভুল হবে না বৈকি!
সমাজের হাজারো বিচ্যুতির মাঝেও কিছু ঘটনা মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন যে কোনো মানুষকে নাড়া দেয়। কিছু না করতে পারলেও অন্তত: করার আকাঙ্খা যোগায়।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তেমনি এক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটে।
আমাদের অনেকেরই এ থেকে শিক্ষা নেওয়ার কিছু রয়েছে, এমন ধারণায় বিষয়টি এখানে অবতারণার প্রয়াস পেয়েছে।
প্রতিদিনের ন্যায় শনিবার দিবাগত রাতেও রাজধানীর চিত্র দেখতে বাংলানিউজের টিম ঢাকার রাজপথে। সঙ্গে ছিলেন বাংলানিউজের আলোকচিত্রী শোয়েব মিথুন।
রাজধানীর অন্যতম প্রবেশপথ উত্তরা থেকেই শুরু হবে রাতের ঢাকা পরিভ্রমণ-এমনটাই চূড়ান্ত হলো মিথুন ও আমার মধ্যে।
সারাদিনের প্রচন্ড যানজট কিংবা খরতাপের বালাই কোনোটাই নেই, রাতের শুরুতে ১০টার দিকে সামান্য বৃষ্টিপাতও হয়েছে, তাই বাতাসের কিছুটা হিমেল আলিঙ্গনে বেশ আরামেই পার হচ্ছিল রাতের সময়, যদিও তখনও মুখোমুখি হয়নি কোনো সংবাদের।
রাতের ফাঁকা রাস্তায় দুর্দান্ত ট্রাকের বায়ুঝাপ্টা আর চাঁদের আলো বেশ রোমাঞ্চেরই সঞ্চার করছিল মনে।
আমাদের গন্তব্য রাজধানী ঢাকার উত্তর সীমান্ত আব্দুল্লাহপুর। গাড়ি থেকে নেমে পায়চারি করছি সেই সঙ্গে চোখ কাজ করছে সংবাদ সন্ধানে। অনেক সময় পার করলেও আশায় গুড়েবালি।
রাত তখন তিনটে বেঁজে ২০ মিনিট হবে। গাড়ি ঘুরিয়ে অফিসে ফিরবো, তাই আমাদের সিএনজির চালককে ডাকছিলাম। ঠিক সেই সময় চোখে পড়ে পাশের সিএনজি পাম্পের একপাশে একটি চা-পানের দোকানের দিকে।
আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যাই। কারণ গভীররাতে ওই চা’য়ের দোকানে বিক্রেতা হিসেবে যাকে দেখা গেলো, তা দেখে বিস্মিত হলাম। পাঁচ কি ছয় বছরের এক শিশু, ক্ষীণকায় দেহ, চোখ দু’টি কোটরে ঢুকে গেছে।
‘তন্দ্রায় ঢুলু ঢুলু’ অবস্থায় চা’র কাপে গরম পানি ঢালছে ওই শিশু। চিনি, দুধ দিয়ে চামচ দিয়ে নাড়তে গিয়ে পড়ি পড়ি অবস্থা। বিস্ময় নিয়ে দেখছিলাম তাকে, তবে তখনো এতটা বিস্মিত হইনি, যতটানা হলাম ওর সঙ্গে কথা বলার পর।
ওর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তার নাম ইমন। বাড়ি নোয়াখালির রায়পুরে। শৈশবে এক কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে গত মাস তিনেক আগে সে পাড়ি জমিয়েছে ঢাকায়।
জীবন সংগ্রামী এই শিশুটির বাবা পারু মিয়া কয়েক মাস আগে দ্বিতীয় বিয়ে করে নিরুদ্দেশ। ২ বোন ১ ভাই আর মা জোসনা বেগমকে বাঁচাতে, তাদের মুখে দু’বেলা আহার যোগাতে ইমনের এই ঢাকা আসা।
মামাতো ভাই মুহিমের সঙ্গে থেকে তারই চা-পানের দোকানে কাজ করছে সে। বেতন নির্ধারিত নেই। খাবার আর কাপড় ছাড়া নগদ কোনো অর্থ পায় না ইমন। দু’মাস পর পর ইমনের মা’য়ের কাছেই টাকা পাঠায় মুহিম।
আব্দুল্লাহপুর আরএস ফিলিং স্টেশনের প্রবেশ পথে ডান দিকের ভাসমান এই দোকানে ইমনকে কাজ করতে হয় রাতের বেলায়। দিনের বেলায় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিশ্রাম! এরপর থেকে টানা সারারাত চা-পান-সিগারেট বিক্রি করতে হয়।
ঘুম ঘুম চোখে ইমন বাংলানিউজকে জানায়, তার বাবা যখন একসঙ্গে ছিল তখন সে স্থানীয় সোনালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা বিয়ে করে চলে গেলে তাদের সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। এত অল্প বয়েসে পরিবারের সবাইকে ছেড়ে চলে এলেও কষ্ট নেই ইমনের।
‘মা’য়ের দু:খ-কষ্ট দূর করতেই তার এত দূর আসা। বড় কিছু হওয়ার স্বপ্নও নেই তার। কেবল মা’য়ের মুখটা যেন থাকে হাসিতে, এটাই তার চাওয়া।’
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় পারিবারিক বন্ধন দিন দিন হালকা হচ্ছে। সন্তানরা বড় হয়ে বৃদ্ধ মা-বাবাকে রেখে আসছে বৃদ্ধাশ্রমে। কেউবা খোঁজও রাখছে না।
বহুযুগ পূর্বে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মা’য়ের জন্য বিশাল নদী পাড়ি দিয়েছিলেন। মা’য়ের জন্য সন্তানদের আত্মত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত কদাচিৎ দেখা যায়।
তবে শিশু ইমনের মাতৃপ্রেমের এমন দৃষ্টান্ত আমাদের বর্তমান পঙ্কিল সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যাসাগরের সঙ্গে খানিকটা তুলনা করলে ভুল হবে না বৈকি!
No comments