স্বাধীনতার চার দশক ও উত্তর-প্রজন্মের ভাবনা by ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবান্বিত অর্জন যদি হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা, তবে সে গৌরবান্বিত অর্জনের আজ আমরা চার দশক অতিক্রম করছি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের যে প্রেরণা ও প্রত্যাশা,


যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাষ্ট্র হিসেবে বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং সময়ের পরিক্রমায় প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার ক্রমবর্ধমান দূরত্ব, তা নিয়ে ইতিমধ্যে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। নানা মত ও বিরুদ্ধ-মতের ভেতর দিয়ে আমরা প্রত্যাশাপ্রাপ্তির মাপজোখ করে নানা মাত্রার হতাশা ও হতাশাজাত হা-হুতাশ প্রকাশ করেছি। চার দশক পরে এসে সেই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ করার পেছনে এক ধরনের যুক্তি হয়তো আছে। তা ছাড়া একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ আগামী নির্মাণের জন্য মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও গৌরবগাথা আমাদের প্রেরণা জোগাবে নিঃসন্দেহে। এ ছাড়া দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে এটাও বলা যায়, অতীতের ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নিতে হয় ভবিষ্যৎ ত্রুটিমুক্ত করার জন্য। এসব যুক্তির আওতায় চার দশকের অর্জনকে পোস্টমর্টেম করার পেছনে এক ধরনের ন্যায্যতাও খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু উত্তর-প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চার দশক কিভাবে হাজির হয়েছে, সেটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে। উত্তর-প্রজন্মের কাছে 'স্বাধীনতার চার দশক' কী আবেদন নিয়ে উপস্থিত হয়েছে, সেটা গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। কেননা আমরা প্রজন্মপরম্পরায় শিকড়-বিযুক্তির নিরন্তর অনুশীলনের ভেতর দিয়ে এখন এমন একটা সমাজ গড়ে তুলেছি, যেখানে আজকের প্রজন্ম, কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদ দিলে, অধিকতর বাজারমুখী, মুনাফা-সন্ধানী এবং বিজাতীয় সংস্কৃতির অন্ধ-মুখাপেক্ষী। আমরা বিশ্বায়নের ডামাডোলের ঢেঁকুর তুলতে গিয়ে এমন একটা সমাজ গড়ে তুলেছি, যেখানে আজকের প্রজন্ম অনেক বেশি ভোগবাদী, আত্মপর ও দেশপ্রেমহীন। মুনাফামুখী সামাজিক প্রবণতায় নিকটপ্রাপ্তির প্রত্যাশা আমাদের নতুন প্রজন্মের স্বপ্নসাধ, জীবনদর্শন, মানবিক মূল্যবোধ এবং সর্বোপরি দেশাত্মবোধকে নিরন্তর সংকুচিত করছে। এমতাবস্থায় উত্তর-প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম বিষয়ে একটি স্বচ্ছ ধারণা ও এর অন্তর্গত দর্শনকে বিস্তারিত করাটা ভীষণভাবে জরুরি হয়ে উঠেছে। এ প্রবন্ধে স্বাধীনতার চার দশকে উত্তর-প্রজন্মের ভাবনা বিষয়ে যৎসামান্য আলোকপাত করা হয়েছে। উত্তর-প্রজন্ম বলতে সেই প্রজন্মকেই বোঝানো হচ্ছে, যাদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পর এবং যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যাদের নেই। মুক্তিযুদ্ধ তাদের কাছে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তৈরি হওয়া কোনো চেতনা নয়, বরং ইতিহাসের পাতায় লিখিত মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপট এবং অগ্রজদের গৌরবগাথা ও ব্রাত্যজনের কথামালার ভেতর দিয়ে তৈরি হওয়া এক চেতনা। একটি আবেগ ও পরম ভালোবাসার নাম।
মহান মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে উত্তর-প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে দুঃখজনক এবং হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে, একটি বস্তুনিষ্ঠ ও সত্যাশ্রয়ী মুক্তিযুদ্ধের কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে, রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস-বিকৃতির এক অসুস্থ ও অরুচিকর প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচিত হয়েছে। ফলে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতা বলতে যা বোঝায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় সেটা আর অবশিষ্ট থাকেনি। কতিপয় রাজনীতিকের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের