সোজা কলমে-এ আত্মহনন আর কত দিন by আহমদ রফিক
ভোরে উঠে খবরের কাগজের পাতায় চোখ বুলাতে গেলে মনে হয়, একরাশ রক্তের ছিটে এসে চোখেমুখে লাগে। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতি, এসিড-সন্ত্রাস, গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যার মতো একের পর এক ঘটনা—যদিও ছোটখাটো কলামের খবর, তবু দিনটা হারাম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
স্নায়ুর ওপর বাড়তি চাপ, কারণ এমনিতেই রাজনৈতিক-সামাজিক বহু ঘটনা, এমনকি নিত্যদিনের দরকারি জিনিসের ক্রমাগত দাম বাড়ার মতো চাপ তৈরির ঘটনা তো আর কম নেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে!
কিছুদিন থেকে যৌন হয়রানি (ইভ টিজিং কথাটা গোটা ঘটনার গুরুত্ব বড় হালকা করে ফেলে) ও নারী নির্যাতন বা হত্যা যেন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে যাদের স্মৃতিশক্তি ভালো, তাদের মনে থাকার কথা বছর কয়েক আগেকার ঘটনা—নূরজাহান, স্বপ্নাহার বা শবনমের মতো আরও অনেকের ইজ্জত বা জান দিয়ে জানিয়ে দিয়ে যাওয়া, আমাদের সমাজটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! বখাটে তরুণ বা মাস্তান যুবকের হাতে নারী নির্যাতন, যৌতুকলোভী বা অন্য নারীতে আসক্ত স্বামীর হাতে গৃহবধূর মৃত্যু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে কেন জানি নাড়া দেয় না। অথচ দেশময় এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। ইয়াসমিন হত্যা নিয়ে কী তুলকালাম কাণ্ডই না ঘটেছিল!
উত্তরবঙ্গের স্কুলছাত্রীটির কথা নিশ্চয় পাঠকের মনে আছে। বখাটে কয়েকটি ছেলের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকেই বরণ করে নিতে হলো। কিংবা পুঠিয়ার আখখেতের সেই তরুণীটির কথা। সেসব তো অনেক দিন আগেরকার কথা। কিন্তু শেষ হয়নি সে কু-ট্র্যাডিশন। সমাজ নির্বিকার। তাই ঘটনা বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়নি আরও এমন কারণে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বখাটে বা মাস্তানের পরিবার বিত্ত বা রাজনৈতিক শক্তির কারণে আইনের আওতায় আসে না। কী করছেন সুশীল সমাজ নামধারী খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীরা?
সম্প্রতি এসব ঘটনার বিস্তার এতটাই, বলা যায় দেশময়, উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ হয়ে পূর্ববঙ্গে। তাই খবরে পড়ছি ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাব টেকনিশিয়ানের বিরুদ্ধে ইভ টিজিংয়ের অভিযোগ’ (আবারও বলি, সাংবাদিক বন্ধুরা, ‘ইভ টিজিং’ কথাটা ঘটনার গুরুত্ব ব্যবহারিক ঐতিহ্যের কারণে কমিয়ে দেয়)। অন্যত্র দেখছি, ‘বখাটের অত্যাচারে স্কুলছাত্রী বাড়িছাড়া’। এ ঘটনা নিয়ে থানায় মামলা করা সত্ত্বেও অত্যাচার বন্ধ হচ্ছে না। অর্থাৎ পুলিশ নির্বিকার। অগত্যা শুধু ছাত্রীই নয়, গোটা পরিবারকে গ্রাম ছেড়ে আত্মীয়বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে, বিশেষ করে স্থানীয় মহলবিশেষের তৎপরতায়। এ ঘটনা ময়মনসিংহের নান্দাইলে।
