মালয়েশিয়া যাত্রা-সম্বল এক বোতল পানি, দুই প্যাকেট সিগারেট by মিঠুন চৌধুরী

মো. শহীদ আলম (৫৫)। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা। মালয়েশিয়া কোথায়, দেশটা কেমন, কিছুই জানেন না। তবু সেখানে গিয়ে ভাগ্য বদলাবেন এমন আশা নিয়ে দালালকে টাকা দিয়েছিলেন। আর দুর্গম এই সমুদ্রযাত্রায় সঙ্গে নিয়েছিলেন মাত্র এক বোতল পানি ও দুই প্যাকেট সিগারেট।


কক্সবাজারে লবণ শ্রমিকের কাজ করেন শহীদ। ৯০ হাজার টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা হয় তৈয়ব নামের এক দালালের সঙ্গে। ৩০ হাজার টাকা পরিশোধও করেন। গত মঙ্গলবার রাতে নগরের পতেঙ্গা থানার নেভাল একাডেমি এলাকায় পাচারের আগে র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার হওয়া ২৬ জনের একজন তিনি।
র‌্যাবের কার্যালয়ে আনার পর উদ্ধারকৃত ব্যক্তিরা জানান, মালয়েশিয়া সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা নেই। তাঁরা শুধু জানেন, জাহাজে করে মালয়েশিয়া যাওয়া যায়।
গত বুধবার দুপুরে র‌্যাব-৭-এর কার্যালয়ে উদ্ধার হওয়া লোকজনের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
মালয়েশিয়া যাত্রায় শহীদের সঙ্গে কী কী ছিল জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বোতল পানি আর দুই প্যাকেট সিগারেট ছিল। কোনো কাপড়চোপড় ছিল না। অল্প কিছু টাকা ছিল পকেটে। আমার পাসপোর্টও নেই। কোন শহরে নিয়ে যেত, জানি না। মালয়েশিয়ায় আমার দূর সম্পর্কের কয়েকজন আত্মীয় আছে। গেলে তাদের খুঁজে নিতাম। আমার এলাকার আরও পাঁচজন আগে এভাবে গেছে।’ আত্মীয়দের খুঁজে নেওয়ার কথা বললেও তাদের কোনো ঠিকানা বা টেলিফোন নম্বর নেই শহীদ আলমের কাছে।
র‌্যাব সূত্র জানায়, উদ্ধার হওয়া ২৬ জনের অধিকাংশই অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত। শ্রমজীবী এসব মানুষকে সচ্ছল জীবনের লোভ দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে পাচারকারী চক্র।
উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, জনপ্রতি সর্বনিম্ন ৯০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ ৬০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার মৌখিক চুক্তি করে পাচারকারীরা। একাধিক ব্যক্তি গ্রামে গ্রামে গিয়ে মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের অগ্রিম টাকা আদায় করা হয়। তিন-চার দিন আগে তাঁদের নিয়ে আসা হয় নগরে। পরে সবাইকে নেভাল একাডেমিসংলগ্ন এলাকায় নিয়ে আসা হয়।
এ বিষয়ে অভিযানে অংশ নেওয়া র‌্যাব-৭-এর কর্মকর্তা লে. কমান্ডার জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, বোট ভাড়া করে উদ্ধারকৃতদের সাগরের কোনো লাইটারেজ জাহাজে নিয়ে যাওয়া হতো। হয়তো সেখান থেকে সুযোগ বুঝে কোনো জাহাজে উঠিয়ে দেওয়া হতো তাঁদের। আমরা এ ঘটনায় জড়িত কয়েকজনের নাম-ঠিকানা পেয়েছি। তবে তাঁদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারিনি।’ মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে শহীদ আলম চার দিন আগে চট্টগ্রাম শহরে আসেন। চকবাজারের গুলজার মোড় এলাকায় একটি হোটেলে শহীদের সঙ্গে ছিলেন মো. আলী (২১) ও মো. শাহেদ (১৮)। মঙ্গলবার রাতে তাঁরা নেভাল একাডেমি এলাকায় আসেন।
উদ্ধার হওয়া নজরুল করিম (২২) মহেশখালীর বাসিন্দা । মালয়েশিয়া যেতে এক পরিচিত ব্যক্তিকে চার হাজার টাকা অগ্রিম দেন। মালয়েশিয়া পৌঁছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা পরিশোধের কথা ছিল।
উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের কয়েকজন তৈয়ব ও জাবেদ নামের দুজন দালালের কথা সাংবাদিকদের জানান। শাহপরীর দ্বীপের মাহমুদুল হাসান (২২) বলেন, ‘জাবেদকে ছয় হাজার টাকা দিয়েছিলাম। মোট এক লাখ ৫৩ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল। তিন দিন আগে শহরে আসি।’
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকার বাসিন্দা ফারুক (১৭) বলেন, ‘নানাবাড়ির প্রতিবেশী নীলচাঁদকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়েছি। যাওয়ার পর আরও এক লাখ ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল। এক মাস আগে নিউমার্কেট এলাকার এক হোটেলে এসে উঠি।’
র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আনোয়ার লতিফ খান বলেন, ‘উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের কারও পাসপোর্ট নেই। তাঁরা মালয়েশিয়ার বিষয়ে কিছুই জানেন না।’ তিনি জানান, বঙ্গোপসাগর, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার একটি সমুদ্রপথ আছে। হয়তো মাছ ধরার ট্রলারযোগে তাঁদের মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হতো।

No comments

Powered by Blogger.