যোগ-বিয়োগের ক্যালকুলাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয়েছে হয় খণ্ডিত, নয় আংশিক কিংবা বিকৃত। ফলে উত্তর-প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হাজির হয়েছে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরে পূর্ণ কিংবা বেহুদা গুণকীর্তনে সয়লাব রাজনৈতিক প্রপাগান্ডায়। একদিকে এমনিতেই ইতিহাস নিজ গুণে সাবজেক্টিভ, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের সুকৌশল-বিনির্মাণ মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উত্তর-প্রজন্মের কাছে করে তুলেছে মিথ্যাশ্রয়ী, একচোখা ও অবিশ্বাস্য। ফলে উত্তর-প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের কোনো সঠিক ইতিহাস নেই। আসলে কোনটা 'সঠিক' আর কোনটা 'সঠিক নয়'_সেটা নির্ধারণ করবে কে? এও এক বিরাট জিজ্ঞাসা বটে। কেননা নির্ধারণ করার মানুষগুলোও রাজনৈতিক মেরুকরণের গ্যাঁড়াকলে পড়ে নিজেরাই হয়ে উঠেছেন বিতর্কিত ও দ্বিধাবিভক্ত। রাজনৈতিক মেরুকরণের অভিশপ্ত ছোবল আমাদের সব কিছুকে রীতিমতো গিলে খেয়েছে। বাদ পড়েনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও। ফলে উত্তর-প্রজন্ম আজ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানে না। কিন্তু তারা জানতে চায় মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস। তারা জানতে চায়, মুক্তিযুদ্ধের মহান বীরদের বীরত্বের ইতিবৃত্ত ও গৌরবগাথা। তারা জানতে চায়, কিভাবে পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ বুক চিতিয়ে বীরের মতো যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য। তারা জানতে চায়, এ দেশের সবচেয়ে গৌরবান্বিত অর্জন মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ও সঠিক ইতিহাস। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ প্রভৃতির ঊধর্ে্ব ওঠা একটি বস্তুনিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধের চার দশক পার করে এসে উত্তর-প্রজন্মের আরেকটি অন্যতম ও প্রধানতম ভাবনা হচ্ছে 'যুদ্ধাপরাধীর বিচার'। রাজাকার, আলবদর ও আলশামস উত্তর-প্রজন্মের কাছে একশ্রেণীর ঘৃণিত মানুষ। ইতিহাসের এ রকম নিরন্তর বিকৃতির ভেতর দিয়েও এ দেশের স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের কাছে একটি বিষয় একেবারেই পরিষ্কার। তা হলো, মুক্তিযুদ্ধকালীন এ দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কোলাবরেটর হিসেবে কাজ করেছিল এ দেশেরই কিছু দালাল শ্রেণীর (অ)মানুষ। আর এসব দালাল ও রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচিত। যেকোনো মূল্যে উত্তর-প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। যারা এ দেশের ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির দোসর হিসেবে কাজ করেছে, স্বাধীনতার চার দশকেও এদের কেন বিচার হলো না_উত্তর-প্রজন্মের কাছে এটা এক বিরাট প্রশ্ন। উত্তর-প্রজন্মের ক্ষোভ এখানেই যে সেই স্বাধীনতার শত্রু, এ দেশের জন্মশত্রুদের এত দিনেও কেন বিচার হয়নি? আরো লজ্জার ব্যাপার এই যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার তো হয়ইনি, বরং তাদের নানাভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্নভাবে পুনর্বাসন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দিয়ে নানা দেশের মেহমান হিসেবে পার করে দেওয়া হয়েছে। কাউকে কাউকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করে রাষ্ট্রক্ষমতার শরিক করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে এটা একটা অত্যন্ত গ্লানিকর অভিজ্ঞতা যে সেই রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের কেউ কেউ এ দেশের মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন এবং সেই মুরদে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এটা কী পরিমাণ লজ্জার, দুঃখের ও অপমানের_তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই স্বাধীনতার চার দশকে এসে উত্তর-প্রজন্মের একটি অন্যতম এবং প্রধানতম দাবি হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এটাই হোক স্বাধীনতা দিবসের চার দশকে আমাদের সবার অঙ্গীকার।

লেখক : গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.