আরও একটি সাম্প্রতিক (১ সেপ্টেম্বর ২০১০) ঘটনা ‘ইডেনছাত্রীর লাশ মিলল গোপালগঞ্জের মজা পুকুরে’। পুলিশের ধারণা, এটা হত্যা, আত্মহত্যা নয়। একের পর এক এমন সব ঘটনা সমাজের নৈতিক দূষণের পরিচয় দেয়। এ দূষণ নানামাত্রিক। তার পরিচয় পাই দুই সন্তানসহ রীতা ফারজানার বহু আলোচিত আত্মহননের ঘটনায়। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে এবং রীতার ওপর অত্যাচার (যে ঘটনায় গোটা পরিবার জড়িত) অসহায় গৃহবধূকে জীবনের মায়া তুচ্ছ বিবেচনা করতে বাধ্য করে। ‘প্ররোচনামূলক আত্মহত্যা’—এ ধরনের কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে কি ঘটনার দায় এড়ানো যাবে? এমন ঘটনাকে আত্মহনন নয়, হত্যা বলাই সংগত।
আশ্চর্য যে এ ঘটনার পর পরই একই কারণে দুই সন্তান নিয়ে বিলাসীর আত্মহত্যা। রীতার ঘটনা কি এখানে প্রভাব ফেলেছে? এরপর আরেক হতভাগ্য মায়ের দুই সন্তানসহ রেললাইনে আত্মহত্যার চেষ্টা। মানুষের স্নায়ু-বিহ্বল করার মতো ঘটনাবলি। কিন্তু মানুষ বা সমাজের স্নায়ু এ দেশের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বড় শক্ত, ঘটনা সেখানে সহজে দাগ কাটতে পারে না। পুরুষশাসিত সমাজ বলে কথা। দীর্ঘকালের ওই প্রভাব যাবে কোথায়?
ওই প্রভাবেরই ভিন্ন এক প্রতিফলন দেখা যায় অফিসে-কর্মস্থলে। সুলক্ষণের বিষয় যদিও, আজকাল সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মস্থলে যথেষ্টসংখ্যক নারীকে কর্মরত দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেসব স্থানেও অনেক সময় তাঁদের, বিশেষ করে সুদর্শনাদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়, কখনো যৌন নির্যাতনের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘বস’দের হাতে। নিছক মর্যাদাবোধ, পারিবারিক সম্মান রক্ষার দায়ে সেসব ঘটনা বড় একটা প্রকাশ পায় না। যা প্রকাশ পায়, তা জলে ভাসমান বরফখণ্ডের দৃশ্যমান সামান্য উপরিঅংশ মাত্র।
এসব ঘটনাও সামাজিক অবক্ষয়, সমাজে মূল্যবোধের বিনাশ, আধুনিক সমাজের অনাচারী ভোগবাদিতার প্রকাশ। দুঃখজনক যে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায়তন থেকে সমাজের অনুরূপ অংশ, বুদ্ধিবৃত্তিকবলয় ও এ জাতীয় অনাচার থেকে মুক্ত নয়। বিষয়টার ভয়াবহতা অনুমান করা চলে, যখন দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। অথচ একসময় তো ছাত্রসমাজের সুনাম ছিল তাদের আদর্শবাদিতার, সুস্থ জীবনাচরণের জন্য। তারা তাদের কর্মে-আচরণে অন্যদের, বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের পথ দেখিয়েছে। তাদের একাংশে হলেও, এ অধঃপতন মেনে নিতে কষ্ট হয়।
এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বলব, স্কুলছাত্রী কিশোরী বা তরুণীদের লাঞ্ছিত হয়ে বা না হয়ে মানসিক পীড়নের চাপে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া নিতান্তই পরাজিত মনোবৃত্তির পরিচায়ক। জীবন যদি শেষ করতেই হয় তাহলে ধর্ষক বা লাঞ্ছনাকারীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাকে দু-ঘা মেরে মৃত্যুবরণ নয় কেন? তুল্যমূল্য নয়, তবু বলি, যুক্তবঙ্গে পঞ্চাশের মন্বন্তরে মানুষের প্রতিবাদহীন মৃত্যুর বিরুদ্ধে দুজন মানুষ সে সময় সদর্থক কথা বলেছিলেন। কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে বক্তৃতায় জওহরলাল নেহরুর প্রাসঙ্গিক মন্তব্য: না খেতে পেয়ে নিঃশব্দে মৃত্যুর চেয়ে খাদ্যগুদাম লুট করে প্রতিবাদী মৃত্যু গৌরবের। একই রকম কথা লিখেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একটি ছোটগল্পে।
