বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামকেন্দ্রিক উন্নয়ন by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি_এটি তর্কাতীত। এই প্রেক্ষাপটে এও সত্য, কৃষির উন্নয়নের সঙ্গে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন জড়িত। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির যেমন কোনো বিকল্প নেই, তেমনি এখন পর্যন্ত কৃষিই দেশের বৃহত্তম কর্মসৃজনকারী খাত।


এ ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন, শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ, আমদানি হ্রাস এবং রপ্তানি বৃদ্ধি করে ইধষধহপব ড়ভ চধুসবহঃ-এ ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কৃষির ভূমিকা সর্বাধিক। আবার এও সত্য, বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ হলেও কৃষির অন্যতম উপাদান কৃষিজমি নেই জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের। সিংহভাগই বর্গা কিংবা প্রান্তিকচাষি। এই বর্গা কিংবা প্রান্তিকচাষিরা যা উৎপাদন করেন, তা থেকে জমির মালিকের অংশ দেওয়ার পর যেটুকু থাকে তা দিয়ে তাঁদের পোষায় না কিংবা কখনো কখনো তাঁরা উৎপাদিত ফসলের সঠিক বাজারমূল্যও পান না। এসব কারণে বাধ্য হয়ে ওই প্রান্তিক বা বর্গাচাষি লাঙ্গল ছেড়ে উদ্বাস্তুর মতো শহরমুখী হন কর্মের সন্ধানে। সব কিছু দিয়ে তাঁদের হাতে যা থাকে, এরও যদি যথার্থ বাজারমূল্য তাঁরা পেতেন, তাহলে কৃষির প্রতি তাঁদের অনীহা জন্মাত না। তাঁরা হতেন না শহরমুখী এবং শহরের জীবনযাপনও হয়ে উঠত না এতটা দুর্বিষহ।
শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক বিপর্যয়েরও দেশ। নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, মন্দা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। প্রায় প্রতিবছরই এর কোনো না কোনোটি আঘাত হানছে এবং এর ফলে দীর্ঘ হচ্ছে সর্বস্বান্তদের তালিকা। শুধু যে প্রকৃতিসৃষ্ট দুর্যোগেই মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে তা-ই নয়, মনুষ্যসৃষ্ট অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডও বহুসংখ্যক মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে কর্মের সন্ধানে শহরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিষয় আরো আছে। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট এসব দুর্যোগের পাশাপাশি এনজিওগুলোর (অর্থলগি্নকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সুদবাণিজ্য) কর্মকাণ্ডও এর জন্য কম দায়ী নয়। তাদের প্রদেয় ঋণের বিপরীতে সুদের সুদ অর্থাৎ চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আদায় ঋণগ্রহীতাকে পথে বসাচ্ছে। তথাকথিত উন্নয়ন ও দরিদ্র মানুষকে স্বাবলম্বী করার ছদ্মাবরণে তাদের নিজেদের লাভের কার্যক্রম বহুসংখ্যক মানুষকে পাঠিয়েছে শহরের ফুটপাতে অথবা বস্তিতে। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, শুধু ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে ফুটপাত এবং বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি, যাঁরা চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই ভাসমান উদ্বাস্তু মানুষরা কেউবা প্রকৃতির বৈরী আচরণে, কেউবা প্রাতিষ্ঠানিক ছোবলে, কেউবা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে তাড়িত। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, তাঁদের সামনে রেখেই ব্যক্তি, মহল বা কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক বনে গেছেন বা বনছেন। এই বিপন্নদের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক হাতে নিয়েছিল 'ঘরে ফেরা কর্মসূচি' প্রকল্প। তবে এর ইতিবাচক ফল কতটা কী তা অজানা।
