গন্তব্য ঢাকা-মোহময় এক গ্রামের মানুষ by শর্মিলা সিনড্রেলা
গ্রামটি মোহময়। চারপাশে সবুজের ছায়া আর বাড়ির পাশের একচিলতে পুকুরে টলটলে জল। ঘরে স্ত্রীর সঙ্গ আর সন্তানদের উচ্ছ্বসিত হাসির কলরব শুনতে কখনোই বিরক্তি জন্মায়নি। কিন্তু জীবনের প্রয়োজন কি ভালোবাসার টান মানে?
আর তাই হাজার হাজার মানুষকে আত্মার টান উপেক্ষা করে পেটের টানে পড়ে থাকতে হয় এই ইট-কাঠের নগর ঢাকায়। আবদুস সাত্তার তাদেরই মতো একজন। যিনি একেবারে পেটের দায়ে না হলেও কিছু স্বপ্ন বাস্তবায়নের তাগিদে ছেড়ে এসেছেন আপন ঘর ও আপনজনদের।
‘এই পত্রিকা নিবেন, পত্রিকা।’ সিগন্যাল বা রাস্তার জ্যামে দাঁড়িয়ে যাওয়া গাড়িগুলোর জানালায় মুখ রেখে বিক্রেতারা যখন তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে, তখন আমরা অনেকেই বিরক্ত হই। একবার যদি রাগ দেখাই, তো পরেরবার মুখ ফিরিয়ে রাখি। কেউ বা হয়তো কয়েকটা টাকার বিনিময়ে কিনেও নিই পত্রিকা। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখি, এই কয়েকটা টাকার জন্যই দিন-রাত কষ্ট করে মানুষগুলো। কেউ একজন যদি একটি পত্রিকা কেনে, তবেই সে তার দৈনন্দিন একমুঠো ভাত বা একটা স্বপ্নের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যায়। আবদুস সাত্তার এমনই একজন পত্রিকা বিক্রেতা। কারওয়ান বাজারের মোড়ে থেমে যাওয়া গাড়িতে তিনিও মুখ বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘পত্রিকা নিবেন?’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পারকালুপুর গ্রামে বাড়ি আবদুস সাত্তারের। চারপাশে আমের বাগান, মাথার ওপরে নীল আকাশ, স্ত্রী রুলির ভালোবাসা, আর ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে জীবন বেশ ভালোই কাটছিল। কিন্তু ওই যে স্বপ্ন। সেটাই তো নিয়ে এল ঢাকায়। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছেলেটা সদ্য কলেজ পাস করেছে। ‘তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার জন্য জমানো কিছু টাকা নিয়ে চলে এসেছি ঢাকায়। ভর্তি করাতে যখন সব টাকা শেষ হয়ে গেল, তখন ভাবলাম, কিছু তো করতে হবে। তা না হলে ছেলের পড়াশোনা চলবে কী করে। তাই ঢাকাতেই থেকে যাওয়া। প্রথম যখন এলাম, তখন কলা, চানাচুর—এই সব বিক্রি করতাম কাওরান বাজারেই। সেইটা দিয়ে চালাতাম ছেলের পড়াশোনা। আমার ছেলেও অনেক কষ্ট করেছে। নিজে রিকশা চালিয়ে পড়াশোনা করেছে। এখন তো ওর ইংরেজিতে মাস্টার (মাস্টার্স) শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে শামীম। এখন টিশানি (গৃহশিক্ষকতা) করে। আর কী একটা প্রাইভেট কিলিনিকে (ক্লিনিক) চাকরি করে,’ বললেন সাত্তার।
‘গ্রামই আমার কাছে বেশি প্রিয়। ঢাকার শব্দ, গ্যাস ভালো লাগে না। গ্রামে আমরা অনেক ভালো ছিলাম। আমবাগানে আম কুড়িয়ে খাওয়া অনেক মজার। এই ঢাকার ছেলেমেয়েরা তো কোনো খেলাধুলা করে না। আমরা স্কুলে কত খেলাধুলা করেছি। আমি তো স্পোর্সম্যান ছিলাম। কত বল, হাইজাম্প, লংজাম্প খেলেছি। এখন সেসব দিন কোথায় যে গেছে?’ নিজের গ্রাম্য জীবনের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন আবদুস সাত্তার।