সমাজ যেখানে স্তব্ধ, নীতিহীন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নীরব বা নিষ্ক্রিয়, সেখানে ব্যক্তিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের বিষয়টাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ—নৈতিক ও সামাজিক বিচারে। আর উত্ত্যক্ত কিশোরী তরুণীদের অভিভাবকদের দায়বদ্ধতা রয়েছে লাঞ্ছিতা বা অত্যাচারিতার পাশে দাঁড়ানো, তাকে মানসিক সাহস ও শক্তি জোগানো, যাতে সে যুক্তিহীন আত্মহননের পথ বেছে না নেয়। ভাবতে অবাক লাগে, সংশ্লিষ্ট স্থানের সমাজে কি এমন একজন মানুষেরও দেখা মেলে না, যে ওই অত্যাচারিতের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারে। যদি না পাওয়া যায় তাহলে ধরে নিতে হয়, সে সমাজ শুধু পোকায় কাটা বা নষ্টই নয়, একেবারে পচে গেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কি তেমন কথা বলে?
আমাদের সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকের অভিমত, বিশ্বায়ন মুক্তবাজার অর্থনীতি, লোভ, দুর্নীতি, মুনাফার বাণিজ্যিকীকরণ, সর্বোপরি করপোরেট বাণিজ্যশক্তির লোভ-লাভের হাতছানি বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে সুস্থ মূল্যবোধের মৃত্যু ঘটিয়েছে, দেশটাকে ভোগ-লালসার মুক্তবাজারে পরিণত করেছে, অবশ্যই বিত্তবান ও উচ্চমধ্যবিত্ত-প্রধান সমাজটাকে। এর প্রভাব পড়েছে সমাজের অন্যান্য স্তরে, শ্রেণীতে।
মেধার মতো, মেধাবীর মতো ভোগবাদিতাও হয়ে উঠেছে পণ্য—যেকোনো মূল্যে বিকিকিনি চলতে পারে। আর এ কথাও সত্য যে ভোগবিলাসিতা ও অপসংস্কৃতি-পর্নো সংস্কৃতির প্রভাব পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে করে তুলেছে পুণ্যশুক্লা। স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বিকিয়ে যায় নারী। ফ্যাশন শো বা বিনোদন মডেলবৃত্তির আকর্ষণে নারীর পক্ষে পা পিছলানো যেন স্বাভাবিক ঘটনা। ইন্টারনেটের ইতিবাচক, কার্যকর দিক ছাড়িয়ে ফেসবুকের অনাচার ও অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ আধুনিক প্রযুক্তির অহংকারে পাঁক ছিটাতে শুরু করেছে।
পাশাপাশি আপত্তিকর বা অশ্লীল (শ্লীল-অশ্লীলের সীমারেখার কথা মনে রেখেই বলছি) বিজ্ঞাপন, বিনোদনের নামে অর্ধনগ্ন নাচ-গানে শরীর প্রদর্শন, হিন্দি ছবির মুক্ত যৌনতা, বিনোদন পত্রিকায় (যেমন—‘প্লেবয়’) বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নগ্ন নারীদেহের ছবি—এককথায় পর্নোসংস্কৃতি কি তরুণ কি বয়স্কমনে অসুস্থ প্রভাব ফেলে। যতটুকু শুনি, যতটুকু জানি সেটাও ওই জলে ভাসমান বরফখণ্ডের মতো।
