সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস by শহিদুল ইসলাম
এক. ৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্র 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণা করে এবং আন্তর্জাতিক আইন-কানুনের প্রতি কোনো রকম সম্মান না দেখিয়ে ওই সন্ত্রাসের জন্য আফগানিস্তান আক্রমণ করে। গত ১১ বছর ধরে আফগানিস্তানে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' চলছে। প্রশ্ন ওঠে, আমেরিকা কেন আফগানিস্তান আক্রমণ করল?
আরো প্রশ্ন ওঠে, সেই যুদ্ধ কি আফগানিস্তান রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে? যারা টুইন টাওয়ার আক্রমণ করেছিল, তারা তো মারা গেছে। ধরে নিলাম, তারা সবাই আফগানিস্তানের নাগরিক। এটা কি প্রমাণ করে, ৯/১১ তারিখে আফগানিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল? তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান আক্রমণের যুক্তি কী? আমেরিকা সেখানে কার বা কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে? তালেবানি শাসন তো অনেক আগেই শেষ হয়েছে। বর্তমানে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের সরকার অধিষ্ঠিত। তারা নিশ্চয়ই সন্ত্রাসী নয়? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের ইতিহাস প্রমাণ করে, সমাজতন্ত্র, সন্ত্রাসবাদ_এগুলো আমেরিকার প্রকৃত শত্রু নয়; আমেরিকার প্রকৃত শত্রু মানুষের স্বাধীনতা। এটা সত্য, আমেরিকা আফগানিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। বরং আফগানিস্তান দখল করে একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, আমেরিকা সরকারের নির্দেশ মান্য করাই যার প্রধান কর্তব্য। আরেকটি কথা। টুইন টাওয়ার আক্রমণকারীরা যদি ১০টি দেশের নাগরিক হতো, তাহলে আমেরিকা কী করত? ১০টি দেশই আক্রমণ করত? এটা সত্য, আমেরিকার 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়; কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে। সেই ব্যক্তি যেকোনো দেশের নাগরিক হতে পারে। সেই গোষ্ঠীও যেকোনো একটি দেশের কিংবা বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসীদের নিয়েও গঠিত হতে পারে। অর্থাৎ, আমেরিকা কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে 'যুদ্ধ' ঘোষণা করেনি; করেছে কোনো একজন সন্ত্রাসী ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। তাহলে প্রশ্ন আসে, সন্ত্রাস কত প্রকার? ব্যক্তিগত সন্ত্রাস, গোষ্ঠীগত সন্ত্রাস এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ৯/১১-এর গোষ্ঠীগত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণা করেছে এবং আফগানিস্তান আক্রমণ করে রাষ্ট্রটি দখল করে রেখেছে তার রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে, সেটাকে 'যুদ্ধ' বলা যায় না। সেটা সন্ত্রাস। ইরাক সেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। মিথ্যা তথ্য প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করেছিল। আজ লিবিয়ার গণবিক্ষোভের সুযোগে ৪০ বছরের স্বৈরশাসক গাদ্দাফিকে পরাস্ত করে লিবিয়া দখল করে আমেরিকা লিবিয়ার তেল সম্পদের ওপর একক কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চায়। ওবামা সেই উদ্দেশ্যের দিকেই অগ্রসর হচ্ছেন।
দুই. বিগত ৬০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে প্রমাণ হয়, আমেরিকা স্বয়ং একটি 'সন্ত্রাসী রাষ্ট্র'। এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন নোয়াম চমস্কি তাঁর '৯/১১' গ্রন্থে। পৃথিবীর গণতন্ত্রকামী মানুষ গাদ্দাফির স্বৈরশাসনের কবল থেকে সে দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তি চায়। সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হোক, সবাই তা চায়। কিন্তু সেই সঙ্গে পৃথিবীর মানুষ সেখানে মহাশক্তিধর শাসন প্রতিষ্ঠা হোক_এটা চায় না। এমন শাসন মানে আরেক ধরনের স্বৈরশাসন; গণতান্ত্রিক শাসন নয়। ইরাক ও আফগানিস্তান তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। আমেরিকা এর আগে আরেকবার মিথ্যা তথ্য প্রদান করে লিবিয়া আক্রমণ করেছিল। ১৯৮৬ সালের ৫ এপ্রিল। পশ্চিম বার্লিনের কালো মানুষের জন্য একটি বারে বোমা হামলায় একজন তুর্কি মহিলা এবং একজন কালো আমেরিকান মারা