যত ক্ষুদ্র পরিসরেই হোক, সরকার সত্যিকার অর্থেই অনুধাবন করেছে_কৃষকের উন্নতি ছাড়া (বিশেষ করে বর্গা ও প্রান্তিকচাষি) দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। সরকারের দায়িত্বশীলদের এই সৎচিন্তার প্রতিফলন শেষ পর্যন্ত কতটা ইতিবাচক হবে বলা কঠিন। ২৩ মার্চ ২০১১, সিপিডি আয়োজিত ঢাকায় এক সেমিনারে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সামাজিক নিরাপত্তাসহ সরকারি সুবিধার সিংহভাগ অতি দরিদ্রের কাছে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি পেঁৗছায় না। 'ঘরে ফেরা কর্মসূচি'র আওতায় 'একটি বাড়ি, একটি খামার'-এর যে প্রকল্প রয়েছে, এর যদি সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ইতিমধ্যে কিছুটাও হয়ে থাকে তাহলে তা বেশ কিছু কর্মহীন, সর্বস্বান্ত মানুষকে স্বাবলম্বী করতে (পরিধি যত সংকুচিতই হোক) সাহায্য করেছে সরকার_তা বলা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু ভিন্ন কথাও আছে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তিক্ত। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে গৃহীত আর্থিক প্রকল্পে নানা রকম তুঘলকি ও নয়ছয় কর্মকাণ্ডের কথা আমাদের অজানা নয়। এমন আর্থিক প্রকল্পের উপকারভোগী যাঁদের হওয়ার কথা, তাঁদের বঞ্চিত রেখে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অসাধুরা উদরপূর্তি করেছেন_এমন দৃষ্টান্তও আছে। যাঁদের লক্ষ্য করে বরাদ্দ দেওয়া হবে, তাঁরা যদি যথাযথভাবে বরাদ্দ পান এবং বরাদ্দকৃত অর্থের সদ্ব্যবহার করেন অর্থাৎ উৎপাদনমুখী কাজে ব্যয় করেন, তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হতে যেমন বাধ্য; তেমনি সার্বিক বিবর্ণ চিত্র মুছে ফেলাও অনেকটা সহজ।
আবারও বলি, শহরমুখী জনস্রোত ঠেকাতে 'ঘরে ফেরা কর্মসূচি' যত ক্ষুদ্র পরিসরেই শুরু হোক না কেন, বিলম্বে হলেও সরকার ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। তবে নির্দিষ্ট একটি-দুটি নয়, উৎপাদনমুখী আরো প্রকল্প হাতে নেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে কৃষিনির্ভর শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে গ্রামে। গ্রামকেই করতে হবে উন্নতির মূল কেন্দ্র। উৎপাদিত কৃষিপণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণ করার পাশাপাশি উৎপাদনকারী যাতে এ মূল্যটা পান, তাও নিশ্চিত করতে হবে। এখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরা@ে@@@্যর কথাও আমাদের জানা আছে। এই মধ্যস্বত্বভোগীরা যাতে না গজাতে পারে, জাল বিস্তৃত করতে না পারে_সে জন্য চাই প্রশাসনিক জোরদার তৎপরতা। তা ছাড়া আবহাওয়ার আনুকূল্যের পাশাপাশি সময়মতো কৃষি উপকরণ তথা বীজ, সার, সেচ, কীটনাশক ইত্যাদির সরবরাহ নিশ্চিত করাও জরুরি। কৃষিতে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের এসবই হচ্ছে পূর্বশর্ত। আমরা জানি, জীবন ধারণের পাশাপাশি কৃষিতে বিনিয়োগের সামর্থ্য সিংহভাগ কৃষকের নেই। তাঁদের জন্য সহজ শর্তে কৃষিঋণ পাওয়ার বিষয়টি শুধু অব্যাহতই নয়, করতে হবে আরো বিস্তৃত। ভবিষ্যতে কৃষিকে জীবন ধারণের পর্যায় থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দাঁড় করাতে আধুনিক কৃষিব্যবস্থা গড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, শস্যের বহুমুখীকরণ, শস্য আবর্তন, কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার, জৈব-প্রযুক্তির গবেষণা ও উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন, কৃষি বিপণনব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ের ওপরও জোর দিতে হবে সমভাবে।