সঙ্গে দীর্ঘদিনের নয়া উপদ্রব মাদকাসক্তি, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এতটাই বিস্তৃত যে বর্তমানে তার চরিত্র মহামারির মতো বললে সম্ভবত অতিকথনের দোষ বর্তায় না। পারিবারিক সচেতনতার অভাব, ভাঙা পরিবার, অসুস্থ দাম্পত্যজীবনের মতো ঘটনাবলি মাদকাসক্তি ও সংশ্লিষ্ট অনৈতিকতার দিকে তরুণ সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে। এ দায় পরিবারপ্রধানের পক্ষে অস্বীকার করা কঠিন।
কথাটা কে না জানেন যে সামাজিক দূষণের প্রধান দায় যদি হয়ে থাকে পুরুষের, সে ক্ষেত্রে ওই দূষণের প্রতিক্রিয়ার বড় আঘাতটা প্রায়ই সইতে হয় নারীকে এবং তা বয়সের হিসাবের বাইরে। পরকীয়া, যৌন নির্যাতন, যৌন অনাচার বা যৌন হয়রানির মতো ঘটনাবলি ওই সামাজিক দূষণের নানারূপ, নানা প্রকাশ। এসব যেন সমাজের ঘরে-পোষা প্রাণী, যা জীবনাচরণের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব নিয়ে বসবাস অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
এসব অনাচারের বিরুদ্ধে ব্যক্তিক প্রতিবাদ—কিশোরী, তরুণী বা গৃহিণী প্রত্যেকের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি নারীর কর্মজীবনে অপ্রিয় ঘটনা এড়াতে ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা প্রকাশ খুবই জরুরি। আমাদের অনড় সমাজে এ পরিপ্রেক্ষিতে দরকার আদর্শবাদী তরুণ বা বয়সী মানুষের উপস্থিতি। সংখ্যায় যত কম হোক, একটি ঘটনা অন্যকে প্রাণিত করতে পারে। স্ফুলিঙ্গপাতের কিছু তৎপরতার সুপ্রভাব তো আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি। দেখেছি এক তরুণীকে বাঁচাতে তরুণের আত্মদান।
আর কিশোরী ইয়াসমিন হত্যার প্রতিবাদে দিনাজপুরে কিছুসংখ্যক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ এবং গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ফাঁড়ি ও থানা পুড়িয়ে দেওয়ার মতো দুঃসাহসী ঘটনা এবং এসবের পরিণামে দোষীর শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা। সে জন্য বলি, যৌন হয়রানি বা নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ আত্মহনন নয়, দৃঢ়প্রতিবাদে ঘুরে দাঁড়ানো অবিকল্প উপায়। আর এ ক্ষেত্রে সমাজের আদর্শবাদী মানুষদের (তরুণ বা বয়সী) অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়াতে হবে। আদর্শবাদী সংস্কৃতি সংগঠনগুলোকেও দূরে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না।
গড়ে তুলতে হবে প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। আন্দোলন-ভিন্ন এ দেশে কোনো দিন কোনো অর্জন সম্ভব হয়নি। এমনকি স্বাধীন স্বদেশও। সমাজ পরিবর্তন এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই সেসবের অপেক্ষায় না থেকে সমাজমনস্কদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় ঘরে-বাইরে এসব অনাচার বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রতিবাদ আন্দোলনের পথে দীর্ঘমেয়াদি অর্জন নিশ্চিত করার চেষ্টা।
প্রসঙ্গত, একটা কথা বলে আলোচনার ইতি টানছি। উল্লিখিত উদ্দেশ্য অর্জনে প্রচারমাধ্যমগুলো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, হোক দৈনিক পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল। সমাজচেতনা বাড়াতে, সমাজে সক্রিয় উদ্দীপনা তৈরি করতে এসব মাধ্যমের সদর্থক ভূমিকা তুলনাহীন। শুধু খবর ছেপে বা কখনো একটি সম্পাদকীয় লিখে দায় সমাপন নয়, দরকার প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ।