যান। সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ঘোষণা দেন, তাঁদের কাছে নিশ্চিত প্রমাণ আছে, সেই বোমাবাজি লিবিয়ার কাজ। কিন্তু সেই প্রমাণ কখনো কোথাও প্রকাশ করেনি, বরং পরবর্তী তদন্তে প্রমাণিত হয়, ওই বোমাবাজির সঙ্গে লিবিয়ার সামান্যতম সম্পর্ক ছিল না। যাহোক, এর ৯ দিন পর আমেরিকা লিবিয়া আক্রমণ করে। আক্রমণ করার কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি ঘটনা ঘটায়। লিবিয়ার আর্টিলারি কামান যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর একটি বিমান লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল। সেদিন এ প্রশ্ন কেউ তোলেনি, কেন লিবিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর একটি বিমানের প্রতি গুলি ছুড়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা পরে এটা নিয়ে গবেষণা চালান। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন_লিবিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন বা অন্য কোনো দেশের বিমানের প্রতি গুলি না ছুড়ে কেবল আমেরিকার বিমানের প্রতি গুলি ছুড়েছিল কেন? কারণ, অন্য কোনো দেশের যুদ্ধবিমান লিবিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করেনি। গুলি খাওয়ার জন্যই ওই আমেরিকান বিমানটিকে লিবিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। বিমানটি অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসে।
আমেরিকা যখন নিকারাগুয়ার গণতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম ধ্বংস করার জন্য নৃশংস সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী 'কন্ট্রা'কে অর্থ, অস্ত্র ও ট্রেনিং দিয়ে সাহায্য করছিল, তখন জাতিসংঘেরই একটি অঙ্গসংগঠন ঞযব ডড়ৎষফ ঈড়ঁৎঃ (বিশ্ব বিচারালয়) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা জানিয়েছিল। আজ পর্যন্ত এটাই এক ইউনিক প্রস্তাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোনো দেশের বিরুদ্ধে বিশ্ব আইনসভা এ রকম সরাসরি নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের জন্যই সেই প্রস্তাব। যুক্তরাষ্ট্র যদি 'ভেটো' না দিত, তাহলে প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত হতে পারত। ১৯৮৬ সালের ওই বিচারে 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবৈধ শক্তি প্রয়োগ' বন্ধের এবং 'নিকারাগুয়ার বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা' প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ২০০৮ সালে জাতিসংঘেরই আরেকটি সংস্থা 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' তার প্রতিবেদনে বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সমস্ত সামরিক স্বৈরশাসন, রাজতন্ত্র, মৌলবাদীকে সমর্থন এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আন্দোলনগুলোর বিরোধিতা করেছে। আমেরিকা যদি সত্যিই 'সন্ত্রাসবাদবিরোধী' হতো, তাহলে সৌদি আরবের সঙ্গে তার এত সুসম্পর্ক থাকত না। আমেরিকা সৌদির তেলসম্পদের ওপর একচেটিয়া অধিকার নিয়েছে। পরিবর্তে সৌদি বাদশাহি টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। হোসনি মুবারকের পলায়নের আগে ওবামা যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে নোয়াম চমস্কি বলেন, 'অত্যন্ত সন্তর্পণে ওবামা কিছু বলেননি। যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা অতীতে যা করেছেন, ওবামাও তা-ই করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘেনার বই আছে_ অত্যন্ত আদরের কোনো স্বৈরশাসক যখন বিপদাপন্ন হয়, যুক্তরাষ্ট্র তাকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। যখন অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন পক্ষ পরিবর্তন করে।'
লেখক : শিক্ষাবিদ