আমরা জানি, কৃষি কিংবা গ্রামীণ উন্নয়ন-সহায়ক অথবা কৃষি বা পল্লীঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে মহাজোট সরকার আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এসব পদক্ষেপ সফল করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে নিজ উদ্যোগে যেসব কাজ করেছেন, এর ইতিবাচক প্রভাব আমরা লক্ষ করেছি। কিন্তু তার পরও 'চাটার দল' কিছু কিছু অপকর্ম করেছে এবং নিজেদের উদরপূর্তির মহড়া চালিয়েছে। তবে আশার কথা, যখনই এমন কিছু ঊর্ধ্বতনদের নজরে গেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের_তখনই তিনি পদক্ষেপ নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এসব বিষয় নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়েও দৃষ্টি প্রসারিত রেখেছেন বিধায় অসাধুদের লম্ফঝম্ফ প্রকট হয়ে উঠতে পারেনি। এই নজরদারি ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল সবারই রাখা খুব দরকার। ঋণ বা প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ থেকে বণ্টনব্যবস্থার আগ পর্যন্ত প্রকৃত কৃষক বা ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ, ঋণগ্রহীতার যোগ্যতা, আবেদন ফরম সহজীকরণ, ঋণের সর্বোচ্চ সীমা, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অর্থ বিতরণ ইত্যাদির প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি রাখা চাই। কৃষির পাশাপাশি পোলট্রি, হ্যাচারি, মৎস্য খামারসহ এলাকাভিত্তিক উপযোগী নতুন নতুন প্রকল্প প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগও নেওয়া দরকার ত্বরিত। কৃষির পাশাপাশি এসব ক্ষুদ্রশিল্প গড়ে তুলতে পারলে এবং ভাসমান বা সর্বস্বান্তদের স্থিতধী করে কর্মে যুক্ত করার প্রক্রিয়া বেগবান করতে সফল হলে একদিকে যেমন বেকার সমস্যা অনেকটাই দূর করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে অর্থনীতির চেহারায়ও চাকচিক্য আনা কঠিন নয়। তবে সর্বাগ্রে চাই স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা-দায়বদ্ধতার পাশাপাশি কর্মসূচি বাস্তবায়নে দায়িত্ববানদের নিষ্ঠা।
যেকোনো সরকারি কার্যক্রমই জনকল্যাণের দোহাই দিয়ে শুরু হলেও প্রকৃতপক্ষে কল্যাণ হয় কতিপয় কালো বিড়ালের_আমাদের অতীত তা-ই বলে। এই কালো বিড়ালরা প্রকাশ্যে সব তছনছ করলেও ক্ষমতার জোরে তারা থেকে যায় অস্পর্শিত_এও আমাদের অভিজ্ঞতায়ই আছে। আমাদের এসব অভিজ্ঞতা বড় বিচিত্র, যা অনেক ক্ষেত্রেই জিজ্ঞাসাসূচক, বিস্ময়কর এবং ক্ষোভসঞ্চারকও বটে। সরকারের সাধু উদ্যোগও অসাধুতার প্রভাবে কিভাবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, এরও বিস্তর প্রমাণ রয়েছে আমাদের সামনে। এত সব নেতিবাচক চিত্রের মধ্যেও আমরা আশাবাদী হতে চাই, আশাবাদী থাকতে চাই। কারণ সরকার যদি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকার মানসিকতা পোষণ করে, তবে ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট অসাধুদের স্বেচ্ছাচারিতা চালানোর পথ এমনিতেই সংকুচিত হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা-উত্তর দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ও গ্রামোন্নয়নে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, এর যথাযথ বাস্তবায়ন কতটা কী হয়েছে তা বিলম্বে হলেও খতিয়ে দেখা দরকার। দুর্নীতি আর প্রয়োজনীয় ব্যয় তো আছেই, এর পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয় প্রতিনিধিরা দরিদ্রদের নিয়ে অংশগ্রহণমূলক উপায়ে দারিদ্র্য বিমোচন করতে চান না। এভাবে চললে দিন বদল অত্যন্ত দুরূহ।

লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.