দুঃসময়ের মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। এবং তেমন প্রচেষ্টাতেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
আহমদ রফিক: প্রবন্ধকার ও রবীন্দ্রগবেষক।
কিছুদিন থেকে যৌন হয়রানি (ইভ টিজিং কথাটা গোটা ঘটনার গুরুত্ব বড় হালকা করে ফেলে) ও নারী নির্যাতন বা হত্যা যেন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে যাদের স্মৃতিশক্তি ভালো, তাদের মনে থাকার কথা বছর কয়েক আগেকার ঘটনা—নূরজাহান, স্বপ্নাহার বা শবনমের মতো আরও অনেকের ইজ্জত বা জান দিয়ে জানিয়ে দিয়ে যাওয়া, আমাদের সমাজটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! বখাটে তরুণ বা মাস্তান যুবকের হাতে নারী নির্যাতন, যৌতুকলোভী বা অন্য নারীতে আসক্ত স্বামীর হাতে গৃহবধূর মৃত্যু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে কেন জানি নাড়া দেয় না। অথচ দেশময় এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। ইয়াসমিন হত্যা নিয়ে কী তুলকালাম কাণ্ডই না ঘটেছিল!
উত্তরবঙ্গের স্কুলছাত্রীটির কথা নিশ্চয় পাঠকের মনে আছে। বখাটে কয়েকটি ছেলের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকেই বরণ করে নিতে হলো। কিংবা পুঠিয়ার আখখেতের সেই তরুণীটির কথা। সেসব তো অনেক দিন আগেরকার কথা। কিন্তু শেষ হয়নি সে কু-ট্র্যাডিশন। সমাজ নির্বিকার। তাই ঘটনা বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়নি আরও এমন কারণে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বখাটে বা মাস্তানের পরিবার বিত্ত বা রাজনৈতিক শক্তির কারণে আইনের আওতায় আসে না। কী করছেন সুশীল সমাজ নামধারী খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীরা?
সম্প্রতি এসব ঘটনার বিস্তার এতটাই, বলা যায় দেশময়, উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ হয়ে পূর্ববঙ্গে। তাই খবরে পড়ছি ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাব টেকনিশিয়ানের বিরুদ্ধে ইভ টিজিংয়ের অভিযোগ’ (আবারও বলি, সাংবাদিক বন্ধুরা, ‘ইভ টিজিং’ কথাটা ঘটনার গুরুত্ব ব্যবহারিক ঐতিহ্যের কারণে কমিয়ে দেয়)। অন্যত্র দেখছি, ‘বখাটের অত্যাচারে স্কুলছাত্রী বাড়িছাড়া’। এ ঘটনা নিয়ে থানায় মামলা করা সত্ত্বেও অত্যাচার বন্ধ হচ্ছে না। অর্থাৎ পুলিশ নির্বিকার। অগত্যা শুধু ছাত্রীই নয়, গোটা পরিবারকে গ্রাম ছেড়ে আত্মীয়বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে, বিশেষ করে স্থানীয় মহলবিশেষের তৎপরতায়। এ ঘটনা ময়মনসিংহের নান্দাইলে।
আরও একটি সাম্প্রতিক (১ সেপ্টেম্বর ২০১০) ঘটনা ‘ইডেনছাত্রীর লাশ মিলল গোপালগঞ্জের মজা পুকুরে’। পুলিশের ধারণা, এটা হত্যা, আত্মহত্যা নয়। একের পর এক এমন সব ঘটনা সমাজের নৈতিক দূষণের পরিচয় দেয়। এ দূষণ নানামাত্রিক। তার পরিচয় পাই দুই সন্তানসহ রীতা ফারজানার বহু আলোচিত আত্মহননের ঘটনায়। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে এবং রীতার ওপর অত্যাচার (যে ঘটনায় গোটা পরিবার জড়িত) অসহায় গৃহবধূকে জীবনের মায়া তুচ্ছ বিবেচনা করতে বাধ্য করে। ‘প্ররোচনামূলক আত্মহত্যা’—এ ধরনের কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে কি ঘটনার দায় এড়ানো যাবে? এমন ঘটনাকে আত্মহনন নয়, হত্যা বলাই সংগত।
আশ্চর্য যে এ ঘটনার পর পরই একই কারণে দুই সন্তান নিয়ে বিলাসীর আত্মহত্যা। রীতার ঘটনা কি এখানে প্রভাব ফেলেছে? এরপর আরেক হতভাগ্য মায়ের দুই সন্তানসহ রেললাইনে আত্মহত্যার চেষ্টা। মানুষের স্নায়ু-বিহ্বল করার মতো ঘটনাবলি। কিন্তু মানুষ বা সমাজের স্নায়ু এ দেশের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বড় শক্ত, ঘটনা সেখানে সহজে দাগ কাটতে পারে না। পুরুষশাসিত সমাজ বলে কথা। দীর্ঘকালের ওই প্রভাব যাবে কোথায়?
ওই প্রভাবেরই ভিন্ন এক প্রতিফলন দেখা যায় অফিসে-কর্মস্থলে। সুলক্ষণের বিষয় যদিও, আজকাল সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মস্থলে যথেষ্টসংখ্যক নারীকে কর্মরত দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেসব স্থানেও অনেক সময় তাঁদের, বিশেষ করে সুদর্শনাদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়, কখনো যৌন নির্যাতনের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘বস’দের হাতে। নিছক মর্যাদাবোধ, পারিবারিক সম্মান রক্ষার দায়ে সেসব ঘটনা বড় একটা প্রকাশ পায় না। যা প্রকাশ পায়, তা জলে ভাসমান বরফখণ্ডের দৃশ্যমান সামান্য উপরিঅংশ মাত্র।
এসব ঘটনাও সামাজিক অবক্ষয়, সমাজে মূল্যবোধের বিনাশ, আধুনিক সমাজের অনাচারী ভোগবাদিতার প্রকাশ। দুঃখজনক যে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায়তন থেকে সমাজের অনুরূপ অংশ, বুদ্ধিবৃত্তিকবলয় ও এ জাতীয় অনাচার থেকে মুক্ত নয়। বিষয়টার ভয়াবহতা অনুমান করা চলে, যখন দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। অথচ একসময় তো ছাত্রসমাজের সুনাম ছিল তাদের আদর্শবাদিতার, সুস্থ জীবনাচরণের জন্য। তারা তাদের কর্মে-আচরণে অন্যদের, বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের পথ দেখিয়েছে। তাদের একাংশে হলেও, এ অধঃপতন মেনে নিতে কষ্ট হয়।
এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বলব, স্কুলছাত্রী কিশোরী বা তরুণীদের লাঞ্ছিত হয়ে বা না হয়ে মানসিক পীড়নের চাপে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া নিতান্তই পরাজিত মনোবৃত্তির পরিচায়ক। জীবন যদি শেষ করতেই হয় তাহলে ধর্ষক বা লাঞ্ছনাকারীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাকে দু-ঘা মেরে মৃত্যুবরণ নয় কেন? তুল্যমূল্য নয়, তবু বলি, যুক্তবঙ্গে পঞ্চাশের মন্বন্তরে মানুষের প্রতিবাদহীন মৃত্যুর বিরুদ্ধে দুজন মানুষ সে সময় সদর্থক কথা বলেছিলেন। কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে বক্তৃতায় জওহরলাল নেহরুর প্রাসঙ্গিক মন্তব্য: না খেতে পেয়ে নিঃশব্দে মৃত্যুর চেয়ে খাদ্যগুদাম লুট করে প্রতিবাদী মৃত্যু গৌরবের। একই রকম কথা লিখেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একটি ছোটগল্পে।