দুই. বিগত ৬০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে প্রমাণ হয়, আমেরিকা স্বয়ং একটি 'সন্ত্রাসী রাষ্ট্র'। এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন নোয়াম চমস্কি তাঁর '৯/১১' গ্রন্থে। পৃথিবীর গণতন্ত্রকামী মানুষ গাদ্দাফির স্বৈরশাসনের কবল থেকে সে দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তি চায়। সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হোক, সবাই তা চায়। কিন্তু সেই সঙ্গে পৃথিবীর মানুষ সেখানে মহাশক্তিধর শাসন প্রতিষ্ঠা হোক_এটা চায় না। এমন শাসন মানে আরেক ধরনের স্বৈরশাসন; গণতান্ত্রিক শাসন নয়। ইরাক ও আফগানিস্তান তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। আমেরিকা এর আগে আরেকবার মিথ্যা তথ্য প্রদান করে লিবিয়া আক্রমণ করেছিল। ১৯৮৬ সালের ৫ এপ্রিল। পশ্চিম বার্লিনের কালো মানুষের জন্য একটি বারে বোমা হামলায় একজন তুর্কি মহিলা এবং একজন কালো আমেরিকান মারা যান। সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ঘোষণা দেন, তাঁদের কাছে নিশ্চিত প্রমাণ আছে, সেই বোমাবাজি লিবিয়ার কাজ। কিন্তু সেই প্রমাণ কখনো কোথাও প্রকাশ করেনি, বরং পরবর্তী তদন্তে প্রমাণিত হয়, ওই বোমাবাজির সঙ্গে লিবিয়ার সামান্যতম সম্পর্ক ছিল না। যাহোক, এর ৯ দিন পর আমেরিকা লিবিয়া আক্রমণ করে। আক্রমণ করার কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি ঘটনা ঘটায়। লিবিয়ার আর্টিলারি কামান যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর একটি বিমান লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল। সেদিন এ প্রশ্ন কেউ তোলেনি, কেন লিবিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর একটি বিমানের প্রতি গুলি ছুড়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা পরে এটা নিয়ে গবেষণা চালান। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন_লিবিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন বা অন্য কোনো দেশের বিমানের প্রতি গুলি না ছুড়ে কেবল আমেরিকার বিমানের প্রতি গুলি ছুড়েছিল কেন? কারণ, অন্য কোনো দেশের যুদ্ধবিমান লিবিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করেনি। গুলি খাওয়ার জন্যই ওই আমেরিকান বিমানটিকে লিবিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। বিমানটি অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসে।
আমেরিকা যখন নিকারাগুয়ার গণতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম ধ্বংস করার জন্য নৃশংস সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী 'কন্ট্রা'কে অর্থ, অস্ত্র ও ট্রেনিং দিয়ে সাহায্য করছিল, তখন জাতিসংঘেরই একটি অঙ্গসংগঠন ঞযব ডড়ৎষফ ঈড়ঁৎঃ (বিশ্ব বিচারালয়) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা জানিয়েছিল। আজ পর্যন্ত এটাই এক ইউনিক প্রস্তাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোনো দেশের বিরুদ্ধে বিশ্ব আইনসভা এ রকম সরাসরি নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের জন্যই সেই প্রস্তাব। যুক্তরাষ্ট্র যদি 'ভেটো' না দিত, তাহলে প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত হতে পারত। ১৯৮৬ সালের ওই বিচারে 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবৈধ শক্তি প্রয়োগ' বন্ধের এবং 'নিকারাগুয়ার বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা' প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ২০০৮ সালে জাতিসংঘেরই আরেকটি সংস্থা 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' তার প্রতিবেদনে বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সমস্ত সামরিক স্বৈরশাসন, রাজতন্ত্র, মৌলবাদীকে সমর্থন এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আন্দোলনগুলোর বিরোধিতা করেছে। আমেরিকা যদি সত্যিই 'সন্ত্রাসবাদবিরোধী' হতো, তাহলে সৌদি আরবের সঙ্গে তার এত সুসম্পর্ক থাকত না। আমেরিকা সৌদির তেলসম্পদের ওপর একচেটিয়া অধিকার নিয়েছে। পরিবর্তে সৌদি বাদশাহি টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। হোসনি মুবারকের পলায়নের আগে ওবামা যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে নোয়াম চমস্কি বলেন, 'অত্যন্ত সন্তর্পণে ওবামা কিছু বলেননি। যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা অতীতে যা করেছেন, ওবামাও তা-ই করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘেনার বই আছে_ অত্যন্ত আদরের কোনো স্বৈরশাসক যখন বিপদাপন্ন হয়, যুক্তরাষ্ট্র তাকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। যখন অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন পক্ষ পরিবর্তন করে।'
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments