একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ফেরতের গল্প by জাহিদ আহমেদ

মো. ওবাইদুল (ছদ্মনাম)। নিম্নমধ্যবিত্ত ও সুবিধাবঞ্চিত একটি পরিবারের ছেলে সে। সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার বাড়ি। সে ধানমন্ডির একটি বিপণিবিতানে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। প্রতিটি মুহূর্ত তাকে কাটাতে হচ্ছে জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে।


তার এ জীবনযুদ্ধ শুরু হয় সেই শৈশব থেকে, যেদিন অর্থের অভাবে বীনা চিকিৎসায় সে তার প্রিয় বাবাকে মরে যেতে দেখেছে। গ্রামে তার বৃদ্ধ মা ও এক বোন। যাঁদের মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে সে সারা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে। সে সূর্যোদয় দেখে, কিন্তু সূর্যাস্ত দেখে না। এভাবেই চলতে থাকে তার প্রতিটি দিন। কর্মস্থল বিপণিবিতানের আশপাশে একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ঘটনাটি ঘটে ২০০৮ সালে। ক্যানটিনে বসাকে কেন্দ্র করে দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া ও মারামারি হয়, যার ব্যাপকতা পরবর্তী সময়ে আশপাশের বিপণিবিতান ও রাজপথে ছড়িয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে ধানমন্ডি থানার এসআই বাদী হয়ে একটি ফৌজদারি মামলা করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ধানমন্ডি থানার পুলিশ এ ঘটনার সঙ্গে ওবাইদুলের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে তাকে আসামি হিসেবে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করে। ওবাইদুল থাকত ধানমন্ডির জিগাতলার একটি মেসে। কিন্তু তার স্থায়ী ঠিকানা ছিল সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলায়। এদিকে ওবাইদুল তার আসামি হওয়ার কথা জানতে পেরে জিগাতলা থেকে পালিয়ে সিলেটে তার গ্রামের বাড়িতে চলে আসে। অন্যদিকে ধানমন্ডি থানার পুলিশ তার গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কপি তার এলাকার সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠিয়ে দেয়। পরে তাকে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশের সহযোগিতায় গ্রেপ্তার করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে পাঠানো হয়। হাকিমের আদালত থেকে ওবাইদুল অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে মুক্ত হলেও মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেতে তাকে নানা বিড়ম্বনা সইতে হয়। এত হয়রানির পর অবশেষে বিচারক তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রাথমিক (প্রাইমা ফেসি) উপাদান না থাকায় তাকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন। অর্থাৎ ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু তার স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কপি ফেরত বা রিকল করা হয়নি। এরই মধ্যে ওবাইদুল সীমাহীন দুর্ভোগ ও হয়রানির অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে আবার কর্মস্থলে ফিরে এসেছে এবং সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে নিয়মিত কাজ করছে। কিছুদিন আগে ওবাইদুল ছোট বোনের পড়াশোনার খরচ দেওয়ার উদ্দেশে এবং অসুস্থ মাকে দেখতে গ্রামের বাড়ি যায়। বাড়িতে যাওয়ার পর পুলিশ এসে তাকে আবার গ্রেপ্তার করে। বৃদ্ধ মায়ের পাশ থেকে তাকে ধরে নিয়ে পুলিশের ভ্যানে তোলা হয় এবং জানানো হয়, তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হবে। কিন্তু ওবাইদুল বুঝে উঠতে পারছে না তাকে আবার কেন গ্রেপ্তার করা হলো? পরে সে জানতে পারে, ২০০৮ সালের ধানমন্ডি থানার যে মামলা থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়, সেই মামলায় পাঠানো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, যেটা সিলেটে পাঠানো হয়েছিল, সেটা রিকল না করার কারণে সিলেটের পুলিশ তাকে ২০১২ সালের মার্চ মাসে এসে আগের মতো গ্রেপ্তার করে আবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে পাঠায়। পরে যখন বিচারক তার রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখতে পান যে তাকে এরই মধ্যে ২০০৯ সালে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, তখন তাড়াহুড়ো করে তার অব্যাহতির কাগজ আবার সিল-স্বাক্ষর করে তাকে যেখানে, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে, সেখানে পাঠিয়ে দেন। মাঝখানে ওবাইদুলকে জেলখানায় থাকতে হলো। এ রকম অনেক ঘটনাই অহরহ ঘটছে, যার শিকার হচ্ছে ওবাইদুলের মতো সহজ, সরল, নিরীহ মানুষ। এ ব্যাপারে কর্তব্যরত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আরও বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিত। মামলার সর্বশেষ অবস্থা না জেনে পুরোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা খুঁজে খুঁজে বের করে নিজেদের খুব বেশি দায়িত্বশীলতা দেখানোর বাণিজ্য বন্ধ করা উচিত। তা না হলে ওবাইদুলদের মতো হাজারো নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন যথেচ্ছ নখরাঘাতে হবে ক্ষতবিক্ষত।
লেখক  আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট

No comments

Powered by Blogger.