সমাজ যেখানে স্তব্ধ, নীতিহীন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নীরব বা নিষ্ক্রিয়, সেখানে ব্যক্তিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের বিষয়টাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ—নৈতিক ও সামাজিক বিচারে। আর উত্ত্যক্ত কিশোরী তরুণীদের অভিভাবকদের দায়বদ্ধতা রয়েছে লাঞ্ছিতা বা অত্যাচারিতার পাশে দাঁড়ানো, তাকে মানসিক সাহস ও শক্তি জোগানো, যাতে সে যুক্তিহীন আত্মহননের পথ বেছে না নেয়। ভাবতে অবাক লাগে, সংশ্লিষ্ট স্থানের সমাজে কি এমন একজন মানুষেরও দেখা মেলে না, যে ওই অত্যাচারিতের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারে। যদি না পাওয়া যায় তাহলে ধরে নিতে হয়, সে সমাজ শুধু পোকায় কাটা বা নষ্টই নয়, একেবারে পচে গেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কি তেমন কথা বলে?
আমাদের সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকের অভিমত, বিশ্বায়ন মুক্তবাজার অর্থনীতি, লোভ, দুর্নীতি, মুনাফার বাণিজ্যিকীকরণ, সর্বোপরি করপোরেট বাণিজ্যশক্তির লোভ-লাভের হাতছানি বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে সুস্থ মূল্যবোধের মৃত্যু ঘটিয়েছে, দেশটাকে ভোগ-লালসার মুক্তবাজারে পরিণত করেছে, অবশ্যই বিত্তবান ও উচ্চমধ্যবিত্ত-প্রধান সমাজটাকে। এর প্রভাব পড়েছে সমাজের অন্যান্য স্তরে, শ্রেণীতে।
মেধার মতো, মেধাবীর মতো ভোগবাদিতাও হয়ে উঠেছে পণ্য—যেকোনো মূল্যে বিকিকিনি চলতে পারে। আর এ কথাও সত্য যে ভোগবিলাসিতা ও অপসংস্কৃতি-পর্নো সংস্কৃতির প্রভাব পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে করে তুলেছে পুণ্যশুক্লা। স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বিকিয়ে যায় নারী। ফ্যাশন শো বা বিনোদন মডেলবৃত্তির আকর্ষণে নারীর পক্ষে পা পিছলানো যেন স্বাভাবিক ঘটনা। ইন্টারনেটের ইতিবাচক, কার্যকর দিক ছাড়িয়ে ফেসবুকের অনাচার ও অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ আধুনিক প্রযুক্তির অহংকারে পাঁক ছিটাতে শুরু করেছে।
পাশাপাশি আপত্তিকর বা অশ্লীল (শ্লীল-অশ্লীলের সীমারেখার কথা মনে রেখেই বলছি) বিজ্ঞাপন, বিনোদনের নামে অর্ধনগ্ন নাচ-গানে শরীর প্রদর্শন, হিন্দি ছবির মুক্ত যৌনতা, বিনোদন পত্রিকায় (যেমন—‘প্লেবয়’) বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নগ্ন নারীদেহের ছবি—এককথায় পর্নোসংস্কৃতি কি তরুণ কি বয়স্কমনে অসুস্থ প্রভাব ফেলে। যতটুকু শুনি, যতটুকু জানি সেটাও ওই জলে ভাসমান বরফখণ্ডের মতো।
সঙ্গে দীর্ঘদিনের নয়া উপদ্রব মাদকাসক্তি, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এতটাই বিস্তৃত যে বর্তমানে তার চরিত্র মহামারির মতো বললে সম্ভবত অতিকথনের দোষ বর্তায় না। পারিবারিক সচেতনতার অভাব, ভাঙা পরিবার, অসুস্থ দাম্পত্যজীবনের মতো ঘটনাবলি মাদকাসক্তি ও সংশ্লিষ্ট অনৈতিকতার দিকে তরুণ সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে। এ দায় পরিবারপ্রধানের পক্ষে অস্বীকার করা কঠিন।