‘আমার বাবার অনেক জমি ছিল। কিন্তু আমরা সাত ভাই, দুই বোন তো। তাই ভাগ করার পর আমি আমার ভিটাটুকুসহ পেয়েছি প্রায় ছয় বিঘা। ওই দিয়েই আমাদের খেয়েপড়ে চলে যায়। ছেলেও পাঠায় ছোট দুই মেয়ের পড়ার খরচ। তাও ঢাকায় আছি, কারণ, মেয়ে দুইটার বিয়ে দিতে হবে; ধরেন, অনেক তো টাকা লাগবে। এভাবে কষ্ট করে যদি কিছু জমাতে পারি, তাহলে মেয়েটার ভালো বিয়ে দিতে পারব। আর আল্লায় যদি দেয়, তো একবার হজ করতে চাই। সে জন্যও তো অনেক টাকার দরকার। শরীর যখন চলছে, তখন যত দিন পারি কাজ করি। দেখি, হজের টাকা জোগাড় করতে পারি কি না।’
ছেলেটার তো পড়াশোনা শেষ হয়েছে, দুটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে আছে এখন দুই মেয়ে আর এক ছেলে। দুই মেয়ের বিয়ে এবং নিজের হজ করার জন্য এই ৫৫ বছর বয়সে এসেও সকাল সাড়ে আটটা থেকে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তিনি করে চলেছেন হাড়ভাঙা পরিশ্রম। ‘কষ্ট তো হয়ই। আগে পপ্পন (পপকর্ন) বিক্রি করতাম। এখন তো রোজার দিন, তাই সকাল থেকে বিক্রি করি পেপার আর রাতে বিক্রি করি চানাচুর-বিস্কুট। আবার রুমালও বিক্রি করি। এখানে রাতে থাকি একটা মসজিদে। খাই, যখন যেখানে পাই।’
সামনে ঈদ। বাড়ি যেতে কার না মন চায়? ‘২৮ রোজার দিন বাড়ি যাব। ওদের জন্য কিছু জিনিস নিয়ে যাব। কিছুই কিনতে পারিনি এখনো। একেবারে চলে যেতে পারলে ভালো হতো। আমার স্ত্রীও মন খারাপ করে, কিন্তু কী করব? জীবনের জন্য তো থাকতেই হবে ঢাকায় একা একা। গ্রামে আমাদের যেটুকু জমি আছে, সেটুকুই চাষবাস করতে হয়। আর একটা গরু আছে। রুলিই সেটার দেখাশোনা করে। সেও তো অনেক কষ্ট করে। বড় একটা গরু দেখাশোনা করা একজন মেয়ের জন্য অনেক কষ্টের। গরুকে খাওয়ানো, পরিষ্কার করা অনেক কঠিন কাজ। যত দ্রুত মেয়ের বিয়ে এবং হজ করার জন্য টাকা জমাতে পারব, তত দ্রুতই চলে যাব গ্রামে। এভাবে আর কত দিন কষ্ট করতে হবে, কে জানে? যদি পারি, তবে গ্রামেই একটা দোকান দেব। তারপর সবাই একসাথে থাকব।’
‘এই পত্রিকা নিবেন, পত্রিকা।’ সিগন্যাল বা রাস্তার জ্যামে দাঁড়িয়ে যাওয়া গাড়িগুলোর জানালায় মুখ রেখে বিক্রেতারা যখন তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে, তখন আমরা অনেকেই বিরক্ত হই। একবার যদি রাগ দেখাই, তো পরেরবার মুখ ফিরিয়ে রাখি। কেউ বা হয়তো কয়েকটা টাকার বিনিময়ে কিনেও নিই পত্রিকা। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখি, এই কয়েকটা টাকার জন্যই দিন-রাত কষ্ট করে মানুষগুলো। কেউ একজন যদি একটি পত্রিকা কেনে, তবেই সে তার দৈনন্দিন একমুঠো ভাত বা একটা স্বপ্নের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যায়। আবদুস সাত্তার এমনই একজন পত্রিকা বিক্রেতা। কারওয়ান বাজারের মোড়ে থেমে যাওয়া গাড়িতে তিনিও মুখ বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘পত্রিকা নিবেন?’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পারকালুপুর গ্রামে বাড়ি আবদুস সাত্তারের। চারপাশে আমের বাগান, মাথার ওপরে নীল আকাশ, স্ত্রী রুলির ভালোবাসা, আর ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে জীবন বেশ ভালোই কাটছিল। কিন্তু ওই যে স্বপ্ন। সেটাই তো নিয়ে এল ঢাকায়। