রঙ্গব্যঙ্গ-আমলা এবং দুর্নীতির গল্প by মোস্তফা কামাল

অনেক দিন আগের কথা। তখন ছিল স্বৈরশাসনামল। সরকারের মন্ত্রী ও আমলারা ছিলেন মহাদুর্নীতিবাজ। দুর্নীতির ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে ছিল চমৎকার মিল। মিলেঝিলে সরকারি অর্থ লোপাট করতেন তাঁরা। এক প্রকল্পে ১০ বার অর্থ বরাদ্দ করা হতো। আর পুরো প্রকল্পের অর্থই তাঁরা নিজেদের পকেটস্থ করতেন।


এ প্রক্রিয়ায় চোখের পলকে তাঁরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন।
দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে জনৈক কর্মকর্তা পুকুরচুরির গল্প বলেছিলেন। দেশের কোনো একটি জেলার প্রশাসকের কার্যালয়ের পাশে একটি পুকুর ভরাট করে খেলার মাঠ করা হবে। এ রকম একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হলো। অথচ সেখানে আগে থেকেই খেলার মাঠ ছিল। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আশপাশেও কোনো পুকুর ছিল না। অথচ এমনভাবে প্রকল্প প্রণয়ন করা হলো যেন সেখানে পুকুর আছে। ভরাট করা হবে। সে জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হলো। জেলা প্রশাসনের সেই পুকুর কাটতেও হলো না, ভরাটও করতে হলো না। সেই প্রকল্পের অর্থ কর্মকর্তারা ভাগাভাগি করে নিলেন। এভাবেই পুকুরচুরির গল্প হলো।
আরেকটি গল্প একজন সচিবকে নিয়ে। সরকারের একজন সচিব হঠাৎ করেই বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে গেলেন। এত অর্থ তিনি কোথায় পেলেন? দুর্নীতি দমন বিভাগের কর্মকর্তারা অনুসন্ধান শুরু করলেন। অবৈধ অর্থের উৎস অনুসন্ধান করতে লাগলেন। একপর্যায়ে দুর্নীতি দমন বিভাগের এক কর্মকর্তা সচিবের মুখোমুখি হলেন। তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, 'স্যার, ধানমণ্ডিতে আপনার একটা বাড়ি আছে। জায়গা কেনা এবং বাড়িটি তৈরি করতে কত টাকা খরচ হয়েছে বলবেন?'
সচিব বিস্ময়ের দৃষ্টিতে কর্মকর্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এসব আপনি কী বলছেন! বুঝতে পেরেছি, আপনি বোধ হয় জানেন না। ওটা আমার শ্বশুর আমার স্ত্রীকে গিফট করেছেন। সরকারি চাকরি করে ওই বাড়ি করা কি সম্ভব?'
'স্যার, আপনার শ্বশুর কী করেন?'
'বিজনেসম্যান। বিরাট বড় বিজনেসম্যান।'
'স্যার, বেয়াদবি নেবেন না। আমরা তো জানি উনি গ্রামে থাকেন। আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো না।'
'কে বলল আপনাকে? ডাহা মিথ্যা কথা। দলিল দেখতে চান, দলিল?'
'জি না।'
'কেন?'
'জানি স্যার, আপনি দলিল করেছেন আপনার স্ত্রীর নামে। কিন্তু জমিটি আপনি নিজে কিনেছিলেন।'
'আরে ভাই, এ নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটির কী দরকার!'
'আরেকটা প্রশ্ন স্যার, গাজীপুরে আপনার একটা বাগানবাড়ি আছে। তাই না?'
'ওহ! বাগানবাড়ি! ওটা আমার আমেরিকা প্রবাসী ছোট ভাইয়ের। আমি মাঝেমধ্যে যাই আর কী!'
'স্যার, মনে কিছু করবেন না। বাগানবাড়ির দলিলটা আপনার ছেলের নামে।'
'তাই নাকি! তাহলে হয়তো ছোট ভাই আমার ছেলেকে দান করেছে। তার নিজের ছেলেমেয়ে নেই তো!'
'আরেকটা প্রশ্ন স্যার।'
'আবার কী প্রশ্ন? জমিজমা-সংক্রান্ত না তো!'
'না স্যার, অর্থ-সংক্রান্ত।'
'সেটা আবার কী?'
'স্যার, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে আপনার নামে এক কোটি টাকা জমা আছে। এত টাকা কোথায় পেলেন?'
'ওই টাকা তো আমার না! আমার ছোট ভাই, ওই যে বললাম না, আমেরিকা প্রবাসী! সে দেশে বিনিয়োগ করবে। তাই আমার নামে টাকাটা পাঠিয়েছে। এবার বুঝতে পারছেন তো। আমার আসলে কিছুই নেই। সরকারি চাকরি করে কী-ই বা করা যায়!'
সচিব সাহেব দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, 'কষ্ট করে আমার বাড়িতে এলেন। তেমন কিছু খাওয়াতেও পারলাম না। এই নিন, কিছু বকশিশ দিলাম।'
কর্মকর্তা বিব্রত দৃষ্টিতে সচিবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বেরিয়ে এলেন।


আওয়ামী লীগ সরকারে গেলে মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ প্রায় আড়াই বছর আগে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। কি�� এখনো মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করেনি। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী বলেছেন, শিগগিরই মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব বিবরণী সরকারের কাছে জমা দিতে হবে। কি�� সরকারি আমলাদের ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। উপর�� দুর্নীতি দমন কমিশনকে ক্ষমতাহীন করেছে সরকার। এখন নাকি সরকারি কর্মকর্তাদের বির�দ্ধে দুর্নীতির তদন্তও করা যাবে না। তদন্ত করতে হলে সরকারের অনুমতি লাগবে। দেশে কী অদ্ভুত আইন!
আইন সবার জন্য সমান। অথচ দুর্নীতি তদন্তের ব্যাপারে আইন সবার জন্য সমান নয়। সরকারি কর্মকর্তা হলে সাত খুন মাফ! মন্ত্রী-এমপিরা যেহেতু জনপ্রতিনিধি সেহেতু তাঁদের জবাবদিহিতা আছে, আমলাদের নেই। তাঁরা সব কিছুর ঊর্ধ্বে।
গণতান্ত্রিক সরকারকে কী কৌশলে আমলারা ফাঁদে ফেলল সে বিষয়টি আমরা কল্পনা করতে পারি। কাল্পনিক চিন্তাটি পাঠকের জন্য উপ��াপন করছি। ধর�ন, একজন সচিব প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার মতো এত যোগ্য-দক্ষ শাসক পৃথিবীতে আর নেই। আপনি মহান। আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বলেই দেশটা শান্তিতে আছে। আমরা তো ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারছি না। কারণ দুদক কী এক আইন করেছে, দুর্নীতি তদন্তের নামে আমাদের হয়রানির সুযোগ করে দিয়েছে। এটা আপনার দেখা উচিত।
সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন, আমার আমলাদের কোনো রকম কষ্ট দেওয়া যাবে না। কোনো রকম হয়রানি করা যাবে না। তাদের দুর্নীতি তদন্তের জন্য সরকারের অনুমতি লাগবে।
ব্যস, হয়ে গেল কাজ! আমলা এবার শুধু পুকুরচুরি নয়, সাগরচুরি শুর� করে দিল। আর বাংলাদেশ আবার দুর্নীতিতে শীর্ষ��ান দখল করল। সবাই বলুন, মারহাবা!

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.