কথাটা কে না জানেন যে সামাজিক দূষণের প্রধান দায় যদি হয়ে থাকে পুরুষের, সে ক্ষেত্রে ওই দূষণের প্রতিক্রিয়ার বড় আঘাতটা প্রায়ই সইতে হয় নারীকে এবং তা বয়সের হিসাবের বাইরে। পরকীয়া, যৌন নির্যাতন, যৌন অনাচার বা যৌন হয়রানির মতো ঘটনাবলি ওই সামাজিক দূষণের নানারূপ, নানা প্রকাশ। এসব যেন সমাজের ঘরে-পোষা প্রাণী, যা জীবনাচরণের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব নিয়ে বসবাস অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
এসব অনাচারের বিরুদ্ধে ব্যক্তিক প্রতিবাদ—কিশোরী, তরুণী বা গৃহিণী প্রত্যেকের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি নারীর কর্মজীবনে অপ্রিয় ঘটনা এড়াতে ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা প্রকাশ খুবই জরুরি। আমাদের অনড় সমাজে এ পরিপ্রেক্ষিতে দরকার আদর্শবাদী তরুণ বা বয়সী মানুষের উপস্থিতি। সংখ্যায় যত কম হোক, একটি ঘটনা অন্যকে প্রাণিত করতে পারে। স্ফুলিঙ্গপাতের কিছু তৎপরতার সুপ্রভাব তো আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি। দেখেছি এক তরুণীকে বাঁচাতে তরুণের আত্মদান।
আর কিশোরী ইয়াসমিন হত্যার প্রতিবাদে দিনাজপুরে কিছুসংখ্যক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ এবং গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ফাঁড়ি ও থানা পুড়িয়ে দেওয়ার মতো দুঃসাহসী ঘটনা এবং এসবের পরিণামে দোষীর শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা। সে জন্য বলি, যৌন হয়রানি বা নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ আত্মহনন নয়, দৃঢ়প্রতিবাদে ঘুরে দাঁড়ানো অবিকল্প উপায়। আর এ ক্ষেত্রে সমাজের আদর্শবাদী মানুষদের (তরুণ বা বয়সী) অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়াতে হবে। আদর্শবাদী সংস্কৃতি সংগঠনগুলোকেও দূরে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না।
গড়ে তুলতে হবে প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। আন্দোলন-ভিন্ন এ দেশে কোনো দিন কোনো অর্জন সম্ভব হয়নি। এমনকি স্বাধীন স্বদেশও। সমাজ পরিবর্তন এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই সেসবের অপেক্ষায় না থেকে সমাজমনস্কদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় ঘরে-বাইরে এসব অনাচার বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রতিবাদ আন্দোলনের পথে দীর্ঘমেয়াদি অর্জন নিশ্চিত করার চেষ্টা।
প্রসঙ্গত, একটা কথা বলে আলোচনার ইতি টানছি। উল্লিখিত উদ্দেশ্য অর্জনে প্রচারমাধ্যমগুলো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, হোক দৈনিক পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল। সমাজচেতনা বাড়াতে, সমাজে সক্রিয় উদ্দীপনা তৈরি করতে এসব মাধ্যমের সদর্থক ভূমিকা তুলনাহীন। শুধু খবর ছেপে বা কখনো একটি সম্পাদকীয় লিখে দায় সমাপন নয়, দরকার প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ।
দুঃসময়ের মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। এবং তেমন প্রচেষ্টাতেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
আহমদ রফিক: প্রবন্ধকার ও রবীন্দ্রগবেষক।
No comments