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছেলেটা সদ্য কলেজ পাস করেছে। ‘তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার জন্য জমানো কিছু টাকা নিয়ে চলে এসেছি ঢাকায়। ভর্তি করাতে যখন সব টাকা শেষ হয়ে গেল, তখন ভাবলাম, কিছু তো করতে হবে। তা না হলে ছেলের পড়াশোনা চলবে কী করে। তাই ঢাকাতেই থেকে যাওয়া। প্রথম যখন এলাম, তখন কলা, চানাচুর—এই সব বিক্রি করতাম কাওরান বাজারেই। সেইটা দিয়ে চালাতাম ছেলের পড়াশোনা। আমার ছেলেও অনেক কষ্ট করেছে। নিজে রিকশা চালিয়ে পড়াশোনা করেছে। এখন তো ওর ইংরেজিতে মাস্টার (মাস্টার্স) শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে শামীম। এখন টিশানি (গৃহশিক্ষকতা) করে। আর কী একটা প্রাইভেট কিলিনিকে (ক্লিনিক) চাকরি করে,’ বললেন সাত্তার।
‘গ্রামই আমার কাছে বেশি প্রিয়। ঢাকার শব্দ, গ্যাস ভালো লাগে না। গ্রামে আমরা অনেক ভালো ছিলাম। আমবাগানে আম কুড়িয়ে খাওয়া অনেক মজার। এই ঢাকার ছেলেমেয়েরা তো কোনো খেলাধুলা করে না। আমরা স্কুলে কত খেলাধুলা করেছি। আমি তো স্পোর্সম্যান ছিলাম। কত বল, হাইজাম্প, লংজাম্প খেলেছি। এখন সেসব দিন কোথায় যে গেছে?’ নিজের গ্রাম্য জীবনের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন আবদুস সাত্তার।
‘আমার বাবার অনেক জমি ছিল। কিন্তু আমরা সাত ভাই, দুই বোন তো। তাই ভাগ করার পর আমি আমার ভিটাটুকুসহ পেয়েছি প্রায় ছয় বিঘা। ওই দিয়েই আমাদের খেয়েপড়ে চলে যায়। ছেলেও পাঠায় ছোট দুই মেয়ের পড়ার খরচ। তাও ঢাকায় আছি, কারণ, মেয়ে দুইটার বিয়ে দিতে হবে; ধরেন, অনেক তো টাকা লাগবে। এভাবে কষ্ট করে যদি কিছু জমাতে পারি, তাহলে মেয়েটার ভালো বিয়ে দিতে পারব। আর আল্লায় যদি দেয়, তো একবার হজ করতে চাই। সে জন্যও তো অনেক টাকার দরকার। শরীর যখন চলছে, তখন যত দিন পারি কাজ করি। দেখি, হজের টাকা জোগাড় করতে পারি কি না।’
ছেলেটার তো পড়াশোনা শেষ হয়েছে, দুটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে আছে এখন দুই মেয়ে আর এক ছেলে। দুই মেয়ের বিয়ে এবং নিজের হজ করার জন্য এই ৫৫ বছর বয়সে এসেও সকাল সাড়ে আটটা থেকে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তিনি করে চলেছেন হাড়ভাঙা পরিশ্রম। ‘কষ্ট তো হয়ই। আগে পপ্পন (পপকর্ন) বিক্রি করতাম। এখন তো রোজার দিন, তাই সকাল থেকে বিক্রি করি পেপার আর রাতে বিক্রি করি চানাচুর-বিস্কুট। আবার রুমালও বিক্রি করি। এখানে রাতে থাকি একটা মসজিদে। খাই, যখন যেখানে পাই।’
সামনে ঈদ। বাড়ি যেতে কার না মন চায়? ‘২৮ রোজার দিন বাড়ি যাব। ওদের জন্য কিছু জিনিস নিয়ে যাব। কিছুই কিনতে পারিনি এখনো। একেবারে চলে যেতে পারলে ভালো হতো। আমার স্ত্রীও মন খারাপ করে, কিন্তু কী করব? জীবনের জন্য তো থাকতেই হবে ঢাকায় একা একা। গ্রামে আমাদের যেটুকু জমি আছে, সেটুকুই চাষবাস করতে হয়। আর একটা গরু আছে। রুলিই সেটার দেখাশোনা করে। সেও তো অনেক কষ্ট করে। বড় একটা গরু দেখাশোনা করা একজন মেয়ের জন্য অনেক কষ্টের। গরুকে খাওয়ানো, পরিষ্কার করা অনেক কঠিন কাজ। যত দ্রুত মেয়ের বিয়ে এবং হজ করার জন্য টাকা জমাতে পারব, তত দ্রুতই চলে যাব গ্রামে। এভাবে আর কত দিন কষ্ট করতে হবে, কে জানে? যদি পারি, তবে গ্রামেই একটা দোকান দেব। তারপর সবাই একসাথে থাকব।’
No comments